Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টেলিভিশন উদ্ভাবন: এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ার ও বিশালাকায় কর্পোরেশনের দ্বন্দ্ব

১৯২০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ফাইলো ফার্ন্সওর্থের মাথায় তখন টেলিভিশনের ভূত ভালো রকমভাবেই জেকে বসেছে। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি টেলিভিশন তৈরির পরিকল্পনা করে বসে আছেন তিনি। টেলিভিশন প্রযুক্তি সবে কয়েক বছর হলো এসেছে। নিপকভ ডিস্ক ব্যবহার করে জন লগি বেয়ার্ড তৈরি করেছেন প্রথম ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল টেলিভিশন। তার উদ্ভাবনের পর যুক্তরাষ্ট্রের নামজাদা সব কোম্পানিও আগ্রহী হয়ে উঠেছে টেলিভিশন প্রযুক্তির দিকে। তারা ব্যয়বহুল সব গবেষণা প্রকল্প শুরু করে দিয়েছে নিপকভ ডিস্কের উন্নতির পেছনে।

এদিকে ফার্ন্সওর্থ বলে বেড়াচ্ছেন, তার টেলিভিশন হবে তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। তিনি তৈরি করবেন প্রথম অল-ইলেকট্রনিক টেলিভিশন। তার পরিকল্পনামতো এগোলে মানের দিক দিয়ে বহুগুণ উন্নত হবে তার প্রযুক্তিটি। সব মিলিয়ে বিষয়টি দুঃসাহসিকই বলতে হবে। ইউটা (Utah)-র এক গ্রাম্য তরুণ নাকি টক্কর দেবে টেক-জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর সাথে। তার দুঃসাহসিক উদ্ভাবনের সে ইতিহাস নিয়েই এ নিবন্ধটি। এর আগের মেকানিক্যাল টেলিভিশন, নিপকভ ডিস্কের দুর্বলতা, ফার্ন্সওর্থের স্বপ্ন ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাবেন এখানে। 

জন লগি বেয়ার্ড ও তার মেকানিক্যাল টেলিভিশন; Image Source: Apic/Getty Images

যে প্রযুক্তির ইতিহাস নিয়ে আজকের আলোচনা, প্রথমে সংক্ষেপে সেই অল-ইলেকট্রনিক টেলিভিশনের কাজের কৌশল দেখে নেওয়া যাক। এ টেলিভিশনে মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে ক্যাথোড রে টিউব (সিআরটি)। এর সাহায্যেই তৈরি হয় ভিডিও চিত্র সংগ্রহ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা। ডিসপ্লের জন্য ব্যবহৃত সিআরটিকে একটি সরু মুখ ও প্রশস্ত তলা সহ কাঁচের বোতলের মতো করে ভাবা যেতে পারে। এটিকে প্রথম বায়ুশূন্য করে নেওয়া হয়। এরপর সরু মাথায় বসানো হয় একটি ইলেকট্রন গান। এরপর এ গান থেকে ইলেকট্রন রশ্মি ছোঁড়া হয় প্রশস্ত তলার দিকে, যেটি ফসফর দ্বারা আচ্ছাদিত। ফসফরে ইলেকট্রন পড়লে তা আলোকিত হয়ে ওঠে। এভাবে ইলেকট্রন গানটিকে উপরে নিচে ঘুরিয়ে ও এর তীব্রতা কমিয়ে বাড়িয়ে সিআরটির পর্দায় ফুটিয়ে তোলা যায় ছবি।

