Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রূপান্তরিত ভবিষ্যতের গাছ: বদলে যাবে পৃথিবী?

এই যে বিটপি-শ্রেণী হেরি সারি সারি-
কী আশ্চর্য শোভাময় যাই বলিহারি! …
এদের স্বভাব ভালো মানবের চেয়ে,
ইচ্ছা যার দেখ দেখ জ্ঞানচক্ষে চেয়ে।”

– কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার

বলা হয়, যেদিন থেকে এই গ্রহে মানুষের পদচারণার শুরু সেদিন থেকেই মানুষ তার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য গাছপালা তথা উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বর্তমান সভ্যতা অব্দি যাত্রাকালে মানুষ উদ্ভিদ থেকে কী না পেয়েছে! উদ্ভিদ আমাদের খাদ্য, আশ্রয় ও ঔষধ থেকে শুরু করে জ্বালানি এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনেরও যোগান দেয়। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং জীবকুলের টিকে থাকার পেছনে গাছের অবদান অনস্বীকার্য বললে অত্যুক্তি করা হবে না। খাবার সহ নানাবিধ প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি উদ্ভিদের অবদান রয়েছে পরিধেয় বস্ত্র থেকে ঘর সাজাবার উপকরণেও। তবে এই বহুমুখী উপকারিতা সম্পন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির উপযোগিতাকে কী মানবজাতি সম্পূর্ণ কাজে লাগাতে পেরেছে?

উত্তর না-সূচক প্রিয় পাঠক। আর তাই বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে উদ্ভাবন করতে চাইছেন উদ্ভিদের এমন সব উন্নত প্রকরণ যাদের অভূতপূর্ব ব্যবহারের মাধ্যমে মানবজীবন ও পৃথিবীতে আসবে অদৃষ্টপূর্ব পরিবর্তন ও উন্নয়ন। এ রচনাটির আলোচ্য পাঠ্যবস্তুও তাই মানবকল্যাণে ব্যবহার্য উদ্ভিদের উন্নত প্রকরণগুলোর বিস্ময়কর ব্যবহার নিয়েই।

যুক্তরাজ্যের কিউ এ অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেনস এর গবেষকদের মতে, উদ্ভিদের শক্তি ও ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ ও কাজে লাগানোর আরো নানাবিধ উপায় আছে। প্রাকৃতিক অগ্নি-নির্বাপক থেকে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ-হন্তারক হিসেবে কিংবা অন্ধকারের আলো বা প্রতিষেধক হিসেবে উদ্ভিদের নানা ধরনের উচ্চমার্গীয় ব্যবহার সম্ভব যা শুধু মানবকল্যাণে বৈপ্লবিক অবদানই রাখবে না, পাশাপাশি ভবিষ্যৎকে করবে সুরক্ষিত।

মাটিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড ধরে রাখবে গাছ

সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে বেড়েছে দূষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার পরিমাণ। এ কথা আমরা সকলেই জানি, বর্তমানে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে। গাছ যে এই কার্বন ডাইঅক্সাইডকে গ্রহণ করে নিজের খাদ্য বানিয়ে উপজাত হিসেবে পাওয়া অক্সিজেনের যোগান নিত্য পৃথিবীতে দিয়ে চলেছে- এ কথাও আমাদের অবিদিত নেই। এভাবেই ক্ষতিকর কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ প্রকৃতিতে নিয়ন্ত্রণ করে উদ্ভিদ। কেমন হতো যদি উদ্ভিদের কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া যায়?

