Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কয়েকটি আলোচিত সোভিয়েত ট্যাংক

যেকোনো যুদ্ধেই ট্যাংকের গুরুত্ব ব্যাপক। কামান বসানো এই যান দুর্গম অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের বিধ্বংসী যুদ্ধ, সব জায়গাতেই ব্যবহৃত হয়। নানা যুদ্ধে ট্যাংককে নানা ভূমিকায় ব্যবহার করা হয়েছে। কখনো বিরাট দল বেঁধে শত্রুপক্ষের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তো কখনো স্রেফ পদাতিকদেরকে কাভার ফায়ার দিয়ে কোনো অঞ্চল দখল করতে সাহায্য করেছে। অন্য অনেক জিনিসের মতো ট্যাংক প্রশ্নেও সোভিয়েত ও পশ্চিমাদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ছিল। সোভিয়েতদের সামরিক নীতিতে ট্যাংক ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আজতক রাশিয়ার ট্যাংকবহর বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে কলেবরে বৃহৎ। এমনই কয়েকটি আলোচিত সোভিয়েত ট্যাংক নিয়ে আলোচনা করা হবে এখানে।

টি-৩৪

এককথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেরা ট্যাংক ছিল টি-৩৪। এর গঠন, তিন ইঞ্চি কামান ও গতি একে দুর্ধর্ষ এক মারণাস্ত্রে পরিণত করেছিল। এমনকি ১৯৪১ সালে লাল ফৌজের বিরুদ্ধে একের পর এক জয় পাওয়ার পরেও জার্মানরা টি-৩৪ কে আক্ষরিকভাবেই ভয় পেত। চল্লিশটির বেশি দেশের হয়ে ৮৪ হাজার টি-৩৪ মাঠে নেমেছে। এর নানা উন্নত সংস্করণও বানানো হয়েছে সমসংখ্যক। দুটি মেশিনগান বসানো যেত এতে। গতি ঘণ্টায় ৫৩ কিলোমিটার, ভর প্রায় ২৭ টন। একজন ক্যাপ্টেন, একজন চালক, একজন গোলন্দাজ এবং একজন সৈন্য ধারণে সক্ষম এটি।

টি-৩৪; source: youtube

টি-৩৪ চল্লিশের দশকের শেষের দিকে যুদ্ধে নামা হাল আমলের ট্যাংকগুলোর বিপক্ষে বিশেষ সুবিধা করতে পারত না। তাছাড়া ট্যাংকটির আকার বেশ ছোট হওয়ায় চারজন মানুষ মিলে চালানোও কষ্টকর ছিল। আর যান্ত্রিক সমস্যা তো ছিলই। তবে তারপরও যুদ্ধের শেষে বেশ কয়েকটি বছর টি-৩৪ ছিল সোভিয়েতদের প্রথম পছন্দ। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের বিরুদ্ধে দারুণ লড়েছিল। এর বাইরেও বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে টি-৩৪। এখনো ছোটখাট অনেক সেনাবাহিনী এই ট্যাংক ব্যবহার করে।

টি-৫৪/৫৫

বিশ্বে টি-৫৫ এর চেয়ে বেশি আর কোনো ট্যাংক বানানো হয়নি। সংখ্যাটা প্রায় এক লক্ষ। বর্তমানেও অন্তত পঞ্চাশটি দেশের সেনাবাহিনী টি-৫৫ ব্যবহার করে। পঞ্চাশের দশকে সোভিয়েত সেনাদলে ৩৬ টনের এই ট্যাংক প্রবেশ করে। ১০০ মিলিমিটার ডি-১০ কামানের পাশাপাশি এটি মেশিনগান নিতে পারতো। এটি চালাতে মানুষ লাগতো চারজন, গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪৮ কিলোমিটার। এটি পরমাণু, রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্রের হামলাও বেশ সইতে পারে।

