Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একটি খরগোশের রূপান্তর এবং কিছু প্রশ্ন

খরগোশের গল্প শুরু করার আগে প্রকৌশলী এবং কারিগরি সম্পর্কিত কিছু কথা বলতে হবে। না হলে আজকের লেখার গুরুত্ব বোঝানো যাবে না। ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রকৌশলের মূল উদ্দেশ্য কী? মৌলিক বিজ্ঞানের সূত্রাদি ব্যবহার করে এমন কিছু তৈরি বা সৃষ্টি করা যা মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু সব সৃষ্টিরই ভালো-খারাপ দুটো দিকই আছে। যে প্রকৌশলের মাধ্যমে শুরু হয় সভ্যতা, নগর জীবন, কলকারখানা, বিলাসিতা এবং দৈনন্দিন সহজলভ্য জীবনাচার, সেই প্রকৌশলই সমাজে ধ্বংস, বৈষম্যতা, বিগ্রহ ইত্যাদির সৃষ্টির জন্য দায়ী। মূলত মানব সভ্যতাকে যুগে যুগে সামনে এগিয়ে নিতে এবং নিত্যনতুন কিছু তৈরি করা প্রকৌশলের উদ্দেশ্য হলেও আজকাল বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম পরিবর্তন করার জন্য প্রকৌশলকে উপায় হিসেবে অবলম্বন করছেন। যেখানে প্রকৃতি সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে মানব সমাজ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার গুরুতর চেষ্টা করছে। তেমনি একটি চেষ্টা হচ্ছে একটি খরগোশের উদ্ভাবন, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইঞ্জিনিয়ার্ড এবং জেনেটিক্যালি মডিফাইড খরগোশ।  

প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়েই জীবজগত টিকে আছে; Image Source: youtube.com

২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। ব্রাজিলিয়ান জীব-শিল্পী এডওয়ার্ডো ক্যাক নামের এক ব্যক্তি ঠিক করলেন তিনি নতুন একধরনের বিষয়বস্তু তৈরি করবেন, যেখানে এক প্রাণীর “বিশেষ বৈশিষ্ট্যের” জিন আরেক প্রাণীর ভিতর সঞ্চার করা হবে। যে প্রাণীতে এই জিন ব্যবহার করা হবে সেই প্রাণীতে সেই “বিশেষ বৈশিষ্ট্য” অনুপস্থিত থাকতে হবে। ব্রাজিলিয়ান সেই ব্যক্তি ঠিক করলেন, তিনি একটি খরগোশকে এমনভাবে রূপান্তরিত করবেন, যেন খরগোশের শরীর থেকে সবুজ আলোর প্রতিপ্রভা বের হয়। তিনি ফ্রান্সের এক ল্যাবে যোগাযোগ করেন এবং তাদেরকে তার পরিকল্পনার কথা জানান। ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা একটি খরগোশের ভ্রূণের ভেতর একটি জেলিফিশের জিন প্রবেশ করিয়ে দেন। সেই জেলিফিশের বৈশিষ্ট্য ছিল এমন যে, এর শরীর থেকে সবুজ আলোর প্রতিপ্রভা বের হয়। জেলিফিশের যে জিনের কারণে এই সবুজ আলো বের হয় শুধুমাত্র সেই জিনই খরগোশের ভ্রূণে রাখা হয় এবং এর থেকে তৈরি হয় সবুজ আলো নির্গমনকারী খরগোশ, যার নাম দেয়া হয় “এলবা” [১]। ব্যাপারটা অনেকটা সুকুমার রায়ের আবোল তাবোলের খিচুড়ি কবিতার হাঁসজারু কিংবা বকচ্ছপ, মোরগরু, সিংহরিণ বা হাতিমির মতো।

জেনেটিক্যালি মডিফাইড খরগোশ এলবা; Image Source: steemit.com

প্রস্তাবনা শেষ। এবার একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। জীব-শিল্পী এডওয়ার্ডো ক্যাকের এমন উদ্ভট এবং অনৈতিক ইচ্ছা পোষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল বায়ো-টেকনোলজির একটি প্রজেক্টে এই রূপান্তরিত খরগোশকে দেখানো এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এরকম নতুন বৈশিষ্টের প্রাণী তৈরি নিয়ে মতামত নেয়া, রূপান্তরিত প্রাণী তাদের বংশবৃদ্ধিকালে কীরকম আচরণ করে এবং বংশ-পরম্পরায় এই বৈশিষ্ট্য কীভাবে প্রবাহিত হয়– সেসব নিয়ে গবেষণা করা। এই উদ্দেশ্য থেকেই ফ্রান্সের National Institute of Agronomic Research (INRA) এর বৈজ্ঞানিকদের সহায়তায় এই খরগোশ তৈরি হয়।

