করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন 'ওয়ার্কিং ফ্রম হোম' বা বাড়িতে বসেই অফিসের কাজ করছেন। মহামারির দিনগুলোয় বড় বড় প্রতিষ্ঠান কর্মীদের অফিসে আসতে নিষেধ করছে। গুগল, মাইক্রোসফট, টুইটার, হিটাচি, অ্যাপল, আমাজন, শেভরন, সেলসফোর্স, স্পটিফাইয়ের মতো বড় বড় কোম্পানি কর্মীদের বাড়ি থেকে কাজ করতে বলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অফিসের টিমওয়ার্ক বাসায় বসে কি আদৌ সম্পন্ন করা সম্ভব? সে প্রশ্নের জায়গায় বড় সমাধান হয়ে এসেছে স্ল্যাক।
'স্ল্যাক' আমেরিকান সফটওয়্যার সংস্থা 'স্ল্যাক টেকনোলজিস' নির্মিত একটি মালিকানাধীন ব্যবসায়িক যোগাযোগ অ্যাপ্লিকেশন। শুধু করোনাকালেই নয়, গেল কয়েক বছর ধরেই অফিস ওয়ার্কপ্লেস হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই প্লাটফর্মটি।
স্ল্যাক তৈরির ভাবনা
স্ল্যাকের শুরুর গল্প জানার আগে আমরা একটু একুশ শতকের শুরুর সময়ে ফিরতে চাই। তখন ২০০২ সাল। কানাডিয়ান উদ্যোক্তা স্টুয়ার্ট বাটারফিল্ড 'লুডিকর্প' নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, উদ্দেশ্য ছিল গেম তৈরি করা। তাদের গেম 'নেভারএন্ডিং' খুব একটা প্রভাব রাখতে পারেনি গেমিং দুনিয়ায়। তবে গেমে এম্বেড থাকা ফটো-আপলোড টুলগুলো খেলোয়াড়দের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। ২০০৪ সালে 'ফ্লিকার' নামে এই টুলটি ইমেজ ও ভিডিও হোস্টিং সেবা হিসেবে তৈরি করেন বাটারফিল্ড।
'নেভারএন্ডিং' থেকে আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় গেমটি বিক্রি করে দিতে উদ্যোগী হন বাটারফিল্ড। পরের বছরই সার্চ ইঞ্জিন ইয়াহু বাটারফিল্ডের পুরো কোম্পানিই (লুডিকর্প ও ফ্লিকার) কিনে নেয় প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি দামে। ফ্লিকারের সাথে তখনও যুক্ত ছিলেন বাটারফিল্ড। ২০০৮ সালে ইয়াহু ছাড়ার আগপর্যন্ত ফ্লিকারের জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন ৪৭ বছর বয়সী এই কানাডিয়ান।
পরের বছর, অর্থাৎ ২০০৮ সালে 'টাইনি স্পেক' নামে নতুন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন বাটারফিল্ড। গেম নির্মাণের উদ্দেশ্যে তৈরি করা এই প্রতিষ্ঠান তাদের প্রথম গেম 'গ্লিচ' বাজারে ছাড়ে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। বাটারফিল্ডের এই প্রজেক্টও তেমন একটা আলোর মুখ দেখেনি।
কিন্তু এই প্রজেক্ট, অর্থাৎ গ্লিচ গেমটি ডেভেলপ করার সময় বাটারফিল্ড ও তার দল নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতে একটি মেসেজিং টুল তৈরি করেন। এটিই 'স্ল্যাক' নামে প্রথমবার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রকাশ করা হয় ২০১৩ সালের আগস্টে। এর সদর দপ্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকোতে অবস্থিত। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ১৫টি শহরে ১৬টি গ্রাহক সেবা কার্যালয় রয়েছে স্ল্যাকের।
কী কী সুবিধা আছে স্ল্যাকে?
