সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েড নিহত হওয়ার পরে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। এরই পাশাপাশি বেশ জোরালোভাবেই ‘পদ্ধতিগত’ বা ‘সিস্টেমিক’ নামে বর্ণবাদের একটি ভিন্ন ধরন নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় অন্য জাতির বেকারত্ব বেশি, এমনকি তা জাতীয় গড় বেকারত্বকেও ছাপিয়ে গেছে। তাদের গড় বেতনও তুলনামূলক অনেক কম। অন্যদিকে, অপরাধ করলে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় তাদেরকেই বেশি শাস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে যেখানে গড় অপরাধ প্রবণতা সবার প্রায় একইরকম।
অনেকে শুনলে অবাক হবেন যে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোও ব্যতিক্রম কিছু না। সিলিকন ভ্যালিতে শ্বেতাঙ্গ নারী কর্মচারীদেরকেও একইরকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ সম্পর্কে প্রথম অভিযোগ তোলা হয় এই দশকের শুরুতে। তখন কোম্পানিগুলোকে বেশ চাপ দেওয়া হয় যেন কর্মচারীদের জাতিগত বৈচিত্র্য বা ‘ডাইভারসিটি’র পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। ডাইভারসিটি বলতে পুরো জনসংখ্যার মধ্যে বিভিন্ন জাতি ও লিঙ্গের বৈচিত্র্য যেভাবে দেখা যায়, কোম্পানিগুলোর কর্মীদের মধ্যেও একই ভারসাম্য তৈরি করাকে বুঝায়। এই ব্যাপারটিকে সংক্ষেপে ‘ডি অ্যান্ড আই’ বলা হয় যার পূর্ণরুপ ‘ডাইভারসিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন’।
২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো কোম্পানিগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ডাইভারসিটির অভাব স্বীকার করে এবং এরপর থেকে প্রতি বছরই তাদের কর্মচারীদের ডাইভারসিটির রিপোর্ট প্রকাশ করে যাচ্ছে। রিপোর্টগুলোই পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে, গত কয়েক বছরে তাদের ডাইভারসিটির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমেরিকার অন্যসব প্রতিষ্ঠানের মতোই প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতেও সিস্টেমিক বর্ণবাদ রয়েই গেছে।
প্রযুক্তি ইন্ডাস্ট্রি উচ্চ পর্যায়ের চাকরির ক্ষেত্রে সবচেয়ে লাভজনক খাতগুলোর একটি। তারা যুক্তরাষ্ট্রের গড় বেতনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেতন দিয়ে থাকে। ফলে, এরকম একটি চাকরি সাধারণ পরিবারের আর্থিক অবস্থা উন্নত করে ফেলার সামর্থ্য রাখে। তাই, এই চাকরিগুলোতে সবার সমান সুবিধা পাওয়ার দাবিটা ন্যায়সঙ্গত। তাছাড়াও বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সমাজ থেকে আসা লোকগুলোর চিন্তার বৈচিত্র্যতা একটি কোম্পানিকে অনেকগুলো দিক থেকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
আইনজীবীরা সর্বপ্রথম চেয়েছিলেন, কোম্পানিগুলো স্বীকার করুক যে তাদের বৈচিত্র্যগত অভাব রয়েছে। এরপরে প্রতিটি কোম্পানি যেন এ ব্যাপারে নতুন বিভাগ তৈরি করে, যেখানে ডাইভারসিটির প্রধান হিসেবে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে, যার কাজ হবে কর্মচারীদের মধ্যে যেন বৈচিত্র্যগত ভারসাম্য থাকে। কিন্তু গত দশ বছরে এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। সমস্যাটি নিয়ে মার্কিন পত্রিকাগুলোতে প্রচুর লিখালেখি ও বিভিন্ন জায়গায় আলোচনাও হয়েছে। এরপরেও সমস্যাটির সমাধান করা যাচ্ছে না। তার একটি বড় কারণ হচ্ছে প্রযুক্তি ইন্ডাস্ট্রি আমেরিকান সমাজেরই একটি অংশ এবং এই সমাজের অন্যসব ক্ষেত্রেই এরকম বর্ণবাদ ও লিঙ্গ বৈষম্য দেখা যায়। তবে সিলিকন ভ্যালির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে প্রতিনিয়ত যোগ হওয়া নতুন কর্মচারী, নতুন উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীর উপরে। এদের মাধ্যমেই হয়তো নতুন করে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
