Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চীনা টেক জায়ান্ট হুয়াওয়ে: মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ‘মচকাবে, কিন্তু ভাংবে না’

গুগলে গিয়ে যদি কখনও ২০২০ সালের সবচেয়ে বেশি স্মার্টফোন বিক্রি করা কোম্পানির তালিকায় চোখ বোলান, তবে বিখ্যাত স্মার্টফোন নির্মাতা কোম্পানি হুয়াওয়ের নামটি প্রথমদিকেই দেখতে পাবেন। করোনা-জর্জরিত এ বছরেও চীনের এই কোম্পানিটি বিশ্ব জুড়ে সাড়ে পাঁচ কোটির অধিক স্মার্টফোন বিক্রি করেছে! হুয়াওয়ের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ কোরিয়ার টেক জায়ান্ট স্যামসাংয়ের স্মার্টফোন বিক্রয় করোনাভাইরাসের আগ্রাসনের কারণে যেখানে ৩০ শতাংশ নেমে গিয়েছে (শুধু স্যামসাং নয়, পৃথিবীর সব বড় কোম্পানিরই বিক্রয় উল্লেখযোগ্য হারে নেমে গিয়েছে), সেখানে হুয়াওয়ের নেমেছে মাত্র ৫ শতাংশ।

পৃথিবীর অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও হুয়াওয়ের বিভিন্ন মডেলের স্মার্টফোন তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তাদের আউটলেটগুলোতে দেদারসে বিক্রি হয়েছে সেসব স্মার্টফোন। মধ্যম বাজেটের মধ্যে যুতসই স্মার্টফোন কেনার জন্য অনেকেই হুয়াওয়েকে বেছে নিয়েছেন, নিচ্ছেন। শুধু স্মার্টফোন নয়, আধুনিক বিশ্বে ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের জন্য যে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো দরকার, তা তৈরি করে দিতে অন্য বড় কোম্পানিগুলোর চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে আছে হুয়াওয়ে।

ৃআমআজআজ
মাঝারি বাজেটে ভালো স্মার্টফোন কেনার ক্ষেত্রে অনেকের মতে হুয়াওয়ে সেরা;
Image source: ph.priceprice.com

চীনের বর্তমান কমিউনিস্ট পার্টি যে জাতীয়তাবাদী ঘরানার রাজনীতি করছে, এটি চালিয়ে যাওয়ার পেছনে চীনের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের বিশাল ভূমিকা আছে। পুরো পৃথিবীতেই বর্তমানে চীনের কোম্পানিগুলো বলতে গেলে রাজত্ব করছে। বিশ্বায়নের ফলে এখন বাজার যেহেতু শুধু নিজ দেশের জন্য সংরক্ষিত নেই, তাই পুরো বিশ্বই এখন চীনের বাজারে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে হুয়াওয়ে। অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে তুলনামূলক কম দামে হুয়াওয়ে বিভিন্ন দেশে আধুনিক স্মার্টফোন কিংবা টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের অবকাঠামো তৈরির সরঞ্জাম সরবরাহ করছে, যা তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকাংশে। চীনের জনগণ রীতিমতো গর্ব করে হুয়াওয়ের জন্য। প্রযুক্তিখাতে পুরো বিশ্বে যদি নিজেদের কোনো কোম্পানি শীর্ষস্থানীয় জায়গা দখল করে থাকে, তাহলে গর্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক বৈকি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকা-চীনের যে বাণিজ্যযুদ্ধ, তাতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে মার্কিনীদের চোখে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হয়ে থাকা হুয়াওয়ে কোম্পানি। হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে চীন পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এভাবেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দু’দেশের বৈরিতা বেড়েছে দিনের পর দিন।

২০১৮ সালে প্রথম মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার পর থেকে নিষেধাজ্ঞার তালিকা শুধু দীর্ঘ হয়েছে। আমেরিকার ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের অবকাঠামো তৈরির খাত থেকে হুয়াওয়েকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, মার্কিন যেসব কোম্পানির সাথে হুয়াওয়ের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল তাদের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, আমেরিকার বাজারে স্মার্টফোন বিক্রি বন্ধ করার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমেরিকা-চীনের যে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব, চীনের বিশ্বশক্তিতে রূপান্তর হওয়ার প্রয়াসকে দাবিয়ে রাখা কিংবা অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পারা– এসব কারণের পাশাপাশি আমেরিকা হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ এনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

