জাদুকর আবার তার সাম্রাজ্যে ফিরলেন। রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাস, মর্যাদা সব মিলিয়ে এ ক্লাব একটি সাম্রাজ্যই। আর জিনেদিন জিদান সাস্তিয়াগো বার্নাব্যু থেকে প্রস্থানের আগে যে ইতিহাস রচনা করে গেছেন, তা শুধু একজন জাদুকরের পক্ষেই সম্ভব। যেখানে কোন ক্লাব কখনও পরপর দু'বার চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা ঘরের তুলতে পারেনি, সেখানে প্রথমবারের মতো বড় ক্লাবের দায়িত্ব পেয়ে জিনেদিন জিদান শিরোপা জিতলেন টানা তিনবার। কি অবিশ্বাস্য! যেন ফুটবলের রূপকথার গল্প।
হুট করে জিদানের চলে যাবার পরের ২৮৪ দিন কত বড় একটি লম্বা সময়। তা নিশ্চয় ঠেকে বুঝেছে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকরাও। বিশ্বকাপের কিছুদিন আগে জিনেদিন জিদানের আকস্মিত বিদায়ের পর পরিবর্তন কী কী হয়েছে, তার যদি একটা তালিকা বানানো হয়, তাতে অনেক প্রসঙ্গ উঠে আসবে। তবে মুখ্য বিষয় হলো, তার বিদায়ের পর মাদ্রিদ প্রায় সবকিছু হারিয়েছে। তাদের সেরা খেলোয়াড়, দুইবার কোচ বিপর্যয়, এক সপ্তাহের মধ্যে সম্ভাব্য তিনটি প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যাওয়া। আর এই ৯ মাসের মাঝে কত অঘটন আর অপমান তো আছেই।
তবে জিদান ফিরেছেন। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ রাজি করাতে পেরেছেন তাদের ঘরের ছেলেকে। জিদান যে দলটি রেখে গিয়েছিলেন, রিয়াল মাদ্রিদ প্রায় সেরকমই আছে। ব্যতিক্রম শুধু একটি জায়গায়। তিনি যখন ছিলেন,তখন এ দলে ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। জিদানের ডান হাত ছিলেন তিনিই। কিন্তু আবার ফিরে এসে সেই রোনালদোকে পাবেন না তিনি। দলের পরিবর্তন খুবই সুক্ষ্ম, কিন্তু মানসিকভাবে এ দলটি প্রচণ্ড বিপর্যস্ত ও ভঙ্গুর।
তবে জিদান কেনো বিদায় নিয়েছিলেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। ক্লাবের সব থেকে স্বস্তির সময়ে জিদানের বিদায়কে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন। অনেকের ধারণা সভাপতি পেরেজের সাথে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। তিনি বুঝে ফেলেছিলেন, বুড়ো রোনালদোকে বিক্রি করে দেবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে রিয়াল বোর্ড। তবে জিদানের পরামর্শ ছিল, বেলকে বিক্রি করে দিয়ে যেভাবে সম্ভব হোক রোনালদোকে রেখে দেওয়া। তবে তার কথা পাত্তা দেননি পেরেজ। রোনালদোহীন ভঙ্গুর দলের দায়িত্ব নেবার কোন ইচ্ছা ছিলো না তার। তাই সম্মানের সাথেই বিদায় নিতে চেয়েছিলেন জিদান। আবার ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলনে তার বক্তব্য প্রায় একই ছিল। তিনি বলেছেন,
'আমি ক্লাব ছেড়েছিলাম ক্লাবের ভালোর জন্য। সবকিছু জয় করতে একাদশে একটি পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমি মাদ্রিদেই ছিলাম, ব্যস্ত ছিলাম আমার কাজ নিয়ে। রিয়াল মাদ্রিদ আমাকে ডেকেছে, তাই আমি আবার হাজির।'
তবে যে জিদান বনিবনা না হবার কারণে হুট করে বিদায় নিলেন, পেরেজের এক ডাকে তিনি ফিরে আসলেন? এ প্রশ্নের জবাব মার্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের ভাষ্যমতে, পেরেজ নাকি কিছু শর্তসহ ৩০০ মিলিয়ন ইউরো খরচের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে প্রস্তাব দিয়েছেন। বাকি পাঁচটি শর্ত হলো:
যেসব খেলোয়াড় জিদানের প্রয়োজন নেই, তাদের বিক্রি করে দেওয়া হবে।
ইসকো এবং মার্সেলো দলে থাকবেন।
