Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

২০১৮ শীতকালীন অলিম্পিকে ভয়াবহ সাইবার আক্রমণের নেপথ্য কাহিনী || পর্ব ১

অলিম্পিককে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ। তবে সাধারণত অলিম্পিক বলতে আমরা যে ইভেন্টকে বুঝি, সেটা ছাড়াও শীতকালীন অলিম্পিক বলেও আরেকটি প্রতিযোগিতার আসর বসে। ২০১৮ সালে তেমনই একটি আসর বসেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের পিয়ংচ্যাং শহরে। উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে যখন সাজসাজ রবরব অবস্থা, তখনই ঘটে গেল নজিরবিহীন সাইবার হামলা। তাও কিনা প্রযুক্তি খাতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ একটি দেশে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার এ হামলার পেছনে রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া নাকি চীন, কে দায়ী তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না।

লেখক অ্যান্ডি গ্রিনবার্গের স্যান্ডওর্ম বই থেকে এ ঘটনার অংশ ওয়েয়ার্ড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর। রোর বাংলার লেখকদের জন্য এ সাইবার হামলার ঘটনা ওয়েয়ার্ড ম্যাগাজিন থেকে ৫ পর্বে ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করা হয়েছে। এখানে পড়ুন ১ম পর্ব। 

২০১৮ সালে পিয়ংচ্যাং অলিম্পিক; Image Source: transworld

২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। সময় দক্ষিণ কোরিয়ার পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য এলাকা পিয়ংচ্যাং শহরে রাত ৮টা বাজার কিছুক্ষণ আগের সময়। পিয়ংচ্যাংয়ের বিশাল পঞ্চভুজাকার অলিম্পিক স্ট্যাডিয়ামে রাখা কয়েক ডজন প্লাস্টিকের চেয়ারের একটিতে বসা অবস্থায় ছিলেন স্যাং-জিন ওহ। তিনি একটি ধূসর ও লাল রঙের অলিম্পিকের অফিসিয়াল জ্যাকেট পরিহিত ছিলেন, যা হিমশীতল আবহাওয়াতেও তাকে সুরক্ষা দিচ্ছিল। তার আসন ছিল প্রেস সেকশনের পেছনে, যেখান থেকে কয়েকশ ফুট উঁচু মঞ্চ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ২০১৮ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান তখন শুরু হতে যাচ্ছিল।

ছাদহীন স্টেডিয়ামে বাতি নেভানো অবস্থায় ৩৫,০০০ দর্শকের মধ্যে বিপুল উত্তেজনা কাজ করছিল। তাদের ফোনের স্ক্রিনের আলো পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে অগ্নিকুণ্ডের আভার মতো দেখাচ্ছিল। ওহ-এর চেয়ে খুব কম লোকই এ উত্তেজনা সরাসরি অনুভব করতে পেরেছে। ৪৭ বছর বয়সী এই সরকারি কর্মচারী তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে পিয়ংচ্যাং অলিম্পিক আয়োজক কমিটির প্রযুক্তি বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি এ ক্রীড়াযজ্ঞের প্রযুক্তি বিষয়ক অবকাঠামোগুলোর বিন্যাস তত্ত্বাবধান করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে ছিল ১০ হাজারের বেশি কম্পিউটার, ২০ হাজারের বেশি মোবাইল ডিভাইস, ৬,৩০০ ওয়াই-ফাই রাউটার এবং সিউলের দুটি ডেটা সেন্টারে থাকা ৩০০টি সার্ভার।

উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রায় ৩৫,০০০ দর্শক। তারা জানত না আড়ালে এত বড় সাইবার হামলার ঘটনা ঘটছে; Image Source: winterolympiclive.webstarts.com

মেশিনের এই বিশাল ভাণ্ডার ‘প্রায়’ স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছিল। আধ ঘণ্টা আগে তিনি একটি বিরক্তিকর কারিগরি ত্রুটির কথা জানতে পারেন। সমস্যার উৎস ছিল এক ঠিকাদার আইটি কোম্পানি, যাদের কাছ থেকে অলিম্পিক আরো একশটি সার্ভার ভাড়া নিয়েছিল। সেই ত্রুটিটি দীর্ঘমেয়াদী মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ওহয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল রাগান্বিত। যখন পুরো বিশ্ব অনুষ্ঠানটি দেখার জন্য বসে আছে, তখনও কিনা কোম্পানিটি তাদের ‘বাগ’ এর সমাধান করতে পারছে না।

