কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারি ছিল গেম ইন্ডাস্ট্রির জন্যে আশীর্বাদ। পুরো পৃথিবীজুড়ে চলা লকডাউনের কারণে একটা বড় সময় ধরে মানুষকে ঘরের ভেতরে সময় কাটাতে হয়। একঘেয়ে সময় কাটানোর জন্যে অনেকে তখন সঙ্গী হিসেবে ভিডিও গেমকে বেছে নিয়েছিল। নতুন যুক্ত হওয়া অডিয়েন্সের কারণে গেমিং ইন্ডাস্ট্রির আয় অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তবে, ২০২১ সালে এসে ইন্ডাস্ট্রির হালচাল কিছুটা পরিবর্তনের রূপ দেখে। বড় কোম্পানিগুলোতে নারী-বৈষম্য, কর্মীদেরকে নির্ধারিত সময়ের চেয়েও অনেক বেশি সময় ধরে খাটানো, মহামারির কারণে বিভিন্ন গেম মুক্তির তারিখ পেছানোসহ বিভিন্ন রকম বিতর্ক ও সমালোচনায় ভারি হয়ে উঠেছিল গেমিং দুনিয়া। বড় কোম্পানিগুলোর এরকম বাজে সময়ে ছোট স্বাধীন ডেভেলপার স্টুডিওগুলোর জন্যে তাই প্ল্যাটফর্মগুলো উন্মুক্ত হয়ে উঠেছিল। আর, বরাবরের মতোই এই স্টুডিওগুলো হতাশ করেনি অডিয়েন্সদেরকে। নতুন ধরনের আইডিয়া ও সৃজনশীলতা দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছে স্টুডিওগুলো।
সব মিলিয়ে কেমন ছিল ২০২১ সালের গেমিং দুনিয়া? তা জানাতেই উল্লেখযোগ্য কিছু ভিডিও গেম নিয়ে এই লেখায় আলোচনা করা হবে। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ও দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সমালোচকদেরকে অনুসরণ করে এই গেমগুলো নির্বাচন করা হয়েছে।
সেবল
যতদূর চোখ যায় ধু ধু মরুভূমির দেখা মেলে শুধু। মাঝে মাঝে হঠাৎ বন্ধুর পাহাড় দেখা যায়, যার পেছনে অপরূপ সূর্যাস্ত কমলা রঙ মেলে ছড়িয়ে থাকে। এরকম একটি জায়গায় রকেটের মতো যান নিয়ে ছুটে চলে একজন তরুণী, যার নাম সেবল। এই অদ্ভুত সুন্দর দুনিয়াটি ভ্রমণে বের হয়েছে সে। শুনতে ওপেন ওয়ার্ল্ড ধাঁচের মনে হলেও গেমটির ধরন পুরোপুরি ভিন্ন। প্রচলিত বন্দুক-যুদ্ধ কিংবা কমব্যাট সিস্টেমের পথে না হেঁটে শুধুমাত্র ভ্রমণ নির্ভর করে বানানো হয়েছে গেমটি। ফরাসি কার্টুনিস্ট মোবিয়াসের চিত্রশৈলী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যে ভিজ্যুয়াল এখানে আঁকা হয়েছে, অডিয়েন্সকে তা নতুন ধরনের স্বাদ দেবে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও অডিয়েন্সকে অন্য একটি দুনিয়ায় নিয়ে যাবে গেমটি।
ডেথলুপ
চমৎকার দেখতে এই গেমটির গল্প আবর্তিত হয় কোল্ট ভ্যান নামের একজন আততায়ীকে ঘিরে। আটজন টার্গেটকে হত্যা করার মিশন দিয়ে তাকে একটি দ্বীপে পাঠানো হয়েছে। কোল্ট যতবার তার মিশনে ব্যর্থ হয়, তাকে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। এই ব্যাপারটি বেশ মজার। কারণ, নতুন করে যখন সে দ্বীপে নামে, ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন বেলায় তাকে শুরু করতে হয়। এই কারণে বিভিন্ন রকম সংকেত বা সাহায্য পায় সে। বিকালে কোনো এক ঘরের জানালা হয়তো বন্ধ থাকে কিন্তু, সকালে যদি একই জায়গায় তাকে পাঠানো হয়, হয়তো সেই জানালা খোলা অবস্থায় পাওয়া যায়। হয়তো, সে জানালা দিয়ে ভেতরের গোপন কোনো কথাবার্তা তার কানে আসে, যা মিশনের জন্যে দরকারি।