সান ডিয়েগোতে অবস্থিত ‘সাল্ক ইন্সটিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল স্টাডিজ’ এর গবেষকগণ এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছেন যেন প্রকৃতি থেকে উদ্ভিদের কার্বন ডাইঅক্সাইডের শোষণক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া যায় এবং এই গৃহীত অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড সঞ্চিত হবে মাটিতে। তাদের ভাষায় এটি উদ্ভিদকে নিয়ন্ত্রিতভাবে কাজে লাগানো।

মাটিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড জমা করবে গাছ; ছবিসূত্র: businessinsider.com

বর্ধনকালে উদ্ভিদসমূহ সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল থেকে ১০০ গিগাটনেরও বেশি পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নেয়, যদিও এর অধিকাংশই পুনরায় কার্বন ডাইঅক্সাইড হিসেবে প্রকৃতিতে ফিরে যায়। এর কারণ হলো মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীকুল উদ্ভিদকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত উদ্ভিদ মানুষ পুড়িয়ে ফেলে। পরবর্তীতে এগুলো মাটির সংস্পর্শে এলে বা মাটিতে মিশে গেলে ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য অণুজীব এগুলোকে ভেঙ্গে ফেলে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রকৃতিতে বিমুক্ত হয়। বাত্‍সরিকভাবে এই চক্রের কী প্রভাব পড়ে তা একটি বিশ্বজনীন মাপকাঠিতে সহজেই নিরূপণ করা যায়। উত্তর গোলার্ধের বসন্ত ও গ্রীষ্মকালীন সময়ে যখন উত্তর আমেরিকা, এশিয়া ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বৃক্ষরাজি ও নানা উদ্ভিদ তরতর করে বৃদ্ধি পায়, সে সময় প্রকৃতিতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ কমতে থাকে। এরপর যখন শীতকালীন সময়ে নিম্ন তাপমাত্রায় উদ্ভিদের বৃদ্ধির হার ও পরিমাণ কমতে থাকে, তখন কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ পুনরায় বেড়ে যায়।

সাল্কে গবেষণাকারী বিজ্ঞানীদের মতে, যেহেতু উদ্ভিদ বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড সরাবার কাজটি প্রাকৃতিকভাবেই করে থাকে, কেন জলবায়ুগত সমস্যায় এটাকে কাজে লাগানো যাবে না? এভাবে কী করে সমস্যাটি নিরসন করবেন তারও একপ্রকার ছক কষে ফেলেছেন তারা।

সকল উদ্ভিদেই ‘সুবেরিন’ নামক একটি পদার্থ থাকে যা কিনা অসংখ্য কার্বন পরমাণুর সমন্বয়ে তৈরি একটি জৈব যৌগ। এই সুবেরিন উদ্ভিদের মূলকে সুরক্ষা দেবার পাশাপাশি উদ্ভিদকে আঘাত, রোগ-বালাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও লবণাক্ততা থেকে রক্ষা করে। সুবেরিনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো অণুজীব একে ভেঙ্গে ফেলতে পারে না অর্থাৎ এটি এমন এক প্রাকৃতিক পলিমার যা অপচনশীল। বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন এক জাতের উদ্ভিদ তৈরি করা যা বায়ুর কার্বন ডাইঅক্সাইড বেশি পরিমাণে নিয়ে তৈরি করবে বেশি বেশি সুবেরিন এবং উত্‍পাদিত এই সুবেরিন সঞ্চিত হবে মাটিতে। এই লক্ষ্যে তারা বড় ও গভীর মূলবিশিষ্ট বিশেষ উদ্ভিদ তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন যা স্বাভাবিক উদ্ভিদের তুলনায় প্রায় কুড়ি গুণ বেশি সুবেরিন উত্‍পাদন করবে।

স্ক্রিপস ইনস্টিটিউশন অফ ওশানোগ্রাফির জলবায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক ভি. রাম রামান্থানের মতে, “আমাদের বায়ুমণ্ডল থেকে প্রায় এক ট্রিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড বের করে নিতে হবে এবং এখনো পর্যন্ত এর কোনো কার্যকরী ও প্রয়োজনমাফিক পরিবর্তনযোগ্য পন্থা আমাদের নেই।” তাই এটা বলাই যায়, সাল্কের গবেষকগণের দিকে আমাদের একরকম তাকিয়ে থাকতেই হচ্ছে।

