১.
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ ‘বি’ থেকে সুপার সিক্সে উঠেছিলো। একই গ্রুপ থেকে সুপার সিক্সে ওঠা বাকি দুই দল পাকিস্তান এবং নিউ জিল্যান্ডের কাছে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে পরাজিত হয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। তাই সুপার সিক্স থেকে সেমিফাইনালে জায়গা করে নিতে হলে গ্রুপ ‘এ’ থেকে সুপার সিক্সে উঠা তিন দলের বিপক্ষে জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না তাদের সামনে।
সুপার সিক্সে উঠা দলগুলোর মধ্যে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি চার দলেরই আগে থেকে পয়েন্ট ছিল। পাকিস্তান চার পয়েন্ট নিয়ে এক প্রকার সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেই সুপার সিক্সে খেলতে নেমেছিলো। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নিউ জিল্যান্ডেরও ছিল দুই পয়েন্ট করে। গ্রুপপর্বে দুর্দান্ত খেলে সুপার সিক্সে ওঠা জিম্বাবুয়েরও আগে থেকে চার পয়েন্ট ছিল। শেষ পর্যন্ত আশা জাগিয়েও তাদের সেমিফাইনাল খেলা হয়নি।
পাকিস্তান, নিউ জিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে চতুর্থ দল হিসাবে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছিলো অস্ট্রেলিয়া। সুপার সিক্সে ভারত এবং জিম্বাবুয়েরর বিপক্ষে জয়ের পর তাদের সামনে শেষ বাধা হিসাবে ছিল আগেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলা দক্ষিণ আফ্রিকা। অস্ট্রেলিয়া সেই বাধা অতিক্রম করে স্টিভ ওয়াহ'র অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ে। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক দুর্দান্ত ব্যাটিং করে দলের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেই মাঠ ছেড়েছিলেন সেদিন।
২.
সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয় দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া জিতলে তারা সেমিফাইনাল খেলবে, আর দক্ষিণ আফ্রিকা জিতলে জিম্বাবুয়ে সেমিফাইনাল খেলবে। এমন সমীকরণে লিডসে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্যাট করতে নেমে হার্শেল গিবসের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে শুভ সূচনা পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। গিবস উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে গ্যারি কারস্টেনের সাথে ৪৫ রান যোগ করেন। এরপর দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ড্যারিল কালিনানকে সাথে নিয়ে ৯৫ রান যোগ করেছিলেন গিবস। কালিনান ৫০ রান করে এবং অধিনায়ক ক্রনিয়ে কোনো রান না করেই পরপর ফিরে গেলে নিজের স্বভাব বদলিয়ে ঠাণ্ডা মেজাজে ব্যাট করতে থাকেন গিবস।
শেষদিকে ল্যান্স ক্লুজনার ও জন্টি রোডসের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে অস্ট্রেলিয়াকে জয়ের জন্য ২৭২ রানের লক্ষ্যে ছুঁড়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। হার্শেল গিবসে ১০১ রান এবং ড্যারিল কালিনানের ৫০ রানের পাশাপাশি ক্লুজনারের ২১ বলে ৩৬ এবং রোডস ৩৬ বলে ৩৯ রানের ইনিংসের কল্যাণে দক্ষিণ আফ্রিকা সাত উইকেটে ২৭১ রান সংগ্রহ করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া ২৭২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই দুই ওপেনারের উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট পাঁচ রান করে এলউর্তির বলে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরে যান। দলীয় ২০ রানের মাথায় আরেক ওপেনার মার্ক ওয়াহ পাঁচ রান করে রান আউটের ফাঁদে পড়েন। দুই ওপেনারের বিদায়ের পর দলের হাল ধরার চেষ্টা করেছিলেন রিকি পন্টিং এবং ডেমিয়েন মার্টিন। এই দুইজনের জুটিও বেশিক্ষণ টেকেনি। ১১.৩ ওভারে দলীয় ৪৮ রানে এলউর্তির দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হয়েছিলেন ১১ রান করা মার্টিন।
তার বিদায়ের পর ক্রিজে আসেন স্টিভ ওয়াহ।
৩.
দক্ষিণ আফ্রিকার দেওয়া ২৭২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ৪৮ রানের মধ্যেই তিন উইকেট হারিয়ে বসে অস্ট্রেলিয়া। উইকেটে থাকা রিকি পন্টিংও নড়বড়ে ব্যাটিং করছিলেন। নড়বড়ে ব্যাটিং করলেও উইকেটে মাটি কামড়ে পড়েছিলেন তিনি। তার উপর থেকে চাপ কমানোর জন্য আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করেন স্টিভ ওয়াহ। মাত্র ৪৭ বলে অর্ধশত রান পূর্ণ করেছিলেন তিনি। ততক্ষণে পন্টিংও তার ইনিংসকে লম্বা করে ফেলেছেন। তারা দুইজন উইকেটে থিতু হয়ে গেলে অস্ট্রেলিয়া ২০ থেকে ৩০ ওভারের মধ্যে ৮২ রান যোগ করেন।
দুর্দান্ত ব্যাটিং করতে থাকা স্টিভ ওয়াহ দলীয় ১৫২ রান এবং ব্যক্তিগত ৫৬ রানের সময় ল্যান্স ক্লুজনারের বলে ফ্লিক শট খেলতে গিয়ে গড়বড় করে ফেলেন। বলটি সোজা গিবসের হাতে পৌঁছায়। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে দুর্দান্ত শতক হাঁকানো গিবস বেশ খোশমেজাজে ছিলেন, তাই ওয়াহ'র গড়বড়ে শটে তিনিও গড়বড় করে ফেলেন। বল ঠিকঠাকভাবে তালুবন্দী করলেও নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। উদযাপনে তাড়াহুড়ো করতে গেলে বল হাত থেকে ফসকে পড়ে যায়। শোনা যায়, নতুন জীবন পাওয়ার পর গিবসকে উদ্দেশ্য করে ওয়াহ নাকি বলেছিলেন, 'You've just dropped the World Cup!' যদিও গিবস কিংবা ওয়াহ কেউই সেটার সত্যতা স্বীকার করেননি। বরং ওয়াহ তার অটোবায়োগ্রাফিতে জানিয়েছিলেন অন্য কিছুই। ওয়াহ'র সত্যিকার কথাটা ছিল,
'Do you realise you've just cost your team the match?'
