Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

থ্রিডি প্রিন্টিং: ত্রিমাত্রিকভাবে ছাপানো যাবে বাইসাইকেল, মানুষের অঙ্গ কিংবা বন্দুক

বাজারে সাইকেল কিনতে গিয়ে দেখলেন, বিক্রেতা আপনার দেহের মাপ নিচ্ছে। আপনার মাপ নিয়েই ক্ষান্ত নয়, আপনার দেহের আকার আকৃতির সাথে মিল রেখে তৈরি করা দেওয়া হবে বাইসাইকেল। কয়েক বছর আগেও এই যেখানে ব্যাপারটি স্বপ্নেও কল্পনা করা সম্ভব হতো না, এটি এখন বাস্তব। ত্রিমাত্রিক স্ক্যানারের মাধ্যমে আরোহীর মাপ নিয়ে সেই অনুযায়ী সাইকেল বানাতে সাহায্য নেওয়া হয় ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিংয়ের। ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং প্রযুক্তির সাহায্যে নির্মিত এই বাইসাইকেলের ওজন সাধারণ সাইকেলের চেয়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ কম। পাশাপাশি গড়পড়তা সাইকেলের চেয়ে অনেক বেশি শক্তপোক্ত বলেই দাবি করেছেন এর নির্মাতারা।

কল্পবিজ্ঞান নয়, বাস্তবেই নিজের পছন্দের বাইসাইকেলটি এবার তৈরি করে নেওয়া সম্ভব; Source: dw.com

ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে প্রতিটি পণ্য আরো অনেক বেশি ক্রেতাবান্ধব হচ্ছে। ক্রেতা তার পছন্দের ডিজাইন, রঙ আর আকৃতির মধ্যে খুব সহজেই সমন্বয় করতে পারছেন। পাশাপাশি নাটকীয়ভাবে কমে আসছে উৎপাদনের সময়ও। হাতের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচামাল থাকলে, মাত্র ১০ দিনে একটি বাইসাইকেল ত্রিমাত্রিকভাবে ছাপিয়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে, শুনে অবিশ্বাস্য মনে হলেও তা এখন বাস্তব। তবে এই বিষয় নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা এই সময়কে আরো কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নেমেছেন। আর সাইকেলের কাঠামো তৈরিতে খাতা কলমের জায়গা দখল করে নিয়েছে কম্পিউটার স্ক্রিন জুড়ে থাকা জটিল সব মডেলিং সফটওয়্যার।

জটিল সব সফটওয়্যার ব্যবহার করেই তৈরি করা হয় সাইকেলের মডেল; Source: roadcyclinguk.com

থ্রিডি প্রিন্টেড বাইসাইকেল নির্মাণে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কার্বন ফাইবার, সূক্ষ্ম প্লাস্টিক আর টাইটেনিয়াম ধাতু। টাইটেনিয়ামের ঘাত সহনক্ষমতা যেমন অ্যালুমিনিয়ামের বেশি, তেমনি এর ওজনও কম।

তবে থ্রিডি প্রিন্টিং দিয়ে যে শুধুমাত্র বাইসাইকেল তৈরি করা হচ্ছে, ব্যাপারটি কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। থ্রিডি প্রিন্টিং যত বিকাশ লাভ করছে, ততই বিচিত্র সব পণ্য তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। অতি সম্প্রতি থ্রিডি প্রিন্টিং ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে পরিধানযোগ্য বিয়ের গাউন।

সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত বিয়ের গাউনটি তৈরি করা হয়েছে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে; Source: dw.com

থ্রিডি প্রিন্টিং ব্যবহার করে এমন সূক্ষ্ম গার্মেন্টস পণ্য তৈরি করা হয়েছে, অনেকেরই ব্যপারটি বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে এই প্রযুক্তি শুধু সাইকেল কিংবা জামাতেই সীমাবদ্ধ নয়। জুতা তৈরিতে থ্রিডি প্রিন্টিংকে ইতোমধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার শুরু করেছে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘নাইক’। ফুটবল খেলায় ব্যবহৃত বুট তৈরিতে তারা ব্যবহার করছে এই প্রযুক্তি।

বুট তৈরিতেও ব্যবহার করা হচ্ছে থ্রিডি প্রিন্টিং; Source: shapeways.com

জুতার কারখানাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই থ্রিডি প্রিন্টিং করে জুতার প্রোটোটাইপ নির্মাণ করা হচ্ছিলো। কিন্তু সরাসরি বাজারে যাওয়ার জন্য থ্রিডি প্রিন্টিং করে জুতা নির্মাণের ব্যাপারটি ছিলো অনেকটাই পরিশ্রমসাধ্য। কিন্তু ‘নাইক’ এর মত বড় প্রতিষ্ঠান এই কাজে এগিয়ে আসায় থ্রিডি প্রিন্টিংকৃত পণ্য বাজারজাতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন দিগন্ত। সাধারণ ফুটবল বুটের চেয়ে ওজন কয়েকগুণ কম এই থ্রিডি প্রিন্টেড বুটের। মাত্র ১৫৯ গ্রাম ওজনের এই জুতা পায়ে অ্যাথলেটরা খুব সহজেই দৌড়াতে পারবেন।

