স্মার্টফোনের ক্যামেরা ঠিক কীভাবে কাজ করে?

আজ সবার হাতে হাতেই পছন্দের স্মার্টফোন। কেউ গান শুনছেন, কেউবা ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন, আবার কেউবা দিন-রাত এক করে শুধু ছবিই তুলছেন। ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ করেই মনের জানালায় প্রশ্ন আসে- প্রিয় স্মার্টফোনটির ক্ষুদ্র এই ক্যামেরাটি কিভাবে এত সুন্দর ছবি তুলছে! বাজারের নামি দামি বড় বড় ক্যামেরার তুলনায় আমাদের প্রিয় স্মার্টফোনটির ছোট এই ক্যামেরা কোন প্রক্রিয়ায় কাজ করছে? সেই উত্তরটি খোঁজার জন্যই আজকের প্রয়াস।

একটি ক্যামেরা কীভাবে কাজ করে? স্মার্টফোন, ডিজিটাল ক্যামেরা অথবা ডিএসএলআর। ব্যাখ্যাটি কিন্তু মোটামুটি একই রকম। বিষয়টি সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যাক।

  • স্মার্টফোনের ক্যামেরায় ব্যবহৃত লেন্সটি আমরা যে বস্তু বা বিষয়ের ছবি তুলতে চাইছি তার দিকে ফোকাস করে।
  • প্রকৃতি থেকে আলো ক্যামেরার লেন্সে প্রবেশ করে।
  • লেন্সের অ্যাপাচার প্রবেশ করা আলোর পরিমাণ নির্ণয় করে।
  • শাটার সেন্সরটি ঠিক কতটা সময় আলোর সংস্পর্শে ছিল- এই বিষয়টি পরিমাপ করে।
  • সেন্সরটি ব্যক্তি, বিষয় বা বস্তুর একটি ছবি প্রাথমিকভাবে ধারণ করে।
  • ক্যামেরার সামগ্রিক হার্ডওয়্যার বিভাগ ছবিটি নিয়ে কাজ করে এবং চূড়ান্তভাবে ছবিটি প্রদর্শন করে।

পুরো প্রক্রিয়াটি মূলত পদার্থবিদ্যার কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করে সম্পন্ন হয়। কিন্তু ক্যামেরায় ব্যবহৃত লেন্স, সেন্সর এবং অ্যাপাচারের আকার-আয়তনের ভিন্নতার কারণে উপরে উল্লেখিত ধাপগুলোর দুই থেকে চার পর্যন্ত ধাপগুলো স্মার্টফোনভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। লেন্স, সেন্সর, এবং অ্যাপাচারের আকার-আয়তনের ভিন্নতার কারণে লেন্সের মধ্যে আসা আলোর পরিমাণে তারতম্য ঘটে এবং এই কারণে ছবির বৈশিষ্ট্য এবং গুণাগুণে পার্থক্য দেখা যায়। পুরো প্রক্রিয়াটিতে আমাদের কোনো ধরনের অসতর্কতার কারণে প্রত্যাশিত মানের ছবি তুলতে আমরা অনেক সময়ই ব্যর্থ হই।

আধুনিক স্মার্টফোনের ক্যামেরায় থাকে নানা প্রযুক্তির কারসাজি; Source: Android Authority

ভালো ছবির ক্ষেত্রে কোন শর্ত কাজ করে?

ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে ভালো ছবি তোলার জন্য যে শর্তগুলো পূরণ হওয়া আবশ্যক সেই বিষয়টি বোঝানোর জন্য একটি মজার উপমা রয়েছে। ফটোগ্রাফি শেখার কম্যুনিটি ক্যামব্রিজ ইন কালার ওয়েবসাইটে বিষয়টি ঠিক এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে –

ছবির ক্ষেত্রে সঠিক এক্সপোজারের বিষয়টি অনেকটা বালতিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার মতোই। বৃষ্টির ধারা আমাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বালতির আকারটি, পানি ধরার সময়টুকু এবং বালতিতে আমরা ঠিক কতটুকু পানি সংরক্ষণ করতে চাই- এই বিষয়গুলোর উপরে কিন্তু আমরা ঠিকই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যাতে আমরা প্রয়োজনের থেকে কম পানি সংরক্ষণ না করি ( ছবির ক্ষেত্রে কম এক্সপোজার), আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানিও যাতে সংরক্ষণ না করি (অধিক এক্সপোজার)।

একটি ভালো ছবি বলতে মূলত সঠিক এক্সপোজারে তোলা ছবিকেই নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে সঠিক এক্সপোজারের ছবি পেতে হলে কয়েকটি বিষয়ের উপরে প্রাথমিক ধারণা থাকা বেশ জরুরি।

একটি লেন্সের মধ্যে কী থাকে?

