Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গুগল ইফেক্ট: ইন্টারনেট কি আমাদের নির্বোধ করে তুলছে?

আপনাকে যদি বলা হয় পৃথিবীর তাবৎ প্রশ্নের একটাই উত্তর, আপনি হয়তো বিস্মিত হবেন। কিন্তু যদি বলা হয়, সেই উত্তরটি হলো ‘Google It’ বা ‘গুগল করো’, তাহলে আপনার বিস্ময় অনেকটাই হ্রাস পাবে। তথ্য সন্ধানের জগতে বর্তমান সময়ে চলছে সার্চ ইঞ্জিনের রাজত্ব। আরো নিখুঁতভাবে বললে গুগলের রাজত্ব। প্রতিনিয়ত ৫ বিলিয়নেরও বেশি সার্চ প্রমাণ করে দেয় আমাদের অফলাইন জগতে উত্তর খোঁজ করার চেয়ে অনলাইন জগতে খোঁজ করার প্রবণতা ঠিক কতটা বেশি।

প্রতিনিয়ত আরো শক্তিশালী এবং কার্যকর করা হচ্ছে গুগল সার্চ অ্যালগরিদম, ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আমাদের এই স্বপ্নের প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলাফল আমাদের জীবনে আরো স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে আনছে এবং আরামদায়ক করে দিচ্ছে। আর আমরা ধীরে ধীরে আমরা প্রবেশ করছি গুগল ইফেক্টের মধ্যে।

প্রতিনিয়ত ৫ বিলিয়নেরও বেশি সার্চ প্রমাণ করে দেয়, অনলাইন জগতে তথ্য খোঁজ করার প্রবণতা আমাদের মাঝে ঠিক কতটা বেশি; Image Source: Discovery Dcode

কী এই গুগল ইফেক্ট? এর প্রভাব কী আমাদের নির্বুদ্ধিতা বাড়িয়ে দিচ্ছে? করে থাকলে ঠিক কতটা ক্ষতিকর এই প্রভাব?

তথ্য এখন আমাদের হাতের আঙ্গুলের মাথায়। শুধুমাত্র একটি ক্লিক এবং কয়েক মুহূর্তেই কাঙ্ক্ষিত তথ্যভান্ডারের সামনে হাজির। দ্রুততর অনলাইন এই সার্চ প্রক্রিয়ার আশীর্বাদে আমাদের সার্চ ইঞ্জিনের উপর নির্ভরশীলতা অতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে। তার ফলে এখন আমরা মস্তিষ্কের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে মস্তিষ্কের বাইরের একটি তথ্য উৎসের উপর নির্ভরশীল হতে শুরু করেছি। আর এই থেকেই বাড়ছে আমাদের ভুলে যাবার প্রবণতা। প্রভাব পড়ছে আমাদের মস্তিষ্ক এবং স্মৃতিশক্তির উপর।

তথ্য ভুলে যাবার এই প্রভাবকেই বলা হয় গুগল ইফেক্ট। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে, অনলাইনে যেসব তথ্য আমরা খুব সহজেই যেকোনো সময় পেতে পারি, সেসকল তথ্য খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাবার প্রবণতা হলো গুগল ইফেক্ট। একে ‘ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া’ বা ‘ডিজিটাল মস্তিষ্কক্ষয়’ও বলা হয়। ২০১১ সালে একটি গবেষণা থেকে এই শব্দটির আবির্ভাব ঘটে এবং গবেষণার ফলাফল থেকে আমরা ঠিক কতটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছি তা স্পষ্টভাবে উঠে আসে। যদিও এই গবেষণার নাম টেক জায়ান্ট গুগলের নাম দিয়ে প্রকাশ করা হয়, কিন্তু আদতে তা সমগ্র ইন্টারনেটের প্রভাবকেই নির্দেশ করে।

২০১১ সালে গবেষণাটি পরিচালনা করেন ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়ার সাইকোলজিস্ট বেটসি স্প্যারো, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিস্ট ড্যানিয়েল ওয়েগনার এবং জেনি লিউ। দেখা যায়, প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ এই ডিজিটাল অ্যামনেশিয়ার ভুক্তভোগী। গবেষণাটিতে ৬,০০০ মানুষের উপর একটি পরীক্ষা চালানো হয়। তাতে দেখা যায়, তারা প্রশ্নের উত্তরের জন্য ইন্টারনেটের উপর অধিক নির্ভরশীল, শুধু তা-ই না, যে সকল তথ্য তারা যেকোনো সময় এক ক্লিকেই পেয়ে যাবেন, সেসকল তথ্য খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাবার প্রবণতা অত্যধিকভাবে বেশি।