হচমচমচ
আমেরিকা-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিখ্যাত কোম্পানি হুয়াওয়ে; Image source: worldpoliticsreview.com

হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগগুলোর একটি হচ্ছে- তথ্য পাচারের মাধ্যমে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে সহায়তা করা। চীনের সাইবার হ্যাকারদের কুখ্যাতির কথা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র খুব ভালো করেই জানে। ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে আমেরিকানরা এখন আগের চেয়ে অনেক সতর্ক। তাদের ধারণা, হুয়াওয়ের মাধ্যমে যদি আমেরিকায় ফাইভ-জি অবকাঠামো তৈরি করা হয়, তাহলে তা চীনের হ্যাকারদের আরও বেশি করে সহায়তা করবে।

আহআুচু
আমেরিকা সন্দেহ করছে হয়তো ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে চীনের এই কোম্পানির সরঞ্জাম ব্যবহার করা হলে চীনের হ্যাকাররা সহজেই বিভিন্ন তথ্য হাতিয়ে নিতে পারবে; Image source: scmp.com

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, চীনের ইন্টেলিজেন্স আইন সম্পর্কে স্পষ্টতা না থাকা। চীনের সংবিধানে বলা হয়েছে, জাতীয় স্বার্থে ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলোকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রয়োজনে সাহায্য করতে বাধ্য থাকবে। আমেরিকার চিন্তার বড় কারণ এটি। মার্কিনীরা মনে করে, হয়তো চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে হুয়াওয়ের বড় যোগসাজশ আছে। তাই চীনা ইন্টেলিজেন্স আইনের খাতিরে মার্কিন সার্ভারের বিভিন্ন স্পর্শকাতর তথ্য হুয়াওয়ে পাচার করতে পারে। যদিও হুয়াওয়ে বরাবরই বলে এসেছে, তারা তাদের ভোক্তাদের কথা চিন্তা করে কখনোই তথ্য পাচারের মতো কাজে জড়িত হবে না। তারপরও আমেরিকা কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে আমেরিকার সফটওয়্যার বা আমেরিকায় তৈরি চিপ ব্যবহার করতে পারবে না হুয়াওয়ে। এটি একটি বিশাল ধাক্কা কোম্পানিটির জন্য। সেমিকন্ডাক্টর ও মাইক্রো চিপের জন্য মূলত আমেরিকার উপর বিশাল নির্ভরশীল চীন৷ হাইসিলিকন, হুয়াওয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি চিপ ডিজাইন করে, আর তা সেই অনুসারে চিপ তৈরি করে তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি)। চিপ ও সেমিকন্ডাক্টর তৈরির জন্য যেসব উৎপাদক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তা সবগুলোই মোটামুটি মার্কিনীদের তৈরি। নতুন নিষেধাজ্ঞায় যেহেতু আমেরিকার তৈরি সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যারের মাধ্যমে উৎপাদন করা চিপ হুয়াওয়ে নিতে পারবে না, তাই বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে কোম্পানিটি।

হুয়াওয়ে স্যামসাং কিংবা অ্যাপলের মতো অতি অল্প কিছু কোম্পানির একটি, যারা নিজেদের ডিজাইন করা চিপ ব্যবহার করে। মূলত সাত ন্যানোমিটারের চিপ ব্যবহার করাতেই হুয়াওয়ের তৈরি পণ্য অন্যান্য কোম্পানির পণ্যের চেয়ে আলাদা হয়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার ফলে এখন তাদের স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।

চীনের নিজস্ব কোম্পানিগুলো এখনও সাত ন্যানোমিটারের চিপ তৈরি করার জন্য প্রস্তুত না, আরও কয়েক বছর লাগবে। তবে হুয়াওয়ের নিষেধাজ্ঞায় চীনের সেমিকন্ডাক্টর ও চিপ তৈরির ফ্যাক্টরিতে যে নতুন হাওয়া লাগবে, এ কথা বলাই যায়। আর চীনও ‘মেড ইন চায়না ২০২৫’ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে চীনে চিপ উৎপাদনকারী কারখানাগুলো হুয়াওয়ের চাহিদামতো চিপ সরবরাহ করতে পারলে চীনের বিনিয়োগ আরও বাড়বে, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, চিপ তৈরির খরচ কমে আসবে।