জেনেটিক্যালি মডিফাইড খরগোশ বংশবৃদ্ধিকালে কীরকম আচরণ করে এবং বংশ-পরম্পরায় এই বৈশিষ্ট্য কীভাবে প্রবাহিত হয়? Image Source: abcnews.go.com

এডওয়ার্ডো ক্যাকের প্রস্তাবনার কারণেই যে বিজ্ঞানীরা এই কাজে মনোনিবেশ করেন তা কিন্তু নয়। ব্রাজিলিয়ান এই শিল্পীর যোগাযোগের প্রায় ১৮ মাস আগেই ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা এমন একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিলেন। এডওয়ার্ডো ক্যাকের কাছ থেকে প্রস্তাব আশার পর দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যায়। যে জেলিফিশের জিন নেয়া হয়েছিলো তার বৈজ্ঞানিক নাম Aequorea victoria। এই জেলিফিশটির শরীরের প্রতিপ্রভা নির্গমনকারী প্রোটিন খরগোশের ভেতর প্রবেশ করানোর পর খরগোশ থেকে যে প্রতিপ্রভা বের হয় তার তীব্রতা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। বিজ্ঞানীদের জন্য এই ঘটনা একটি মাইলফলক ছিল। কিন্তু প্রকৃতি এবং মানবতার দিক থেকে এখান থেকে কিছু প্রশ্নের জন্ম নেয়।

যে জেলিফিশের জিন নেয়া হয়েছিলো তার বৈজ্ঞানিক নাম Aequorea victoria; Image Source: thoughtCo

এই পৃথিবীর এবং পৃথিবীতে জন্ম নেয়া প্রাণীদের প্রায় ৪ বিলিয়ন বছরের ইতিহাস। এত বছরে জীবজগতে যেসব উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জন্ম হয়েছে প্রত্যেকেই টিকে থেকেছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের সূত্র ধরে, যে সম্বন্ধে আমরা ডারউইনের মতবাদ থেকে জানতে পারি। উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীদের ক্রমাগমনের সূত্র ধরে আজকের জীবকূলের আবির্ভাব। কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ কৃত্রিমভাবে তৈরি হয়নি। দুশো বছর আগেও ভাবা যেত না যে জীবজগতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে কখনও পরিবর্তন করা যাবে কিংবা যে বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের মধ্যে নেই সেগুলো অন্য প্রাণীর থেকে নিয়ে স্থানান্তর করা যাবে। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে। এটা কতটুকু নৈতিক?

ফ্রান্সের National Institute of Agronomic Research (INRA); Image Source: TEM partners

প্রকৃতির নিয়ম পরিবর্তনের চেষ্টা করলে কি প্রকৃতি আমাদের ছেড়ে দেবে? খুব সহজ উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি বোঝানো যায়। আমরা সভ্য জগতের মানুষ বন-জঙ্গল, শহরের গাছপালা কেটে ফেলছি, অনিয়ন্ত্রিত এবং পরিকল্পনাহীন কল-কারখানা তৈরি করছি, যা পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে তাপপ্রবাহ তৈরি করছে, এবং যার ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলস্বরূপ অনেক দেশের কিছু কিছু অংশ তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে। গাছপালা কেটে ফেলার কারণে পরিবেশ ঠাণ্ডা হচ্ছে না, বৃষ্টি হচ্ছে না, উত্তরোত্তর গরম বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য খরার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, ফসলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষের খাবার-সংকট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে [২]।  

উপরের মনুষ্যসৃষ্ট কারণ এবং তার থেকে সৃষ্ট ফলাফলের যে কথাগুলো বলা হলো, এর প্রত্যেকটি মানুষের দুর্বুদ্ধিতার ফল। মানুষের এমন আচরণের ফলে প্রকৃতিও নিজের মতো করে এসবের শোধ তুলছে এবং  মানুষই এসবের ভুক্তভোগী হচ্ছে।

ইন-অরগানিক লাইফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর পরিণতি কী হবে বলা মুশকিল; Image Source: EPFL

