Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লিফটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বুর্জ খলিফা, সাংহাই টাওয়ার কিংবা কিংডম ক্লক টাওয়ারের মতো সুউচ্চ ভবনের আজকের এই পৃথিবীতে লিফট ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। হাজার হাজার ফুট উঁচু ভবন তো পরের কথা, প্রতিদিনের জীবনে আমরা লিফট ব্যবহারে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, আবাসিক ভবন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক ভবন, প্রায় সব ভবনেই লিফট এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমানে সবচেয়ে দ্রুতগামী লিফটের গতি প্রতি প্রতি সেকেন্ডে ৬৭ ফুট! কিন্তু ১৮৫৭ সালে প্রথম যে যাত্রীবাহী লিফট স্থাপন করা হয়েছিল নিউ ইয়র্কের হগওয়ার্ট ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ৫ তলা ভবনে, সেটি ছিল অত্যন্ত ধীর গতির। ধীর গতির সাথে নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রথম যাত্রীবাহী লিফট অবশ্য মানুষকে তখন খুব একটা আকৃষ্ট করতে পারেনি। চালু হওয়ার তিন বছর পরেই বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র ৫/৬ তলা যখন স্বচ্ছন্দে হেঁটে ওঠা যায়, সেখানে নিরাপত্তার ঝুঁকির সাথে সময়ক্ষেপণ কে-ই বা করতে চায়!

তৎকালীন সময়ে ভবনে লিফট ছিল অনেকটা বিলাসিতার মতো। কেননা, তখনও উল্লেখযোগ্যভাবে গগনচুম্বী ভবন তৈরি হওয়া শুরু হয়নি।

প্রাচীন অনেক সভ্যতায় লিফট ব্যবস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়; Image Source: telegraph.co.uk

লিফট সংক্রান্ত প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিক স্থপতি ভিত্রুবিয়াসের লেখায়। ভিত্রুবিয়াসের মতে, খ্রিস্টপূর্ব ২৩৫ সালের দিকে গ্রিসের গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীরা প্রথম লিফট তৈরি করেছিলেন। তবে ধারণা করা হয়, আরও আগে থেকেই এই ধরনের ব্যবস্থা অনেক প্রাচীন সভ্যতায় ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদরাও বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় এই ধরনের কিছু কাঠামোর সন্ধান পেয়েছিলেন, যেগুলো অনেকটা লিফটের মতোই কাজ করত। রোমান সাম্রাজ্যে মানুষ, প্রাণী ও পানির শক্তি ব্যবহার করে উত্তোলক যন্ত্র নির্মাণের নজির রয়েছে। রোমান কলোসিয়ামের নিচের অংশ থেকে উপরের দিকে গ্ল্যাডিয়েটর ও বন্য প্রাণী তুলতে এই ধরনের ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছিল।

তাছাড়া, ১৭৯৩ সালে স্ক্রু মেকানিজম ব্যবহার করে রাশিয়ান এক উদ্ভাবক কেবিন উত্তোলনের জন্য যে লিফট তৈরি করেছিলেন, সেটি স্থাপন করা হয়েছিল রাশিয়ার মস্কো ও পিটার্সবার্গের রয়্যাল প্যালেসে। সেই সাথে আধুনিক প্রথম যাত্রীবাহী লিফটের ধারণাও নতুন কিছু ছিল না, কারণ ১৮০০ সালের শুরু দিকেই ভূমি থেকে উপরে মালামাল তোলার জন্য যন্ত্রচালিত উত্তোলক ব্যবহার করা হত। এই ধরনের যন্ত্রচালিত উত্তোলক ব্যবহার করে ভবনে যাত্রী পরিবহনের ধারণার শুরু ১৮৫০ সালের শেষের দিকে। শুরুর দিকে এগুলো ছিল খোলা প্ল্যাটফর্মের উপর এবং আজকের মতো এতটা নিরাপদ একেবারেই ছিল না। লিফট প্রচলনের শুরুর দিকেই নিরাপত্তার দিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন শিল্পপতি এলিশা ওটিস।