এই বিষয়টি তত্ত্বগতভাবে বুঝে নেওয়া একটু কষ্টসাধ্য মনে হলেও বস্তুত বিষয়টি ব্যবহারিকভাবে ব্যাখ্যা করলে কিন্তু অতটা কঠিন কিছু নয়। লেন্সের কার্যক্রমের বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের মূলত তিনটি বিষয়কে বুঝতে হবে।

  • ফোকাল দৈর্ঘ্য
  • অ্যাপাচার ও
  • শাটার গতি

ফোকাল দৈর্ঘ্য

ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে সাধারণত একটি ৩৫ মিলিমিটারের পূর্ণ-ফ্রেমকে আদর্শ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু স্মার্টফোনের লেন্সের আকার-আয়তন খুবই ছোট হবার কারণে স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে খুব ভালো কোনো লেন্সের ক্ষেত্রে এই ফ্রেমটি সর্বোচ্চ ২৮ মিলিমিটার হয়ে থাকে। কোনো লেন্সের ফোকাল দৈর্ঘ্য যত বেশি হবে ছবি তোলার সময়ে ঐ লেন্সে ততটা বেশি জুম পাওয়া যাবে। আবার এই ফোকাল দৈর্ঘ্য যত কম হবে, লেন্সের ‘ফিল্ড ভিউ’ ততটা প্রশস্ত হবে। আমাদের চোখের স্বাভাবিক ফোকাল দৈর্ঘ্য সাধারণভাবে ৫০ মিলিমিটারের বেশি সম্ভব নয় বিধায় ৫০ মিলিমিটারের কোনো লেন্স ব্যবহৃত হলে (বাস্তবে ব্যবহৃত হয় না) সেক্ষেত্রে ছবিটির পরিধি আমাদের চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টির মতোই হবে।

অ্যাপাচার

অ্যাপাচার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পূর্ববর্তী একটি লেখার অংশে উঠে এসেছে। সহজ কথায়,  অ্যাপাচার হচ্ছে প্রকৃতি থেকে লেন্সের অর্থাৎ ক্যামেরার মধ্যে আসা আলো নিয়ন্ত্রিত হবার একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ছবির ‘পটভূমি’ এবং ছবির ‘বিষয়বস্তুর’ উপরে একটি কার্যকরী ফোকাস ব্যবস্থা কাজ করে। ছবি তোলার সময়ে অ্যাপাচার যতটা নিয়ন্ত্রিত হবে ছবিতে থাকা বিষয়ের উপরে ফোকাস তত বেশি সুনির্দিষ্ট হবে, আবার অ্যাপাচার যতটা অনিয়ন্ত্রিত এবং উন্মুক্ত হবে ছবিতে ফোকাসের বিষয়টি ততটা কম হবে।

অ্যাপাচার যত বড়, Ƒ সংখ্যাটি ততই ছোট; Source: Android Authority

Ƒ দিয়ে আপাচারের বিষয়টি নির্দিষ্ট হয়। এই সংখ্যাটি যত কম হবে, অ্যাপাচার তত বেশি বড় হবে। এক্ষেত্রে একটি গাণিতিক হিসাব কাজ করে।

Ƒ অনুপাত= ফোকাল দৈর্ঘ্য / উন্মুক্ত জায়গা

উদাহরণস্বরূপ, ৫০ মিলিমিটার ফোকাল একটি লেন্সের ১০ মিলিমিটার আলোর জন্য উন্মুক্ত হলে সেক্ষেত্রে অ্যাপাচার হবে Ƒ/৫।

প্রশস্ত অ্যাপাচার (বামে), সংকীর্ণ অ্যাপাচার (ডানে); Source: Android Authority

ইলেকট্রনিক শাটার

অ্যাপাচারের পরেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে শাটার গতি। কাঙ্ক্ষিত মানের ছবি তুলতে চাইলে এই বিষয়টির উপরে সতর্ক নজর রাখা দরকার। সাধারণভাবে বলা যায়, ধীর গতির শাটারে সাধারণত ঘোলাটে ছবি পাওয়া যায়, আবার খুব দ্রুতগতির শাটারেও ছবির গুণাগুব নষ্ট হতে পারে। শাটারের গতিকে বাড়ানো বা কমানোর বিষয়টি ক্যামেরার ভাষায় “Stops” দিয়ে প্রকাশ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১/৩০ সেকেন্ড এক্সপোজার ১/৬০ সেকেন্ড এক্সপোজারের থেকে এক বেশি ঝকঝকে ছবি প্রদান করবে। এক্ষেত্রে মূল বিষয়টি এভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে-

