Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

স্টিভ জবস বনাম স্টিভ ওজনিয়াক: সাফল্য, সুখ ও তৃপ্তিতে কে এগিয়ে

স্টিভ জবস ও স্টিভ ওজনিয়াক একইসাথে অ্যাপল কোম্পানি শুরু করেছিলেন। ওজনিয়াক প্রযুক্তিগত দিকে দক্ষ ছিলেন আর জবস ছিলেন ব্যবসায়িক দিকে পাকা। এ দুজনের হাত ধরে শুরু হওয়া অ্যাপল আজ পৃথিবীর প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান। তবে অ্যাপলের কথা বললে এখন কেবল স্টিভ জবসের নামই উঠে আসে। ওজনিয়াক যেন অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছেন তার ছায়ায়। ওজনিয়াক জবসের মতো খ্যাতি বা অর্থকড়ি অর্জন করতে পারেননি। তাই আজকাল দেখা যায়, অনেকেই জবসকে সফল হিসেবে, আর ওজনিয়াককে তুলনামূলকভাবে ব্যর্থ হিসেবে তুলে ধরেন। আসলে কি তা সঠিকটা বলছে? এখানে আমরা এ দুজনের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো। গোটা চিত্র দেখে একটু বোঝার চেষ্টা করবো, কে বেশি সফল?

স্টিভ ওজনিয়াক ইলেকট্রনিক্সের জাদুকর ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার বাবার সূত্র ধরে শৈশবেই ইলেকট্রনিক্সের প্রতি ভালোবাসার শুরু। দক্ষতার এই দিক থেকে জবস আর ওজনিয়াকের মধ্যে ছিল বিস্তর পার্থক্য। যে বয়সে জবস প্রথম কার্বন মাইক্রোফোন দেখেন, ওজ সে বয়সে বন্ধুদের সাথে কথা বলার জন্য ইন্টারকম সিস্টেম তৈরি করে ফেলেছেন। যে সময় জবস কম্পিউটার সম্পর্কে তেমন কিছু জানতেনই না, ওজনিয়াক তখন নিজে নিজে কম্পিউটার ডিজাইন করতেন।

শৈশবে ওজনিয়াক; Image Source: info-android.com

এ জুটির প্রথম প্রজেক্টটির কথাই ধরা যাক, তারা একটি ডিভাইস বানিয়েছিলেন যা দিয়ে বিনা খরচে টেলিফোন কল করা যেত। এর নাম ছিল ব্লু বক্স। এক ম্যাগাজিনে একজন হ্যাকারের আইডিয়া দেখে ওজ বানিয়েছিলেন সেটি। সে সময়ে ব্যয়বহুল টেলিফোন কলের বাজারে এটি সত্যিই অসাধারণ জিনিস ছিল। এটি দেখে মানুষ কতটা চমকে যাবে তা ভেবেই তিনি উত্তেজিত ছিলেন। জবসের মাথায় আসে, এটি দিয়ে তো ব্যবসাও করা সম্ভব। এরপর তারা এ ফোন বিক্রি করতে শুরু করেন। চল্লিশ ডলারে তৈরি ব্লু বক্সের বিক্রয়মূল্য ধরেন দেড়শো ডলার। দেখতে দেখতেই সবকটি বিক্রি হয়ে গেল। অ্যাপলের শুরুর কাহিনীও অনেকটা এরকম। ওজ জবসকে একটি ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিলেন। হোমব্রু কম্পিউটার ক্লাব নামের এই ক্লাবটি ছিল ইলেকট্রনিক্সে আগ্রহী সব ছেলেপেলেদের মিলনমেলা। ছেলেপেলেরা এখানে তাদের আইডিয়া ও কাজ সম্বন্ধে নিজেদের ধারণা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন।

এ ক্লাব থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ওজনিয়াক নিজে একটি মিনি কম্পিউটার ডিজাইন করেন। এবারও ব্যবসার কথা তার মাথায় আসেনি। তিনি নিজের কাজটি ক্লাবের সবাইকে দেখানোর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। সেখানে সবার কাছ থেকে কিছু বাহবা কুড়ানোর লোভও হয়তো ছিল। এরপর জবসের বুদ্ধিতে তারা এটিকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু স্রেফ সার্কিট বোর্ডটি কিনতে তেমন কেউ আগ্রহী ছিল না।

অ্যাপল-১; Image Source: Wikimedia Commons

লোকজনের চাহিদার প্রেক্ষিতে তারা এটিকে সম্পূর্ণ কম্পিউটারে রূপ দান করেন। এটির নাম হয় অ্যাপল-১। জবসের বাড়ির গ্যারেজে তার আর ওজের হাত ধরে এভাবেই জন্ম নেয় অ্যাপল। উপরের ঘটনাগুলোতে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, ওজ কাজ করতেন কেবল তার কাজ করার আনন্দেই। ব্যবসায়িক চিন্তা তার মাথায় তেমন একটা ঢুকতো না, এসব আসতো জবসের মাথা থেকে।

আসলে ওজ সবসময়ই একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন,

“আমি ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতাম, কারণ ইঞ্জিনিয়াররা মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলে। আজ যে কাজ করতে আপনার পাঁচ দিন লাগছে, ইঞ্জিনিয়াদের কল্যাণে কাল হয়তো তা চার দিনেই হয়ে যাবে।”

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতি এ ভালোবাসাই তাকে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করতো। তিনি যশ-খ্যাতি চাননি, চাননি বিশাল অর্থ সম্পত্তিও। তিনি সুখী হতে চেয়েছিলেন। যখন যা তাকে তৃপ্তি এনে দিয়েছে তিনি তা-ই করেছেন। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়,  অ্যাপল-১ ও অ্যাপল-২ কম্পিউটার দু’টির সফলতার পর জবস যখন তার ম্যাকিন্টশ কম্পিউটার তৈরির কাজ শুরু করছেন, তখন  তিনি ওজকেও এ দলে আনতে চেয়েছিলেন।

