টিভি, মোবাইল বা ল্যাপটপে সিনেমা দেখার চেয়ে হলে সিনেমা দেখা সবসময়ই ভিন্ন অনুভূতির সঞ্চার করে। সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তি যেমন উন্নত হচ্ছে, তার ছোঁয়া এসে লাগছে সিনেমা হলেও। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংযোজন আইম্যাক্স থিয়েটার। আইম্যাক্সের ধারণা নতুন না হলেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে এটি পেয়েছে দারুণ জনপ্রিয়তা। সাধারণ দর্শক থেকে বড় বড় পরিচালক- সবাই এখন আইম্যাক্সের ভক্ত। বর্তমানে হলিউডের বড় বাজেটের সিনেমাগুলো বেশিরভাগই আইম্যাক্স থিয়েটারে মুক্তি পাচ্ছে। আইম্যাক্স থিয়েটারে দর্শকরা সিনেমা দেখে ভিন্ন অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন। তাদের কাছে মনে হয় যে, তারাও সিনেমার একটি অংশ। সিনেমার সব ঘটনা যেন তাদের চোখের সামনেই ঘটছে।
বাড়িতে বা ব্যক্তিগত জাহাজ বা ইয়টে সাধারণ সিনেমা থিয়েটার নতুন কিছু নয়। তবে ব্যক্তিগত ইয়টে প্রথমবারের মতো আইম্যাক্স থিয়েটার আসতে যাচ্ছে এই বছর। এই ইয়ট বানাতে নির্দেশ দেন আমেরিকান বিলিয়নিয়ার ড্যানিয়েল স্নাইডার। তিনি ন্যাশনাল ফুটবল লিগের দল ওয়াশিংটন রেডস্কিনের মালিক। ৯৩ মিটার দীর্ঘ এই ইয়টটি বিশ্বের প্রথম সনদপ্রাপ্ত ভাসমান আইম্যাক্স থিয়েটার। এটি তৈরি করেছে ডাচ জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ফিডশিপ। ইয়টটিকে ‘লেডি এস’ নাম দেয়া হয়েছে। তবে একে থিয়েটারের স্বীকৃতি পেতে আইম্যাক্স কর্পোরেশনের কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। সেগুলো জানতে হলে আইম্যাক্স সম্পর্কে জানাও জরুরি।
আইম্যাক্স শব্দটি ‘ইমেজ ম্যাক্সিমাম’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এর যাত্রা প্রথম শুরু হয় কানাডার মন্ট্রিলে ১৯৬৭ সালের এক্সপোতে। থিয়েটারের মধ্যে দর্শকরা কীভাবে আরো বড় পর্দায় উপভোগ করতে পারেন কানাডার কিছু চলচ্চিত্র নির্মাতারা সেটা নিয়ে কাজ করছিলেন। তাই তারা তখন একাধিক পর্দায় একসাথে সিনেমা দেখানোর কথা চিন্তা করেন। এতে ৯টি প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়েছিল। এভাবে গঠিত হয় আইম্যাক্স কোম্পানি। তবে শুরুতে এটি শুধুমাত্র তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল। ১৯৭০ সালে জাপানের ওসাকায় সর্বপ্রথম জনসম্মুখে আইম্যাক্স থিয়েটারে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
এরপর শুধু নির্দিষ্ট কিছু স্থানে আইম্যাক্সের উপযোগী থিয়েটারে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো। যেমন যাদুঘর, সায়েন্স সেন্টার এবং কিছু বাণিজ্যিক এলাকায়। তখন এগুলোতে সমুদ্রের নিচে বা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে অনুসন্ধানের চিত্র, মহাকাশ সম্পর্কিত তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হতো। তবে নব্বই দশকে আইম্যাক্স হলিউডের দিকে নজর দেয়। সর্বপ্রথম এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা সিনেমা ছিল টম হ্যাংকস অভিনীত ‘অ্যাপোলো ১৩’। এরপর থেকে শুধুই এগিয়ে যাওয়ার গল্প। এই প্রযুক্তির অন্যতম ভক্ত পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান। ২০০৮ সালের ‘দ্য ডার্ক নাইট’ সিনেমা থেকেই আইম্যাক্স ব্যবহার করে আসছেন তিনি। এছাড়া জাস্টিন লিন, জেজে আব্রামসও আইম্যাক্স নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।
এ পর্যন্ত পড়ে আইম্যাক্সের বিশেষত্ব নিয়ে অনেকের কৌতূহল হতে পারে। প্রচলিত থিয়েটারের সাথে এর কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। প্রচলিত থিয়েটারে যে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় তার চেয়ে এই থিয়েটারের স্ক্রিন ২১%-৪০% বড় হয়। প্রচলিত সিনেমাগুলোকে ক্যামেরায় ধারণের পর একে প্রস্থে বড় করে দেখানোর জন্য উপর-নিচের অনেক দৃশ্য ক্রপ করতে হয় বা কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু আইম্যাক্স ক্যামেরায় দৃশ্য আরো বেশি থাকে। কারণ এতে ৭০ মিলিমিটার ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে আইম্যাক্সবিহীন সিনেমাগুলো ৩৫ মিলিমিটার ক্যামেরায় হয়ে থাকে। তবে আইম্যাক্স ক্যামেরার সমস্যা হচ্ছে এগুলো অনেক ভারী আর ব্যয়বহুল। তাছাড়া এর ব্যবহারও জটিল। এ কারণে সিনেমাগুলোতে সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু দৃশ্যে আইম্যাক্স ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। তবে ‘অ্যাভেঞ্জারস: ইনফিনিটি ওয়ার’ পুরোটাই আইম্যাক্স ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে।
