Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জিনেদিন জিদান: ব্রাজিলকে দুবার কাঁদানো এক মহানায়ক

২০১৪ পর্যন্ত বিশ্বকাপের আসর হয়েছে ২০টি। এর ভেতর সবচেয়ে বেশি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ব্রাজিল, ৫ বার। তবে কথিত আছে, বেশিরভাগ ব্রাজিলিয়ানই নাকি মনে করে, তাদের বিশ্বকাপ থাকতে পারতো আরো দুটি, কেবলমাত্র টেকো মাথার একজন মানুষের জন্যেই তাদের দুটি বিশ্বকাপ কমে গিয়েছে। টেকো মাথার সেই মানুষটির নাম জিনেদিন জিদান।

১৯৭০ বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে যেকোনো কারণেই হোক, ব্রাজিলের আর বিশ্বকাপটা জেতা হচ্ছিলো না। মাঝে জিকো-সক্রেটিসদের দলটা চমৎকার হলেও ফাইনালের পথটাই খুঁজে পাচ্ছিলো না। ১৯৯৪ সালে রোমারিওর নেতৃত্বে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ব্রাজিল দলে যেন আবারও একটা সোনালী প্রজন্ম আসে। অসাধারণ এই প্রজন্মটা ১৯৯৫ সালের কোপা আমেরিকাতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে রানার্সআপ হয় ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে হেরে গিয়ে। তবে ১৯৯৭ সালের কোপা আমেরিকা আর কনফেডারেশনস কাপ জিতে ফেভারিট হিসেবেই ‘৯৮ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। বিশ্বকাপের ইতিহাসে মাত্র দুটি দল পরপর তিনবার ফাইনাল খেলতে পেরেছে; একটি জার্মানি (১৯৮২, ১৯৮৬ ও ১৯৯০), অপরটি ব্রাজিলের এই প্রজন্ম (১৯৯৪, ১৯৯৮ আর ২০০২)।

কতটা দুর্ধর্ষ ব্রাজিলকে আটকে দিয়েছিলেন জিনেদিন জিদান, সেটা বলাই বাহুল্য। জিদানের সেই যাদুকরী ম্যাচ দুটোর কথাই একটু শোনা যাক।

১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনাল

আগের আসরের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল এবারেও দল হিসেবে দুর্দান্ত ছিল। আগের আসরের নায়ক রোমারিওকে বিতর্কিত ইনজুরির কারণে দল থেকে বাদ দেওয়া হলেও কাফু, কার্লোস, রিভালদো, রোনালদোর সমন্বয়ে গড়া দলটা বিশ্বকাপ জয়ের দাবিদারই ছিল। বিশেষ করে এই বিশ্বকাপ শুরুর আগে রোনালদো লিমা মিডিয়ার কাছ থেকে প্রচুর লাইম লাইট পান। এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড (জা ফন্টেইনের ১৩ গোল) রোনালদোই ভাঙবেন বলেও অগ্রিম ধারণা করা হয়। সেটা না পারলেও ফাইনালের আগপর্যন্ত ৪ গোল আর ৩ অ্যাসিস্ট করে ব্রাজিলের ফাইনালে যাওয়ার পথে মূল ভূমিকাটা তিনিই পালন করেছিলেন।

গ্রুপ পর্যায়ে নরওয়ের কাছে একটা ম্যাচ হেরে গেলেও সেটা অঘটন বলেই বিবেচিত হয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে চিলির বিপক্ষে ৪-১ গোলের সহজ জয় পেলেও ডেনমার্কের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচটাতে একটু হোঁচট খায় ব্রাজিল। ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই ডেনমার্ক এগিয়ে গেলে ২৭তম মিনিটের মাঝেই পরপর দুই গোল করে ব্রাজিলই ম্যাচে এগিয়ে যায়। কিন্তু ৫০ তম মিনিটে ডেনমার্ক আবার গোল করে ম্যাচে সমতা নিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত ৬০ তম মিনিটে ব্রাজিল জয়সূচক গোল করে পরের পর্বে ওঠে।

সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে টুর্নামেন্টের মূল বাধার মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। বার্গক্যাম্প, ক্লুইভার্ট, ওভারমার্স, এডগার ডেভিডস, ফ্রাঙ্ক ডি বোরদের সমন্বয়ে গড়া নেদারল্যান্ড দলটিরও যথেষ্ট যোগ্যতা ছিল চ্যাম্পিয়ন হবার। এই ম্যাচটাতে দুর্দান্ত গতি, প্লেমেকিং আর ড্রিবলিং দিয়ে রোনালদো যেন একাই কাঁপিয়ে দিচ্ছিলেন নেদারল্যান্ডের রক্ষণভাগ। বারবার নেদারল্যান্ড রক্ষণের কাছে পরাস্ত হলেও শেষপর্যন্ত রিভালদোর ক্রস থেকে অসাধারণ একটা গোল করেন রোনালদো। ওদিকে নেদারল্যান্ডও পিছিয়ে ছিল না। ক্লুইভার্টের বেশ কিছু শিশুতোষ ভুলের জন্য গোলের দেখা না পেলেও ম্যাচের ৮৭তম মিনিটে ক্লুইভার্টের গোলেই ম্যাচে ফেরত আসে ডাচরা। শেষপর্যন্ত টাইব্রেকারে ম্যাচটা জিতে নিয়ে ফাইনালের টিকেট পায় ব্রাজিল।

