Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লিসা সু: যে সিইও পাল্টে দিয়েছেন এএমডির ভাগ্য

বর্তমান প্রযুক্তি জগতে এএমডি একটি বাজারকাঁপানো নাম। অথচ ২০১৩ সালে এই কোম্পানিই দেউলিয়া হতে চলছিল, শেয়ারবাজারে প্রতি শেয়ারের দাম ছিল ২ ডলার যা কোম্পানির ইতিহাসে সর্বনিম্ন। কোম্পানি বাঁচাতে একদিকে ঢালা হচ্ছিল অজস্র অর্থ, অন্যদিকে বাড়ছিল ঋণের পরিমাণও। কিন্তু কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছিল না, অবশেষে ভঙ্গুর এক পরিস্থিতিতে সিইও হিসেবে নিয়োগ পান লিসা সু। আর তারপর বাকিটা ইতিহাসই বলা যায়। প্রযুক্তিখাতের ইতিহাসে লিসা সুর হাত ধরে তৈরি হলো নতুন এক অধ্যায়। সেদিনের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এএমডির শেয়ার আজ বেড়েছে ২০ গুনেরও বেশি। চলুন শোনা যাক লিসা সুর ইতিহাস বদলে দেয়ার গল্প।

সেমিকন্ডাক্টরের শহর থেকে সিলিকন ভ্যালি

ড. লিসার জন্ম ১৯৬৯ সালে তাইওয়ানের তাইনান শহরে হলেও জন্মের তিন বছর পরেই তার পরিবার তাকে নিয়ে পাড়ি দেয় যুক্তরাষ্ট্রে। পারিবারিকভাবে ছোট থেকেই তাকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে উৎসাহ দেয়া হয়েছিল। তার বাবা ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত পরিসংখ্যানবিদ এবং মা ছিলেন একজন হিসাবরক্ষক, যিনি পরবর্তীতে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। মায়ের কাছে থেকেই ব্যবসার নানা দিক সম্পর্কে তিনি ধারণা পান। নিজেকে লেখা এক চিঠিতে লিসা সু বলেন, ছোট থেকেই তার ইলেক্ট্রনিক জিনিসের উপর কৌতূহল ছিল। ১০ বছর বয়সে ভাইয়ের রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি খুলে ফেলে ঠিক করার অনুভূতিও নেহাত কম অনুপ্রেরণা দেয়নি তাকে!

১৯৮৬ সালে ব্রনক্স হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞানে পড়াশোনা করে সেবছরই এমআইটি-তে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। যদিও শুরুতে খানিক দ্বিধায় ছিলেন যে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নিবেন না ইলেক্ট্রিক্যাল এবং শেষপর্যন্ত ইলেক্ট্রনিক জগতই বেছে নেন। লিসা সু নিঃসন্দেহেই একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। গ্রাজুয়েশন চলাকালেই তিনি বিভিন্ন রিসার্চ প্রোগ্রামে যোগ দেন। গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে ১৯৯১ সালে তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েশন এবং ১৯৯০-৯৪ সাল পর্যন্ত পিএইচডির জন্য কাজ করেন।

পিএইচডি সম্পন্ন করে লিসা সু যোগদান করেন টেক্সাস সেমিকন্ডাক্টর নামক এক কোম্পানিতে। তবে মাত্র ৭ মাস সেখানে থাকতেই তৎকালীন অন্যতম সেরা কোম্পানি আইবিএম-এ ভাইস প্রেসিডেন্ট অফ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট পদের জন্য ডাক পান, যা বলেই দেয় ২৬ বয়সী এই নারী তখন কতটা গুণসম্পন্ন ছিলেন।

আইবিএম কোম্পানিতে রিসার্চ ম্যানেজার হিসেবে লিসা সু; Image Source: insight.stanford.edu