নেইমারের মতো খেলোয়াড় এবং লোনে হামেস রদ্রিগেজকে ফেরানোর কোনো দরকার নেই।
কিলিয়ান এমবাপের মত খেলোয়াড় কেনার চেষ্টা করা হবে।
এসব শর্ত বা প্রস্তাব সব উড়োখবর হলেও এমন পরিবর্তন কিন্তু মাদ্রিদের জন্য খুবই জরুরি। হুলেন লোপেতেগি বা সান্তিয়াগো সোলারির ব্যর্থতার দায় তাদের ট্যাকটিক্স নয়। তাই জিদান যে দলের দায়িত্ব নিয়েই রিয়াল মাদ্রিদকে বদলে দেবেন, তা ভেবে নেওয়াটাও যুক্তিসঙ্গত হবে না। এমনটা হয়তো জিদান নিজেও জানেন। তাই তার ফেরাতে প্রথমে পরিবর্তন আসবে দলের একাদশে।
জিদান যে তিন মৌসুম ক্লাবে ছিলেন, সে সময়ের মাদ্রিদ আর বর্তমান মাদ্রিদের আকাশ-পাতাল তফাৎ। সম্ভবত সে সময়ে রিয়ালের মধ্যমাঠের খেলোয়াড় লুকা মদ্রিচ ও টনি ক্রুস তাদের ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করছিলেন। বর্তমানে তাদের বয়স ত্রিশের প্রায় আশেপাশে, লুকা মদ্রিচ তো পার করে ফেলেছেন জীবনের ৩৩টি বছর। তাই তাদের পারফরম্যান্স যে সর্বদা একরকমই থাকবে, এমনটা কিন্তু নয়। যদিও এ বছরের পারফর্মেন্স দেখে এটাই ধারণা করা যায়, তারা দু'জনই যথেষ্ট অবদান রাখতে পারছেন না। তাই তাদের পরিবর্তে যে দলে নতুন মুখের প্রয়োজন, সেটা জিদান জানেন। আগামী মৌসুমের শুরুতে হয়তো তিনি চেষ্টা করবেন দলে নতুন মিডফিল্ডার ভেড়াতে। আর এক সপ্তাহে তিনটি শিরোপার হাতছাড়া ও একটি ভুলে যাবার মতো বছর পার করে এবার নিশ্চয় পেরেজ আর খেলোয়াড় কিনতে অনীহা করবেন না।
জিদানের ফিরে আসায় ক্লাবের খেলোয়াড়দের মধ্যে যে সেই পুরনো শক্তি মুহূর্তে ফিরে আসবে, সেটা ভেবে নেওয়াও মস্ত বড় ভুল। রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়েরা কখনও সোলারি বা লোপেতেগি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল না, যেমনটা ঘটেছিলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের খেলোয়াড়দের মধ্যে মরিনহোর বিবাদের ঘটনায়। এদিকে জিদানের সাথে প্রায় সকল খেলোয়াড়দের সম্পর্ক ভালো। লোপেতেগি স্কোয়াড সাজাতেন ইসকোকে কেন্দ্র করে, যার কারণে মদ্রিচ ও ক্রুসের নিয়মিত খেলায় ভাটা পড়েছিলো। সোলারির ট্যাকটিক্সে ইসকোর মতো কোনো খেলোয়াড়ের প্রয়োজন ছিল না, তাই তিনি ছিলেন উপেক্ষিত। এক পর্যায়ে তো সোলারির সাথে ইসকো বিবাদেই জড়িয়ে পড়লেন। ফর্ম না থাকায় মার্সেলোকে স্কোয়াডে রাখতেন না তিনি। তাই মার্সেলোর সাথেও সোলারির সম্পর্ক তেমন সুবিধার ছিল না। তাই এদিক ভাবলে, জিদানকে নিয়ে বোর্ড এবং খেলোয়াড় সবাই খুশি।
কিন্তু সবকিছু ঠিকমতো থাকলেও সমস্যা দলের স্কোয়াডে। জিদানের যে ধরণের ট্যাকটিক্স, তাতে দরকার পূর্ণাঙ্গ এক উইঙ্গার। জিদান ৪-৩-৩ বা ৪-৪-২ ফরমেশনে একাদশ সাজালেও তার আক্রমণ গড়ে উঠতো দুই উইং ঘিরে। তাই তার একাদশে পছন্দের খেলোয়াড় ছিলেন আসেনসিও এবং মার্সেলো। রক্ষণ ও আক্রমণ একই সাথে দুই পজিশন সামলানোর কারণে ভাসকেজ হয়ে উঠেছিলেন তার প্রিয়পাত্র। তাই জিদান ফেরায় মার্সেলো, আসেনসিও এবং ভাসকেজের একাদশে ফেরার সম্ভাবনা বেশি। তবে জিদানের বিদায়ের পর থেকে আসেনসিও ও মার্সেলো সেভাবে ফর্মে নেই। পাশাপাশি আসেনসিও'র দুর্বলতাও সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে, আর মার্সেলোর মূল প্রতিপক্ষ বয়স। তবুও মার্সেলো টিকে গেলে উইংয়ের ডান ও বাম পাশে দেখা যেতে পারে নতুন মুখ। জিদানের ব্যক্তিগতভাবে প্রিয় ফুটবলারদের একজন হলেন এডেন হ্যাজার্ড, যিনি রিয়াল মাদ্রিদে খেলার জন্য মুখিয়ে আছেন। সভাপতি পেরেজের অনেক দিনের চাওয়া কিলিয়ান এমবাপে বা নেইমারকে বার্নাব্যুতে আনা। তাই রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণভাবের দায়িত্ব বদলে যদি নেইমার, হ্যাজার্ড বা এমবাপের হাতে চলে যায়, তাতে খুব একটা অবাক হবার কথা নয়। তবে জিদান আসাতে নেইমারের 'মন খারাপ' হয়ে যেতেই পারে। বিগত বছরগুলোতে পেরেজ চাইলেও তার কারণে নেইমারের মাদ্রিদে আসা হয়নি। এবারও জিদান তা হতে দেবেন না, সেটা আর বিস্তারিত নিশ্চয়ই বলতে হবে না।