অন্যদিকে প্লাতিনি-যুগ শেষে স্বাগতিক ফ্রান্স আগের দুই আসরে মূল পর্বে খেলার সুযোগ না পেলেও এই আসরে এক নতুন প্রজন্ম নিয়ে মাঠে নামে। গ্রুপ পর্বে তিনটা ম্যাচে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় পর্বে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে জয় পায় ১১২তম মিনিটের গোল্ডেন গোলে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালিকে হারায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে। সেমিতে লিলিয়ান থুরামের দুই গোল থামিয়ে দেয় ডেভর সুকারের ক্রোয়েশিয়ার জয়যাত্রা। ফাইনাল শুরুর আগে ব্রাজিলই ছিলো নিরঙ্কুশ ফেভারিট। ফ্রান্সের কেবল একটাই সুবিধা, তারা স্বাগতিক। এখন এই স্বাগতিক দেশ হওয়ার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তারা শক্তিশালী ব্রাজিলকে থামাতে পারে কি না সেটাই ছিলো প্রশ্ন।

হেড থেকেই দুটো গোল করেন জিদান; Image Source: Goal.com

ফ্রান্সের টার্গেট ছিল শুরু থেকেই ডিফেন্স ঠিক রেখে আক্রমণ করা। কাউন্টার অ্যাটাক থেকে ফ্রান্স গোলের কিছু সুন্দর সুযোগ সৃষ্টিও করে ফেলে, কিন্তু পেটিট আর গিভর্শের ব্যর্থতায় ফ্রান্স গোল পায় না। এরই মাঝে রোনালদোর একটা ক্রস এবং লিওনার্দের একটা হেড দুর্দান্তভাবে ফিরিয়ে দেন বার্থেজ। তবে এরপরই কর্নার কিক থেকে জিনেদিন জিদান একটা অসাধারণ গোল করেন হেড থেকে। কর্নার কিক নেওয়ার সময় জিদান ছিলেন ডি-বক্সের বাইরে। কিন্তু কর্ণার মারার সাথে সাথে আনমার্কড অবস্থায় থাকা জিদান দ্রুত ভেতরে চলে আসেন এবং লিওনার্দোর সাথে ডুয়েলে জিতে চমৎকার হেডে তাফারেলকে পরাস্ত করেন। বিরতির ঠিক আগমুহূর্তে গিভর্শ আরেকটি বল পান ডি-বক্সের মাঝে একেবারে ফাঁকা অবস্থায়। কিন্তু তার দুর্বল শট তাফারেল সহজেই আটকে দেন।

অতিরিক্ত সময়ে ফ্রান্স আরেকটা কর্নার কিক পায়। এবারেও যেন আগের গোলটার পুনরাবৃত্তি ঘটে। আবারও ডি-বক্সের বাইরে থেকে দৌড়ে এসে জিদান হেডের মাধ্যমেই গোল করেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সেই ফাইনালের আগপর্যন্ত জিদানের সম্পর্কে অভিযোগ ছিল যে তিনি হেডে দুর্বল।

দর্শকদের সাথে উদযাপনরত; Image Source: Daily Mail

বিরতির পর ফ্রান্স একটু রক্ষণাত্মক খেলতে শুরু করে, অন্যদিকে ব্রাজিল আক্রমণাত্মকভাবে খেলা শুরু করে। ম্যাচের ৬৮তম মিনিটে দেশাইলি দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠের বাইরে চলে গেলে ১০ জনের দলে পরিণত হয় ফ্রান্স। কিন্তু এরপরেও তাদের জমাট রক্ষণের সামনে ব্রাজিলের আক্রমণ বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। অবশ্য ব্রাজিলের বাজে খেলার পেছনে রোনালদোর রহস্যময় ইনজুরিকেও দায়ী করা হয়। একেবারে শেষ মুহুর্তে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে পেটিট আরেকটি গোল করে ব্রাজিলের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেন। অসাধারণ পারফর্মেন্সের জন্য জিনেদিন জিদান ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কার পান।

রোনালদো লিমার অসুস্থতাও একটা কারণ ছিল ব্রাজিলের পরাজয়ের; Image source: Sports Illustrated