অগ্নিনির্বাপক গাছ

উদ্ভিদের দাহ্যতা নিয়ে হঠাত্‍ এত গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে কেন এ নিয়ে প্রশ্ন জাগতেই পারে। কিন্তু অনেক দেশেই বড় বড় দাবানলে বিস্তীর্ণ এলাকা পুড়ে যায়, সাথে পুড়ে যায় গাছপালাও। এসব দাবানলে শুধু পরিবেশেরই নয়, পাশাপাশি আর্থিক ও সামাজিক সম্পদও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাই বিজ্ঞানীরা এমন উদ্ভিদের সন্ধান করছেন যা দাবানলের অগ্নিসহিষ্ণু এবং তা আগুনকে ছড়িয়ে যেতে বাধা দেবে। এতে মূল্যবান সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে।

মোটা বাকলযুক্ত উদ্ভিদ, যা আগুনকে অধিকতর সময় সহ্য করতে পারে এবং যেসব উদ্ভিদের দ্রুত অঙ্কুরোদগম হয়, পাশাপাশি যেসব উদ্ভিদে সেরোটিনযুক্ত কোন রয়েছে, এগুলোকেই বিজ্ঞানীরা আগুনের ধ্বংসলীলা প্রশমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কথা ভাবছেন। যেমন নিজস্ব ছাই থেকে ফিনিক্স পাখি পুনর্জন্ম নেয়, তেমনি এসকল বীজযুক্ত কোনগুলো আগুনের সংস্পর্শে আসলে তার সেরোটিনযুক্ত প্রতিরক্ষা আবরণ পুড়ে যায় এবং বীজগুলো বাতাসে অবমুক্ত হয়ে উড়ে যায়, ফলে অন্যত্র এই প্রজাতিটির টিকে থাকা সুনিশ্চিত হয়। কাজেই দাবানলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ রুখতে এবং আগুনে পুড়ে উদ্ভিদের যেকোনো প্রজাতির বিলুপ্তি রোধকল্পে উদ্ভিদের ব্যবহারের ব্যাপারে গবেষকগণ আশাবাদী।

বিস্ফোরণ সনাক্তকারী পালং শাক!

অসংখ্য পুষ্টিগুণে ভরপুর পালং শাক শুধুমাত্র উচ্চমানের খাদ্য হিসেবেই আর সীমাবদ্ধ নেই, বরং বর্তমানে একে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বিস্ফোরক সনাক্তকরণেও। এমআইটি’র (MIT) গবেষকগণ কার্বনের ন্যানোটিউব ব্যবহার করে সাধারণ পালংশাককে সেন্সরে রূপান্তরিত করেছেন। এই সেন্সরগুলো বিষ্ফোরক সনাক্ত করতে পারে এবং ধারণকৃত তথ্য কোনোরকম তারের ব্যবহার ছাড়া হাতে ধরা যায় এমন প্রায় স্মার্টফোনের ন্যায় যন্ত্রে পাঠায়। এভাবে তড়িৎ প্রকৌশলভিত্তিক যান্ত্রিকব্যবস্থা উদ্ভিদে প্রয়োগের ঘটনাকে ‘প্ল্যান্ট ন্যানোবায়োনিকস’ বলা হয়। এমআইটির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি অংশের অধ্যাপক ও এই গবেষকদলের প্রধান মাইকেল স্ট্র্যানোর মতে, “এই ন্যানোবায়োনিকসের উদ্দেশ্যই হচ্ছে কীভাবে ন্যানো বা অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকে উদ্ভিদে প্রবেশ করিয়ে উদ্ভিদকে দিয়ে এমন কাজ করানো যা তার সহজাত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে না।

