এই সময়টায় চীনের উহানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটা প্রশমিত হয়ে আসলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সেই সাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও করোনার জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। আর করোনার আক্রমণ ঠেকানোর জন্য চীন মাত্র ১০ দিনেই একটি ১০০০ শয্যার হাসপাতাল তৈরি করে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
যদিও চীনের মতো প্রযুক্তি নির্ভর দেশের জন্য এটি নতুন কিছু নয়, কারণ এর আগেও তারা মাত্র ৬ দিনে হাসপাতাল তৈরি করে দেখিয়েছে। তবে এর পেছনে যে হাজার হাজার মানুষের শ্রম ও সাধনা রয়েছে, তা মোটেও ফেলে দেবার নয়। কিন্তু মাত্র ১০ দিনে কীভাবে একটি জাতি গোটা হাসপাতাল তৈরি করে দেখাতে পারে?
ফিরে যাওয়া যাক নভেম্বর ২০১৯ এর শেষ সপ্তাহের দিকে। ধারণা করা হয় চীনের উহানে কেউ একজন একটি বন্য প্রাণী খায় যার মধ্যে আগে থেকেই নভেল করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব ছিল। সেখান থেকেই সেই মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয়। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই এই ভাইরাস তার লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। প্রথমদিকে এটি কেবল ঠাণ্ডা এবং জ্বরের মতো লক্ষণ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে এই ভাইরাস অন্যান্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
২০১৯ এর পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়ে এই ভাইরাস উহানের মানুষজনের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু কেউই এই ভাইরাসের অস্তিত্ব টের পাননি। প্রাথমিকভাবে এটিকে নিউমোনিয়া বলে ধারণা করা হলেও, দ্রুতই বের হয়ে আসে এটি কোনো নিউমোনিয়ার সংক্রমণ নয়। এটি সম্পূর্ণ নতুন কোন এক ভাইরাসের আক্রমণ।
২০২০ এর জানুয়ারি ৮ তারিখে এই নতুন ভাইরাসকে কোভিড-১৯ বা নভেল করোনা ভাইরাস নামে চিহ্নিত করা হয়। আর এর আক্রমণের মাত্রা বুঝার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানুয়ারির ২১ তারিখ থেকে ট্র্যাকিং শুরু করে। জানুয়ারির ২১ তারিখ এই ভাইরাসের সংক্রমণ হয় ২৮২ জনের মধ্যে। পরবর্তী দিন ৩১৪ জনের অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ৩য় দিন আরও ৫৮১ জনের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ৪র্থ দিন ৮৪৬ জন, ৫ম দিন ১৩২০ জন এবং ৬ষ্ঠ দিন ২০১৪ জন নতুন এই ভাইরাসের আক্রমণের শিকার হয়।
সংস্লিষ্ট সকলেই বুঝতে পারে, সহজে এই ভাইরাসের মোকাবেলা করা যাবে না। এই ভাইরাস ইতিহাসে নাম লিখে যাওয়ার মতো ক্ষতি করতে পারে এবং বর্তমান ফলাফল তাই বলছে। করোনা ভাইরাসের মোকাবেলায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।
WHO এর ট্র্যাকিং এর শুরুতেই চীন সরকার বুঝতে পারে এই ভাইরাস দ্রুতই চারপাশে ছড়িয়ে যাবে এবং উহান হাসপাতালে সকলকে জায়গা দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। এজন্য তারা দ্রুত ১০০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল গঠনের পরিকল্পনা হাতে নেয়। ২৩ জানুয়ারি একটি সভার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় ২ ফেব্রুয়ারি থেকে হাসপাতালে রোগী ভর্তি নেয়া শুরু হবে। অর্থাৎ মাত্র ১০ দিন সময়ের মধ্যে শূন্য থেকে তারা একটি হাসপাতাল তৈরি করবে!