টি-৫৫; source: pinterest

টি-৫৫ এর কামান, গতিবেগ, ৪৫টি গোলা বহনের সক্ষমতা- সব মিলিয়ে সময়ের প্রেক্ষাপটে দারুণ এক ট্যাংক ছিল এটি। ট্যাংকটি আকারে ছোট হওয়ায় অনেক সংখ্যক ট্যাংক খুব কম খরচে বানানো যেত। টি-৫৫ এর একটি আলাদা ভার্সন আছে, টি-৫৪। তবে ট্যাংক দুটি অনেক ক্ষেত্রেই একই রকমের হওয়ায় এবং পরবর্তীতে উন্নত সংস্করণ আসায় এই ঘরানার সব ট্যাংককেই টি-৫৪/৫৫ সিরিজে ফেলা হয়।

অন্তত সত্তরের দশক পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে টি-৫৫ রাজত্ব করে গিয়েছে। ভিয়েতনামেও এদের সাফল্য দেখবার মতো। এর বাইরেও টি-৫৫ ব্যবহৃত হয়েছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধসহ পৃথিবীর বহু অঞ্চলে। এর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল আকার। ছোট হওয়ায় ভেতরে ক্রুরা খুব সমস্যায় পড়ে যেত। তবে এরকম হালকা ওজনের ছোট্ট ট্যাংক আর মারাত্মক শক্তিশালী কামান একে বিরাটাকার, ধীরগতির পশ্চিমা ট্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে প্রচুর সাফল্য এনে দিয়েছে।

টি-৬২ এবং টি-৬৪

টি-৫৫ এর কামান আধুনিক পশ্চিমা ট্যাংকগুলোর আর্মারের বিরুদ্ধে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। সোভিয়েতরা তাই ১৯৬১ সালে মাঠে নামায় টি-৬২। এর ১১৫ মিলিমিটার স্মুথবোর কামান টি-৫৫ এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী ও নিখুঁত ছিল। তবে টি-৬২ এর সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই ছিল বেশি। এর দাম ছিল টি-৫৫ এর দ্বিগুণ, অথচ রক্ষণাবেক্ষণ ছিল অনেক কঠিন। ট্যাংকটির গোলা ছুড়ঁতে সময় লাগতো বেশ। ওপর থেকে আক্রান্ত হলে বিশেষ কিছু করার থাকতো না। তবে এসব ঝামেলা সত্ত্বেও ইরাকিরা ইরানীদের বিরুদ্ধে টি-৬২ নিয়ে প্রচুর সাফল্য পেয়েছে। অপারেশন নাসরের সময় দুই শতাধিক ইরানী ট্যাংক গুড়িয়ে দেয় ইরাকি টি-৬২।

টি-৬২; source: weaponsystems.net

টি-৬২ এর সমস্যাগুলো সমাধানের আশায় ষাটের দশকেই বানানো হয় টি-৬৪। টি-৬২ এর চেয়েও এটি বেশি দামি ছিল। এর ছিল আরো শক্তিশালী ১২৫ মিলিমিটার স্মুথবোর কামান। টেকসই কম্পোসিট আর্মারের কারণে একে দেখতে বেশ ওজনদার মনে হলেও এটি আসলে বেশ হালকা, ৩৮ টন।

টি-৬৪ এর সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপারটি হলো এর অটোলোডার সিস্টেম। সাধারণত ট্যাংকে গোলন্দাজের পাশাপাশি একজন সহকারী থাকে, যার কাজ কামানে গোলা ভরে দেওয়া। এই দুজনের সাথে ড্রাইভার আর ক্যাপ্টেন মিলে মোট চারজন মিলে ট্যাংক চালায়। টি-৬৪ এ সোভিয়েতরা একটি বিশেষ যন্ত্র জুড়ে দেয়। এই অটোলোডার স্বয়ংক্রিয়ভাবে গোলা ভরার কাজটি করায় তিন জন লোক মিলেই ট্যাংক চালাতে পারতো। সোভিয়েত ট্যাংকের ছোট আকারের কারণে এই ব্যবস্থা সবার খুব মনঃপুত হয়। সোভিয়েত আর্মার ব্রিগেডগুলোতে টি-৬৪ দেওয়া হতো আর মোটর ইনফ্যান্ট্রিদের সাথে থাকতো টি-৬২।

