Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কল আসলে ভাইব্রেট করে জানাবে নোকিয়ার ট্যাটু

একসময় মোবাইল বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলো নোকিয়া। বিভিন্ন ডিজাইনের মোবাইল ফোন তৈরি এবং এর বিভিন্ন মানোন্নয়নের দিক দিয়ে নোকিয়া ছিলো এক বিশেষ অগ্রদূত। সেই সাথে মোবাইল ফোনের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সকল দিকেও তাদের ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত পদচারণা। প্রযুক্তি বিশ্বের যা কিছু প্রথম এমন তালিকাতেও নোকিয়ার রয়েছে অন্যতম রেকর্ড।

যেমন- বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক কল করা হয় একটি নোকিয়া ফোনের মাধ্যমেই। প্রথম মোবাইল ফোন স্যাটেলাইট কলও করা হয়েছিলো নোকিয়া ফোনে। ২জি, ৩জি, ৪জি, এমনকি ৫জি নেটওয়ার্কের মানোন্নয়নেও রয়েছে নোকিয়ার অন্যতম অবদান।

নোকিয়ার ব্যতিক্রমী চমকপ্রদ ফোনগুলোর একটি n93i; Image Source: baomoi.com

আর মোবাইল ফোনের সাথে সম্পৃক্ত এত কিছু উদ্ভাবন এবং সেখানে অবদানের মধ্য দিয়ে নোকিয়ার তৈরি হয়ে গিয়েছে হাজার হাজার প্যাটেন্ট। শুধু ১৯৮৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নোকিয়ার নিজস্ব ৩০,০০০ প্যাটেন্টের পোর্টফলিও এবং প্যাটেন্ট অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করতেই খরচ হয়েছে ৫০ বিলিয়ন ইউরো! পরবর্তীতে ২০১৭ সালের শেষের দিকে সেই প্যাটেন্ট পোর্টফলিওতে ২০,০০০ এর মতো প্যাটেন্ট পরিবার এখনো বিদ্যমান রয়েছে।

আর এই প্যাটেন্টগুলো অবশ্যই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের নামীদামী মোবাইল কোম্পানিগুলো এখনো নোকিয়ার সেই প্যাটেন্ট করা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন ব্যবহার করে আসছে। এমনকি কিছুদিন আগেই অ্যাপল নোকিয়ার সাথে একটি প্যাটেন্ট সংক্রান্ত আইনি ঝামেলায় পড়ে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছিলো। তাই বোঝা যায়, নোকিয়ার নিজস্ব প্যাটেন্টগুলো কতটা অনন্য, কার্যকর এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন।

নোকিয়া ট্যাটু; Image Source: digiweb.excite.de

নোকিয়ার এই উদ্ভাবনী ক্ষমতার নিদর্শন পাওয়া যায় নোকিয়ার আরেকটি প্যাটেন্টের মাধ্যমে। ২০১২ সালে নোকিয়া অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি উদ্ভাবনের প্যাটেন্টের আবেদন জানিয়েছিলো। আর তা হলো একধরনের ‘ভাইব্রেটিং ম্যাগনেটিক ইংক’ বা ’ট্যাটু’।

কী এই ভাইব্রেটিং ম্যাগনেটিক ট্যাটু?

এটি হচ্ছে একধরনের কালি যা আসলে ফেরোম্যাগনেটিক ধাতু। একে সহজেই স্প্রে করে বা উত্তাপে গলিয়ে কালি হিসেবে ব্যবহার করে মানুষের দেহের যেকোনো স্থানে প্রতিস্থাপন করা যাবে। তারা চাইলে একে সুন্দর ট্যাটু রূপেও দেহে ব্যবহার করতে পারবেন। ট্যাটুটি লাগাতে পারবেন আপনার হাতে, পেটের যেকোনো স্থানে, আঙুলে, এমনকি আঙুলের নখেও।

ট্যাটু কনসেপ্ট; Image Source: fr.slideshare.net

যেহেতু এই কালির সাথে মিশে থাকবে নোকিয়ার উদ্ভাবিত একধরনের চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবস্থা, সেহেতু ব্যবহারকারী সহজেই তার ফোনটির সাথে নিজস্ব ট্যাটুটিকে ‘পেয়ার’ করে নিতে পারবেন; যেমনটি আমরা করে থাকি একটি ব্লুটুথ ডিভাইসের সাথে অপর একটি ব্লুটুথ ডিভাইসের। অর্থাৎ আপনার পুরো দেহটি হয়ে যাবে একপ্রকারের ম্যাগনেটিক ফিল্ড