ডেথলুপের এরকম পর্যবেক্ষণ ও এক্সপ্লোর নির্ভর ডিজাইনের কারণে অডিয়েন্স অনুসন্ধানী হয়ে ওঠে। এর চমকপ্রদ এবং স্টাইলিশ শিল্প নির্দেশনা গল্পের দুর্বলতাগুলো ভুলিয়ে দেয়। এই বছরের দ্যা গেম এওয়ার্ডসে এটা আর্ট এবং গেম ডিরেকশনে পুরষ্কার পেয়েছে।
ইন্সক্রিপশন
ইন্সক্রিপশন আরেকটি ইন্ডি গেম যেটা ইন্ডাস্ট্রির বড় গেমগুলোর আধিপত্যের মাঝে নতুন ধরনের স্বাদ দেবে। কিছুটা কার্ড গেম, কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা দিয়ে সাজানো এই গেমটির এস্থেটিকস তৈরি করা হয়েছে নব্বই দশকের মতো করে। ভূতুড়ে পরিবেশ, নব্বইয়ের মতো গ্রাফিক্সের কারণে নির্দিষ্টভাবেই এখানে নস্টালজিয়ার ছোঁয়া পাওয়া যায়, গল্পের মধ্যে যেটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
প্লেয়ারের প্রতিপক্ষ এখানে আবছা আলোতে বসে থাকা কেবিনে মাস্ক পড়া একজন রহস্যময় লোক, যে প্লেয়ারকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। খেলায় টিকে থাকার জন্যে প্লেয়ারের অবলম্বন হচ্ছে, শুধুমাত্র কিছু নিয়ম, তার বুদ্ধি আর কথা বলা একটা কার্ড। ঠিকভাবে খেলতে পারলে পুরো ম্যাপটি প্লেয়ার ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে পারবে, চিনে নিতে পারবে কেবিন থেকে তার মুক্তির পথ। তবে একটু অসাবধান হলে আর রক্ষা নেই, নিশ্চিত মৃত্যু।
রেসিডেন্ট ইভিল: ভিলেজ
সমালোচকদের প্রশংসা পাওয়া রেসিডেন্ট ইভিল ৭-এর সিক্যুয়েল হিসেবে মুক্তি পায় রেসিডেন্ট ইভিল: ভিলেজ। গেমের পটভূমি এখানে পূর্ব ইউরোপ। কিছু অভিজাত ভ্যাম্পায়ার এবং তাদের অনুসারীদের কবল থেকে ইথান উইন্টারসকে তার পরিবার রক্ষা করতে হয়। গেমের শুরুতে বেশ লোমহর্ষকভাবে তার স্ত্রী মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের বাচ্চাকে কিডন্যাপ করা হয়। নতুন করে কোন ধরনের মহাবিপদে পড়েছে সেটা খুঁজতে গিয়ে ইথান ‘ভিলেজ’ এক্সপ্লোর করা শুরু করে।
জনরা হিসেব করলে গেমটি সারভাইভ্যাল হররের একদম মূল উপাদানগুলোতে ফিরে গিয়েছে। জাম্প স্কেয়ার থেকে শুরু করে জটিল পাজল সবই এখানে উপস্থিত। সব মিলিয়ে এখানে আগের গেমগুলোর অনেক উপাদান রয়েছে, যেগুলো গেমটিকে সিরিজের ভক্তদের কাছে অনেক উপভোগ্য করে তুলেছে।
ফোরজা হরাইজন ফাইভ
ফোরজা হরাইজন সিরিজটি ওপেন ওয়ার্ল্ড রেসিং গেম হিসেবে সুপরিচিত। এই সিরিজের সর্বশেষ সংযোজনের মাধ্যমে গেমটি রেসিং গেম ঘরানাতে নতুন মাত্রা যোগ করলো। মেক্সিকোর অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির মাঝে গাড়ি চালাতে চালাতে সময় কীভাবে চলে যাবে অডিয়েন্স বুঝতেই পারবে না। গেমটির গ্রাফিক্স এতোই জীবন্ত যে, মনে হবে সত্যিকারভাবে মেক্সিকোতে কোনো ভ্রমণে রয়েছেন আপনি।
