উনিশ শতকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যারা বিপ্লব নিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে এডিসন ও টেসলার নাম আমাদের সবার পরিচিত। তাদের সমসাময়িক একজন কিংবদন্তি উদ্ভাবক হওয়া সত্ত্বেও ওয়ার্নার সিমেন্সকে অনেক কম লোকই চেনেন। হয়তো তার মূল কাজের ক্ষেত্র আমেরিকা ছিল না বলেই এমনটা হয়েছে। তবে উদ্ভাবক হিসেবে সিমেন্সকে না চিনলেও, আমরা কিন্তু তার প্রতিষ্ঠা করা কোম্পানি সিমেন্সকে বেশ ভালোভাবেই চিনি। অথবা পদার্থবিজ্ঞান পড়তে গিয়ে তড়িৎ পরিবাহীতার একক হিসেবে-সিমেন্স নামটির সাথে পরিচিত হয়ে থাকবো অনেকে। প্রযুক্তিবিদ হিসেবে তার অবদান ছাড়াও, ব্যবসায়ী হিসেবেও তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছিলেন পৃথিবীতে। তার জীবন ও কাজ নিয়েই আজকের লেখাটি।
১৮১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর, বর্তমান জার্মানির প্রুশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ওয়ার্ণার সিমেন্স। দরিদ্র কৃষক বাবার চতুর্থ সন্তান ছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে তারা ভাই-বোন ছিলেন চৌদ্দজন। এ টানাটানির সংসারে বেড়ে ওঠা সিমেন্সকে অনেক কিছুই শিখিয়েছিল জীবন সম্পর্কে। তবে এর জন্যে ত্যাগও কম স্বীকার করতে হয়নি তাকে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে কোনো ডিগ্রী না নিয়েই ছাড়তে হয় মাধ্যমিক স্কুল। স্কুল ছেড়ে সতের বছর বয়সে তিনি যোগ দেন প্রুশিয়ার সেনাবাহিনীতে।
সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে তিন বছর ‘আর্টিলারি এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে’ পড়াশোনা করার সুযোগ পান তিনি। এখানে তিনি পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান ও গণিতের ওপর উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। বিজ্ঞানের সান্নিধ্যে এসে যেন এক নতুন দুনিয়া খুলে যায় তার সামনে, যা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল তার জীবনের গতিপথ। এরপর আর সামরিক বাহিনীতে ক্যারিয়ার তৈরির কোনো ইচ্ছা রইলো না তার। তিনি সামরিক বাহিনীতে চাকরির বিষয়টিকে দেখেছিলেন প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ লাভের উপায় হিসেবে। তাছাড়া নিজের চাহিদামতো কাজ পাওয়ার আগ পর্যন্ত ভরণ-পোষণের একটা ব্যবস্থাও তো রাখতে হবে।
১৮৩৭ সালের দিকে তিনি সামরিক বাহিনীর সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট হন। ১৮৩৮ সালে তার প্রশিক্ষণ শেষ করে যোগ দেন নিজের ইউনিটের সাথে। সব ঠিকঠাকভাবেই চলছিলো বলা যায়। কিন্তু এ সময় ভাগ্য যেন আবার মুখ ফিরিয়ে নিল তার থেকে। ১৮৩৯ সালের জুলাইয়ে তার মা ও ছয় মাসের ব্যবধানেই তার বাবা মৃত্যুবরণ করেন। ছোট দশজন অনাথ ভাই-বোনের দায়িত্ব এসে পড়ে ওয়ার্নারের কাঁধে। ছোট ভাই উইলিয়ামকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন আরো আগেই। এ সময়ে বাকিদের জন্যে কিছু করার তাগিদও তীব্রভাবে অনুভব করতেছিলেন তিনি।
সামরিক বাহিনীর অন্য অফিসারদের মতো সিমেন্স তাস খেলে বা আড্ডা দিয়ে অবসর সময় কাটাতেন না। অবসরে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেই কাটতো তার সময়। এ সময় ধাতব পদার্থের ওপর প্রলেপ দেওয়ার একটি কৌশল উদ্ভাবন করেন তিনি। এজন্য ১৮৪২ সালে তিনি প্রথম প্যাটেন্টের স্বত্বাধিকারী হন। সামরিক বাহিনীতে তার পদেরও পরিবর্তন ঘটে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় তার দক্ষতা দেখে বার্লিনের আর্টিলারি ওয়ার্কশপে নিযুক্ত করা হয় তাকে।
সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হওয়ার কারণে ওয়ার্নারের জন্যে তার উদ্ভাবন বাজারজাত করা কঠিন ছিল। এ দায়িত্ব অর্পিত হয় তার ভাই উইলিয়ামের ওপর। ক্রেতার সন্ধানে উইলিয়াম ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। বেশ চড়া দামে প্যাটেন্টটি বিক্রি করতেও সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। এ সফলতা ওয়ার্নারকে নতুন করে উৎসাহিত করে বিজ্ঞানে মনোযোগ দিতে। পাশাপাশি তার আরো তিন ভাই কার্ল, ফ্রেডরিখ ও ওয়াল্টারকে নিয়ে আসেন বার্লিনে।
এ সময় যোগাযোগখাতে টেলিগ্রাফের গুরুত্ব বুঝতে পেরে প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীও নিজেদের টেলিগ্রাফ তৈরি করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ওয়ার্নার মনোযোগ দেন টেলিগ্রাফের দিকে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একটি নতুন ধরনের পয়েন্টার টেলিগ্রাফ উদ্ভাবন করেন। তার ব্যবস্থায় দুটি টেলিগ্রাফকে বৈদ্যুতিকভাবে সমলয় (Synchronize) করা হতো, একটিতে কোনো অক্ষরের বাটন চাপলে অন্য দিকে পয়েন্টারটি সেই অক্ষরের দিকে নির্দেশ করতো। ওয়ার্নারের টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার ডিজাইন সেসময়ের অন্য সব ব্যবস্থা থেকে অনেক উন্নত ছিল।
একত্রিশ বছর বয়সে ওয়ার্নার সিমেন্স টেলিগ্রাফের ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার ডিজাইন অনুসারে টেলিগ্রাফ নির্মাণের জন্যে একজন দক্ষ মেকানিকের দরকার ছিল। সেই খোঁজ করতে গিয়ে তিনি পরিচিত হন জোহান জর্জ হালসকের সাথে। হালসকে সফলভাবে ওয়ার্নারের টেলিগ্রাফ ব্যবস্থাটি তৈরি করতে সক্ষম হন। প্রযুক্তিগত দিক থেকে তখন তারা কোম্পানি শুরু করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাদের দুজনের কারো কাছেই পর্যাপ্ত মূলধন ছিলো না। তাই মূলধন নিয়ে তৃতীয় পার্টনার হিসেবে যুক্ত হন ওয়ার্নারের চাচাতো ভাই জোহান জর্জ সিমেন্স। শুরু হয় সিমেন্স-হালসকে টেলিগ্রাফ কোম্পানির যাত্রা।
প্রুশিয়ায় টেলিগ্রাফ স্থাপন করা শুরু হলে সেই দায়িত্ব পায় তাদের কোম্পানি। বার্লিন থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপন করেন তারা। ব্যবসার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে ১৮৪৯ সালে সামরিক বাহিনী থেকে অব্যহতি দেন ওয়ার্নার সিমেন্স। তিনি তার ব্যবসাকে কেবলমাত্র জার্মানির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। তার নজর ছিল গোটা পৃথিবীর দিকে। সে উদ্দেশ্যেই তার আরো দুই ভাই কার্ল ও ফ্রেডরিখ লন্ডনে পাড়ি জমালেন উইলিয়ামের সাথে যোগ দিতে। সিমেন্স-হালসকে টেলিগ্রাফি কোম্পানির আন্তর্জাতিক বিস্তারের দায়িত্ব নিলেন তারা।
তার ভাইরা গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্ব নেওয়ায় ব্যবসার ক্ষেত্রে বেশ সুবিধা হয়েছিল। ওয়ার্নার তার ভাইদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারতেন। বিশেষত কার্লের ওপর তার ভরসা ছিল বেশি। কার্ল প্রথমত বার্লিনে, পরে লন্ডন, প্যারিস ও সেন্ট পিটাসবার্গে কোম্পানির দায়িত্ব পালন করেন। তারা শীঘ্রই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশাল সব কাজ বাগিয়ে আনতে সক্ষম হন। রাশিয়ায় বাল্টিক সাগর থেকে কৃষ্ণ সাগর পর্যন্ত টেলিগ্রাফের চুক্তি পান তারা। গ্রেট ব্রিটেনে লন্ডন থেকে কলকাতা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ স্থাপনের বিশাল প্রকল্পের দায়িত্বও পায় সিমেন্সের টেলিগ্রাফ কোম্পানি। এ সময় টেলিগ্রাফিতে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের যন্ত্রপাতি তারা নিজেরাই তৈরি করতেন। এমনকি ফ্যারাডে নামের তাদের একটি জাহাজও ছিল। ছয়টি ট্রান্স-আটলান্টিক টেলিগ্রাফ ক্যাবল স্থাপন করা হয়েছিল সেটির সাহায্যে।
ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য দাঁড় করিয়ে ফেললেও ওয়ার্নার প্রযুক্তি নিয়ে হাতে-কলমে কাজে করতেই বেশি ভালোবাসতেন। ১৮৬৭ সালের দিকে তিনি আরেকটি বৈপ্লবিক উদ্ভাবন করেন। এবার তিনি কাজ করেন জেনারেটর নিয়ে। ব্যবহারের উপযোগী জেনারেটর তখনও নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল এতে ব্যবহার করা দুর্বল চুম্বক। ওয়ার্নার এ সময় জেনারেটরে তড়িৎ-চুম্বক ব্যবহারের কৌশল উদ্ভাবন করেন। এটি ব্যবহারেরর ফলে জেনারেটর উদ্ভাবনের পথে বিশাল অগ্রগতি সম্ভব হয়।
জেনারেটর ও মোটর উদ্ভাবনের পরে বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি এক নতুন মাত্রা পায়। টেলিগ্রাফ ও অন্যান্য ব্যবস্থায় ব্যাটারির বদলে জেনারেটর ব্যবহৃত হতে শুরু করে। এডিসন, ওয়েস্টিংহাউসসহ আরো কয়েকজন উদ্ভাবক, বৈদ্যুতিক আলোকায়ন ও বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে পৃথিবীকে নিয়ে আসেন বৈদ্যুতিক যুগে। এ সময় বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্রে সিমেন্সের কোম্পানি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।
এছাড়া বৈদ্যুতিক যানবাহন খাতেরও অগ্রদূত ছিল সিমেন্সের প্রতিষ্ঠান । ১৮৭৬ সালে প্রথম স্ট্রিট-ট্রলি বাজারে আনে সিমেন্স। ১৮৭৯ সালে তৈরি করে পৃথিবীর প্রথম বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন। ইউরোপ মহাদেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ রেলওয়েটিও তাদের তৈরি। চীনের বেইজিংয়ে তারা তৈরি করেছিল স্ট্রিট-ট্রলি লাইন। এ সময় যেন পৃথিবীর সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল ওয়ার্নার সিমেন্সের প্রতিষ্ঠানটি।
শুধু প্রযুক্তিগত দিক থেকেই নয়, সামাজিক ও কর্পোরেট ম্যানেজমেন্টের দিক থেকেও ওয়ার্নার সিমেন্স পৃথিবীতে অসাধারণ সব দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ১৮৫৮ সালে তিনি সর্বপ্রথম কর্মীদের সাথে লভ্যাংশ শেয়ার করার ব্যবস্থা চালু করেন। ১৮৭২ সালে শুরু করেন অবসর-তহবিল ও জীবনবীমা ব্যবস্থা। এর আগে কোনো কোম্পানি বা সরকার কর্মীদের কল্যাণের জন্যে এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এছাড়া সিমেন্সই প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি কর্মীদের জন্যে দৈনিক সাড়ে ৮ ঘন্টা ও সাপ্তাহিক ৫০ ঘন্টার কাজের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেন।
একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে তার ব্যবস্থাপনা এতটাই অসাধারণ ছিল যে, অনেক কোম্পানিই তখন তার আদলে নিজেদের পরিবর্তন করে নিতে শুরু করে। জে পি মরগান যখন জেনারেল ইলেকট্রিককে নতুন করে সাজান, তখন তিনি সিমেন্সের কোম্পানিকে অনুসরণ করেছিলেন। মেইজি পুনরুত্থানের সময় যখন জাপানের অর্থনীতি নতুন করে বিকশিত হতে শুরু করে, তখন সফল ও অভিজাত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত হয়েছিল সিমেন্সের আদলে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোই পরবর্তীতে জাপানের শক্তিশালী প্রযুক্তি শিল্পের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে।
ওয়ার্নার সিমেন্স মৃত্যুবরণ করেন ১৮৯২ সালে। নিজের ৭৬ বছরের জীবনে তিনি রেখে গিয়েছেন অনুকরণীয় সব দৃষ্টান্ত। দশজন ভাই বোনের দায়িত্ব নিয়ে সিমেন্স দেখিয়েছেন কীভাবে একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক হতে হয়। তিনি যেভাবে নিজের জ্ঞানতৃষ্ণা মিটিয়েছেন, এগিয়েছেন উদ্ভাবনের পথে- তা সকলের জন্যেই ভীষণ অনুপ্রেরণার। আর উদ্যোক্তা ও শিল্পপতি হিসেবে তার রেখে যাওয়া দৃষ্টান্ত তো সবসময়ের জন্যই অনুকরণীয়।
This article is in Bangla language. It's about biography of great inventor and industrialist werner von siemens.
References:
1) Conquering the Electron by Derek Cheung, Eric Brach, page (100-102).
2) Lifelines: Werner von siemens
For more references check hyperlinks inside the article.
Featured Image: twitter.com/siemens