লিফটের নিরাপত্তার ব্যাপারে ওটিসের প্রচেষ্টা ছিল অসাধারণ; Image Source: express.co.uk

১৮৫৪ সালে নিউ ইয়র্কে আয়োজিত একটি মেলায় লিফটের নিরাপত্তার ব্যাপারে মানুষকে আশ্বস্ত করতে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন তিনি। প্রদর্শিত লিফটে তিনি নিরাপত্তার জন্য একটি আলাদা ব্যবস্থা সংযোজন করেছিলেন। নির্দিষ্ট কাঠামোতে দড়ির মাধ্যমে যন্ত্রচালিত উত্তোলক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্ল্যাটফর্ম উপরে তুলে দড়ি কেটে দিয়েছিলেন। দড়ি কাটলেও সংযোজিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার দরুন প্ল্যাটফর্মটি মাটিতে পড়ে যায়নি। কারণ, এরপর সাথে সাথে প্ল্যাটফর্মটির দুই পাশ থেকে কাঁটার মতো দাঁত বের হয়ে এসে প্ল্যাটফর্মটি আঁকড়ে ধরত। ছোট এই আয়োজনের প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী। ওটিসের এলিভেটর কোম্পানিই আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে বড় লিফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।

শুরুর দিকের লিফট ছিল খুব ধীর গতির; Image Source: time.com

অসাধারণ ব্যবসায়িক বুদ্ধির দরুন, ওটিসের লিফট সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল। যদিও ১৮৫৯ সালে ওটিস টুফটস নামের এক প্রকৌশলী ‘ভার্টিক্যাল রেলওয়ে’ নামের একটি ব্যবস্থা পেটেন্ট করেছিলেন, যা ছিল মূলত একটি গাড়ি এবং ভেতরে বসার জন্য আসন ব্যবস্থাও ছিল। এই ওটিসের সাথে নামের মিল থাকলেও শিল্পপতি ওটিসের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। শিল্পপতি ওটিস তার প্ল্যাটফর্ম লিফটের পেটেন্ট করেছিলেন আরও পরে, ১৮৬১ সালে। বলা যায়, শুধুমাত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংযোজনের কারণে ওটিসের লিফট মানুষের মনে লিফট সংক্রান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভয় দূর করতে অনেকটা সক্ষম হয়েছিল।

প্রথমদিকে লিফট ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল; Image Source: icp.org

প্রথম লিফটগুলো ছিল ব্যয়বহুল, বিক্রি তেমন একটা হচ্ছিল না। তাই, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি রাতারাতি। লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্কের হোটেলগুলোতে বিলাসিতার বস্তু হিসেবে লিফট সংযুক্ত করা হতো তখন, যেগুলো ছিল অত্যন্ত ধীর গতির। মানুষ নতুন প্রযুক্তি দেখার আকাঙ্ক্ষায়, শখের বশে কিংবা বিলাসিতার অংশ হিসেবে এসব লিফটে উঠত। কিন্তু সময় বাঁচানো ও সিঁড়ি বেয়ে ওঠার কষ্ট লাঘবের জন্য সেই লিফটগুলো যথেষ্ট উপযোগী ছিল না। লিফটের বিবর্তনের পালে হাওয়া লাগে, যখন এর গতি বৃদ্ধি পায়। শুরুর দিকে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের দ্বারা পরিচালিত লিফটের গতি খুব কম ছিল, কিন্তু পানির শক্তি বা হাইড্রলিক সিস্টেম ব্যবহার করে তৈরি লিফটের গতি ছিল বেশ প্রশংসনীয়। এরপর থেকে ক্রমেই লিফট ব্যবস্থা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। হাইড্রলিক লিফট ব্যবস্থাপনাও অনেক সহজ ও তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল ছিল। ১৮৭০ সালে ম্যানহাটনে ইকুইট্যাবল লাইফ বিল্ডিংয়ে ওটিস এলিভেটর কোম্পানি যে লিফট স্থাপন করে, তা ছিল হাইড্রলিক চালিত। শিকাগোর হোম ইনস্যুরেন্স বিল্ডিংয়ে ১৮৮৫ সালে চারটি লিফট স্থাপন করা হয়, যেগুলো ১০ তলা পর্যন্ত পরিচালিত হতো। ধীরে ধীরে সুউচ্চ ভবনের সাধারণ অংশ হয়ে উঠতে থাকল লিফট।