একটা কথা আগেই বলা হয়ে গেছে। জিদানের যেসব খেলোয়াড়ের প্রয়োজন নেই, তাদের দলে থাকার সম্ভাবনা কম। তাই হয়তো গ্যারেথ বেলের বিদায় এবার নিশ্চিত। তরুণ তুর্কি ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের স্থান হতে যাচ্ছে বেঞ্চে। হামেস রদ্রিগেজেরও আর মাদ্রিদে ফেরা হচ্ছে না। বিগত মৌসুমগুলোতে জিদানের পরিকল্পনায় হামেস কখনোই ছিলেন না। তবে জিজুর নেতৃত্বে সেখানে নতুনভাবে ইসকো অধ্যায় শুরু হতে পারে, যাকে বেশ কিছুদিন আগে সোলারি ও গুটিকয়েক মাদ্রিদ সমর্থক কোনো পাত্তা দেননি।
এবার জিনেদিন জিদানের বিপক্ষে কিছু যুক্তি ধরা যায়। সেক্ষেত্রে বলা দরকার, তিনি প্রচন্ড ভাগ্যবান একজন মানুষ। যখন রিয়াল মাদ্রিদে এসেছিলেন, তখন তাদের সাজানো-গোছানো দল ছিল। আর সে দলে ছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো খেলোয়াড়, যিনি প্রতি মৌসুমে ৫০ গোলের প্রতিশ্রুতি দিতে পারতেন। তাই জিজু'র তেমন সমস্যা হয়নি। এ স্কোয়াড তাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে, পাশাপাশি জিদান তার মস্তিষ্ক আরেকটু খাটিয়ে দলকে এনে দিয়েছেন শিরোপা। তবে জিদানের একটি দুর্বল দিক অবশ্য আছে। তিন মৌসুমে তার দল কখনও নিরঙ্কুশ ধারাবাহিকতার সাথে জয় পায়নি, লিগে জিদান মাঝে মাঝেই হোচঁট খেয়েছেন। আর তিনি পাখির চোখ করতেন চ্যাম্পিয়নস লিগকে, যার ফলে লিগে জিদানের রিয়াল মাদ্রিদ কিন্তু মনে রাখার মতো কোনো পারফরম্যান্স দেয়নি।
তবে সেসব থাকুক। জিদান পেয়েছিলেন একটি সাজানো-গোছানো দল, যেটা তিনি আবার নিজের মত সাজিয়ে নিয়েছিলেন। বর্তমান মাদ্রিদ আর পুরনো মাদ্রিদ নেই। দলের খেলোয়াড়ের অনেকেই তাদের সামর্থ্য হারিয়েছেন দৃষ্টিকটুভাবে, আত্মবিশ্বাসও হারিয়েছে আরও বহু আগে। এমন একটি দলকে জিদান কীভাবে সামলে নেবেন, সেটা বর্তমানে দেখবার বিষয়। মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে রোনালদোও নেই। মাদ্রিদকে পুনরায় সাজাতে হবে, ম্যাচ জিততে হবে। জিনেদিন জিদান কিন্তু পাহাড়সমান চ্যালেঞ্জ নিয়েই ফিরলেন তার রাজ্যে।
৯ মাস আগে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন জিদান, পেরেজের যা মনে ধরে নি। কিন্তু জিদান যে সঠিক ছিলেন, তা এ মৌসুমের প্রতিটা ম্যাচে বুঝেছে 'লস ব্লাংকোস'রা। তবে ভুল থেকেই মানুষ শিক্ষা নেয়। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ তাই বুঝেলেন, এই ভয়াল সময়ে জিদানকে আবারও তাদের প্রয়োজন। তাই পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরিয়ে আনলেন জিদানকে। হয়তো এই পরিবর্তনই আবার রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে যাবে ইতিহাসের দোড়গোড়ায়।
This article is in Bangla language. It is about Zinedine Zidane and his dramatic comeback to Real Madrid. The writer tried to gather the facts and rumours together through this feature. Please click on the hyperlinks to look for references.
Feature Image Source: AFP/John Thys/Getty Image