গাড়ি নির্বাচন করার জন্যে রয়েছে জমকালো সুপারকার, র্যালি গাড়ি থেকে শুরু করে বিখ্যাত ক্ল্যাসিকগুলো। গাড়িগুলো আবার নতুন শক, অ্যারো পার্ট, ব্রেকপ্যাড ইত্যাদি দিয়ে কাস্টোমাইজ করা যায়, গাড়িপ্রেমিকদের জন্যে যা মধুর একটি অভিজ্ঞতা। আঁকাবাঁকা অথবা কর্দমাক্ত রাস্তা, ঘন বন কিংবা বিবর্ণ ট্রেইলে বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতা করার যে অসাধারণ অভিজ্ঞতা ফোরজা হরাইজন ফাইভ তৈরি করেছে, তাতে গেমটিকে সহজেই ভিজ্যুয়াল মাস্টারপিসের কাতারে জায়গা দেওয়া যায়। দ্যা গেম এওয়ার্ডস ২০২১-এর সেরা রেসিং গেম হিসেবে এটা নির্বাচিত হয়েছে।
হেলো ইনফিনিট
বিখ্যাত হেলো সিরিজটির প্রথম গেম মুক্তি পেয়েছিল প্রায় বিশ বছর আগে। এত বছর পরে এসে মূল চরিত্র মাস্টার চিফের গল্প কিছুটা পুরনো অনুভব হতে পারে। কিন্তু, এই বিশাল স্কেলের স্পেস শ্যুটারের মধ্যে জাদুকরী এমন কিছু আছে, যা সিরিজটির প্রতি প্রবল আকর্ষণ তৈরি করে। হেলো ইনফিনিট গেমটি ওপেন ওয়ার্ল্ড ধাঁচের করা হয়েছে, সাথে যুক্ত হয়েছে অনেকগুলো নতুন ধরনের অস্ত্র। প্রতিটি লড়াইয়ে তাই নতুন ধরনের উত্তেজনা তৈরি করা সম্ভব। তবে, হেলো ইনফিনিটের নতুন আকর্ষণ হচ্ছে ‘গ্র্যাপলিং গান’, যেটা মাস্টার চিফের মধ্যে স্পাইডারম্যানের একটা হালকা ধরন তৈরি করেছে।
হেলোর মাল্টিপ্লেয়ার মোডও কম আকর্ষণীয় নয়। সিজন পাস কেনার মাধ্যমে এখানে ভিন্ন চরিত্র, আর্মার কিংবা ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের দেখা পাওয়া যাবে।
রিটার্নাল
রিটার্নাল একটা অতিপ্রাকৃতিক সাই-ফাই ঘরানার গেম যেখানে প্লেয়ারকে সেলিন নামের একটি চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সেলিন জেদি একজন নভোচারী, যার স্পেসশিপটি দুর্ঘটনার ফলে একটি অচেনা গ্রহে বিধ্বস্ত হয়। এক্সপ্লোর করতে গিয়ে এখানে তার বিদঘুটে অনেক এলিয়েনের সাথে দেখা হয়, লড়াই করে এগিয়ে যেতে থাকলেও একটা পর্যায়ে এসে অনিবার্যভাবে সে মৃত্যুবরণ করে। এরপরে প্রথমবারের মতো আবার তাকে সেই গ্রহে পাঠানো হয়। এরকম একটা টাইম লুপের মাঝে সেলিন বন্দি থাকে। গ্রহের মাঝে এমনকি সে নিজের পুরনো মৃতদেহ খুঁজে পায়। রিটার্নাল এভাবে একটা দুঃসাধ্য অভিযানের অভিজ্ঞতা দেয়।
গল্পের টাইম লুপটির সাথে টম ক্রুজের এজ অব টুমরো (২০১৪) সিনেমার কিছুটা মিল পাওয়া যায়। এই গেমটির গ্রাফিক্সও বেশ সুন্দর। নির্জন গ্রহটির মাঝে হেঁটে চলা, সেলিনের হেলমেটে টুপ টুপ করে বৃষ্টি পড়লে কন্ট্রোলারে তার ফিডব্যাক, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে সবসময় একটা অশরীরী আতঙ্ক, সব মিলিয়ে গেমটি বাস্তবের মতো একটি ভয়াল অভিজ্ঞতা তৈরি করে। ২০২১ সালের দ্যা গেম এওয়ার্ডসে রিটার্নাল সেরা অ্যাকশনধর্মী গেম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।