টি-৬৪; source: btvt.narod.ru

তবে টি-৬৪ খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। এর যন্ত্রপাতিতে গোলযোগ লেগেই থাকতো। অটোলোডার যন্ত্রটি অত্যন্ত চমৎকার হলেও সেটা কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে ট্যাংকের ক্রুদের কামান চালাতে নাভিঃশ্বাস উঠে যেত। সব মিলিয়ে ট্যাংকটি মোটেও নজর কাড়তে পারেনি। বর্তমানে উজবেকিস্তান বা কঙ্গোর মতো অল্প কিছু দেশ এই ট্যাংক ব্যবহার করে। অনেক দেশই অবশ্য টি-৬২ আর টি-৬৪ এর উন্নত সংস্করণ বানিয়েছে।

টি-৭২

সোভিয়েত সেনাবাহিনীর আইকনিক সমরাস্ত্রগুলোর তালিকা করলে মিগ-২৯ যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি টি-৭২ এর কথা বলতেই হবে। ১৯৭৩ সালে বানানোর পরে চল্লিশটি দেশের হয়ে প্রায় ২৫ হাজার টি-৭২ এ পর্যন্ত মাঠে নেমেছে। ১২৫ মিলিমিটার স্মুথবোর কামানের পাশাপাশি পরমাণু, জীবাণু কিংবা রাসায়নিক হামলা প্রতিরোধী ছিল এটি। বহু বছর ধরে এতে নানারকমের পরিবর্তন আনা হয়েছে। বসানো হয়েছে স্তোরা জ্যামিং সিস্টেম, এক্সপ্লোসিভ রিয়্যাক্টর আর্মার, মেশিনগান, স্মোক বোম্ব, থার্মাল ইমেজিং সাইটসহ নানা সরঞ্জাম।

টি-৭২; source: nationalinterest.org

টি-৬৪ এর মতো টি-৭২ ট্যাংকেও অটোলোডার ছিল। তবে টি-৭২ বানাতে খরচ অনেক কম পড়তো। এর শক্তিশালী কামান ছিল এর সবচেয়ে বড় অস্ত্র। গতিবেগ ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। কম করে হলেও ২৫ হাজার টি-৭২ বানানো হয়েছে এ পর্যন্ত।

বিশ্বের বহু দেশের যুদ্ধে লড়াই করেছে টি-৭২। রাশিয়া আর সিরিয়ার সেনাবাহিনীর হয়ে এর উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে। সিরিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদের মতে, এটি বিশ্বের সেরা ট্যাংক। এরই একটি ইরাকি সংস্করণ, আসাদ বাবিল/লায়ন অব ব্যাবিলন। অবশ্য উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন আব্রাহামের হাতে বেধড়ক নাস্তানাবুদ হয়েছিল। তবে ইরান-ইরাক যুদ্ধে এই ট্যাংক দারুণ সাফল্য পেয়েছে। পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, সার্বিয়া, ইউক্রেন, ভারতসহ নানা দেশ টি-৭২ এর নিজস্ব সংস্করণ ব্যবহার করছে।