সিআরটিকে কিছুটা পরিবর্তন করে তৈরি করা যায় ভিডিও ক্যামেরাও, যেটি চলমান ছবিকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করতে পারে। ফার্ন্সওর্থের ক্যামেরাটির নাম ছিল ইমেজ ডিসেক্টর। সরলভাবে বললে, ইমেজ ডিসেক্টর বাইরের পৃথিবীকে দেখে একটি কাঁচের লেন্সের সাহায্যে। এ লেন্সটি বাইরের দৃশ্য থেকে আলো এনে ফোকাস করে একটি বিশেষ প্লেটে। এ প্লেটটি সিজিয়াম অক্সাইডের প্রলেপ দ্বারা আচ্ছাদিত। সিজিয়াম অক্সাইডে আলো এসে পড়লে এটি ইলেকট্রন বিকিরণ করে। সে ইলেকট্রনগুলো গিয়ে ধরা দেয় একটি ক্ষুদে ডিটেক্টর সার্কিটে। এভাবে বাইরের চলমান দৃশ্য পরিণত হয় বৈদ্যুতিক সংকেতে। এ সংকেতকে এবার সহজেই দূর দূরান্তে পাঠানো সম্ভব। এই ছিল ফার্ন্সওর্থের পরিকল্পিত টেলিভিশন ক্যামেরা ও ডিসপ্লে ব্যবস্থার সহজ সরল রূপ।

ফার্ন্স‌ওর্থে‌র ইমেজ ডিসেক্টর; Image Source: sciencemuseum.org.uk

সমস্ত পরিকল্পনা শেষে তিনি লেগে পড়েন একে পরিণতি দেওয়ার কাজে। ভরসা বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যে যোগাড় করে ছয় হাজার ডলারের তহবিল। এ সময় তার উৎসাহ-উদ্দীপনার মাত্রা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। তিনি তার টেলিভিশনের জন্যে সিআরটি তৈরি করতে গিয়েছিলেন সল্ট-লেকের একটি দোকানে। কিন্তু তাদের কাজ সন্তুষ্ট করতে পারলো না তাকে। তারুণ্যের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত ফার্ন্সওর্থ সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই গ্লাসব্লোয়িং-এর কাজ শিখবেন, যাতে সম্পূর্ণ মনমতো করে গড়ে তুলতে পারেন তার টেলিভিশনকে।

এসব কীর্তি-কাণ্ডের ফলে কিছুদিনের মধ্যে কিছুটা নাম-ধাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে তার। সে সুবাধে আরো পঁচিশ হাজার ডলারের বিনিয়োগ যোগাড় করতে সক্ষম হন তিনি। এ পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন তার কাজ আরেকটু জোরগতিতে এগিয়ে নেওয়া উচিত। তাই নিজের খামার ছেড়ে সান ফ্রান্সিসকো শহরের এক কোণে একটি ছোটখাটো গবেষণাগার স্থাপন করেন। সেখানে চালিয়ে যেতে থাকেন তার কাঙ্ক্ষিত টেলিভিশন তৈরির কাজ।

১৯২৭ সালে তার অল-ইলেকট্রনিক টেলিভিশনের প্রোটোটাইপ তৈরি হয়। সবে একুশ বছর বয়সী ফার্ন্সওর্থ নাম লেখান ইতিহাসে, গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবকদের মধ্যে কনিষ্ঠতম একজন হিসেবে। ততদিনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পেটেন্ট-এর আবেদনও করে রেখেছিলেন তিনি। এর পরের বছর আনুষ্ঠানিকভাবে  উন্মোচিত হয় তার টেলিভিশনের পর্দা।

নিজের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সাথে ফার্ন্সওর্থ; Image Source: thehistoryoftv.com

সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক টেলিভিশনে প্রথম ছবি হিসেবে সম্প্রচারিত হয় একটি ডলার সাইন ($)। এতদিন তার প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে যারা নান অজুহাত দেখিয়েছেন তাদের প্রতি খোঁচা হিসেবে দেখা যেতে পারে বিষয়টিকে। কিংবা কে জানে ফার্ন্সওর্থ হয়তো এটিএন্ডটি কিংবা জেনারেল ইলেকট্রিকের মতো বিশালাকায় কোম্পানিগুলোকে একহাত দেখে নিতে চেয়েছিলেন, যারা তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেও কাছাকাছি সফলতা অর্জন করতে পারেনি। তিনি স্রেফ একার পরিশ্রমে ততদিনে এ বিশালাকায় কোম্পানিগুলোর চেয়ে উন্নত টেলিভিশন তৈরি করে ফেলেছিলেন।