তার হাত ধরেই প্রসেসরের ভেতর আলুমিনিয়ামের বদলে কপারের কানেক্টর ব্যবহার শুরু হয় যা তৎকালীন প্রসেসরের কার্যক্ষমতা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করে। এছাড়া তার গবেষণার মাধ্যমে একটি গেমিং মাল্টি-প্রসেসর তৈরি করা হয় সনির প্লেস্টেশন-৩ এর জন্য যা সেসময় ছিল প্রথম। কিন্ত দুর্ভাগ্যবসত সেসময় এই আইডিয়া ততটা জনপ্রিয় হতে পারেনি। ২০০৭ সালে লিসা আইবিএম ছেড়ে ফ্রি-স্কেল সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিতে যোগদান করেন। সেখানে তিনি এমবেডেড চিপ নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং এ ধরনের চিপের নতুন একটি মডেল প্রণয়ন করেন।

২০১২ সালে লিসা সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে এএমডিতে যোগদান করেন এবং মাত্র ২ বছরের মাথায় তিনি হয়ে যান কোম্পানিটির ইতিহাসে প্রথম নারী সিইও। তার স্বপ্নপূরণের মাধ্যমেই এরপর শুরু হয় দিন বদলের পালা।

অন্ধকার দিনের এএমডি

২০১২ সালে লিসা যখন এএমডির সিইও হিসেবে যোগ দেন তখন অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দু’দিক দিয়েই এএমডির অবস্থা বেহাল। শুধু নেট লসই হয়েছিল ১ বিলিয়ন ডলারের মতো। এছাড়া একই বছরে কোম্পানিটি তার ২৫ শতাংশ কর্মী ছাটাই করে টিকে থাকার জন্য। ২০১৩-তে আরো ধস নামে, স্টক মার্কেটে শেয়ারমূল্য কমে যায় ৬০ শতাংশ। ক্যাশ রিজার্ভের পরিমাণ ১ বিলিয়ন থেকে নেমে আসে ৭৮৫ মিলিয়নে। সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনার অবশেষে তারা ২ বিলিয়ন লোন নেয়। কিন্তু পরিস্থিতি যেন দেউলিয়ার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল।

সেই সময়ে এএমডির ক্ষতির পরিমাণ; Image Source: Tech PowerUP

একদিকে ডেক্সটপ চিপ বাজারে এএমডির মার্কেট শেয়ার নেই বললেই চলে, অন্যদিকে জিপিউ মার্কেটও নড়বড়ে। সদ্য সম্ভাবনাময় মোবাইল চিপ নির্মাণেও নেই কোনো সম্ভবনা। এমতাবস্থায় লিসা সু লেগে পড়লেন পুরো কোম্পানিকে পুনরায় গোছাতে।

প্রথমে তিনি কর্মীদের দুটি গ্রুপে ভাগ করেন। একটি দলের কাজ ছিল পিসি প্লাটফর্ম, গ্রাফিক্স, ভিআর নিয়ে, এবং আরেকদলের কাজ ছিল এন্টারপ্রাইজ, সার্ভার, গেমিং কনসোল, ক্লাউড ও নেটওয়ার্কিং নিয়ে। লিসাকে যখনই তার সাফল্যের পিছনের কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো তার উত্তর ছিলো খুবই সাধারণ,

সেরা প্রোডাক্ট তৈরি করা, ভোক্তাদের সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করা, এবং যা-ই করা হোক না কেন সেটা সহজভাবে করা।