সুউচ্চ ভবনে লিফট এখন অবিচ্ছেদ্য অংশ; Image Source: flickr.com

লিফট ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের নতুন ধাপের সৃষ্টি হয় বৈদ্যুতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। বিদ্যুৎচালিত প্রথম লিফট ১৮৮০ সালে তৈরি করেন জার্মান উদ্ভাবক উইনার ভন সিমেন্স। কিন্তু এই লিফট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের শুরু হতে সময় লেগেছিল আরও নয় বছর। এর মধ্যে ১৮৮৭ সালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লিফটের দরজা খোলা ও বন্ধ করার প্রযুক্তিও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে লিফট ব্যবস্থা প্রযুক্তির উন্নতির সাথে ক্রমেই নতুন মাত্রা পেতে থাকে। সেই সময়ের আদর্শ লিফট ব্যবস্থার অধিকাংশ আজও মেনে চলা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং চালু হয় ১৯৩১ সালে, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন। এই ভবনে ৭৩টি লিফট ছিল এবং এটি প্রতি মিনিটে ১২০০ ফুট গতিতে ভ্রমণ করতে পারত।

বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির লিফট হলো চীনের সাংহাই টাওয়ারের। ঘণ্টায় ৪৬ মাইল বেগে এটি ২০৭৩ ফুট ভবনের ১৮৯৮ ফুট পর্যন্ত ক্রমাগত ওঠানামা করে। স্কাইস্ক্র্যাপারগুলোতে লিফট যুক্ত করার ব্যাপারটি বেশ জটিল। কারণ এত উঁচু ভবনে নিরাপত্তার বিচারে অনেক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হয়। যদিও প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে যেকোনো জটিল বিষয়ও সফলতার সাথে অর্জন করা এখন সময়ের ব্যাপার, তবুও কিছু সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়।

বুর্জ খলিফা, বিশ্বের সবচেয়ে উচু ভবন; Image Source: memphistours.com

যেমন- বুর্জ খলিফায় ৫৭টি লিফট রয়েছে, কিন্তু সবগুলো লিফটের কোনোটিই ভবনের প্রতিটি তলায় পৌঁছাতে পারে না। সৌদি আরবের জেদ্দায় নির্মাণাধীন কিংডম টাওয়ারে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচুতে পৌঁছানো লিফট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। এক কিলোমিটার বা ৩২৮০ ফুট উঁচু ভবনের সর্বোচ্চ তলা পর্যন্ত লিফট নিতে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কোন (Kone) কার্বন ফাইবারের তৈরি নতুন ধরনের ক্যাবল নিয়ে কাজ করছে। কারণ, গতানুগতিক স্টিলের ক্যাবল অপেক্ষাকৃত ভারী।

সুউচ্চ ভবনে ক্রমাগত ওঠানামা করলেও, লিফট ব্যবস্থা অন্য যেকোনো পরিবহণ ব্যবস্থার চেয়ে বেশি নিরাপদ। দুর্ঘটনা যে একেবারেই ঘটে না তা না। যুক্তরাষ্ট্রে লিফট দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ২৭ জন নিহত হয় এবং আহত হয় কমপক্ষে ১৭,০০০ জনের মতো। তবে যাদের লিফট ভীতি রয়েছে তারা আশ্বস্ত হতে পারেন এই জন্য যে, সিঁড়ি ও চলন্ত সিঁড়ির চেয়েও লিফট অধিক নিরাপদ।

Related Articles