সাইবার নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কি ল্যাবের সহায়তায় গবেষণাটি করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি জানায়,

আমরা তথ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব মস্তিষ্কের উপর সমর্পণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। ইন্টারনেটে এক ক্লিকে তথ্য পেতেই খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। 

৪টি পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালিত হয়, যার কোনোটিতে তাদেরকে বলা হয় কোনো তথ্য পড়তে কিংবা লিখতে। সাথে সাথে বলে দেয়া হয় সেই তথ্যটি সংরক্ষিত থাকবে নাকি মুছে ফেলা হবে। গবেষণা শেষে ৩টি হতাশাজনক ফল উঠে আসে।

১. পরীক্ষার্থীরা প্রশ্নের উত্তরের জন্য ইন্টারনেট এবং কম্পিউটারকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে অন্য কোনো উৎসের তুলনায়।

২. যে সকল তথ্য তারা পরে আবার এক ক্লিকেই পেয়ে যাবে সে সকল তথ্য তারা মনে রাখার চেষ্টাও করেনি।

৩. তারা তথ্য পাবার পর সেই তথ্য মনে রাখার চেয়ে তথ্যের উৎসটি মনে রাখায় বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। যার মধ্যে খুব কম সংখ্যকই তথ্য এবং উৎস উভয়ই মনে রেখেছিল।

 প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ এই ডিজিটাল অ্যামনেশিয়ার ভুক্তভোগী; Image Source: Alamy

মজার ব্যাপার হল, পরীক্ষার সময় তাদের যখন বলা হয়েছিল কোনো নির্দিষ্ট তথ্য সংরক্ষিত থাকবে, অর্থাৎ তারা যখন চাইবেন সেই তথ্য পুনরায় দেখতে পারবেন তাদের জিজ্ঞেস করা হলে, সেসকল তথ্য তাড়াতাড়ি ভুলে যাবার প্রবণতা দেখা যায় তাদের মধ্যে। অপরপক্ষে যেসকল তথ্য একবার দেখার পর মুছে ফেলা হবে ইন্টারনেট থেকে বলে ঘোষণা দেয়া হয়, সেসকল তথ্য তারা বেশিরভাগই মনে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এই ফলাফল যে কেবল অনলাইন জগতের তথ্য মনে রাখার উপরেই প্রভাব ফেলেছে তা কিন্তু না, বরং আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য মনে রাখাতেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জন্ম দিয়েছে এক ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া যুগের। 

প্রতিদিনের কাজগুলোতে ছোটখাটো ভুল, ফোন নম্বর ভুলে যাওয়া, প্রিয় জনের জন্মদিন বা বিশেষ কোনো তারিখ ভুলে যাওয়া কিংবা সর্ট টাইম মেমোরি লসের মতো ভুলে যাওয়া রোগের সম্ভাবনা অত্যধিক বাড়িয়ে দিচ্ছে গুগল ইফেক্টের প্রভাব। 

গবেষণাটিতে ক্যাসপারস্কি ল্যাবের সাথে কাজ করা ড. মারিয়া উইম্বার জানান, ইন্টারনেট আমাদের তথ্য পরিচালনা এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। আমরা এখন তথ্য মনে রাখার চেয়ে সেই তথ্যটির উৎস মনে রাখি যা আমাদের মধ্যে গুগল ইফেক্ট তৈরি করছে। আমরা পুরোপুরিভাবে ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি, মস্তিষ্কের উপর না।

গবেষণাটির প্রধান বেটসি স্প্যারো গুগল ইফেক্ট সম্পর্কে বলেন, আমরা আমাদের পরিবারের সদস্য বা সহযোগীদের উপর যেভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ি কোনো তথ্যের ব্যাপারে, ঠিক একইভাবে ইন্টারনেটের উপরেও আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি, তথ্যের থেকে তার উৎসের উপর বেশি নজর দিয়ে।

২০০৩ সালের আরেক গবেষণায় এমনই কিছু তথ্য উঠে আসে। সেখানে কিছু ব্যক্তিকে বলা হয় একটি মিউজিয়াম পরিদর্শন করতে। এক দলকে বলা কেবলমাত্র চোখ দিয়ে তা পরিদর্শন করতে, আরেক দলকে বলা হয় মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ছবি তুলতে। দেখা যায়, যারা কেবলমাত্র খালি চোখে পরিদর্শন করেছেন তারা ফটোগ্রাফারদের তুলনায় মিউজিয়ামের ভেতরের দৃশ্যপটের ব্যাপারে নিখুঁত ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছেন। খালি চোখের চেয়ে লেন্সের উপর নির্ভরশীলতাও এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ফুটে ওঠে।