সেই সাথে নোকিয়ার এই ট্যাটুটিও একটি ব্লুটুথ রিসিভারের মতো কাজ করবে। আর একবার ফোনের সাথে ট্যাটুর সংযোগ দেওয়া হয়ে গেলে আপনার দেহটিই হয়ে উঠবে আপনার ফোনের আগত যত কল, মেসেজ এবং অন্যান্য নোটিফিকেশনের একটি আউটপুট মাধ্যম। অর্থাৎ নোকিয়ার এই উদ্ভাবনে আপনার ফোনে যখনই কোনো কল, মেসেজ, ক্যালেন্ডার অ্যালার্ট, অ্যালার্ম, প্রোফাইলের পরিবর্তন, টাইমজোনের পরিবর্তন, এমনকি যদি ব্যাটারি লো-ও হয় তখনও আপনার ট্যাটুতে একধরনের কম্পনের সৃষ্টি হবে।

নোকিয়া ফোনের ট্যাটু; Image Source: ruwhim.com

কম্পনটা কেমন হবে সে ব্যাপারেও নোকিয়া খোলাসা করেছিলো। নোকিয়ার ফোনগুলোর ভূমিকম্প স্বরূপ ভাইব্রেশনের কথা কে না জানে? তাই এতটা তীব্র কম্পন নিয়ে ব্যবহারকারীর দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কম্পনটা অনুভূত হবে অনেকটাই হালকা। কিছুটা চুলকানোর মতো অনুভূতি হবে। তবে তা এত কম নয় যে আপনি আপনার ফোনের কোনো অ্যালার্ট মিস করে যাবেন।

এমনকি অ্যালার্ট ভিত্তিক কম্পনের মাত্রা পরিবর্তন করার সুবিধার কথাও নোকিয়ার সেই প্যাটেন্টে উল্লেখ ছিলো। যেমন ছোট পালস, কয়েকটি ছোট ছোট পালস, বড় পালস, কয়েকটি বড় মাত্রার পালস ইত্যাদি। কাজেই আপনার ফোনে কল আসলে ভাইব্রেশনের একপ্রকারের পালসের অনুভূতি হবে আপনার ট্যাটুটিতে, মেসেজ আসলে আরেক রকমের এবং লো ব্যাটারিতে আরেক প্রকারের। অর্থাৎ যাতে আপনি ভাইব্রেশনের সেই পালস অনুভব করেই বুঝতে পারেন আপনার ফোনে ঠিক কিসের অ্যালার্ট এসেছে।

যেসব কারণে এই উদ্ভাবন আলোর মুখ দেখেনি।

২০১২ সালে নোকিয়ার এই প্যাটেন্টের পর বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিলো পুরো প্রযুক্তি বিশ্বে। সকলেই বেশ চমকপ্রদ হয়েছিলেন নোকিয়ার এমন আবিষ্কারে। কিন্তু সেই সাথে এই প্রযুক্তির ব্যাপারে অনেক জটিল জটিল প্রশ্নও উঠতে থাকে। ফোন যখন সবাই নিজের কাছেই রাখে তখন এমন ভাইব্রেটিং ট্যাটু শরীরে লাগানোর যৌক্তিকতার প্রশ্নটিই প্রথমে উঠে।

নোকিয়া এই প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছিলো সেসব মানুষদের কথা ভেবেই যারা তাদের ফোন সবসময় নিজের সাথে রাখতে পছন্দ করেন না। হয়তো পাশে কোথাও রেখেই কেউ অন্য কোনো কাজ করছেন, ঘুমের সময় বা নিতান্তই ব্যক্তিগত কোনো সময়ে যখন আপনি ফোনটিকে কাছে রাখতে পারছেন না বা রাখা সম্ভব নয়, তখনও যাতে আপনি আপনার ফোনে আসা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ অ্যালার্ট সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন সেজন্যই নোকিয়ার এই উদ্ভাবন।

সবসময় ফোন এভাবে চেক করা সম্ভব হয় না; Image Source: seafoodnet.info

আবার ধরুন, আপনি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কল বা মেসেজের জন্য অপেক্ষা করছেন। এখন কোনো বিশেষ পরিবেশে সব সময় আপনি ফোনটি নিজের চোখের সামনে এনে চেক করতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে এই চৌম্বকীয় ট্যাটু প্রযুক্তি আপনার অনেক উপকারে আসবে। আবার ফোনে চার্জ দিতে ভুলে গেলেও আপনার ট্যাটুটিই আপনাকে মনে করিয়ে দিবে যে আপনার ফোনের ব্যাটারি লো।

এরপর আরো কিছু প্রশ্ন জাগে। যেমন- ব্যবহারকারীরা যখন এই চৌম্বকীয় ট্যাটু ব্যবহার করবেন তখন ফোনগুলো কিভাবে ব্যবহারকারীকে অন্যদের থেকে আলাদা করে শনাক্ত করবে?