স্ল্যাক মূলত অফিসিয়াল কাজের একটি ওয়ার্কপ্লেস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ই-মেইল, মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপের মতো অন্যান্য মেসেজিং অ্যাপের ন্যায় স্ল্যাকেও বার্তা ও ফাইল আদান-প্রদানের পাশাপাশি ফোন ও ভিডিও কলে কথা বলার সুবিধা রয়েছে। তবে স্ল্যাকের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চ্যানেল।
একটি কোম্পানি যখন স্ল্যাকের সাবস্ক্রাইবার হয়, তখন সেই কোম্পানির ওয়ার্কপ্লেসে কোম্পানির বিভিন্ন বিভাগ বা শাখাকে একেকটি চ্যানেল হিসেবে খোলা হয় স্ল্যাকে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি কোম্পানিতে কেউ হয়তো ক্রিয়েটিভ টিমে কাজ করেন, আবার অন্য কেউ হয়তো প্রোডাকশন টিমে কাজ করেন। সেক্ষেত্রে আপনার টিমকে নিয়ে আপনি একটি চ্যানেল খুলতে পারবেন আপনার কোম্পানির স্ল্যাক ওয়ার্কপ্লেসে। সেই চ্যানেলে টিমের যাবতীয় কাজের আপডেট থাকবে। এতে করে কে কী করছেন, সেটা সম্পর্কে যেমন একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকবে, ঠিক তেমনি সার্চ অপশনের মাধ্যমে সহজেই পূর্ববর্তী কোনো ফাইল সহজেই পেয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। স্ল্যাকে একই অ্যাপের অধীনে একাধিক কোম্পানির সাথেও কাজ করা যায়।
আপনি চাইলে কোনো চ্যানেলে যুক্ত না হয়েও সেই চ্যানেলের যাবতীয় কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন, যদি সেই চ্যানেল পাবলিক প্রাইভেসিতে থাকে। প্রাইভেট প্রাইভেসিতে এ সুবিধা নেই। স্ল্যাকে আপনি আপনার সুবিধামতো অন্যান্য ওয়ার্ক টুল, যেমন- গুগল শিট, ডক, ড্রাইভ ইত্যাদি সংযুক্ত করতে পারবেন। এতে করে ফাইল আদান-প্রদানে সুবিধা পেয়ে থাকেন গ্রাহকরা। স্ল্যাকের ভিডিও কলে গুগল মিট কিংবা জুম অ্যাপের মতো স্ক্রিন শেয়ারের সুবিধা আছে। এজন্য সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে আপনাকে আলাদা করে অন্য অ্যাপে যেতে হবে না।
স্ল্যাকে আপনি অফিসের মতো সময়ও ঠিক করে দিতে পারবেন। আপনার অফিস টাইম যদি হয়ে থাকে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা, তাহলে স্ল্যাকে ঐ সময়ের মধ্যে আসা বার্তার নোটিফিকেশনই আপনি পাবেন।
গ্রাহকেরা কতটা নির্ভরশীল?
ধরুন, আজ শারীরিক অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে আপনি বাসা থেকে বেরোতে পারছেন না, অফিসে গিয়ে কাজ করার মতো অবস্থাও নেই। কিন্তু আপনি চান, বাসায় বসেই কাজ করবেন, সংযুক্ত থাকবেন অফিসের সাথে। স্ল্যাক সেই সুযোগ করে দিয়েছে। অফিসে উপস্থিত না থেকেও স্ল্যাকের চ্যানেলের মাধ্যমে আপনি আপনার টিমের সাথে সহজেই আপনার কাজগুলো করতে পারবেন।
স্ল্যাক কর্তৃপক্ষ গেল বছরের (২০২০) আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় থাকা তাদের ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি জরিপ চালায়। জরিপের ফল বলছে, ৭৫ শতাংশ ব্যবহারকারীই তাদের কাজ সম্পন্ন করার জন্য স্ল্যাকের উপর নির্ভরশীল। ৯১ শতাংশ ব্যবহারকারী মনে করেন, ঘরে বসে স্ল্যাকের মাধ্যমে কাজ সম্পাদনে তারা উন্নতির দেখা পেয়েছেন। স্ল্যাক ব্যবহারের ফলে কাজের গতি বেড়েছে ২৩ শতাংশ হারে। ই-মেইল আদান-প্রদানের হার কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। স্ল্যাক কর্তৃপক্ষের মতে, গ্রাহকদের আস্থার প্রতিদান দিতে তারা বদ্ধ পরিকর।