সিউলের ডেটা সেন্টারগুলো অবশ্য এ রকম কোনো সমস্যা নিয়ে বিবৃতি দেয়নি। ওহয়ের টিম মনে করছিল, ঠিকাদার কোম্পানিটির সমস্যাটা মিটিয়ে ফেলা যাবে সহজেই। কিন্তু তিনি তখনো জানতেন না, তারা কিছু অংশগ্রহণকারীর টিকিট প্রিন্ট করা বন্ধ করে দিয়েছিল, যার মাধ্যমে তারা স্টেডিয়ামে প্রবেশ করবে। 

আটটা বাজার দশ সেকেন্ড আগে মঞ্চের চারদিকে এক এক করে সংখ্যাগুলোর বাতি জ্বলে উঠল। বাচ্চাদের এক গায়কদল কোরিয়ান ভাষায় কাউন্টডাউন শুরু করল। কাউন্টডাউনের মাঝখানে হঠাৎ ওহয়ের স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট-৮ ফোন আলোকিত হয়ে উঠল। তিনি দেখতে পেলেন কোরিয়ান জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ কাকাওটকে তার অধীনস্থ এক কর্মীর মেসেজ। মেসেজটিতে ওহ সম্ভবত সে মুহূর্তে তার সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদটি জানতে পারলেন। সিউলের ডেটা সেন্টারগুলোর প্রতিটি ডোমেইন কন্ট্রোলারগুলো কিছু একটা বন্ধ করে দিচ্ছে। এই সার্ভারগুলো ছিল অলিম্পিকের প্রযুক্তি কাঠামোর মূল ভিত্তি।

উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর স্টেডিয়াম জুড়ে হাজার হাজার আতশবাজি পোড়ানো হচ্ছিল। কয়েক ডজন বিশালদেহী পাপেট ও কোরিয়ান নৃত্যশিল্পী মঞ্চে প্রবেশ করল। ওহ সেগুলোর কিছুই দেখলেন না। তাদের প্রযুক্তি কাঠামো পুরো অন্ধকারে চলে যাওয়ায় ওহ রাগান্বিত হয়ে তার সহকর্মীদের সাথে বার্তা আদান-প্রদান করছিলেন। তিনি দ্রুতই উপলব্ধি করলেন তাদের অংশীদার কোম্পানি যে ত্রুটির কথা বলছিল, সেটা সাধারণ কোনো ত্রুটি নয়। এটা ছিল সাইবার আক্রমণের প্রথম নিদর্শন। তিনি তখন তার টেকনোলজি অপারেশন সেন্টারে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন।

উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর হাজার হাজার আতশবাজি পোড়ানো হচ্ছিল;  © Brendan Smialowski

তিনি যখন প্রেস সেকশন দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলেন, সাংবাদিকরা ইতোমধ্যে অভিযোগ করা শুরু করেন ওয়াইফাই সংযোগ হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে। স্টেডিয়ামের জুড়ে ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকা হাজার-হাজার টেলিভিশন স্ক্রিন ও ১২টি অলিম্পিক যন্ত্র কালো হয়ে যায়। অলিম্পিক ভবনে থাকা রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি ভিত্তিক প্রতিটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। অলিম্পিকের অফিসিয়াল অ্যাপও কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়, যার মাঝে ডিজিটাল টিকেটিংয়ের ব্যবস্থাও ছিল। যখন এর ব্যাকএন্ড সার্ভার থেকে ডেটার প্রয়োজন হয়, তখন কিছুই দেখাতে পারছিল না।

পিয়ংচ্যাং আয়োজক কমিটি এর জন্য প্রস্তুত ছিল। ২০১৫ সাল থেকে এর সাইবার নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সাথে ২০ বার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তারা অলিম্পিকের আগের বছরের গ্রীষ্মে সাইবার আক্রমণ, আগুন দুর্ঘটনা ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার অনুশীলন করেছিল। কিন্তু এখন সেই দুঃস্বপ্নগুলোর একটি বাস্তব হয়ে ধরা দিলো। তিনি একই সাথে ক্ষুব্ধ ও পরাবাস্তবতা অনুভব করছিলেন। তিনি ভাবছিলেন, “এটা (সাইবার আক্রমণ) আসলেই ঘটেছে।” যেন তিনি নিজেকে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন থেকে বাস্তবে নিয়ে আসতে চাইছিলেন।

ওহ ভিড় থেকে ছাড়া পাওয়া মাত্রই দৌড়ে স্টেডিয়ামের বের হওয়ার গেট দিয়ে রাতের ঠাণ্ডা বাতাসের দিকে ছুটলেন। স্টেডিয়ামের বাইরে পার্কিং লটে তার সাথে আরো দুই আইটি সহকর্মী যোগ দিলেন। তারা একটা হুন্দাই এসইউভিতে চড়ে পার্বত্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে উত্তর দিকে ৪৫ মিনিটের যাত্রা শেষে উপকূলীয় শহর গ্যাংনিউংয়ে পৌঁছান। এখানেই ছিল অলিম্পিকের টেকনোলজি অপারেশন সেন্টার।