সিলিকন ভ্যালি প্রথম থেকেই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ কর্মচারী নির্ভর ইন্ডাস্ট্রি ছিল যারা ভিন্ন জাতি ও ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের ব্যাপারে পর্যাপ্ত শ্রদ্ধাবোধ রাখতো না। তাই ভিন্ন জাতি ও ভিন্ন লিঙ্গের অনেকেই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতো। বিভিন্নভাবেই শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের বুলিয়িংয়ের (bullying) শিকার হতো তারা। এই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ কর্মচারীদের ‘ওল্ড বয়েজ ক্লাব’ নামে আলাদা পরিচয়ও হয়ে গিয়েছিল। দশ বছর আগে সর্বপ্রথম এই শ্বেতাঙ্গ প্রভাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ওই সময় শুধু প্রযুক্তি কনফারেন্সগুলোতে লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে কথা উঠেছিল। তবে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের কারণে এ ব্যাপারে আবারো বেশ কথাবার্তা শুরু হয়েছে। তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বড় সব প্রযুক্তি কোম্পানিই এই সমস্যা সমাধানের জন্যে কাজ করার ব্যাপারে আলাদা আলাদা নোটিশ দিয়েছে।
একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সালে প্রধান দশটি সিলিকন ভ্যালি কোম্পানিতে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীর সংখ্যা ১৬ শতাংশ কমে গিয়েছিল যেখানে কোম্পানিগুলোতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৬ শতাংশ। অন্যদিকে, নারী কর্মীর সংখ্যা ৪ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এর একটি বড় কারণ ছিল বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনগুলো এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছিল যেন কম্পিউটার প্রযুক্তি ও প্রোগ্রামিং শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের জন্যে। এর ফলে, কম্পিউটার বিজ্ঞান ক্রমে যখন আজকের মতো মূলধারার গবেষণার জায়গা হয়ে উঠছিল তখন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ছাড়া সে জায়গাগুলোতে অন্যদের প্রবেশ খুবই কম হচ্ছিল। এভাবে প্রথমদিকেই তারা পিছিয়ে পড়েছিল। এরপরে প্রায় একদশক পরেও এই পরিসংখ্যানের খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। ২০১৪ সালে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ প্রতিষ্ঠার পরে বড় কোম্পানিগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ডাইভারসিটির রিপোর্ট প্রকাশ করা শুরু করলো এবং তা বৃদ্ধি করার আশ্বাস দিয়েছিল।
২০১৪ থেকে ২০১৯ সালে প্রধান দশটি প্রযুক্তি কোম্পানির নারী কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ শতাংশেরও কম। এবং এই নারী কর্মীর সিংহভাগই শ্বেতাঙ্গ। কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ শতাংশের কম, ল্যাটিন কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১ শতাংশ। ন্যাটিভ আমেরিকানের সংখ্যা আবার ০.১ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, এশিয়ানরা এই কোম্পানিগুলোর প্রায় ৩০ শতাংশ পদের প্রতিনিধিত্ব করে।
শ্বেতাঙ্গ ও এশিয়ানরা সবচেয়ে বেশি বেতন পেয়ে থাকে। এই তালিকার সবচেয়ে নিচে থাকে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা।