বিষ্ফোরক সনাক্ত করবে গাছ; ছবিসূত্র: ucrtoday.ucr.edu

এক্ষেত্রে, ল্যান্ডমাইনসহ অন্যান্য বিস্ফোরকে ব্যবহৃত নাইট্রোঅ্যারোম্যাটিকস রাসায়নিক পদার্থ সনাক্ত করবার জন্য উদ্ভিদগুলোকে প্রস্তুত করা হয়। উদ্ভিদ স্বাভাবিক উপায়ে মাটি থেকে পানি সংগ্রহ করে। এই সংগৃহীত পানিতে এই ধরনের রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়ামাত্র এসব বিশেষায়িত উদ্ভিদের পাতায় বসানো ন্যানোটিউবগুলো থেকে একপ্রকার ফ্লুরোসেন্ট আলোক সংকেত বের হয় যা কিনা ইনফ্রারেড বা অবলোহিত রশ্মিধারক ক্যামেরার মাধ্যমে সনাক্ত করা যায়। ক্যামেরাটিকে প্রায় স্মার্টফোনের আকৃতির ছোট কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করে দেয়া যায় যা ব্যবহারকারীকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইমেইল পাঠাতে পারে। স্ট্র্যানোর মতে, “কীভাবে আমরা মানুষ ও উদ্ভিদের মধ্যবর্তী যোগাযোগ বাধাকে অতিক্রম করেছি এটি তারই একপ্রকার নতুন বাস্তবায়ন।” তিনি মনে করেন, উদ্ভিদের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দূষণপদার্থ ও প্রাকৃতিক অবস্থার (যেমন- খরা) পূর্বাভাস পাওয়া যাবে যা আমাদের আগেভাগেই সতর্ক হয়ে যেতে ভূমিকা রাখবে। স্ট্র্যানো ও তার দল এর আগেও উদ্ভিদে ন্যানোটিউবের ব্যবহার করেছেন। এসব প্রযুক্তির ফলে নাইট্রিক অক্সাইড, টিএনটি বিষ্ফোরক, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, সেরিন নামক স্নায়ুগ্যাস সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

বিষ্ফোরকের তথ্য চলে আসবে হাতে থাকা ছোট্ট যন্ত্রে; ছবিসূত্র: bbc.com

ভারী ধাতু অপসারণ করবে উদ্ভিদ!

এই গ্রহের মৃত্তিকা ভারী ধাতব মৌলের দ্বারাও দূষিত। বিভিন্ন খনি ও শিল্পকারখানার দ্বারা দূষিত অঞ্চলকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। পুরো পৃথিবীজুড়ে নানা ধাতব মৌল যেমন- নিকেল, সীসা, জিঙ্ক কিংবা উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত ক্যাডমিয়াম ইত্যাদির ফলে মাটি দূষিত হয়ে পড়েছে। প্রচলিত নিয়মে এর প্রতিকার বেশ কষ্ট, সময় ও অর্থসাধ্য ব্যাপার। তাই বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করতে চাইছেন এমন সব উচ্চমানের উদ্ভিদ যারা মাটি থেকে এসব ভারী ধাতু শুষে নিয়ে মাটিকে করতে পারে দূষণমুক্ত ও স্বাভাবিক।

এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা প্রায় পাঁচ শতাধিকেরও বেশি উদ্ভিদের তালিকাভুক্তি করেছেন যেগুলো এ পরিকল্পনায় অবদান রাখতে পারে। এরই মধ্যে একটি উদ্ভিদ অ্যারাবিডপসিস হ্যালেরি (Arabidopsis halleri), যা নিয়ে গবেষণারত উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ববিজ্ঞানী উটে ক্র্যামার বলেন, “এই উদ্ভিদগুলো এমন পরিমাণে বিষাক্ত ধাতুগুলোকে ঘনীভূত করতে সমর্থ যা অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় প্রায় শতাধিক থেকে কয়েক সহস্রগুণ বেশি।