গাড়ি থেকে ওহ স্টেডিয়ামে থাকা সহকর্মীদের ফোনে নির্দেশ দিচ্ছিলেন সাংবাদিকদের কাছে ওয়াইফাই হটস্পট বিতরণ করতে এবং নিরাপত্তাকর্মীদের সক্রিয়ভাবে ব্যাজ চেক করতে, কারণ রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি সিস্টেম কাজ করছিল না। কিন্তু সেটা ছিল তাদের উদ্বেগের ক্ষুদ্রতম অংশ।

ওহ জানতেন আর মাত্র ২ ঘণ্টা পরই উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে। তখন হাজার হাজার অ্যাথলেট, ভ্রমণে আসা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও দর্শকরা টের পাবে তাদের ওয়াইফাই সংযোগ নেই। একইসাথে অলিম্পিকের অ্যাপ কাজ করছে না। ফলে পুরো সূচি, হোটেলের তথ্য, মানচিত্র কোনো কিছুরই অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না তারা।

পিয়ংচ্যাং অলিম্পিকে ছিল প্রযুক্তির ছড়াছড়ি; Image Source: Olympics

এর ফলাফল হবে অপমানজনক। তারা যদি পরের দিন সকালের মধ্যে সার্ভার পুনরুদ্ধার না করতে পারেন, তাহলে আয়োজক কমিটির পুরো আইটি ব্যবস্থা অচল হয়ে যাবে। অলিম্পিক শুরু হয়ে যাওয়ায় এতে খাবারের ব্যবস্থা থেকে হোটেল ঠিক করা, টিকিট কেনা সব অফলাইনে করতে হবে। ফলে অলিম্পিকে এই অভূতপূর্ব প্রযুক্তিগত চরম ব্যর্থতা দেখা যাবে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির একটি দেশে।

ওহ গ্যাংনিউংয়ে টেকনোলজি অপারেশন সেন্টারে পৌঁছান রাত ৯টায়। ততক্ষণে উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানের অর্ধেক সময় পেরিয়ে গেছে। অপারেশন সেন্টারটি ছিল বড় একটি কক্ষ, যেখানে ১৫০ জন কর্মীর ডেস্ক ও কম্পিউটারের ব্যবস্থা ছিল। একটি দেয়াল ছিল কম্পিউটার স্ক্রিন দিয়ে ভরা। ওহ যখন পৌঁছান, তখন ওই কর্মীদের অনেকে একত্রিত হয়ে উত্তেজিতভাবে আলোচনা করছিল কীভাবে এই আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। তারা এ সমস্যার কারণে নিজেদের মধ্যে ইমেইল ও মেসেজিংয়ের মতো মৌলিক বিষয়গুলো বন্ধ করে দিয়েছিল।

উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে অনেক শৈল্পিক কর্ম থাকলেও সেগুলো দেখার মতো অবস্থায় ছিলেন না অলিম্পিকের স্টাফরা; © Javier Soriano 

অলিম্পিক স্টাফদের নয়টি ডোমেইন কন্ট্রোলার ছিল। এ শক্তিশালী মেশিনগুলোর মাধ্যমে নেটওয়ার্কে থাকা কোনো কর্মী কোন কম্পিউটারে প্রবেশাধিকার পাবে, তা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সবগুলো কন্ট্রোলারই কোনো কারণে অচল হয়ে যাওয়ায় পুরো সিস্টেমই ভেঙে পড়ে।

কর্মীরা তখন সাময়িক সমাধান বের করে। তারা ওয়াইফাই ও ইন্টারনেট সংযুক্ত টেলিভিশন সার্ভিস দেওয়া কিছু মৌলিক সার্ভিস দেওয়া অক্ষত সার্ভারগুলোকে অচল মেশিনগুলো থেকে বাইপাস করে। এতে তারা অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক মিনিট আগে ন্যূনতম কিছু সিস্টেম অনলাইনে আনতে সক্ষম হয়।

পরবর্তী দুই ঘণ্টায় তারা আরো দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ ডোমেইন কন্ট্রোলার পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৌশলীরা বারবার দেখতে পাচ্ছিলেন সার্ভারগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাদের সিস্টেমে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুর উপস্থিতি থেকে যাচ্ছিল, যা তাদের মেশিনগুলো পুনরায় চালু করার চেয়ে দ্রুত গতিতে এর কার্যক্রম ব্যহত করছিল। (এরপর দেখুন পর্ব ২-এ) 

This is a Bengali article written about the scene of a disastrous cyberattack in the 2018 winter Olympics. The article is translated from an article of WIRED magazine published on 17 October 2019. 

Featured Image: Getty Images 

Related Articles