সিলিকন ভ্যালির একজন উদ্যোক্তা, অনিল দাশ ২০০৭ সালে ‘দ্যা ওল্ড বয়েজ ক্লাব ইজ ফর লুজারস’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যেখানে শ্বেতাঙ্গ পুরুষ কর্মচারীদের প্রতিপত্তি বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। তার প্রবন্ধে লিখেছেন, যারা এই শ্বেতাঙ্গ প্রাধান্যতা সমর্থন করে তারা একটি ব্যর্থ সংস্কৃতির সাথে একমত পোষণ করছেন। আজকের দিনে এরকম কোনো প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে অনেকেই তা সমর্থন করবে। কিন্তু ২০০৭ সালের চিত্র ছিল ভিন্ন। তখন মূলধারার প্রযুক্তিবিদদের জাতিগত বৈচিত্র্য সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা রাখতো। তা এতোই ভিন্ন ছিল যে, অনিল দাশ ভেবেছিলেন তার প্রবন্ধ প্রকাশ হওয়ার পরে প্রযুক্তি ইন্ডাস্ট্রিতে তার ক্যারিয়ারের অবসান ঘটবে।
এলেন পাও সিলিকন ভ্যালির একজন নারী উদ্যোক্তা। ২০১২ সালে তিনি যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন তার বিরুদ্ধে লিঙ্গ বৈষম্যের অভিযোগ করেছিলেন। সে সময়টাতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে এরকম অভিযোগ করার ব্যাপারটি একেবারেই নতুন ছিল। এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা তা নিতে পারেনি। এলেন পাওকে তাই ‘মিথ্যাবাদী’, ‘পাগল’ এরকম বিশেষণও শুনতে হয়েছিল। আজকের সময়ে এই অবস্থার কিছুটা উন্নতি দেখা যাচ্ছে। যেমন: উবারের প্রধান নির্বাহী ট্র্যাভিস ক্যালানিকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে তাকে সরিয়ে নতুন নির্বাহী নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু তাই বলে যে সমস্যাগুলোর সমাধান হয়েছে ভাবলে ভুল হবে। কারণ, কোম্পানিগুলোতে বর্ণবাদী সংস্কৃতির পরিবর্তন দেখা যায়নি। দুই বছর আগেও টেসলার ক্যালিফোর্নিয়া ফ্যাক্টরিতে কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকরা বর্ণবাদ ও বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছিল।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ভেতরে যে টিমগুলো নেতৃত্ব দেয়, সেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য দেখাতে পারলে একটি কোম্পানি প্রমাণ করতে পারবে যে তারা জাতিগত বৈষম্য না দেখিয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মচারীদেরকে ঠিকঠাক প্রমোশন ও নিয়োগ দেয়। এই টিমগুলো তখন বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা মানুষগুলোকে নিয়োগ দিতে উদ্যোগী হবে। কিন্তু প্রধান দশটি প্রযুক্তি কোম্পানিতে দেখা যায়, মাত্র ২৭ শতাংশ লিডার হচ্ছে নারী, ৬ শতাংশ ল্যাটিন, ৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ও ০.৩ শতাংশ ন্যাটিভ আমেরিকান। সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলোতে দেখা যায়, ভিন্ন জাতির কর্মচারীদেরকে বেশিরভাগই কম বেতনের চাকরিগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
গুগল যখন ২০১৪ সালে প্রথমবার তাদের কর্মচারীদের বৈচিত্র্যের রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল তখন এই বৈষম্য দূর করার জন্যে খুব সামান্য চেষ্টাই দেখা গিয়েছিল। এ কারণে এ ধরনের কার্যক্রমের নাম হয়ে যায় ‘লিপ সার্ভিস’ (Lip service)। এর অর্থ, মানুষ কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে কিন্তু তা সমাধানের জন্যে কাজ করে না।
২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী গুগলের ৬১.৩ শতাংশ কর্মচারী শ্বেতাঙ্গ ও ৬৯.৪ শতাংশ পুরুষ। সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী শ্বেতাঙ্গের পরিমাণ ৫৪.৪ শতাংশ ও ৬৮.৪ শতাংশ পুরুষ। এই সংখ্যাই বলে দিচ্ছে অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।
ফেসবুকের রিপোর্টেও একইরকম অবস্থা। তবে তাদের চিফ ডাইভারসিটি অফিসার ম্যাক্সিন উইলিয়ামস দাবি করেছেন যে, কোম্পানিতে প্রতিটি আলাদা আলাদা গ্রুপে অনেক পরিবর্তন এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের পরিমাণ দশ গুণ ও নারীর সংখ্যা পঁচিশ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