গাছ নির্মূল করবে ভারী ধাতুর দূষণ; ছবিসূত্র: slideshare.net

এসব উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ভিদগুলোকে অনেকটা জ্যান্ত ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বলা যায়। মূলের মাধ্যমে এরা বিষাক্ত পদার্থসমূহ গ্রহণ করে, উদ্ভিদের কোষসমূহ এসব বিষাক্ত পদার্থগুলোকে বহন করে উপরে নিয়ে যায় এবং পাতার বহির্ভাগের দিকে অবস্থিত ভ্যাকুওল বা কোষপ্রকোষ্ঠে জমা করে। অ্যারাবিডপসিস হ্যালেরির ক্ষেত্রে ‘নিকোটিনামাইন’ নামক জীন (ডিএনএ এর অংশ যা প্রোটিন তৈরিতে ভূমিকা রাখে) এই কাজটি করতে ভূমিকা রাখে। এই জীনের কার্যকারিতা বন্ধ রাখা হলে এসব ধাতব দূষণপদার্থ মূলেই রয়ে যায় বলে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন।

এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫০০টি এমন উদ্ভিদ তালিকাভুক্ত হয়েছে যাদের কোনো না কোনোভাবে এ কাজে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এটি দুই প্রকারে ফলপ্রসূ হবে। প্রথমত, এর মাধ্যমে ‘ফাইটোরেমেডিয়েশন’ প্রক্রিয়ায় শিল্পকারখানাকেন্দ্রিক দূষিত এলাকা দূষণমুক্ত ও নির্মল করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, এই প্রক্রিয়া কাজে লাগিয়ে মূল্যবান ধাতুসমূহের খনিজ উত্তোলন সম্ভব হবে যা ‘ফাইটো-মাইনিং’ বা উদ্ভিদভিত্তিক খনিজ উত্তোলন নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে আহরিত খনিজযুক্ত গাছগুলো পুড়িয়ে প্রাপ্ত ছাই থেকে এসিড প্রয়োগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ধাতু ও ধাতব পদার্থ অর্জন করা সম্ভব।

গাছের বাতি!

ঠিকঠাক ঘরে বাইরে ব্যবহৃত বাতির মতো না হলেও গাছ থেকে যে আলো বের করা যেতে পারে এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কেমন হতো যদি পথে ব্যবহৃত স্ট্রিট লাইটের বদলে আলো দিতো গাছ? রাস্তায় দিকনির্দেশনাকারী চিহ্ন হিসেবে কিংবা কোনো আবাসস্থলের অভ্যন্তরীণ আলোকসজ্জার কাজে যদি হাত বাড়িয়ে দেয় গাছ? কল্পবিলাসী মনের প্রতিচ্ছবি মনে হলেও এর সম্ভাবনা অনবরত উঁকি দিয়ে যাচ্ছে।

জোনাকি পোকা কিংবা সামুদ্রিক ব্যাকটেরিয়া যেমন অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে, তাদের এই আলো দেবার ক্ষমতার জন্য দায়ী জীনকে উদ্ভিদে স্থানান্তর করে উদ্ভিদেও এরূপ বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে উদ্ভিদের পাতা দিনের সূর্যালোক থেকে যে শক্তি সঞ্চয় করে তা রাতে কাজে দেবে। ওয়েলকাম ট্রাস্ট স্যাঙ্গার ইন্সটিটিউট এর পিএইচডিরত ছাত্র থিও স্যান্ডারসনের মতে যদি উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় ছন্দ নিয়ন্ত্রণকারী জীনসমূহকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে গাছগুলোর আলোক নির্গত করার প্রক্রিয়াকে সুবিধা মতো চালু ও বন্ধ করা যাবে। এর ফলে প্রক্রিয়াটি দিনে বন্ধ ও অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই চালু করা যাবে। অর্থাৎ জল, হাওয়া, মাটি ও মাটির খনিজ পদার্থসমূহের উপস্থিতিই গাছকে সুষ্ঠুভাবে আলোর উত্‍স হিসেবে কাজ করে যেতে সাহায্য করবে।

ছবিটি বাস্তব না হলেও হয়তো সেদিন খুব বেশি দূরে নেই যেদিন রাতে রাস্তায় গাছই দেবে আলো! ছবিসূত্র: dezeen.com