২০০৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল

রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকা, রবিনহো, আদ্রিয়ানো, কাফু, রবার্তো কার্লোস, জুনিনহো, দিদা – নামগুলো দেখেই কেমন ঝলমলে মনে হচ্ছে না? হ্যাঁ, ব্রাজিলের ২০০৬ বিশ্বকাপের স্কোয়াডটা বিশ্ব জয় করার মতোই ছিল। এত সব তারকার মধ্যমণি ছিলেন রোনালদিনহো নামের এক জাদুকর, যিনি কি না আগের দুই সিজনে বার্সালোনার হয়ে ইতিহাস গড়ে এসেছেন। ২০০২ বিশ্বকাপটাও ভালো খেলেছেন, কিন্তু সেই ব্রাজিলের মূল খেলোয়াড় না হওয়াতে লাইমলাইট ততটা পাননি। ২০০৬ বিশ্বকাপে শুধুমাত্র মূল খেলোয়াড় হিসেবেই আসেননি, অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এই বিশ্বকাপ জিতে পেলে-ম্যারাডোনার পাশাপাশি থাকতো তার নামটাও।

এভাবেই ঘিরে রাখা হয়েছিল তাকে পুরো ম্যাচ জুড়ে; Image Source: m.sports.ru

ফ্রান্স সেই বিশ্বকাপের আগ থেকেই ভাঙাচোরা একটা দল। বাছাইপর্বে যখন খাবি খাচ্ছিল, তখন জিদানসহ আরো কয়েকজন সিনিয়র ফুটবলার অবসর ভেঙে ফেরত আসলে বিশ্বকাপের টিকেট পায় দলটা। কিন্তু মূল পর্বে এসে আবারও সেই একই অবস্থা। সোনালী প্রজন্মেরও প্রায় সবাই বয়সের ভারে কাবু। গ্রুপ পর্বে সুইজারল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দলের বিপক্ষে প্রথম দুই ম্যাচে ড্র করে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার উপক্রম। শেষ ম্যাচে কোনোক্রমে টোগোর সাথে জয় পেয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হিসেবে দ্বিতীয় পর্বে উঠে মুখোমুখি হলো স্পেনের। স্পেনের গায়ে তখনও ‘কোয়ার্টার ফাইনালের দল’ এর তকমা লাগানো। তাদের বিপক্ষে ৩-০ গোলে জিতলেও তাই খুব বেশি মূল্যায়ন পেলো না স্পেন। সত্যিকার পরীক্ষার মুখোমুখি হলো কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে।

রোনালদিনহোর সাথে ব্যক্তিগত দ্বৈরথে জিদানই জয়ী; Image Source: YouTube

দল হিসেবে বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ব্রাজিল এগিয়ে, টুর্নামেন্টেও সেটার প্রতিফলন দেখা গেল। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচের তিনটিতেই জয় পেয়েছে ব্রাজিল, ৭টি গোল করার বিপরীতে হজম করেছিলো মাত্র ১টি। দ্বিতীয় পর্বেও ৩-০ গোলের সহজ জয়। বিপরীতে ফ্রান্স গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচের মাঝে জয় পেয়েছে মাত্র ১টিতে, বাকি দুই ম্যাচ ড্র। মাত্র ৩টি গোল করার বিপরীতে গোল খেয়েছে ১টি। দ্বিতীয় পর্বে ৩-১ গোলের জয়।

সব পরিসংখ্যান পক্ষে নিয়ে ব্রাজিল খেলা শুরু করলেও ম্যাচ শুরুর পর পাশার দান পাল্টে যায়। জিদান তার ক্যারিয়ারের সেরা খেলাটাই হয়তো খেললেন। ৩৪ বছর বয়স্ক জিদানের কৌশলের আলোকচ্ছটার কাছে ব্রাজিলের সব তারকাই যেন নিভু নিভু করছিলেন। রোনালদোর মাথার উপর দিয়ে বল নেয়া, কাকাকে ড্রিবলিংয়ে পরাস্ত করা, কাফুকে ধোঁকা দেয়া– সেদিন যেন জিদান যা ইচ্ছে সেটাই করতে পেরেছিলেন।

ব্রাজিলের বাধাকে এভাবেই ছিটকে ফেলেছিলেন জিজু; Image Source: Lounging Pass

শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ৫৭তম মিনিটে জিদানের ফ্রি-কিক থেকে গোল করেন থিয়েরি হেনরি। এরপর আর ব্রাজিল ম্যাচে ফিরে আসতে পারেনি। পুরো ম্যাচটা অসাধারণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ম্যাচটা জেতার সাথে সাথে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কারও পান জিদান। বিশ্বকাপ ইতিহাসের একটা অন্যতম স্মরণীয় এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা ম্যাচ হিসেবে বিবেচিত হয় এই ম্যাচটা। চাইলে সেই ম্যাচের হাইলাইটস এখানে দেখে নিতে পারেন।

শেষ কথা

বিশ্বকাপ অনেক দলই জেতে, বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কারও অনেক খেলোয়াড়ই জিতে নেন। তবে খুব কম ম্যাচই বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা ম্যাচগুলোর তালিকায় স্থান পায়। জিনেদিন জিদান সেই গুটিকয়েক জাদুকরদের একজন, যার কি না একের অধিক স্মরণীয় ম্যাচ আছে বিশ্বকাপে।

বিশ্বকাপ ফুটবল যতদিন থাকবে, ফুটবলপ্রেমীরা এই দুটি ম্যাচের কথাও ততদিন মনে রাখবেন।

ফিচার ইমেজ: theScore

Related Articles