খালি চোখের চেয়ে লেন্সের উপর নির্ভরশীলতাও আমাদের বৃদ্ধি পাচ্ছে; Image Source: Getty Images

আমরা আমাদের নিজেদের তুলনায় নিজেদের ডিভাইসগুলোর উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি, নিজেদের চেয়ে সেগুলোকে আমরা বেশি পরিমাণে বিশ্বাস করে থাকি, যা আমাদের মস্তিষ্কের উপর এক মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলে যাচ্ছে নীরবে। তবে এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন অনেকেই।

ইনটেলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. জেনেভিভ বেল এর মতে, ইন্টারনেট আর প্রযুক্তি আমাদের আরো চৌকষ হতে সাহায্য করে, আমাদের সময় বাঁচায়। তথ্য মনে রাখার চেয়ে আমাদের সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনার উপর গুরুত্বারোপ করা উচিত। এই প্রযুক্তিগুলোর অবদানে আমরা সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনার সময় বের করে পারি।

ইন্টারনেট আর প্রযুক্তি আমাদের আরো চৌকষ হতে সাহায্য করে, আমাদের সময় বাঁচায়; Image Source: Rex Features

অপরদিকে আমেরিকান লেখক নিকোলাস কার এর বিপরীতে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তার মতে, আমরা সবথেকে ভয়াবহ বিষয়টাই উপেক্ষা করে যাচ্ছি, তা হলো মানব স্মৃতি কম্পিউটার স্মৃতির মতো নয়। চিন্তা-ভাবনা, আবেগ, অনুভবের সাথে জড়িয়ে প্রতিটি নিউরনের যোগাযোগ থেকে এর উন্নতি ঘটে। আমরা যদি এদের মধ্যে সঠিক সমন্বয় ঘটাতে না পারি, তবে নতুন জ্ঞান তৈরি করতে পারবো না। বিজ্ঞান আমাদের দেখিয়ে দেয় আমরা কীভাবে স্মৃতি একত্রীকরণে মনোযোগের দরকার হয়। গুগল ইফেক্ট এই পথের কাঁটার মতো।

ইন্টারনেটের সকল তথ্য আমাদের জন্য উপযোগী নয়, সকল তথ্য বিশ্বাসযোগ্যও নয়। কিন্তু তারপরও আমরা কোনোভাবেই এর গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারি না। আবার একইসাথে এর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীলও হতে পারি না। মস্তিষ্কের বিকল্প হিসেবে ইন্টারনেট এবং চোখের বিকল্প ক্যামেরার লেন্স কখনোই আমাদের একটি স্বতন্ত্র সত্ত্বা হিসেবে প্রকাশ করবে না অদূর ভবিষ্যতে। ধীরে ধীরে আমরা প্রযুক্তির দাসে পরিণত হচ্ছি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিজ্ঞান আমাদের দেখিয়ে দেয় আমরা কীভাবে স্মৃতি একত্রীকরণে মনোযোগের দরকার হয়, গুগল ইফেক্ট এই পথের কাঁটার মতো; Image Source: SlideShare

এর একমাত্র সমাধান হতে পারে প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। অনলাইন জগত থেকে বেরিয়ে অফলাইনে তথ্যের অনুসন্ধান বেশি বেশি করা। তথ্যের উৎসের উপর নির্ভরশীল না হয়ে তথ্যের উপর বেশি করে গুরুত্বারোপ করা। ইন্টারনেট জগত আমাদের জন্য খুলে দিয়েছে অপার সম্ভাবনার দ্বার। আমরা সেই সম্ভাবনা কখনোই উপেক্ষা করতে পারবো না। কিন্তু একইসাথে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যাতে আমাদের নির্বুদ্ধিতা অত্যধিক পরিমাণে বেড়ে যেতে না পারে।

আপনার কি মনে হয় ইন্টারনেট আমাদের নির্বোধ করে তুলছে? আপনি কতটুকু নির্ভরশীল গুগলের উপর? কোনো তথ্য যাচাইয়ের ব্যাপারে কতটুকু সতর্ক থাকেন এই অন্তর্জালের দুনিয়ায়? আপনিও কি এই ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া বা গুগল ইফেক্টের ভুক্তভোগী?

This article is in Bangla Language. It's about a psychological fact called google effect. Is internet making us stupid?
References used in this article are hyperlinked inside this article. 
Featured Image:  lamenteesmaravillosa.com

Related Articles