আবার এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে এমন উদ্ভিদ তৈরি করার স্বপ্ন দেখছেন বিজ্ঞানীরা যার বর্ধনকালে কোনো কিছুর অভাব (পানি বা পুষ্টি) কিংবা অসুবিধা (রোগ-বালাই, কীট-পতঙ্গ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ) হলে তা নিজে থেকেই জানান দেবে চাষীদের! উদ্ভিদের বিচ্ছুরিত আলোই জানান দেবে চাষীদের যে তার কী প্রয়োজন, এমনকি জানান দেবে ফল পাকার সময়েরও। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্থনি ট্রেওয়াভাস এমন একপ্রকার আলু উদ্ভাবন করেন যা পানিশূন্যতা অনুভব করলে কালো আলোয় উজ্বল আলো দিতে পারে। সাধারণ আলুর সাথে কিছু পরিমাণে এমন আলু জমিতে লাগালে সেগুলো দেখে কৃষক সহজেই বুঝতে পারবেন কখন জমিতে সেচ দেয়ার সময় হয়েছে। তবে খাদ্যবস্তুতে এহেন জীন প্রকৌশলের ব্যবহার অনেকেই স্বাভাবিকভাবে নেননি এবং অনেক দেশে এটি নিয়ে বিধি-নিষেধ আছে। এগুলো এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে।

এ সকল উদ্যোগই এখনো তাত্ত্বিক পর্যায়েই রয়েছে। গবেষণারত বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু আশাব্যঞ্জক ফলাফল পেলেও এ পরিকল্পনা সত্যি করতে হলে এখনো পাড়ি দিতে হবে বহুদূর।

পাকা কলা হটাবে ভিটামিন ‘এ’ জনিত অন্ধত্বের অভিশাপ

বিল গেটস ও তার সহধর্মিণী মেলিন্ডা গেটসের কথা কে না জানে? বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে করা গবেষণা কলা নামক ফলটিকে দিয়েছে নতুন বৈশিষ্ট্য। এই কলাগুলো বিটা-ক্যারোটিন নামক পদার্থে ভরপুর যা আমাদের শরীরে ভিটামিন এ তৈরি করতে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে পুরো বিশ্বে প্রায় ৭ লক্ষ শিশু ভিটামিন এ এর অভাবে মারা যায় এবং ৩ লক্ষ শিশু প্রাণে বাঁচলেও অন্ধত্বের করালগ্রাসের শিকার হয়। এই কলা তাদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে বলে ভাবা হচ্ছে।

ভিটামিন-এ যুক্ত সোনালি-হলুদ কলা; ছবিসূত্র: standard.co.uk

কলাগোত্রীয় একপ্রকার গাছ থেকে এমন জীন আলাদা করে ভক্ষণযোগ্য কলায় স্থানান্তরিত করা হয় যা কলায় ভিটামিন এ তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। এটি অনেকটা  প্রায় এক যুগ আগে শুরু হওয়া ‘গোল্ডেন রাইস’ (ভিটামিন এ যুক্ত ধান) এর মতো একটি পরিকল্পনা, যদিও গোল্ডেন রাইস আপত্তি ও নানাবিধ সমস্যার কারণে এখনো নানা বাধা অতিক্রম করে বাজারে আসতে পারেনি। আশা করা হচ্ছে খুব শীঘ্রই প্রায় ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচে এই কলাগুলো মানুষের ওপর পরীক্ষামূলকভাবে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং দেখা হবে এই কলা খেয়ে মানুষের দেহে ভিটামিন এ এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায় কিনা। আশা করা হচ্ছে আনুমানিক ২০২০ সাল নাগাদ আফ্রিকায় এর চাষাবাদ শুরু হবে। বিটা-ক্যারোটিন থাকায় সোনালি রঙ হয়ে যাওয়া এই কলা আসলেই মানুষের মুখে সোনালি হাসি ফোটাতে পারবে কিনা তা জানার জন্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতেই হচ্ছে।