জআজআজআ
হুয়াওয়ে তাদের ট্রেডমার্ক কিরিন চিপ ব্যবহার করতে পারবে না মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে; Image source: androidauthority.com

ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের প্রযুক্তিগত অবকাঠামো তৈরিতে হুয়াওয়ে নিজেকে দিনের পর দিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। এর কারণ, হুয়াওয়ে যে খরচে অবকাঠামো দাঁড় করিয়ে দিতে পারে, অন্যান্য কোম্পানি এত সহজে তা করতে পারে না। এজন্য সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোও অনায়াসে হুয়াওয়ের উপর ভরসা করে নিজেদের ফাইভ-জি অবকাঠামো তৈরি করে নিয়েছে। চিপ সংকটের কারণে তাদের এ খাতটি ভোগার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে।

নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন থেকে মাইক্রোসফট কিংবা গুগল আর হুয়াওয়ের সাথে কোনো চুক্তি করতে পারবে না। ইতোমধ্যেই হুয়াওয়ে নিজস্ব অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন এই অপারেটিং সিস্টেমের নাম হবে ‘হারমনি ওএস‘। ২০১৯ সালে হুয়াওয়ের ডেভেলপারদের একটি প্রোগ্রামে এই অপারেটিং সিস্টেমের কথা ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সম্ভবত ২০২০ সালের স্মার্টফোনগুলোতেই শেষবারের মতো গুগলের বিভিন্ন পরিসেবামূলক অ্যাপ্লিকেশনগুলো থাকছে। এরপরে যেসব স্মার্টফোন বা পিসি বের হবে, সেগুলোতে গুগল ও মাইক্রোসফটের কোনো চিহ্ন থাকবে না। তাই নতুন যেসব ফিচার নিয়ে হুয়াওয়ে হাজির হবে, তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হুয়াওয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করবে কি না, সেটিও ভাবার মতো বিষয়।

আমেরিকায় চীনের স্মার্টফোনের বাজার খুব বেশি বড় ছিল না। সেখানে অ্যাপলের জয়জয়কার। কিন্তু বাকি দেশগুলোর স্মার্টফোনের বাজারে অ্যাপল স্যামসাং কিংবা অপোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে রাজনৈতিকভাবে যেসব দেশ আমেরিকার মিত্র, তারা চাপে রয়েছে। ধীরে ধীরে হুয়াওয়ে থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে হচ্ছে তাদের। তাই আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় হুয়াওয়ে শুধু যে মার্কিন বাজার হারিয়েছে তা নয়। বিশেষত আমেরিকার দীর্ঘদিনের মিত্র ইউরোপের দেশগুলোর বাজার হারানোর বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ইউরোপের অনেক দেশ, যেমন জার্মানি হুয়াওয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় চীন হয়তো বাজার হারাবে, স্বল্পমেয়াদে তাদের উৎপাদন ও মুনাফা কমে যেতে পারে, কিন্তু দিনশেষে একেবারে সবকিছু থেকে মুছে যাবে না হুয়াওয়ে। চীনের হাতে বিকল্প আছে অনেক, নাহলে অর্থনৈতিক অবকাঠামো অত্যন্ত ব্যবসাবান্ধব হওয়ায় নিজেরাই বিকল্প তৈরি করে নিতে পারবে।

বাণিজ্যযুদ্ধের বলি হয়ে হুয়াওয়ে বেকায়দায় পড়ায় অন্য টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলো বেশি দিন নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারবে না। কারণ অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় নিলে হুয়াওয়ে সবচেয়ে সাশ্রয়ী, সবচেয়ে টেকসই।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা চীনের সাধারণ জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদকে আরও দৃঢ় করবে। হুয়াওয়ের ইস্যুতে যদি চীনা নাগরিকরা অ্যাপল ও অন্যান্য মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বয়কট করে, তাহলে আমেরিকাকেও ভুগতে হবে। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যেই অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। হুয়াওয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, এবং চিপ ও সেমিকন্ডাক্টর সংকট কাটিয়ে উঠলে আবার আগের অবস্থানে ফিরে যাবে– এ কথা বলাই যায়।

Related Articles