বর্তমানে Zen 4 নিয়ে কাজ করছে AMD; Image Source: Gadget 360

তিনি একটি প্রোডাক্ট রোডম্যাপ তৈরি করেন যা পরবর্তী সময়ে অন্তত সফলভাবে মেইন্টেইন করেন। তার আসার আগে এএমডির লক্ষ্য ছিল কম শক্তিসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন। কিন্তু তিনি এই মোড় ঘুরিয়ে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন এবং সব পর্যায়ের পণ্য উৎপাদন শুরু করেন। এর পুরোটাই সম্ভব হয়েছে জোরালো গবেষণা এবং ঝুঁকি নেয়ার মাধ্যমে। কারণ যেখানে তার কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ায় দোরগোড়ায় সেখানে ২০১৩-১৬ পর্যন্ত এএমডি কোনো সিপিউ বাজারে ছাড়েনি। এই সময়ে ইন্টেল ডেস্কটপ, ল্যাপটপসহ প্রতিটি খাতেই বাজার দখল করে নেয়। এছাড়া প্রতিবছর নতুন প্রসেসর বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে এএমডির সাথে একটা জেনারেশন গ্যাপও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এএমডি যদি শক্তিশালি কিছু নিয়ে না ফিরতে পারত তাহলে হয়তো আজকে এএমডির কোনো অস্তিত্বই থাকত না।

চিপ কোম্পানিগুলো টিক-টক নিয়মে চলে। এই নিয়মে এক বছর শুধু ম্যানুফ্যাকচারিং নিয়ে কাজ করা হবে এবং পরের বছর চিপ ডিজাইনকে উন্নত করা নিয়ে। এই টিক-টকের উদ্দেশ্য হচ্ছে সহজেই ত্রুটি নির্ণয় ও ডেভেলপমেন্ট বজায় রাখা। যদি কোনো কারণে কিছু কাজ না করে তাহলে যাতে সহজেই বোঝা যায় সমস্যা চিপ ডিজাইনে না ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে।

টিক-টক মডেলের ধারণা; Image Source: Wccftech.com

কিন্তু এএমডির জন্য তখন টিক-টক নিয়মে চললে হবে না, কারণ হাতে সময় কম। লিসা পুরোনো সব ফেলে দিয়ে লেগে পড়লেন নতুন চিপ ডিজাইনে আর ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হলো TSMC-কে। এটাই ঘুরিয়ে দিলো মোড়। কাজে দিল এএমডির মাল্টিকোর নিয়ে পুরো গবেষণাও। এছাড়া লিসাও তো একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, সবকিছুই চলতে লাগল টাইমলাইন অনুযায়ীই।

২০১৭-তে যখন রাইজেন উন্মোচন করা হয় তখন ৫ বছরে প্রথমবারের মতো এএমডি নেট প্রফিট অর্জনের ঘোষণা দেয়। ২০১৮-তে আরো ১ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব যোগ হয়। ২০২০ এ এসে মোট রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯.৭ বিলিয়ন ডলারে যা ধারণা করা হচ্ছে ২০২১ সালে খুব সহজেই ১০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। পিসিমার্ক অনুযায়ী ১৫ বছরে প্রথমবার ৫০.৮ শতাংশ বাজার দখল করে এএমডি ডেস্কটপ বাজারে ইন্টেলকে ছাড়িয়ে গেছে, যা ২০১৭ তে ছিল ১১ শতাংশ। আর মোট শেয়ারমূল্য বেড়েছে ১,৩০০ গুণ।

২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এএমডির রাজস্ব বৃদ্ধি (মিলিয়ন ডলারে) Image Source: AnandTech.com

অদ্যম্য লিসা সু

এএমডি যে শুরু থেকেই ইন্টেলের পেছনে ছিল এমনটা কিন্তু নয়। তারা এর আগেও ইন্টেলকে ছাড়িয়ে যায় এবং ৬৪ বিট আর্কিটেকচারের মতো যুগান্তকারী কিছু জিনিসের আবিষ্কার করে। কিন্তু তারা তখন ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেনি যা লিসা করে যাচ্ছেন। ইন্টেল ল্যাপটপ বাজার এতটাই শক্তিশালীভাবে হাতিয়ে নিয়েছে যে রাইজেন ভালো হলেও অনেক ল্যাপটপ ম্যানুফ্যাকচারার এএমডির উপর ভরসা করতে পারেনি। যদিও ২০২১ এ এসে চিত্র অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। কিন্তু ২০১৭ সালের পর শুধু ৪ বছর লাগছে একটি বিশাল ডিভাইস নির্মাতাদের বিশ্বাস অর্জন করতেই।