ভক্ষণযোগ্য ভ্যাক্সিন ও অন্যান্য

ঔষধের উত্‍স হিসেবে উদ্ভিদের ব্যবহার যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ঔষধি গুণসম্পন্ন প্রায় ২৮,০০০ গাছের দেখা মিলবে এই দুনিয়ায় যা অবদান রাখতে পারে চিকিত্‍সাবিজ্ঞানে। প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা দুনিয়ার নানা প্রান্তে থাকা গাছের অজানা ঔষধি গুণ কাজে লাগিয়ে তৈরী ঔষধ চিকিত্‍সাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

এছাড়াও জীবপ্রযুক্তি ও জীনপ্রকৌশলের নানাবিধ প্রয়োগে গাছেই উত্‍পাদন করা যেতে পারে খাওয়া যায় এমন প্রতিষেধক! কৃত্রিমভাবে জীনগত পরিবর্তন আনা উদ্ভিদে নানা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন প্রতিষেধক ও প্রয়োজনীয় পণ্য উত্‍পাদন করে যাচ্ছে যা পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। এরূপ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো:

১) ম্যাপ বায়োফার্মাসিটিক্যালস (Mapp Biopharmaceutical, Inc.) –  ZMappTM নামক ইবোলা ভ্যাক্সিনের একটি উপাদান তামাক গাছে তৈরি করছেন তারা।

২) মেডিক্যাগো (Medicago) –  তামাক গাছ ব্যবহার করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও এইচআইভির মতো ভাইরাসের প্রতিষেধক প্রস্তুতের কাজ চলছে এখানে।

৩) ভেনট্রিয়া বায়োসায়েন্স (Ventria Bioscience) –  অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে যে ডায়রিয়া হয়ে থাকে তার চিকিত্‍সায় ব্যবহারের জন্য ধানগাছে ‘হিউম্যান ল্যাকটোফেরিন’ (VEN 100) তৈরি করছে এই প্রতিষ্ঠানটি।

৪) প্ল্যানেট বায়োটেকনোলজি (Planet Biotechnology) – মার্স করোনাভাইরাস সংক্রমণের চিকিত্‍সায় ব্যবহার্য উপাদান উত্‍পাদনের লক্ষ্যে গাছ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি।

গাছে তৈরি করা যেতে পারে খাবারযোগ্য ভ্যাক্সিন বা প্রতিষেধক; ছবিসূত্র: researchgate.net

জৈবজ্বালানির উত্‍স যখন গাছ

উদ্ভিদের নানা অংশ ব্যবহার করে তৈরি করা সম্ভব জৈবজ্বালানি। ভুট্টা, আখ, বিট, ক্যানোলা, জ্যাথ্রোপা, পামতেল, সয়াবিন, সুইচগ্রাসের মতো গাছগুলোর নানা অংশ থেকে তৈরি করা যেতে পারে ইথানল, বায়োডিজেল এর মতন জ্বালানি। জ্বালানি হিসেবে জীবাশ্ম জ্বালানির মতো অত কার্যকরী না হলেও আশা করা যায় বিজ্ঞানীদের উপর্যুপরি প্রচেষ্টায় একদিন উদ্ভিদজাত জ্বালানি জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হবে।

জ্বালানী তৈরি করা যেতে পারে গাছ থেকে! ছবিসূত্র: indianbioenergy.com

গাছ মানুষের বন্ধু এবং গাছকে সম্বল করেই মানুষ গড়ে নিতে পারে সুন্দর, নিরাপদ ও উজ্বল ভবিষ্যত। গাছ ও বিজ্ঞানের মিলিত অবদানে চমত্‍কার, মনোরম ও উন্নত হয়ে উঠতে পারে আগামীর পৃথিবী।

ফিচার ছবিসূত্র- thegallopingbeaver.blogspot.com এবং kids.frontiersin.org

Related Articles