হিটম্যান থ্রি
‘ওয়ার্ল্ড অব অ্যাসঅ্যাসিনেশন’ ট্রিলজির সর্বশেষ সংযোজন হিটম্যান থ্রি, এটা ট্রিলজির সবচেয়ে ভালো গেমও বটে। ঘরানা হিসেবে হিটম্যান স্টেলথ গেম। প্রধান চরিত্র এজেন্ট ৪৭ একজন আততায়ী, যার ভূমিকায় খেলতে হয় প্লেয়ারকে। এই গেমে তাকে ইংল্যান্ডের গ্রাম থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত ভ্রমণ করতে হয়। বিভিন্ন রকম অস্ত্র পরীক্ষা করতে করতে মারামারি, হত্যার মুখোমুখি হয় সে। গেমপ্লে এখানে প্লেয়ারকে বিভিন্ন রকম উপায়ে খেলার সুযোগ দেয়। যেমন: কোনো একটি হত্যা করার পরে সেটাকে দুর্ঘটনা হিসেবে সাজানো যায়, যেটা প্লেয়ারের ধৈর্য্য এবং উদ্ভাবনীকে চ্যালেঞ্জ করবে। আবার, উদ্ভট উপায়ও বের করা যায়। কেউ চাইলে মাছ দিয়ে আঘাত করেও কাউকে হত্যা করতে পারবে।
গেমের গল্প কিছুটা দুর্বল হলেও গোপন এজেন্ট ভিত্তিক গাম্ভীর্যের মাঝে এই গেম বুদ্ধিদীপ্ত স্যাটায়ার যুক্ত করেছে। হিটম্যানের ডেভেলপার আইও ইন্টার্যাকটিভ বর্তমানে জেমস বন্ডের ভিডিও গেম নির্মাণ করছে। হিটম্যান থ্রিয়ের পরে জেমস বন্ডের আসন্ন এই গেম নিয়ে আশাবাদী হওয়াই যায়।
ইট টেইকস টু
ইট টেইকস টু সম্ভবত প্রথম কোনো ভিডিও গেম যেটা রিলেশনশিপ থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। গেমের গল্প এক দম্পতিকে ঘিরে আবর্তিত, যারা বিচ্ছেদের প্রান্তে রয়েছে। হঠাৎ করেই তারা নিজেদেরকে তাদের মেয়ের খেলনা পুতুলের দেহে আবিষ্কার করে। তাদেরকে একত্রে অনেকগুলো কাজ করতে হবে, পাজল সমাধান করতে হবে যেন নিজেদের দেহে তারা ফিরে যেতে পারে। এই গেমের সবচেয়ে মজার দিকটি হচ্ছে, দুইজন মিলে এটা খেলতে হবে। যদি একজনের চরিত্রকে হাতুড়ি দেওয়া হয়, আরেকজনকে অবশ্যই পেরেক ধরে রাখতে হবে। এভাবে একটি গেমের মধ্যেই অনেকরকম গেমের অভিজ্ঞতা তৈরি করা হয়েছে, যেগুলো অনেকটা মারিও'র অ্যাডভেঞ্চারের মতো অনুভূত হতে পারে।
এই গেমটি নিশ্চিতভাবেই টয় স্টোরি, ফ্রোজেন কিংবা মাদাগাস্কারের মতো পরিবারকেন্দ্রিক অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত। চমৎকার ঘরোয়া পরিবেশের মাঝে গেমটি দুইজন প্লেয়ার খেলার মতো অনেকগুলো পাজলের চ্যালেঞ্জ দেয়। একজন প্লেয়ারকে বেশিরভাগ সময়ে দৌড়ানো, লাফানো কিংবা বেয়ে উঠার মতো কাজগুলো দেওয়া হয়, যেখানে অন্যজন সেই নির্দিষ্ট পথগুলো তৈরি করে দেয়। প্লেয়ার দুইজনের নিজেদের মধ্যে কথা বলা এবং পরিকল্পনা করা তাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গল্প দুর্বল হলেও অভিনবত্বের জন্যে গেমটি সমালোচকদের অনেক প্রশংসা পেয়েছে। ইট টেইকস টু ২০২১ সালের দ্য গেম এওয়ার্ডসে শ্রেষ্ঠ গেমের মুকুটটি জিতে নিয়েছে।
This Bangla article is on some of the best games of 2021. The Guardian and TIME magazine has been followed to create this list.
Feature Image: Ember Lab