প্রকৃতি যে জীবজগত নিজের নিয়মে তৈরি করেছে, সেখানে মানুষ যদি প্রকৃতির সেই শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, তার ফলস্বরূপ কী ধরনের দুর্যোগ নেমে আসবে সেটা কি ভেবে দেখা হয়েছে? খরগোশকে প্রকৃতি প্রতিপ্রভা ছাড়া তৈরি করেছে। এটাই প্রকৃতির নির্বাচন। প্রকৃতি জেলেফিশকে সবুজ প্রতিপ্রভা দান করেছে- সেটাও প্রকৃতিরই নির্বাচন। প্রাকৃতিক ডিজাইন বা নকশাকে পরিবর্তন করে মানুষ এখন যে নকশা প্রণয়ন করছে (যাকে মানুষ নাম দিয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত নকশা বা Intelligent Design) তা দিন শেষে ভালো ফল নিয়ে আসবে না। বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো খরগোশদের স্বাভাবিক জীবনকাল এক থেকে দুই বছরের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে, কারণ তাদেরকে নানা প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু গৃহপালিত খরগোশ প্রায় দশ থেকে বারো বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু জেনিটিক্যালি পরিবর্তিত খরগোশ “এলবা” মোটামুটি চার বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিল এবং কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সে মারা যায়। ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা এর কারণ সম্পর্কে খোলাসা করে কিছু বলেননি। কিন্তু তারা এটাও স্বীকার করতে রাজি নন যে, জেলিফিশের জিন স্থানান্তারিত করার ফলে খরগোশটির মৃত্যু হয়।

তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি এবং সূক্ষ্ম-যন্ত্রপাতি বিকাশের ফলে মানুষ এখন অসাধ্য সাধন করছে। স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি, হিউম্যান জিনোম কোডিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলেই সম্ভব হচ্ছে প্রকৃতির সাথে পাল্লা দেয়ার স্পর্ধা। এই স্পর্ধা থেকেই জন্ম নিচ্ছে বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং, সাইবর্গ ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন-অরগানিক লাইফ ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি।

সাইবর্গ ইঞ্জিনিয়ারিং- অভিশাপ নাকি আশীর্বাদ? Image Source: shutterstock.com

বিজ্ঞানের জয়জয়কার হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের বাইরে গিয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নিলে সেটা কতটুকু কল্যাণকর হবে সেটা ভাবার বিষয়। যেমন- ইন-অরগানিক লাইফ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরিণতি কী হবে বলা মুশকিল। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার মতো মাইক্রো-অরগানিজম যেমন অন্য কোনো প্রাণী প্রজাতির মধ্যে থেকে সেখানকার জিনগত বৈশিষ্ট্য নিজের ভেতর নিয়ে নতুন করে নিজেকে তৈরি করে নেয়, ইন-অরগানিক লাইফ ইঞ্জিনিয়ারিংও অনেকটা সেরকম। আমাদের জীবজগত কার্বন দিয়ে অর্থাৎ জৈব যৌগ দিয়ে তৈরি। এছাড়া বাকি সব অজৈব যৌগের ভেতর পড়ে। অজৈব যৌগ দিয়ে এমন জীবন তৈরি করার দিকে বিজ্ঞানীরা এগোচ্ছেন, যারা নিজেরাই নিজেদের তৈরি করবে এবং তাদের অজৈব কোষ আচরণ করবে জীবিতের মতো।

একটি খরগোশকে অন্য রূপে রূপান্তরিত করার মধ্য দিয়ে মানব সমাজে যে যুগের সূচনা হয়েছে, সেটা থেকে বের হওয়া সম্ভব কি না, এই ধরনের কার্কযকলাপ কল্যাণ বয়ে আনবে কি না সেটা সময়ই বলে দেবে। অবশ্যই মানুষ নতুন কিছু জানার পেছনে ছুটবে, নতুনকে আঁকড়ে ধরবে, কিন্তু এতে যেন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। না হলে যে মানব সমাজকে টিকিয়ে রাখতে এত কিছু, সেই মানব সমাজই না বিলুপ্ত হওয়ার পথে চলে যায়!

This article is in Bangla language. It analyzes some of the current practices of Bio-engineering and its future consequences. The article is written with an assumption that Bio-engineering may harm the humanity and natural processes. For references please click on the hyperlinks inside the article.

Featured Image: colorado.edu

References: 

[১] Harari, Y.N. (2014). Sapiens - A Brief History of Humankind, Vintage Books, Penguin Random House, UK, Chapter 20: The End of Homo Sapiens, pg: 445 - 448

[২] Rees, M. (2018). On the Future - Prospects for Humanity, Princeton University Press.  

Related Articles