আইম্যাক্স থিয়েটারের স্ক্রিন মেঝে থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। তবে এই স্ক্রিনের বিশেষত্ব হচ্ছে এটি একটু বাঁকানো থাকে। আর এটি সামনে থেকে পাশের দেয়াল পর্যন্তও ছড়ানো থাকে। এতে দর্শকরা ভালোভাবে উপভোগ করতে পারেন। আইম্যাক্সের ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তিও উন্নত। এতে দুটি প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়। একটি থেকে ডান চোখের দৃশ্য রূপার প্রলেপ দেয়া ত্রিমাত্রিক পর্দায় ফেলা হয় এবং অন্যটি থেকে বাম চোখের দৃশ্য ফেলা হয়। এতে দর্শক থ্রিডি চশমা পরার পর ভালোভাবে দেখতে পান।
আইম্যাক্সে সিনেমা দেখার অসাধারণ অভিজ্ঞতার কারণ, এর আবিষ্কৃত ‘ডিজিটাল মিডিয়া রি-মাস্টারিং’ বা ডিআরএম প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে আগে শ্যুট হয়ে যাওয়া সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম সম্পাদনা করা হয়। প্রতিটি দৃশ্যের শব্দ সম্পাদনা, উজ্জ্বলতাসহ খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয় সম্পাদনা করা যায় এই প্রক্রিয়ায়। এটি ঠিকভাবে করার জন্য আইম্যাক্স থেকে পরিচালকদের পরামর্শ দেয়া হয় কোন দৃশ্যে আইম্যাক্স ক্যামেরা ব্যবহার করতে হবে বা এর কালার গ্রেডিং কেমন হবে।
আইম্যাক্সের আরেকটি দারুণ ব্যাপার হলো এর শব্দের মান। এই থিয়েটারে স্পিকারগুলো সাধারণ থিয়েটারের তুলনায় বেশ বড় এবং সংখ্যায়ও বেশি। এতে শব্দের মান এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় যেন পিন পড়ার আওয়াজও মনে হয় খুব মৃদুভাবে শোনা যাচ্ছে। এ কারণে মনে হয় সিনেমার দৃশ্যগুলো আমাদের পাশেই ঘটছে। তাছাড়া থিয়েটারগুলোর ডিজাইন আইম্যাক্সের নামে পেটেন্ট করতে হয়।
এসব কারণেই ভাসমান আইম্যাক্স থিয়েটার হওয়াটা বিশেষ কিছু। তবে লেডি এস ইয়টের ইঞ্জিনের শব্দ থেকে যেন থিয়েটার মুক্ত থাকে সেজন্য অনেক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। থিয়েটারটি দুই ডেক নিয়ে গঠিত। এর কাজ শেষ করে একে ঘিরেই ইয়টের বাকি অংশের কাজ করতে হয়েছে। এই থিয়েটারে রয়েছে ১২টি আসন। এর সাংকেতিক নাম হচ্ছে প্রজেক্ট ৮১৪। থিয়েটারের পাশাপাশি বিলাসবহুল এই ইয়টে রয়েছে ৮কে এইচডি টেলিভিশন, একটি হেলিপ্যাড ও চারটি ভিআইপি সুইট। এছাড়া এতে বাস্কেটবল, ভলিবল, ফুটবল খেলার ব্যবস্থাও রয়েছে।
ড্যানিয়েল স্নাইডার এবং তার স্ত্রী তানিয়ার এই সুপার ইয়টটি কিনতে খরচ পড়েছে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। এই দম্পতির আরেকটি সুপার ইয়ট রয়েছে যার নাম লেডি অ্যানি। এর দাম ছিল ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্নাইডার তার ইয়ট হাতে পাবেন এই বসন্তে। এর আগে একে সাগরে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হবে।
ড্যানিয়েল স্নাইডারের বর্তমান সম্পদের মূল্য ২.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৫৪ বছর বয়সী স্নাইডার বর্তমানে ফোর্বসের বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় ৩৬৮তম অবস্থানে আছেন। ছাত্রজীবনে তিনি ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপআউট হন এবং ব্যবসা শুরু করেন। তার ‘স্নাইডার কমিউনিকেশনস’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ২০ বছর বয়সেই মিলিয়নিয়ার হন। ১৯৯৬ সালে তিনি ছিলেন নিউ ইয়র্ক শেয়ার লেনদেন বাজারের সবচেয়ে কম বয়সী সিইও। ২০০০ সালে তার কোম্পানিটি ফরাসি বিলিয়নিয়ার ভিনসেন্ট বল্লোরির হাভাস কোম্পানির কাছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করে দেন। ১৯৯৯ সালে ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে ন্যাশনাল ফুটবল লিগের দল ‘ওয়াশিংটন রেডস্কিন’ কিনে নেন। এখনো তিনি এর সর্বোচ্চ শেয়ারের মালিক।
লেডি এস এর প্রস্তুতকারক ফিডশিপ কোম্পানিটি এর আগেও বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির জন্য ইয়ট বানিয়ে দিয়েছে। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে তারা তিনটি ইয়ট নির্মাণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ম্যালকম ফোর্বসের জন্য নির্মিত ‘দ্য হাইল্যান্ডার’। বর্তমানে এটি প্রতি সপ্তাহে ১,৫০,০০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ভাড়া দেয়া হয়। এছাড়া ২০০৪ সালে রোমান আব্রামোভিচের জন্য একস্টেসিয়া এবং ২০১২ সালে স্টিভ জবসের জন্য ভেনাস ইয়টটিও তারাই নির্মাণ করে। যদিও ইয়ট নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই মারা যান স্টিভ জবস।
This is a Bangla article about the first floating imax theater of the world.All the references are hyperlinked in the article.
Feature Image: feadship