লক্ষণীয় বিষয়টি হচ্ছে ঠিক কতটা সময় ধরে ক্যামেরার সেন্সরটি ছবিটি ধারণ করছে। এই নিয়ন্ত্রণটি আপনার হাতে। কাঙ্ক্ষিত ছবি তোলার জন্য কখনোই এই সময়টি কম-বেশি হওয়া উচিত নয়। সঠিক সময় থেকে এক্সপোজার কম বা বেশি হলে হয় স্বল্প এক্সপোজার হবে, নাহয় দীর্ঘ এক্সপোজার হবে।

ক্যামেরা সেন্সিটিভিটি

ক্যামেরার ক্ষেত্রে সেন্সিটিভিটি বা সংবেদনশীলতা হচ্ছে ক্যামেরার একটি কম্যান্ড বা নির্দেশনা, যার ফলে চূড়ান্ত ছবিটি পাবার সময় কাঙ্ক্ষিত মাত্রার উজ্জ্বলতা পাওয়া যায়। ফটোগ্রাফির পরিভাষায় বিষয়টিকে আইএসও (ISO) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এখানে একটি সাধারণ সূত্র কাজ করে।

আইএসও যত বাড়ানো হয়, ছবির উজ্জ্বলতা ততটা বাড়ে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যাটি হচ্ছে, এটি যতটা বাড়ানো হবে, ছবিতে নয়েজের পরিমাণ ঠিক ততটা বাড়বে। কাজেই, কম আলোতে অপেক্ষাকৃত অধিক ঔজ্জ্বল্যের ছবি পাওয়া গেলেও এক্ষেত্রে আমাদের ছবির গুনের ব্যাপারে (Details) আপোষ করতেই হয়।

যত বেশি আইএসও, তত বেশি নয়েজ; Source: Flickr

 বেশি মেগাপিক্সেল, বেশি ঝামেলা

মোবাইল ক্যামেরার ক্ষেত্রে মেগাপিক্সেলের হিসাবটি একটু জটিলই বটে! ডিজিটাল ক্যামেরার ক্ষেত্রে বেশি মেগাপিক্সেলের সেন্সর বেশি ভালো ছবির ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করলেও স্মার্টফোন বা মোবাইলের ব্যাপারে কিন্তু ব্যাপারটি একটু ভিন্ন। স্মার্টফোনের ক্যামেরার সেন্সর ডিজিটাল ক্যামেরার সেন্সরের তুলনায় অনেক বেশি ছোট বলে এক্ষেত্রে হিসাবে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

ডিজিটাল ক্যামেরার লেন্সে প্রতিটি পিক্সেলের সঠিকভাবে বসা এবং কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে স্থান সঙ্কুলান হয়ে থাকে। কিন্তু মোবাইল সেন্সর এতটাই ছোট যে, এখানে অনেক বেশি পিক্সেল সঠিকভাবে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত স্থান সঙ্কুলান সম্ভব নয়। বরং হিসাবের বাইরে এখানে পিক্সেল থাকলে প্রতি পিক্সেল সঠিকভাবে আলোর সংস্পর্শে আসতে পারে না। এক্ষেত্রে পিক্সেল পরিমাপের বিষয়টিও অগোছালো বা এলোমেলো হয়ে যায়।

ডিজিটাল ক্যামেরার সাথে স্মার্টফোন ক্যামেরার সেন্সরের একটি তুলনা; Source: Android Authority

কাজেই স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে বেশি মেগাপিক্সেল দুর্দান্ত ডিটেইলের কোনো ছবির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। কোনো কোনো স্মার্টফোনে অনেক বেশি মেগাপিক্সেলের সেন্সর থাকলেও সেক্ষেত্রে পিক্সেল বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত হয়ে কাজ করে থাকে।

শট নেবার পরে

ক্যামেরায় কোনো শট নেবার অর্থ হচ্ছে, যা ধারণ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে সেন্সরে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা পৌঁছানো। এর পরে প্রসেসর প্রতিটি পিক্সেলে পৌঁছানো তথ্যগুলো একীভূত করে থাকে। পরবর্তীতে প্রসেসর থেকে ক্যামেরা সফটওয়্যারটিতে নির্দেশনা আসলে চূড়ান্তভাবে আমরা একটি ছবি দেখতে পাই।

স্মার্টফোন ক্যামেরার প্রাথমিক কিছু বিষয় সম্পর্কে পূর্ববর্তী লেখাটি পাবেন এখানে

ফিচার ইমেজ: youtube.com

Related Articles