Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেডিকেল সেলফি: হাতের স্মার্টফোন দিয়েই সম্ভব রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা

ছবি তোলাকে ডাল-ভাতে পরিণত করেছে যে যন্ত্রটি, সেটি হলো আমাদের হাতের মোবাইল ফোন। এর মাধ্যমে যখন খুশি, যেভাবে খুশি; নিজের, প্রিয়জনের কিংবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ছবি তুলতে পারি আমরা। শুধু তা-ই নয়, ইন্টারনেটের কল্যাণে মুহূর্তের ভিতর সেই ছবি অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করেও নিতে পারি, আয় করতে পারি শয়ে শয়ে লাইক-কমেন্ট-রিয়েকশন। কিন্তু একটু গভীরে চিন্তা করলেই দেখা যাবে, মোবাইল ফোন দিয়ে সর্বক্ষণ ছবি তোলা ও তা অনলাইনে আপলোড করা আমাদেরকে আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক বা আত্মপ্রেমী করে তোলা ছাড়া, বিশেষ আর কোনো উপকারে আসছে না। অথচ অনেকেই হয়তো জানেন না, মোবাইলের ছবি তোলা ও তা অনলাইনে আপলোডের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই সম্ভব বেশ কিছু মারাত্মক রোগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসা। এবং এই বিশেষ ব্যবস্থার নামই হলো মেডিকেল সেলফি।

যেভাবে শুরু

ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজের অধীনে দেশটির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা ছিলেন জোনাথান আদিরি। একবার তার মা ও বাবা গিয়েছিলেন চীন ভ্রমণে। সেখানে গিয়ে একটি দুর্ঘটনার শিকার হন তার মা। পড়ে গিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য চেতনাও হারান তিনি। প্রাথমিক ডায়াগনোসিসের পর জানা যায়, কয়েকটি পাঁজর ভেঙে গেছে তার, এর বেশি গুরুতর কিছু নয়। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য তাকে হংকংয়ে নিয়ে যাওয়ার।

কিন্তু জোনাথানের বাবা একটু বেশিই খুঁতখুঁতে। চিকিৎসকদের কথায় মন থেকে সায় পাচ্ছিলেন না তিনি। তাই স্ত্রীর আঘাতের সিটি (কম্পিউটারাইজড টোমোগ্রাফি) স্ক্যানের ছবি তুলে, ছেলেকে মেইল করে পাঠিয়ে দেন তিনি। জোনাথান সেই ছবিগুলো দেখান এক ট্রমা চিকিৎসককে। সেই চিকিৎসক ছবিগুলো দেখামাত্রই রায় দেন, ফুটো হয়ে গেছে রোগীর ফুসফুস। এই অবস্থায় তাকে হংকংগামী প্লেনে চড়ানো হলে মৃত্যুও হতে পারে তার।

জোনাথান আদিরির হাত ধরে গড়ে উঠেছে Healthy.io; Image Source: Healthy.io

কিন্তু ভাগ্য অতি সুপ্রসন্ন জোনাথানের মায়ের। তার স্বামী ঠিক সময়ে ছবিগুলো তুলে ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন, আর ছেলেও সেগুলো নিয়ে যোগ্য লোকের কাছে পৌঁছেছিলেন। স্বামী-পুত্রের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে জীবন বেঁচে গিয়েছিল তার।

নিজের জীবনে ঘটা এই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত হন ইসরায়েলি উদ্যোক্তা জোনাথান। তিনি চিন্তা করেন, স্মার্টফোনকেই তো পরিণত করা যায় একটি কার্যকরী মেডিকেল গ্রেড ডায়াগনস্টিক যন্ত্রে। আর তার এই উদ্ভাবনী চিন্তার ফলেই জন্ম হয় Healthy.io-এর, যেটি বিবেচিত হয় মেডিকেল সেলফির পথিকৃৎ হিসেবে।

মূত্র পরীক্ষায় যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা

Healthy.io-এর প্রথম প্রোডাক্ট হলো একটি ইউরিন টেস্ট কিট, যা দিয়ে মূত্রের মাধ্যমে সংক্রমিত ইনফেকশন, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা প্রভৃতি রোগের নির্ভূল নির্ণয় করা সম্ভব।

এক্ষেত্রে আদর্শ মূত্র পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয় একটি বিশেষ ডিপস্টিক, যাতে দশটি ছোট ছোট প্যাড থাকে। যখনই তারা মূত্রের নমুনায় বিভিন্ন সারবস্তু যেমন রক্ত, সুগার বা প্রোটিনের অস্তিত্ব শনাক্ত করতে পারে, তখনই তাদের রঙের পরিবর্তন হয়। সাধারণত একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্লিনিশিয়ান এই রঙের পরিবর্তন খালি চোখে পর্যবেক্ষণ করে থাকে, কিন্তু Healthy.io‘র স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন সেই কাজটিই করতে পারে আরো নির্ভুলভাবে, এবং এক্ষেত্রে সেটি ব্যবহার করে কম্পিউটার ভিশন অ্যালগরিদম।