অনেক রকম পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা যে পরিবর্তন দেখতে চাচ্ছি তা কি হয়েছে? না। যখন এই ব্যাপারে পরিবর্তন শুরু হয়েছিল তখন আমরা নয় বছর পুরনো কোম্পানি ছিলাম যার কর্মচারী সংখ্যা হাজারের উপরে ছিল। প্রধান সমস্যা হচ্ছে, আপনি যত পরে শুরু করবেন, পরিবর্তন করাটা ঠিক ততটাই কঠিন হয়ে ওঠে।
২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে অ্যাপলে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীর সংখ্যা কমেছে। অর্থাৎ, তাদেরকে যে হারে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার চেয়ে বেশি হারে অপসারণ করা হয়েছে।
অ্যামাজন কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে কাজ করছে এমন অর্গানাইজেশনগুলোকে সমর্থন দেওয়ার জন্যে তাদের কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীদেরকে ফান্ড দিচ্ছে। কিন্তু গ্লাসডোরের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যামাজনের ওয়্যারহাউজের কর্মীদের বাৎসরিক বেতন মাত্র ৩২ হাজার ডলার যেখানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের গড় বেতন ১৩২০০০ ডলার। ২০১৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যামাজনের ৮৮ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারীই শ্রমিক। কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের জন্যে এই সংখ্যাটি হচ্ছে ৯০ শতাংশ।
এলেন পাওয়ের মতে, ভারসাম্য ডাইভারসিটি তৈরি হবে যখন কর্মীদের ১৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ও ১৭ শতাংশ ল্যাটিন হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার পরিসংখ্যানেও কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনদের সংখ্যা অনেকটা এরকমই পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো কোম্পানির রিপোর্টেই এ ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে কাছাকাছি যে কোম্পানিটি রয়েছে তা হচ্ছে লিফট (Lyft)। ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী তাদের ১০.২ শতাংশ কর্মচারী কৃষ্ণাঙ্গ ও ৯ শতাংশ ল্যাটিন। নিচের চার্টটি দেখা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দশটি প্রযুক্তি কোম্পানির রিপোর্ট দেওয়া আছে এখানে।
নারী কর্মীর সংখ্যা এখনো ৩২ শতাংশ। ল্যাটিন আমেরিকানরা মাত্র ৮ শতাংশ, কৃষ্ণাঙ্গ কর্মী ৭ শতাংশ। এর সাথে মার্কিন আদমশুমারীর রিপোর্টের তুলনা করলে নিচের চার্টটি পাওয়া যাবে এবং তা থেকে পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে, বৈচিত্র্যের মাপকাঠিতে তারা পুরো জনসংখ্যাকে চিত্রায়িত করে না।
আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশেলে একটি সুস্থ ও খোলা মনের পরিবেশের অভাব। এর ফলে অনেক কর্মচারী ‘ইম্পোস্টার সিনড্রোমে’ ভুগে। যার ফলে তাদের পারফর্মেন্স খারাপ হয়ে যায়। এ সম্পর্কে অভিযোগ করার প্রক্রিয়াটিও বেশ অসুবিধাজনক, সরাসরি অভিযোগ করার কোনো উপায় নেই। এরকম নানা সমস্যার কারণে উন্মুক্ত পরিবেশে প্রোডাক্টিভ আলোচনার উপায় নষ্ট হয়ে যায়। এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোম্পানির নির্বাহী ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। কিছু কোম্পানি বিশেষ ধরনের মানসিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে কিন্তু শুধুমাত্র তাতেই অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়।