ওজনে হালকা এই বুট দেখতেও চমৎকার; Source: shapeways.com

এই ধরনের জটিল ডিজাইনের বুটকে ত্রিমাত্রিকভাবে ছাপিয়ে বের করা মোটেও চাট্টিখানি কথা নয়। জুতার কাঁচামালকে প্রক্রিয়াজাত করে তাকে প্রিন্টারে দিয়ে দেওয়া এবং সেখান থেকে ছাপিয়ে বের করা বেশ দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু এই প্রযুক্তির অন্যতম বড় সুবিধা হলো, একবার পুরো প্রক্রিয়াটি শুরু করে দিতে পারলে প্রচলিত উপায়ের চেয়ে অনেক কম সময়ে একটি জুতা উৎপাদন করা সম্ভব। পাশাপাশি এই প্রক্রিয়ায় ক্রেতার পছন্দ, রঙ আর অন্যান্য সুবিধাকে আরো ভালো সমন্বিত করা যায়।

তবে শুধু জুতা, পোশাক কিংবা সাইকেলই নয়, দুবাইয়ে ত্রিমাত্রিকভাবে প্রিন্ট করা হয়েছে ২,৭০০ বর্গ ফুটের একটি অফিস। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে থ্রিডি প্রিন্ট করা কিছু অসাধারণ ব্রিজও। এমনকি থ্রিডি প্রিন্টিং ব্যবহার করে তৈরি করা হচ্ছে গাড়িও

থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে তৈরিকৃত গাড়ি; Source: popularmechanics.com

অনেক কম সময় আর জনবল ব্যবহার করে এই ধরনের গাড়ি প্রিন্ট করে নেওয়া সম্ভব। থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের জগৎ খুব বিস্তার লাভ করছে। এমনকি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও ত্রিমাত্রিকভাবে ছাপিয়ে নেওয়া হচ্ছে আজকাল। সার্জনদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কৃত্রিম সেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।

সার্জনদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবহৃত কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হচ্ছে থ্রিডি প্রিন্টিং এর মাধ্যমে; Source: Walter Reed National Military Medical Center

তবে সরাসরি প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গ তৈরিতেও কাজ করে যাচ্ছেন গবেষকেরা। এই কাজের জন্য জন্ম নিয়েছে ‘বায়োপ্রিন্ট্রিং’ নামে একধরনের অত্যাধুনিক ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং ব্যবস্থা। যেখানে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে জীবন্ত টিস্যুর মতো জটিল উপাদান। পাশাপাশি অন্য মানুষের দেহ থেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ফলে প্রায়শই গ্রহীতা কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। জীবনভর তাকে কিছু ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। কিন্তু সফলভাবে যদি মানুষের অঙ্গ গবেষণাগারে ত্রিমাত্রিকভাবে ছাপিয়ে বের করা যায়, তাহলে অচিরেই সেই সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে। ‘Organovo’ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে গবেষণাগারে মানবদেহের টিস্যু প্রিন্ট করার জন্য তৈরি করেছে ‘Novogen-mmx-bioprinter’

মানুষের অঙ্গ গবেষণাগারে ত্রিমাত্রিকভাবে ছাপিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে জোরেশোরে; Source: organovo.com

প্রতিদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই গড়ে একুশজন মানুষ উপযুক্ত অঙ্গদাতা না পাওয়ার কারণে মৃতুবরণ করে। বিশ্বজুড়ে এই সংখ্যা আরো অনেকগুণ বেশি। এই ধরনের বায়োপ্রিন্টারে যদি অঙ্গ তৈরি করে নেওয়া যায়, তাহলে বিশ্বজুড়ে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে বিশাল পরিবর্তন আসতে পারে বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা।

কল্পবিজ্ঞান থেকে বাস্তবে রূপ নিয়েছে বায়োপ্রিন্টার; Source: Wake Forest Institute for Regenerative Medicine

তবে এই প্রক্রিয়ার আছে বেশকিছু সমস্যাও। মস্তিষ্ক কিংবা কিডনির মতো বহুল দরকারি জটিল অঙ্গ ত্রিমাত্রিকভাবে ছাপিয়ে বের করা এখনো সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে এই প্রক্রিয়ায় অব্যাহত গবেষণা আশার আলো জ্বেলে রেখেছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। পাশাপাশি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন জীবন্ত টিস্যু কিংবা অঙ্গে যে আরো দক্ষতার সাথে বিভিন্ন টিকা আর ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে লক্ষ কোটি মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হবে।

তবে থ্রিডি প্রিন্টিংকে যেমন ভালোভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি এটি ব্যবহার করে উৎপাদন করা হচ্ছে প্লাস্টিক হ্যান্ডগানের মতো মারাত্মক সব অস্ত্র। ২০১২ সালে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রথম বন্দুক উৎপাদনের খবর সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

তবে ভয়ানক ব্যপার হলো, এধরনের বন্দুক আর এতে ব্যবহৃত গুলি প্লাস্টিক নির্মিত। তাই মেটাল ডিটেক্টরে একে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। তাই এধরনের বন্দুক তৈরির প্রযুক্তি সকলের নিকট সহজলভ্য হয়ে উঠলে আছে বিপর্যয়ের আশঙ্কা।

তবে শুধু বন্দুক নয়, থ্রিডি প্রিন্টিং ব্যবহার করে তৈরি করা সম্ভব মাস্টার কি কিংবা ভুয়া এটিএম কার্ড। যার মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য পর্যন্ত আত্মসাৎ করা যেতে পারে।  তাই ইতোমধ্যেই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজ্যে থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহারেও এসেছে বেশ কিছু বিধিনিষেধ

তাই থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নিলে সামনে হয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে ভয়াবহ কোনো দুর্যোগ।

ফিচার ইমেজ- 3dengr.com

Related Articles