এই একটি ভুল ছাড়া স্টিভ ওয়াহ'র ইনিংসটি ছিল নিখুঁত। দলের জয়ের লক্ষ্যে তিনি শুরু থেকেই প্রয়োজনানুসারে ব্যাট করতে থাকেন। দলীয় ১৭৪ রানে রিকি পন্টিং এবং ওয়াহ'র ১২৬ রানে জুটি ভাঙে পন্টিং ৬৯ রান করে ফিরে গেলে। পন্টিং তার ৬৯ রানের ইনিংসে পাঁচটি চার এবং দু'টি ছয় হাঁকালেও বল খেলেছিলেন ১১০টি। পন্টিংয়ের ধীরগতির ব্যাটিংয়ের পরও অস্ট্রেলিয়া লড়াই করে যাচ্ছিলো স্টিভের ব্যাটে চড়ে।
ম্যাচে ফেরার নিমিত্তে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হ্যানসি ক্রনিয়ে ৩৯তম ওভারে অ্যালান ডোনাল্ডকে আক্রমণে আনেনে। 'সাদা বিদ্যুৎ' নামে পরিচিত ডোনাল্ড আক্রমণে আসলে তাকে দু'টি চার হাঁকিয়ে স্বাগত জানান ওয়াহ। শট দুটি এতই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, ডোনাল্ডও বিস্মিত হয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিলেন। ডোনাল্ডের উপর চড়াও হওয়ার পর এলউর্তির বলে মিড-উইকেট দিয়ে ছয় হাঁকিয়ে মাত্র ৯১ বলে শতক পূর্ণ করেন তিনি।
শতক হাঁকানোর পরেও থেমে থাকেননি তিনি। মাইকেল বেভান ও টম মুডিকে সাথে নিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করেই তবে মাঠ ছাড়েন ওয়াহ। ১১০ বলের লড়াকু ইনিংসে দশটি চার এবং দুটি ছয় হাঁকিয়ে অপরাজিত ১২০ রানের ইনিংস খেলে দলকে দুই বল ও পাঁচ উইকেট বাকি থাকতে জয় এনে দিয়েছিলেন। গিবসকে উদ্দেশ্য করা বলা কথাটা তিনি বলেননি বটে, তবে বললেও সেটা খুব ভুল কিছু হতো না। গিবস সেদিন আসলেই ওয়ার্ল্ডকাপ হাত ফসকে ফেলে দিয়েছিলেন। তার হাতের মুঠো থেকে বল বের হয়ে যাওয়ার পর জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার টনি গ্রেগ তখন ধারাভাষ্য কক্ষে বলেছিলেন,
"He's dropped it, I don't believe it! That's unbelievable! He was throwing it up, he thought he had it… Well, this could change the course of this match, that's for sure."
অস্ট্রেলিয়ার কাছে সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচে পরাজিত হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা এই ম্যাচের আগেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছিলো। তারা সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসাবে পায় এই অস্ট্রেলিয়াকেই। বার্মিংহামে ঐ ম্যাচটি এর চেয়েও বেশি নাটকে ভরপুর ছিলো। শেষপর্যন্ত নাটকীয়ভাবে ম্যাচটি ‘টাই’ হয়। কিন্তু সুপার সিক্সে হেড টু হেডে এগিয়ে থাকার কারণে ফাইনাল খেলে অস্ট্রেলিয়া এবং খুব সহজেই পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেয়।
৪.
স্টিভ ওয়াহ টেস্ট ক্রিকেটের তুলনায় ওয়ানডেতে এমন ভয়ংকর ব্যাটসম্যান ছিলেন না। লিডসে শতক হাঁকানোর আগে ২৬৫টি ওয়ানডে খেলে মাত্র একটি শতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি, তাও অভিষেকের দশ বছর পর। প্রথম ২৬৫টি ওয়ানডেতে গড়পড়তা ব্যাটিং করা স্টিভ ওয়াহ ২৬৬তম ওয়ানডেতে দলের কঠিন সময়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। গিবসের হাতে সহজ ক্যাচ তুলে দেওয়া ছাড়া পুরো ইনিংসে ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাটিং করে দলকে দুই বল বাকি থাকতে জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ মোট ৩২৫টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিলেন। এর মধ্যে ২৮৮ ইনিংসে ব্যাট করে শতক হাঁকিয়েছিলেন মাত্র তিনটি। ক্যারিয়ারসেরা ইনিংস খেলেছিলেন লিডসে দক্ষিণ আফ্রিকার সুপার সিক্সের ঐ ম্যাচে। তার খেলা অপরাজিত ১২০ রানের ইনিংসটি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা ইনিংসগুলোর তালিকায় উপরের দিকেই থাকবে।
স্টিভ ওয়াহ'র অসাধারণ ইনিংস এবং হার্শেল গিবসের আশ্চর্যজনক মিসে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে আছে। এই ম্যাচটি না জিতলে ১৯৯৯ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার যাত্রা সুপার সিক্সেই শেষ হয়ে যেতো।
This article is in Bangla language. It is about 1999 world cup's super six match between South Africa and Australia. Please click on the hyperlinks to look for references.
Featured Image: Getty Images