Healthy.io নতুন মাত্রা যোগ করেছে মূত্র পরীক্ষায়; Image Source: Healthy.io

এ কাজটিকে আরো সহজ করে তুলতে রয়েছে একটি স্মার্টফোন চ্যাটবটও, যার নাম এমিলি। এটি ব্যবহারকারীদেরকে ভয়েস, টেক্সট ও ভিডিওর মাধ্যমে বিভিন্ন কীভাবে কী করতে হবে সে সংক্রান্ত বিশদ দিক-নির্দেশনা প্রদান করতে থাকে। আর এভাবেই মূত্র পরীক্ষায় যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা।

ব্যবহার বিধি

রোগীকে ডিপস্টিকটি একটি কালার-কোডেড কার্ডবোর্ড ফ্রেমের মধ্যে প্রবেশ করাতে হয়। এরপর তাকে পুরো জিনিসটি ফোনের মাধ্যমে স্ক্যান করাতে হয়। স্ক্যানকৃত ছবিটি ক্লাউডে চলে যায়। সেখানে ছবিটি বিশ্লেষিত হয়ে ফলাফল পাঠিয়ে দেয় রোগীর চিকিৎসকের কাছে।

এভাবেই ডিপস্টিক স্ক্যান করা হয়; Image Source: Healthy.io

চিকিৎসাক্ষেত্রে অমিত সম্ভাবনা

জোনাথান আদিরির মতে, “এটি কোনো রোগ সারাবার ডিভাইস নয়, এটি একটি মেডিকেল ডিভাইস,” যা ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রেগুলেটর্সের অনুমোদন লাভ করেছে।

যেহেতু এভাবে পরীক্ষাটি খুব সহজেই ঘরে বসে করে ফেলা সম্ভব, তাই এর পক্ষে সম্ভব স্বাস্থ্যখাতকে প্রতিবছর শত মিলিয়ন ব্যয়ের হাত থাকে রক্ষা করা। এর মাধ্যমে যেকোনো রোগ একদম প্রাথমিক অবস্থায়ই নির্ণয় করে ফেলা যায় বলে, দেরিতে রোগ নির্ণয়ের ফলে চিকিৎসা করতে যে পরিমাণ খরচ হতো, তার চেয়ে অনেক কম খরচেই রোগ নিরাময় সম্ভব।

স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন ও কিটটির দাম একত্রে ৯.৯৯ পাউন্ড, যা ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী লক্ষাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ফার্মেসি চেইন বুটস কর্তৃক এই মুহূর্তে ব্যবস্থাটি পরীক্ষাধীন অবস্থায় রয়েছে। আর দেশটির ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস এটি ব্যবহার করছে কিডনি সংস্থাপন ও ডায়াবেটিস রোগীদের মনিটরিং করার কাজে।

অন্ধত্ব দূরীকরণেও কাজে আসতে পারে ব্যবস্থাটি

এই ব্যবস্থাটির তাৎপর্যের পেছনে মূল কারণ হলো স্মার্টফোন ব্যবহার। একে তো স্মার্টফোন এখন মানুষের হাতে হাতে ঘুরছে, এছাড়াও “স্মার্টফোনের রয়েছে ব্যাপক কম্পিউটেশনাল শক্তি, হাই-রেজোলিউশন স্ক্রিন, চমৎকার ক্যামেরা, এবং সবচেয়ে বড় কথা, এর মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে কানেকটেড থাকা সম্ভব,” বলছিলেন পিক ভিশন নামক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সহজে চোখ পরীক্ষায় নিয়োজিত একটি প্রযুক্তি কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, ড. অ্যান্ড্রু বাস্টাওরাস।

কেনিয়ায় পিক অ্যাকিউইটি নিয়ে অ্যান্ড্রু বাস্টাওরাস; Image Source: Rolex Joan Bardeletti

তিনি আরো বলেন, এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী ৩৬ মিলিয়ন মানুষ অন্ধ, যাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই অন্ধত্বের কারণ সহজেই চিকিৎসাযোগ্য বিভিন্ন রোগ, কিন্তু সঠিক সময় সেসব রোগ নির্ণয় করা যায়নি বলেই আজ তাদের এই অবস্থা। যদি আরো আগেই তাদের ডায়াগনোসিস করা যেত, তাহলে তাদের অধিকাংশেরই দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করা সম্ভব হতো।