এএমডির সাথে যেসব কোম্পানির পুরনো সম্পর্ক ছিল (যেমন- মাইক্রোসফট, সনি), সেসবও এ সময়ে এসে জোরদার হয়। ফলে মাইক্রোসফট ও সনির নতুন কনসোল উভয়ই ব্যবহার করছে এএমডির চিপ। এছাড়া এএমডির চিপগুলো এতটাই আশাজাগানিয়া ছিল যে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জি তাদের সুপার কম্পিউটারে এএমডির চিপ ব্যবহার করা শুরু করে। এছাড়া লরেন্স ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি তাদের সুপারকম্পিউটারে এএমডির চিপ ব্যবহার করবে।

তবে বিগত ২০২০ সালে এবং বর্তমান বছরে এএমডির সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিপ সংকট। যেহেতু এএমডির কোনো নিজস্ব ফ্যাব্রিকেশন প্লান্ট নেই এবং পুরোটাই নির্ভর করে TSMC এর উপর, আবার TSMC বড় অনেক কোম্পানিরই চিপের যোগান দেয়, তাই চাহিদামতো চিপ পাচ্ছে না এএমডি। ইন্টেলের মতো এএমডিরও নিজস্ব ফ্যাব্রিকেশন প্লান্ট ছিল, কিন্তু ২০১৬-তে অর্থ সংকটের জন্য তারা সেগুলো বিক্রি করে দেয়। চিপ সংকট নিয়ে লিসাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 

আমরা আমাদের প্রসেসরগুলোর আশাতীত ডিমান্ড পাচ্ছি, কিন্তু সেই অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছি না। এমতাবস্থায় চিপ ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টগুলোর পরিসর আরো বৃদ্ধি করতে অন্য সব চিপনির্ভর কোম্পানিকে এগিয়ে এসে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। 

২০০৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এএমডির মার্কেট শেয়ার; Image Source: Notebookcheck.net

শুধু সিপিইউ সেক্টরেই নয়, জিপিইউ জগতেও এএমডি তাদের হারানো মার্কেট শেয়ার ফিরে পেতে শুরু করেছে। কিন্তু এনভিডিয়া শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় এই খাতে এএমডির আগাতে আরো খানিকটা সময়ের প্রয়োজন।

পরিশেষে এটি বলাই যায় যে, এএমডির বর্তমান অবস্থান পুরোটাই প্রায় লিসা সুর সময়োচিত সিদ্ধান্তের ফল। শুধু তা-ই নয়, তিনি দেখিয়েছেন যে শুধুমাত্র একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়েও টেক ইন্ডাস্ট্রিতে সফলতা অর্জন করা যায়। ২০১৮ সালে তিনি ন্যাশন্যাল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ নির্বাচিত হন এবং Dr. Moris Chang Exemplary Leadership Award জিতে নেন। ফরচুন ম্যাগাজিন তাকে নির্বাচিত করে One of the most powerful Women in Business হিসেবে, এবং ২০২০ সালে Business person of the year এ দ্বিতীয় অবস্থানে জায়গা করে নেন লিসা। এসব ছাড়াও আরো অসংখ্য পুরস্কার জেতেন তিনি।

লিসা সুর আগমনে টেক ইন্ডাস্ট্রিতে একপাক্ষিক প্রভাব কমেছে এবং পূর্বের চেয়ে আরো আধুনিক পণ্য বাজারে আসছে যা ভোক্তাদের জন্য একটি খুশির সংবাদ। আশা করা যায় বর্তমান চিপ সংকট পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতেও তার নেতৃত্ব কাজে আসবে।

Related Articles