হেড অভ ডাইভারসিটি নিয়োগ দেওয়ার পরেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। কারণ, দূর্ভাগ্যক্রমে বেশিরভাগ কোম্পানির হেড অভ ডাইভারসিটি লিপ সার্ভিসের একটি উপায় ছাড়া কোনো ভূমিকা পালন করে না। এক্ষেত্রে গুগলের উদাহরণ দেওয়া যায়। ২০১৬ সালের পর থেকে এই পর্যন্ত কোম্পানিটির তিনজন হেড অভ ডাইভারসিটি নিয়োগ পেয়েছে। লেজলি মাইলি, যিনি টুইটার, গুগল ও অ্যাপলের ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি সরাসরি এটাকে গুগলের ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
লিফটের হেড অভ ডাইভারসিটি মনিকা পয়েনডেক্সটারের মতে, বৈচিত্র্যের ব্যাপারে লিফটের প্রতিষ্ঠাতা জন জিমার ও লোগান গ্রিনের বেশ ভালো দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তিনি লিফটের প্রচেষ্টার ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী হলেও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটিকে যেভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে সে ব্যাপারে বেশ হতাশ। এভাবে আক্রমণ করলে কোনো সমস্যা সমাধানের পথটি সহজ হয়ে উঠে না। প্রথম দিকের তুলনায়, হেড অভ ডাইভারসিটির ভূমিকা অনেকভাবেই পরিবর্তন হয়েছে। তবে মনিকা মনে করেন, যদি এটা সম্পূর্ণরূপে নিরসন করতে হয়, তাহলে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর নির্বাহীদের একসাথে কাজ করতে হবে।
পিন্টারেস্টের সাবেক হেড অভ ডাইভারসিটি ক্যান্ডিস মরগান এই ভূমিকায় সবচেয়ে দীর্ঘসময় কাজ করা একজন কর্মী। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানে আচরণিক আগ্রাসন বা বুলিয়িংয়ের ব্যাপারেও কাজ করা হচ্ছে। এটা যেকোনো কিছু হতে পারে, যেমন: কোনো কৃষ্ণাঙ্গের চুল নিয়ে তামাশা করা বা যেকোনো ধরনের লিঙ্গ বৈষম্যমূলক শব্দের ব্যবহার।
জাতিগত বৈচিত্র্যের যে অভাব তার পেছনে অন্য একটি কারণ হচ্ছে ফান্ডিংয়ের বৈষম্যমূলক বন্টন। ২০১৮ সালে নারী উদ্যোক্তারা আমেরিকান ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা উদ্যোগ মূলধনের মাত্র ২.২ শতাংশ সংগ্রহ করতে পেরেছে। ‘উইমেন হু টেক’ নামের একটি সংস্থার কয়েক বছর আগের রিপোর্টে দেখা যায়, ৪৪ শতাংশ নারী হয়রানির অভিযোগ করেছে এবং তার ৭৭ শতাংশই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহীর হয়রানির শিকার হয়েছে। অন্যদিকে, ৬৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা যৌন সম্পর্কের বিনিময়ে ফান্ডিংয়ের প্রস্তাবনা পেয়েছে।
কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যানটি আরো খারাপ। তারা ফান্ডিং পায়ই খুব কম। ২০১৫ সালে মাত্র বারো জন কৃষ্ণাঙ্গ নারী এক মিলিয়ন ডলারের উপরে ফান্ডিং পেয়েছে। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যাটি হয় ৩৪। তাদের ফান্ডিংয়ের মধ্যক পরিমাণ হচ্ছে শূন্য! এর কারণ, কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের দ্বারা যেসব স্টার্টআপ তৈরি হচ্ছে তাদের অধিকাংশই কোনো অর্থ পান না। যারা ১ মিলিয়ন ডলারের নিচে ফান্ডিং পেয়েছেন তাদের গড় ফান্ডিংয়ের পরিমাণ মাত্র ৪২০০০ ডলার যেখানে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের ব্যর্থ স্টার্টআপও ১ মিলিয়ন ডলারের বেশি ফান্ডিং পেয়ে থাকে। ২০০৯ সালের পর থেকে তারা সকল প্রযুক্তি ভেঞ্চার ফান্ডিংয়ের মাত্র ০.০০০৬ শতাংশ সংগ্রহ করতে পেরেছেন।
তবে কিছু কিছু ফান্ডিং কোম্পানি তৈরি হয়েছে যারা এই বৈষম্য দূর করতে এগিয়ে আসছে। তাদের এই উদ্যোগ বেশ প্রশংসামূলক। এরকম একটি কোম্পানি হচ্ছে ‘ব্যাকস্টেজ ক্যাপিটাল’ যারা শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে। ২০১৬ সালের শেষের দিকে, তারা সর্বমোট পাঁচ মিলিয়ন ডলারের ফান্ড তুলতে পেরেছিল। ব্যাকস্টেজ ক্যাপিটালের সহপ্রতিষ্ঠাতা আরল্যান হ্যামিল্টন দ্বিতীয়বারের মতো ৩৬ মিলিয়ন ডলার ফান্ড তুলেছিলেন ২০১৯ সালে। শুরু থেকে এই পর্যন্ত তারা ৬০টিরও বেশি স্টার্টআপে বিনিয়োগ করেছে। তবে এরকম বিনিয়োগের সংখ্যা খুবই কম। ন্যাশনাল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যাসোসিয়েশনের রিপোর্ট অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের মাত্র ২ শতাংশ হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ ও ১ শতাংশ হচ্ছে ল্যাটিন।
অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধাও এই সমস্যার অন্য আরেকটি কারণ। শ্বেতাঙ্গদের থেকে অন্য জাতির সম্পদের পার্থক্য বিশাল এবং এই কারণে এই জাতিগুলো থেকে কেউ উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখার আগে বেশ ভাবতে হয় এবং সবমিলিয়ে তা একটি প্রভাব ফেলে। মধ্যবিত্ত একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবারের সম্পদ মধ্যবিত্ত কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের চেয়ে ৪১ গুণ বেশি এবং ল্যাটিন পরিবারের তুলনায় তা ২২ গুণ বেশি। তাছাড়াও, শ্বেতাঙ্গ পরিবারগুলো উত্তরাধিকার ক্রমে যে পরিমাণ সম্পদ পেয়ে থাকে তা অর্থনৈতিকভাবে তাদের অনেক বড় সহায়ক হয়ে দাঁড়ায় যেখানে, কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের সে ধরনের কোনো অবলম্বন নেই।
লিঙ্গ ও জাতিগত বৈচিত্র্যের ব্যাপারে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে কিছুটা উন্নতি হলেও কিছু কিছু জায়গায় নতুন ধরনের অবনতি দেখা গেছে। স্ল্যাক ও পিন্টারেস্টের সাথে কাজ করা জোয়েল এমারসন এরকম একটি দিক তুলে ধরেন। সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানিগুলো কর্মচারীদের প্রমোশন, মনোভাব, ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে বেশি প্রশ্ন করছে যেটা আগে দেখা যায়নি। আগে কর্মচারীদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোম্পানির নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল কিন্তু এখন প্রতি বছরেই তা পরিবর্তিত হচ্ছে। এসব ব্যাপারে কর্মচারীদের কোম্পানির বিরুদ্ধে বিভিন্নরকম সক্রিয় প্রভাব রেখেছে। একটি বিখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে, ২০১৮ সালের নভেম্বরে বিশ হাজার গুগল কর্মচারীর ধর্মঘট। এই ধর্মঘটের কারণ ছিল, যৌন হয়রানির অভিযোগে বহিষ্কার হওয়া দুইজন নির্বাহীকে ১০৫ মিলিয়ন ডলার এক্সিট প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে একজন অ্যান্ড্রয়েডের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। কর্মীরা পাঁচটি দাবি উত্থাপন করলেও মাত্র একটি গ্রহণ করা হয়েছিল।
এরপর থেকে অবস্থার শুধুই অবনতি হচ্ছিল। গুগলের কর্মচারীরা পরবর্তী মে মাসে ম্যানেজারদের প্রতিশোধমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ তুলতে বাধ্য হয়েছিল। দুজন গুগল কর্মচারী কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন যে, তারা ধর্মঘটের ঘটনাটি সংগঠিত করার ফলে কোম্পানি তাদের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। গুগলের ওপেন রিসার্চের লিড মেরেডিথ হুইটেকার বলেন, কোম্পানিতে তার ভূমিকা ‘নাটকীয়ভাবে’ পরিবর্তন হয়েছে। আরেকজন কর্মী ক্লেয়ার স্টেপলটন জানান, তার ম্যানেজার তাকে হুমকি দিয়েছে যে, তার পদাবনতি হবে। এরপরে গুগলাররা প্যারেন্ট কোম্পানি অ্যালফাবেটের তখনকার প্রধান নির্বাহী ল্যারি পেজকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে আবেদন করেছিলেন যেন তাদের দাবিগুলো পূরণ হয়।
এই ঘটনার পরেও গুগলে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। লেজলি মাইলি অবশ্য সে ব্যাপারে বিস্মিত না। তার মতে, কোম্পানির ২০ শতাংশ কর্মী ধর্মঘট করেছিল। এটা আরো প্রভাবশালী হতো যদি ৫০-৬০ শতাংশ কর্মী তাতে যুক্ত হতো।
মানুষ মনে করে গুগল সঠিক সিদ্ধান্তই নিতে চায়। কিন্তু না, গুগল একটি কোম্পানি এবং কোম্পানি জানে কীভাবে কর্মচারীদের ক্ষমতা সীমিত করে ফেলা যায়।