আসাদ বাবিল ওরফে ব্যাবিলনের সিংহ; source: projects21.files.wordpress.com

টি-৮০

সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ ট্যাংক ছিল টি-৮০। প্রচলিত ডিজেল ইঞ্জিনের স্থলে এর ছিল গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিন, গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার। ছিল ১২৫ মিলিমিটার স্মুথবোর কামান আর মেশিনগান, অটোলোডার সিস্টেম; সব মিলিয়ে এটি ছিল দারুণ আধুনিক ট্যাংক। মূলত টি-৬২ আর টি-৬৪ নামক দুটি অতি আধুনিক কিন্তু সমরক্ষেত্রের অনুপযুক্ত ট্যাংকের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে টি-৮০ বানানো হয়েছিল। অন্যান্য সোভিয়েত ট্যাংকের তুলনায় এটি বানাতে খরচও অনেক বেশি হতো। স্টিল ও সিরামিকের কম্পোজিট আর্মার একে সুরক্ষা দিত।

১৯৯৩ সালে রাশিয়ার সংসদীয় সংকটের সময় টি-৮০ থেকে সংসদ ভবনের ওপরে গোলাবর্ষণ করা হয়। সোভিয়েতরা টি-৮০ কে এমনভাবে ডিজাইন করেছিল যেন এটি ইউরোপীয় প্রান্তরে বিরাট দল বেঁধে যুদ্ধ করবার উপযোগী হয়। অথচ ট্যাংকটি প্রথম যুদ্ধ দেখলো খোদ রাশিয়ার মাটিতে, চেচনিয়াতে, নব্বই এর দশকে।

রুশ পার্লামেন্টে গোলা ছোঁড়া হচ্ছে; source: 2.bp.blogspot.com

রুশ ট্যাংক ক্রুরা নতুন এই ট্যাংক কীভাবে চালাতে হয় তা জানতো না। ট্যাংকটির নতুন ধরনের ইঞ্জিনের কারণে গতিবেগ অনেক বাড়লেও, রেঞ্জ ছিল সীমিত। তাছাড়া শহরের রাস্তা-গলিতে যুদ্ধ করবার উপযুক্ত ছিল না এটি। এর কামান খুব বেশি ওপরের দিকে গোলা ছুড়তে পারতো না, গোলা বারুদ রাখবার চেম্বারে কোনোক্রমে একবার আগুন লাগলে গোটা ট্যাংকটা ক্রু সমেত উড়ে যেত (পশ্চিমা ট্যাংকে এই বিপদ এড়াবার জন্য ব্লাস্ট ডোর থাকে, এটা বিস্ফোরণের ধাক্কা ক্রুদের গায়ে লাগতে দেয় না)। সব মিলিয়ে চেচেন গেরিলাদের হাতে নাজেহাল হয় রুশ বাহিনী। রাজধানী গ্রোজনী দখল করতে গিয়ে কেবল প্রথম মাসেই ২২৫টি টি-৮০ ধ্বংস হয়ে যায়। রাশিয়া এখনো অল্প কিছু টি-৮০ ব্যবহার করে। এর একটি ইউক্রেনীয় ভার্সন টি-৮৪ বর্তমানে অনেক দেশ ব্যবহার করছে। তবে চেচেন যুদ্ধে এর লজ্জাজনক পারফরম্যান্স একে সোভিয়েত ট্যাংকের ইতিহাসের সবথেকে নিকৃষ্ট সদস্যে পরিণত করেছে। যদিও অনেকেই ভুলে যান চেচনিয়াতে সফল হতে না পারার পেছনে রুশ সমরবিদদের ভুল কৌশল অনেকাংশে দায়ী।

টি-৮০; source: pinterest

সোভিয়েত ইউনিয়ন টি-৮০ এর পরে আর কোনো ট্যাংক বানায়নি। ১৯৯৩ সালে, রুশ সেনাবাহিনীর হয়ে মাঠে নামে টি-৯০ নামক আরেকটি ট্যাংক। গুণে-মানে এটি খুবই উন্নত এবং যুদ্ধেও এর সাফল্য উল্লেখযোগ্য। টি-৭২ এর একটি উন্নত সংস্করণ হওয়ার কারণে আলাদাভাবে এর বিবরণ উল্লেখ করা হলো না এখানে।

ফিচার ইমেজ – Pinterest

Related Articles