এ ব্যাপারটিও নোকিয়ার মাথায় ছিলো। নোকিয়ার মতে, ব্যবহারকারীর দেহের ম্যাগনেটিক ফিল্ডকেই শনাক্তকরণের কাজে ব্যবহার করা যাবে। অর্থাৎ ব্যবহারকারীদের দৈহিক গঠন এবং গড়ন বা উচ্চতা, প্রসারতা ইত্যাদি ভেদে ম্যাগনেটিক ফিল্ডের আকারও ভিন্নরকম হবে। আর এই ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে শনাক্ত করেই ফোনগুলো নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীকে সংকেত প্রদান করবে। তাই অন্য আকৃতির ম্যাগনেটিক ফিল্ড নিকটে থাকলেও ফোনটি তাকে কোনো প্রকারের অ্যালার্ট প্রদান করবে না যতক্ষণ না নির্দিষ্ট ম্যাগনেটিক ফিল্ড সম্বলিত সেই ব্যবহারকারী নিকটবর্তী হয়। অর্থাৎ একে একধরনের ‘পাসওয়ার্ড’ সিস্টেমের সাথেও তুলনা করা যায়, যেখানে একমাত্র সঠিক ব্যবহারকারীই নিজের ব্যক্তিগত জিনিসের অ্যাকসেস পান।

যদি কেউ নতুন ফোন কিনতো সেক্ষেত্রে কী হতো? নতুন ফোন কিনলে যে ব্যবহারকারীকে পুরনো ট্যাটু তুলে আরেকটি নতুন ট্যাটু লাগাতে হতো তা কিন্তু নয়। ব্যবহারকারীর তার নতুন ফোনটিও পুরনো ট্যাটুর সাথে পেয়ার করার ব্যবস্থা থাকতো।

ট্যাটু ও চুম্বক; Image Source: ezaap.com

আরেকটি যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো নোকিয়াকে তা হলো, মানুষের পছন্দ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। এক ট্যাটু সবসময় তো আর সকলের কাছে ভালো লাগবে না। আর এই প্রযুক্তিতে যে কালি ব্যবহার করা হবে তা ধরা যায় একদম স্থায়ী। তাই সেক্ষেত্রে কিছুদিন পর কেউ যদি অন্য ট্যাটু ব্যবহার করতে চায় সেক্ষেত্রে কী হবে?

এই প্রশ্নের সমাধানে নোকিয়া আরেকটি সমাধান নিয়ে আসার কথা ভেবেছিলো, যা অতটা বাহ্যিকভাবে আকর্ষণীয় না হলেও যথাযথ ছিলো। আর তা হলো ম্যাগনেটিক স্টিকার। বিভিন্ন আকৃতির ও ডিজাইনের স্টিকারগুলো ব্যবহারকারীরা কিনে নিজের দেহে ব্যবহার করতে পারবেন। তাদের কার্যপ্রণালী আগের সেই ট্যাটুর মতোই থাকবে। শুধু এই স্টিকারগুলো আপনার নিজের পছন্দমত বাছাই এবং সহজে বদলে ফেলতে পারবেন। তবে এই প্রযুক্তি ট্যাটুর মতো অতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। তবে স্টিকারগুলোই আসলে হতে পারতো নোকিয়ার এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মার্কেটিংয়ের অন্যতম হাতিয়ার।

একটি ম্যাগনেটিক ফিল্ড; Image Source: walldevil.com

তবে এক্ষেত্রেও স্টিকারগুলো নিজের দেহে ব্যবহারে অস্বস্তিজনক মনে হতে পারে। পাশাপাশি অনেকে মনে করেছিলেন, কোনো ব্যবহারকারী যদি ঘটনাক্রমে কোনো শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ডের কাছে এসে পড়েন, নিজের দেহে লাগানো সেই ট্যাটু বা স্টিকারের জন্য সেক্ষেত্রে তার ক্ষতি হবার সম্ভাবনাও থেকে থাকে। আবার প্রযুক্তিটিতে ব্যবহারকরা কালির ডাক্তারি পরীক্ষারও দরকার ছিলো। যেহেতু সেই কালি দেহে অনেকদিন ধরে থেকে যাবে, সেহেতু সেগুলো দেহের জন্য ক্ষতিকর কি না তা যাচাই করার দরকার ছিলো।

আর সেসময়ে নিত্যনতুন প্রযুক্তির আনাগোনা শুরু হয়ে যাওয়ায় এই এক প্রযুক্তি মানুষ কতদিন নিজের দেহে বয়ে বেড়াতে চাইবে সেটাও ছিলো একটি প্রশ্ন। তাই বিভিন্ন অসুবিধা, উত্তর না পাওয়া জিজ্ঞাসা বা আনুষঙ্গিক অন্যান্য কারণেই হোক- নোকিয়ার এই উদ্ভাবনটি প্যাটেন্ট আকারেই রয়ে গিয়েছে আজ অব্দি। এটি বাস্তবের মুখ দেখেনি। তবে আলোর মুখ না দেখলেও এটি বলা যায় যে, নোকিয়া তার এমন উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্যই অতীতে ছিলো অন্যদের থেকে একদম আলাদা এবং অনন্য।

ফিচার ইমেজ সোর্স: Edited by writer

Related Articles