তবে ফার্ন্সওর্থই ইলেকট্রনিক টেলিভিশনে আগ্রহী একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন না। ভ্লাদিমির জোরিকিন নামের একজন রাশিয়ান অভিবাসী গবেষকের চরিত্রও এ গল্পে বেশ গুরুত্ববহ। তিনিও অনেক আগ থেকে সিআরটি-এর ওপর ভিত্তি করে টেলিভিশন ব্যবস্থা তৈরির বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। আমেরিকায় আসার পর জোরিকিন কাজ করতেন ওয়েস্টিংহাউস কোম্পানিতে। কর্তৃপক্ষের কাছে বহুদিন ধরেই টেলিভিশন নিয়ে একটি গবেষণা প্রকল্প চালু করার জন্যে তদবির করে আসছিলেন। অবশেষে ১৯২৩ সালের দিকে এসে তার ভাগ্য খুলে। একটি ছোটখাটো গবেষণা প্রকল্প শুরু করার সুযোগ দেওয়া হয় তাকে।

কিছুদিন কাজ করার পর আইকনোস্কোপ নামের একটি চমৎকার টেলিভিশন ক্যামেরার প্যাটেন্টের জন্যে আবেদন করেন তিনি। তার ডিভাইসটির স্রেফ একটিমাত্র দুর্বলতা ছিল- এটি কাজ করতো না। বছর দুয়েক পর, ওয়েস্টিংহাউস কর্তৃপক্ষ তার গবেষণার অগ্রগতিতে নাখোশ হয়ে সে প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। আর জোরিকিন স্থানান্তরিত হন রেডিও কর্পোরেশন অব অ্যামেরিকায় (আরসিএ)।

আরসিএ প্রধান ডেভিড সারনফ; Image Source: hackaday.com

আরসিএ-তে আসা জোরিকিনের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ রেডিও বাজারে অত্যন্ত প্রভাবশালী এ প্রতিষ্ঠানটি তখন ভিডিওর বাজারে ঢোকার রাস্তা খুঁজছিল। স্বাভাবিকভাবেই জোরিকিনের টেলিভিশনের প্রতি আগ্রহ মনে ধরে আরসিএ প্রধান ডেভিড সারনফের। তারা ততদিনে ফার্ন্সওর্থের কাজের বিষয়ে জেনেছেন। জোরিকিন তার দলবল নিয়ে ঘুরে এসেছেন তার গবেষণাগার। তার কাজের মূল্য বুঝে এক লাখ ডলারের বিনিময়ে তার প্যাটেন্টগুলো কিনে নিতে চায় আরসিএ। ফার্ন্সওর্থ রাজি হননি তাতে।

তবে ডেভিড সারনফ এত সহজে পিছু হটার পাত্র নন। এবার তিনি তার কূটকৌশলে প্রয়োগ করতে শুরু করলেন, যেমনটি তিনি করেছিলেন এফ.এম রেডিওর উদ্ভাবক এডুইন.এইচ আর্মস্ট্রংয়ের সাথে। ফার্ন্সওর্থের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিলেন তিনি। অভিযোগ ফার্ন্সওর্থ নাকি ১৯২৩ সালে করা জোরিকিনের সেই প্যাটেন্ট নকল করে তার টেলিভিশন তৈরি করেছে। অথচ সেটি তখনো কাজই করেনি। কিন্তু ফার্ন্স‌ওর্থের কাছে ছিল সম্পূর্ণ কর্মক্ষম প্রযুক্তি। তাতে কী, আদালতে এ দাবির ‘সত্যতা’ প্রমাণ করার জন্যে আরসিএর জাঁদরেল আইনজীবিদল তো ছিলই। তারা সবাই মিলে কোনঠাসা করে ফেলেন ফার্ন্সওর্থকে। প্রথমদিকে বেশ কয়েকটি মামলায় জিতেও যায় আরসিএ।