পিক ভিশনের চোখ পরীক্ষার অ্যাপ্লিকেশন

চোখ পরীক্ষার জন্য পিক ভিশন যে স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশনটি বানিয়েছে, তার নাম পিক অ্যাকিউইটি। এটি স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ইংরেজি ‘ই’ (E) বর্ণটি দেখায়, এবং পরীক্ষা চলাকালীন সেটির আকার ও ঝোঁক পরিবর্তন করতে থাকে। রোগীর কাজ হলো সে যেদিকে মনে করে বর্ণটি নির্দেশ করছে, নিজেও সেদিকে নির্দেশ করবে এবং স্ক্রিন সেদিক বরাবর সোয়াইপ করবে। এ থেকে অ্যাপ্লিকেশনটি নির্ধারণ করবে রোগীর উত্তর ঠিক না ভুল। ফলাফল ক্লাউডে জমা হয়ে থাকবে, এবং নিকটস্থ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্লিনিশিয়ানের কাছে পৌঁছে যাবে।

বুঝতেই পারছেন, অ্যাপ্লিকেশনটির ডিজাইন করা হয়েছে খুবই সাদামাটাভাবে, যাতে করে যে কেউ এটি ব্যবহার করতে পারে। অ্যাপ্লিকেশনটি কীভাবে কাজ করে তা বুঝে নিতে একজনের সময় লাগবে বড়জোর পাঁচ মিনিট, এবং এরপর সে নিজেই নিজের চোখ পরীক্ষা করতে পারবে।

সাধারণত একজন ব্যক্তি পৃথিবীটাকে কীভাবে দেখছে, তা খুব সহজে নিরূপণ করা যায় না। কিন্তু ফোনের ক্যামেরা সেটিও করতে পারে, এবং এর ফলে অভিভাবকদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় তাদের সন্তান চোখের সমস্যায় ভুগছে কি না। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন চ্যারিটি সংস্থা ও সরকারি অনুদানের ভিত্তিতে পিক অ্যাকিউইটি ব্যবহার করে কেনিয়া, বতসোয়ানা ও ভারতের আড়াই লাখেরও বেশি মানুষের চোখ পরীক্ষা করা হয়েছে।

দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করে পিক অ্যাকিউইটি; Image Source: Peek Vision

চলছে মেডিকেল সেলফিকে আরো উন্নত করার প্রচেষ্টা

আরো অনেকগুলো কোম্পানি ও গবেষকদল কাজ করে যাচ্ছে স্মার্টফোনকে মেডিকেল ডায়াগনস্টিক টুল হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনার উপর। এবং ক্ষেত্রবিশেষে তারা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন সহায়ক কিটও প্রস্তুত করছে।

সেলোস্কোপ এমন একটি কোম্পানি, যারা স্মার্টফোনের ক্যামেরার সাথে একটি এটাচমেন্ট ডেভেলপ করেছে, যার মাধ্যমে অভিভাবকেরা সন্তানের কানের কর্মক্ষমতা যাচাই করে দেখতে পারে, এবং কানের ভিতরে কী অবস্থা তার ভিডিওচিত্রও রেকর্ড করতে পারে, যা একই সময় নিকটবর্তী কোনো চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে যায়। এভাবে চিকিৎসকের চেম্বারে না গিয়েই অভিভাবকেরা তাদের সন্তানের কানের পরীক্ষা করিয়ে ফেলতে পারে।

চলছে মেডিকেল সেলফির উন্নয়ন প্রচেষ্টা; Image Source: Healthy.io

এছাড়া অন্যান্য গবেষকদল এমন সব প্লাগ-ইন সেন্সর ডেভেলপের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে এইচআইভি থেকে শুরু করে ইবোলা, সম্ভাব্য প্রায় সবরকম রোগই স্মার্টফোনের সহায়তায়, ছোট রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। কেবল একটি এটাচমেন্টের ফলেই ফোনের ক্যামেরা হয়ে উঠতে পারবে মাইক্রোস্কোপ, যা দিয়ে লোহিত রক্তকণিকাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলে দেয়া যাবে কারো শরীরে ম্যালেরিয়ার চিহ্ন রয়েছে কি না।

শেষ কথা

চিকিৎসাবিজ্ঞানকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতে মোবাইল ফোনই পালন করতে পারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা। আর তা যদি সম্ভব হয়, তবে মোবাইল ফোন নিঃসন্দেহে পরিণত হবে বিগত ২০ বছরের সবচেয়ে বড় উদ্ভাবনে। কিন্তু যে বিষয়টি অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে তা হলো, মোবাইল ফোনে ইতিমধ্যেই অসংখ্য ফিচার থাকা সত্ত্বেও, বেশিরভাগ মানুষ কথা বলার পাশাপাশি মোবাইল ফোনের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখছে কেবল ছবি তোলা, গেমস খেলা আর ইন্টারনেট ব্রাউজ করাতেই। যতদিন পর্যন্ত মোবাইল ফোনের সাথে তাল মিলিয়ে এর ব্যবহারকারীরাও স্মার্ট না হচ্ছে, ততদিন যতই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন হোক না কেন, তা কেবল উলুবনে মুক্তো ছড়ানোই হবে।

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about how mobile phone is helping to improve medical science with Medical Selfie. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Eximo 46

Related Articles