অবশ্য এটি চীনের জন্য নতুন কিছু না। এর আগেও ২০০৩ সালে করোনা ভাইরাসের গোষ্ঠিরই অপর একটি ভাইরাসের কারণে Severe Acute Respiratory Syndrome বা SARS এর কবলে পড়তে হয় চীনকে। তখন ৭০০০ কর্মী নিয়ে মাত্র ৬ দিনের মধ্যে শাওটাংশা হাসপাতাল তৈরি করা হয়। কিন্তু এবারের করোনা ভাইরাস আক্রমণের সাথে গতবারের বড় পার্থক্য হলো, ২০০৩ সালে প্রথম আক্রমণের প্রায় ৬ মাস পরে হাসপাতাল তৈরি করা হয়। অর্থাৎ তখন পরিকল্পনার জন্য যথেষ্ট সময় হাতে ছিল। কিন্তু এবার অল্পদিনের মধ্যেই পরিকল্পনা ঠিক করে কাজ শুরু করতে হবে।
এবার আলোচনা করা যাক কিভাবে উহানের নতুন হাসপাতাল, হুশেনশান হাসপাতাল তৈরির কাজ শুরু হলো সেটি নিয়ে। প্রথম কাজ ছিল স্থান নির্ধারণ করা। উহান নগরীর কেন্দ্র থেকে ১৪ মাইল বা ২২ কিলোমিটার দূরে একটি ফাঁকা মাঠ পাওয়া যায় যেটি হাসপাতাল নির্মানের জন্য উপযুক্ত। এই মাঠটি বাছাই করার আরেকটি কারণ হলো, এর পাশ দিয়ে একটি প্রশস্ত সড়ক গিয়েছে। হাসপাতাল নির্মাণের সময় সেই সড়ক বন্ধ করে দিয়ে সেটিকে পার্কিং লট এবং নির্মাণ সরঞ্জাম তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা হয়।
হুশেনশান হাসপাতাল নির্মাণের গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘চায়না কন্সট্রাকশন থার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো’। বিশ্বের বিখ্যাত সকল স্থাপনা নির্মাণের জন্য এরা বেশ অভিজ্ঞ। বেইজিং এয়ারপোর্ট, মিশরের রাজধানী বিনির্মান, সাংহাইতে তেসলার গিগাফেক্টরি নির্মাণের কাজ এরাই করেছিলো। এছাড়া এর আগে মাত্র ৬ দিনে শাওটাংশা হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল এদেরই হাত ধরে। তাই কেউ যদি ১০ দিনে একটি ১০০০ শয্যার হাসপাতাল তৈরি করতে পারে, তাহলে একমাত্র তারাই পারবে।
হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠের আশেপাশের গাছ কেটে এবং মাটি সমান করে সেখানের জায়গা প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীতে জানুয়ারি ২৬ তারিখ থেকে মাটির উপর এর স্তর ফেলার কাজ শুরু হয়। প্রথমে ৮ ইঞ্চি বা ২০ সেন্টিমিটার পুরু বালুর স্তর ফেলা হয়। তার উপর ফেলা হয় জিওটেক্সটাইলের একটি ফেব্রিক স্তর যার উপর পানি রোধী প্লাস্টিকের স্তর দেয়া হয়। এরপর আবার জিওটেক্সটাইলের স্তর এবং বালুর স্তর ফেলা হয়। সবশেষে ফেলা হয় কংক্রিটের স্তর। এটিই হাসপাতালটির মেঝের গঠন।
যেহেতু হাসপাতালটির জন্য মাটির নীচে আলাদা কোন খুঁটি দেয়া হয়নি, তাই মেঝের উপরের স্তর অবশ্যই হালকা উপাদানের হতে হবে। স্বল্প সময়ে বাড়ি নির্মাণের জন্য চীনের প্রচলিত নিয়ম হলো পূর্বনির্মিত নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা। সহজ ভাষায়, হুশেনশান হাসপাতালের সমস্ত দেয়াল নির্মাণ স্থলের বাহিরে অন্য কোথাও আগে থেকেই তৈরি করে রাখা হবে এবং সেগুলো এনে কেবল হাসপাতালের দেয়ালের জায়গায় বসিয়ে দেয়া হবে। এগুলো সাধারণত অ্যালুমিনিয়াম স্টিল, কাঠ, ফাইবারগ্লাস কিংবা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হয়। ওজনে হালকা হওয়ায় এগুলো বহন করা এবং ব্যবহার করা উভয়েই সময় এবং অর্থ সাশ্রয়ী।
জানুয়ারি ২৭ তারিখ থেকে অর্থাৎ নির্মাণ শুরুর মাত্র ৪ দিনের মাথায় হাসপাতালের দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এজন্য আগে কাঠ দিয়ে হাসপাতালের দেয়াল বসানোর একটি গঠন নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে সেই গঠনের উপর দেয়াল বসিয়ে দেয়া হয়। প্রায় ৭০০০ কর্মী একসাথে এই হাসপাতাল নির্মাণে কাজে হাত দেন। তারা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে হাসপাতালের সুয়েজ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও পানি ব্যবস্থার কাজ করেন। ইন্টারনেট এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য হুয়ায়ে এবং লেনোভো কাজ করে।
জানুয়ারি ২৮, ২৯ এবং ৩০ তারিখের মধ্যে হাসপাতালের অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। যেহেতু এটি করোনা ভাইরাস মোকাবেলার জন্য বিশেষভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে, তাই অধিকাংশ কেবিনই কোয়ারেন্টাইনের কথা চিন্তা করে বানানো হয়েছে। জানুয়ারি ৩১ তারিখ থেকে ফেব্রুয়ারির ২ তারিখের মধ্যে হাসপাতালের সকল সেবার নির্মাণ কাজ নিশ্চিত করা হয় এবং হাসপাতাল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সেনাবাহিনীকে তা হস্তান্তর করা হয়। ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ থেকে এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি এবং চিকিৎসার কাজ শুরু হয়।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে প্রতিদিন এই হাসপাতালের কাজের অগ্রগতি সরাসরি দেখানো হচ্ছিল। চীনা সরকারের কাছে এটি ছিল বিশ্ব দরবারে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার একটি সুযোগ। এজন্য তারা খরচের কথা চিন্তা না করে, কীভাবে স্বল্প সময়ে একটি মরনঘাতি ভাইরাসের মোকাবেলা করা যায় সেটিই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছিলো এবং এই যাত্রায় তারা বেশ দারুণভাবেই সফল হয়েছে।
চীনের মতো অন্যান্য দেশ হয়তো এরকম স্বল্প সময়ে একটি হাসপাতাল তৈরি করে দেখাতে পারবে না। কিন্তু তাদের এই সাধনা ও পরিশ্রম অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে করোনা আক্রান্ত অন্যান্য দেশগুলোর জন্য।
This is a Bengali article based on how China built a hospital in 10 days.
Feature image: CGTN
All the references are hyperlinked.