তবে গুগলই একমাত্র কোম্পানি না যেখানে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে এরকম বিক্ষোভ হয়েছে। গতবছরের মে মাসে যৌন হয়রানিকে কেন্দ্র করে রায়ট গেমসেও একইরকম ধর্মঘট দেখা গেছে। ‘গার্লস হু কোড’ নামের একটি সংস্থার জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৫২ জন নারী লিঙ্গ বৈষম্য বা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে অথবা এমন কাউকে চেনে যার এরকম অভিজ্ঞতা রয়েছে।
একটা গুরুতর সমস্যা হচ্ছে, যার উপর অভিযোগ আনা হয় সে যদি তা স্বীকারও করে তাতে খুব বেশি প্রভাব পড়ে না। অনেকসময়েই তারা কোম্পানি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময়ে মিলিয়ন ডলারের এক্সিট প্যাকেজ পায়। এটা ঠিক ওল্ড বয়েজ ক্লাবের মতোই। সোফি (SoFi) কোম্পানির সাবেক নির্বাহী মাইক ক্যাগনির বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির পরে তাকে কোম্পানি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি ৫০ মিলিয়ন ডলারের ফান্ড সংগ্রহ করে নতুন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০১৯ সালে আবার ৬৫ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছেন। এভাবে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র বহিষ্কার করলে তা বড় প্রভাব রাখছে না। তাই যৌন আক্রমণকারীরা এই ব্যাপারে গ্রাহ্য করছে না। কাপর ক্লেইন নামের একজন অ্যাকটিভিস্ট জানান, হলিউডে ‘মিটু’ মুভমেন্টের পরে তার প্রভাব প্রযুক্তি ইন্ডাস্ট্রিতেও পড়েছে। কিন্তু তা হয়রানিকারীদের উপরে কোনো প্রভাব ফেলছে না। বরং ভিকটিমের তুলনায় তারা তুলনামূলক বেশি প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে। কাপর ক্লেইন ক্রিস স্যাকা, স্টিভ জুরভেটসন, জাস্টিন ক্যাল্ডবেকের মতো আরো কয়েকজন বিনিয়োগকারীর নাম বলেন যাদের কাছে বিভিন্ন নারী প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে।
You can name white guy after white guy.
বড় কোম্পানিতে পরিবর্তন আনা কঠিন। কারণ তাদের কর্মচারীর পরিমাণ বিশাল। তাই, রাতারাতি ডাইভারসিটিতে ভারসাম্য আনতে হলে তাদেরকে অনেক কর্মী ছাটাই করতে হবে। তবে স্টার্টআপগুলোতে এখনো সেই আশা রয়েছে। যদি যথেষ্ট পরিমাণ সফল স্টার্টআপ বৈচিত্র্যের ব্যাপারে উন্নতি বজায় রাখতে পারে তাহলে তা পুরো ইন্ডাস্ট্রির পরিবেশেই বিশাল পরিবর্তন রাখবে। এলেন পাও জানান, তিনি অ্যাসানা (Asana) সিইও ডাস্টিন মস্কোভিটজ ও টোয়াইলিও (Twilio) সিইও জেফ লসনের উদ্যোগ দেখে আশ্বাস পাচ্ছেন কারণ তারা বেশ পরিষ্কারভাবেই পরিবর্তন আনয়নে আগ্রহী এবং নিজেদের কোম্পানিতে এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্টের জনসংখ্যায় যেভাবে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তাতে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে। আদমশুমারী অনুযায়ী, ২০৪৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গের পরিমাণ ৫০ শতাংশ থেকেও কমে যাবে। সবগুলো ইন্ডাস্ট্রিতেই তাই সে অনুযায়ী পরিবর্তন আসা জরুরী।
This Bangla article is a discussion on the struggle of diversity in the US tech industry and how racism and sexism is a big hurdle against the effort to keep the balance.
References:
1. Is Big Tech Still Struggling With Diversity?
2. See Big Tech’s terrible diversity record, visualized using its logos
3. Tech companies say they value diversity, but reports show little change in last six years
4. Five Years of Tech Diversity Reports—and Little Progress
5. The future of diversity and inclusion in tech
Featured Image: Reddit