তবে কয়েক বছর পর ফার্ন্সওর্থের একজন স্কুল শিক্ষকের বয়ানে আদালত তার মত বদলাতে বাধ্য হয়। তার শিক্ষক কিশোর বয়সে টেলিভিশন নিয়ে তার কাজের বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন আদালতকে। এদিকে আরসিএ ততদিনে নিজেদের তৈরি টেলিভিশন ব্যবস্থাও সামনে নিয়ে এসেছে। যাতে অনেক দিক থেকে ফার্ন্সওর্থের টেলিভিশন ব্যবস্থার সাথে স্পষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এসব মিলিয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে আরসিএ ফার্ন্সওর্থকে এক মিলিয়ন ডলার দিতে বাধ্য হয়। বিনিময়ে তারা পায় তার ছত্রিশটি টেলিভিশন প্যাটেন্টের সবগুলো ব্যবহারের সুবিধা।

ফার্ন্স‌ওর্থকে বাঁচিয়েছিলেন তার শিক্ষক; Image Source: thehistoryoftv.com

ফার্ন্সওর্থের অনুকরণে তৈরি হলেও, আরসিএর টেলিভিশন ব্যবস্থা তুলনামূলক উন্নত ছিল। এটা স্বাভাবিক। কারণ ফার্ন্সওর্থ একা কাজ করেছেন, আর ওখানে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের গোটা একটি দল। সাথে ছিল বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ। এছাড়া আরসিএ টেলিভিশনের সাথে আর্মস্ট্রংয়ের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া এফ.এম রেডিও ব্যবস্থার সমন্বয় করে। ফলে অডিও ভিডিওর সমন্বয়ে, বাণিজ্যিকভাবে টেলিভিশন প্রযুক্তি সামনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় তারা। বাণিজ্যিক ময়দানে তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে পারেননি ফার্ন্সওর্থ। হতাশ হয়ে টেলিভিশন ছেড়েছুড়ে নিউক্লিয়ার ফিউশন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি।

এদিকে দৃশ্যপট থেকে ফার্ন্সওর্থ সরে যাওয়ায় টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে সর্বেসের্বা হয়ে উঠে আরসিএ। ১৯৩৯ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হওয়া ওয়ার্ল্ড’স ফেয়ারকে তারা বেছে নেয় গোটা পৃথিবীর সামনে টেলিভিশনকে উন্মোচন করার জন্যে। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের উদ্বোধনী ভাষণ সরাসরি প্রচারিত হয় নিউইয়র্ক শহরের একুশটি সাদা-কালো টেলিভিশনে। মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখেন যোগাযোগ প্রযুক্তিতে এক নতুন যুগের সূচনা করছেন তাদের রাষ্ট্রপতি।

প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক টেলিভিশন সম্প্রচারে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট; Image Source: earlytelevision.org

তবে সে সময় টেলিভিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কয়েক বছর পিছিয়ে যায় এর বিপণন। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে টেলিভিশন এক নতুন উন্মাদনা নিয়ে আসে মানুষের জীবনে। এর সবটুকু লাভের ভাগ পায় আরসিএ। আর যেমনটা হয়, বিজয়ীরাই ইতিহাস লেখে সবসময়। টেলিভিশনের ইতিহাসও রচিত হয় আরসিএর দ্বারা। টেলিভিশন প্রযুক্তির ইতিহাস থেকে ফার্ন্সওর্থকে মুছে দিয়ে, জোরিকিনকে সবটুকু কৃতিত্ব প্রদানের সম্পূর্ণ চেষ্টা চালায় তারা।

পৃথিবীও তেমনটাই মেনে নিয়েছিল। ইলেকট্রনিক টেলিভিশনের জনক হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল জোরিকিনকে। তবে ফার্ন্সওর্থকে সম্পূর্ণ চাপা দেওয়া সম্ভব হয়নি। অনেকদিন পরে হলেও ইতিহা্সের পাতা থেকে তাকে খুঁজে বের করেছেন ইতিহাসবিদরা। শ্রদ্ধার্ঘ্য‌ জানিয়েছেন তার অসামান্য অবদানের জন্যে।

This article is in the Bangla language. It's about the patent war between Radio Corporation of America(RCA) & inventor Philo Farnsworth.

Reference: Conquering the Electron by Derek Cheung, Eric Brach, page (146-151).

For more references check hyperlinks inside the article.

Featured Image: thehistoryoftv.com

Related Articles