স্ল্যাকের পথচলা
২০১৩ সালে যখন প্রথম স্ল্যাক গুগল প্লে-স্টোরে প্রকাশ করা হলো, সেদিন প্রথম ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৮ হাজার কোম্পানি অ্যাপটিতে সাইনআপ করে। এর বছর দুয়েক পর, ২০১৫ সালের শুরুর দিকে স্ল্যাক কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের সে সময়ে প্রতিদিন পাঁচ লক্ষ সক্রিয় ব্যবহারকারী ছিল। প্রতি মাসে ৩০ হাজার সক্রিয় দল বা কোম্পানি অ্যাপটির মাধ্যমে ২০০ মিলিয়নেরও বেশি বার্তা আদান-প্রদান করত। সে বছরের এপ্রিলে স্ল্যাকের মূল্য দাঁড়ায় ৩ বিলিয়ন ডলারে। বাজারে আসার এত কম সময়ের মধ্যে এই পরিমাণ মূল্য ছোঁয়া অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে সবার উপরে ছিল স্ল্যাক।
কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশ্বের দেড়শোরও বেশি দেশে এখন তাদের দৈনিক সক্রিয় ব্যবহারকারী প্রায় ১২ মিলিয়নের উপরে। এর মধ্যে ১ লাখ ১৯ হাজারের 'পেইড', অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যের বিনিময়ে অ্যাপটির সেবা নিচ্ছেন।
কেন বিক্রি হলো স্ল্যাক?
২০২০ সালের ডিসেম্বরে অনেকটা হুট করেই স্ল্যাকের মালিকানা বদলের খবর আসে সংবাদমাধ্যমে। মার্কিন ক্লাউড কম্পিউটিং জায়ান্ট 'সেলসফোর্স' স্ল্যাককে ২৭.৭ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেওয়ার কথা জানায়। স্ল্যাকের এই বিক্রি হয়ে যাওয়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যবসায়িক সফটওয়্যার শিল্পে সবচেয়ে বড় ক্রয়-বিক্রয়ের ঘটনা।
প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদমাধ্যম দ্য ভার্জ বলছে, স্ল্যাকের বিক্রি হয়ে যাওয়ার পেছনে কোম্পানিটির প্রতিযোগিতার বাজারে অস্তিত্ব সংকটে ভোগার ফল হিসেবে দেখা হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বাসা থেকেই কাজ করছেন বহু কর্মী। আর অনলাইন মিটিংয়ের কারণে বেড়েছে স্ল্যাক এবং মাইক্রোসফটের টিমস সেবার চাহিদাও। গত দুই প্রান্তিকে ২০ হাজারের বেশি পেইড গ্রাহক যোগ হয়েছে স্ল্যাক প্ল্যাটফর্মে। ফলে প্রতিষ্ঠানের পেইড গ্রাহক সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার। তবু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে স্ল্যাককে।
সম্প্রতি মাইক্রোসফট, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ফিচার সমৃদ্ধ করায় অফিস ওয়ার্কপ্লেস হিসেবে কঠিন এক প্রতিযোগিতাতেই টিকে থাকার লড়াই করছিল স্ল্যাক। এর পরিপ্রেক্ষিতেই মালিকানা বদল হয়ে গেল স্ল্যাকের। সেলসফোর্স ও স্ল্যাক উভয়ই ভবিষ্যতে একসাথে মিলে প্রতিযোগিতার বাজারে উন্নতির পথে হাঁটবে, এমনটাই প্রত্যাশা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের।
This article is in Bangla. It is about 'Slack', a virtual workspace.
References:
2. Flickr founder plans to kill company e mails with slack
4. Flickr founder stewart butterfields new slack signed up 8000 companies in 24 hours
Featured Image: Kinsta