স্বপ্নের ম্যাকিনটশ কম্পিউটারের সাথে স্টিভ জবস; Image source: theverge.com

কিন্তু ওজের মাথায় তখন অন্য পাগলামি চেপেছে। হঠাৎ করে তার মনে হলো, দশ বছর আগে তিনি যে কলেজ থেকে ড্রপ আউট হয়েছিলেন, সেখান থেকে ডিগ্রিটা না আনলে ঠিক জমে না। তিনি বার্কলি কলেজে ফিরে আসলেন। কিন্তু তার নামটি ততদিনে ইলেকট্রনিক্স জগতে বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। জানলে অবাক হতে হয়, এ ঝামেলা এড়াতে তিনি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলেন রকি রেকুন ক্লার্ক ছদ্মনাম নিয়ে।

ওজের এ কাজটিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? ম্যাক টিম ছেড়ে কীভাবে একজন ব্যক্তি কলেজে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করতে চলে আসতে পারে, যে গ্র্যাজুয়েশনের কোনো মূল্যই নেই তখন? শুধুমাত্র কর্পোরেট অর্জনকেই যদি সফলতা বলে মন করেন, তাহলে হয়তো বলবেন এটি সম্পূর্ণ নির্বোধের মতো একটি সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ওজ এটি করেছিলেন তার মানসিক তৃপ্তির জন্য। ওজের এ তৃপ্তির সন্ধান করার আরেকটি দৃষ্টান্ত দেখা যায় অ্যাপল যখন শেয়ার বাজারে আসে তখন। অ্যাপল ততদিনে বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি, এর শেয়ার মানে সাত রাজার ধন। তবে তারা এসময় নিয়ম করে যে, কেবলমাত্র অ্যাপলে মাসিক বেতনভোগীরাই এর শেয়ার পাবে। ফলে এমন অনেক ব্যক্তি শেয়ার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়, যারা অ্যাপলের সাথে সেই জন্মলগ্ন থেকে ছিলেন, কিন্তু কাজ করতেন পার্ট-টাইমার হিসেবে।

অ্যাপল-১ এর সাথে ওজনিয়াক ও জবস; Image Source: computerhistory.org

তারা স্টিভ জবসের কাছে অনেক দেন-দরবার করে রূঢ় ব্যবহার ছাড়া কিছুই পাননি। অথচ তারা শুরুর সময়গুলো থেকেই জবস-ওজের সঙ্গী ছিলেন। একটি ঘটনা থেকে এক্ষেত্রে জবসের অবস্থান বোঝা যায়। অ্যাপলের একজন ইঞ্জিনিয়ার সেসব ব্যক্তিদের সহায়তা করতে চেয়েছিলেন। তিনি জবসকে বললেন,“তুমি তোমার স্টক থেকে কিছু দাও, আমরাও কিছুটা করে দেই তাদের।”  জবসের জবাব ছিল,

ঠিক আছে। আমি শূন্যটা দিলাম, বাকিটা তোমরা যোগ করে দাও।

তখন এসব ব্যক্তির সামনে তাদের অনেক পরে আসা কর্মীদের মিলিওনার হতে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। এ সময় ওজনিয়াক তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি তার শেয়ার থেকে বর্তমান বাজারে প্রায় বিশ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের শেয়ার পাঁচজনকে ভাগ করে দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, 

আমি কোনোকিছু কেন করব যদি আমার পাশে আমাকে উৎসাহ দেয়া আমার বন্ধুরাই না থাকে?

এছাড়াও তিনি বাজারে ছাড়ার আগেই, তার ভাগের প্রায় দুই হাজার শেয়ার, অধঃস্তন কর্মচারীদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। যেগুলোর মূল্য মার্কেটে ছাড়ার সাথে সাথে রাতারাতি বহুগুণ বেড়ে যায়। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, তাদের আয়ের মধ্যে আরো সাম্যাবস্থা থাকা দরকার। তিনি একা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাবেন আর অন্যরা কিছুই পাবে না, এমনটি তার নীতি ছিল না। এসব ঘটনা থেকেই ওজনিয়াককে বোঝা যায়। বোঝা যায় তার জীবন দর্শন।

স্টিভ ওজনিয়াক; Image Source: Kris Van de Sande

উপরের কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য কোনোভাবেই ওজনিয়াকের তুলনায় জবসকে ছোট করে দেখানো নয়। জবস তার দিক থেকে অনন্য ছিলেন। প্রযুক্তি জগতে তার অবদান অপরিসীম। ওজনিয়াকের সাথে তিনি যুক্ত না হলে, আজকের অ্যাপলের জন্ম হতো না। মিনি কম্পিউটার হয়তো আরো বহুদিন ওজ নামের এক ইলেকট্রনিক্স পাগলের টেবিলেই পড়ে থাকতো, সবার টেবিলে টেবিলে আসতো না। তাই জবসকে ছোট করে দেখার কোনো প্রশ্নই আসে না।

সমস্যা হলো, যখন আমরা কেবল জবসের অর্জনকে সফলতা বলে আখ্যা দেই, আর ওজনিয়াকের অর্জনকে মূল্য দিতে জানি না। এটি সত্যি যে, ওজ জবসের মতো যশ-খ্যাতি পাননি, তার মতো বিপুল অর্থ সম্পদও অর্জন করেননি। তবু তিনি যেটি অর্জন করেছিলেন তা হলো  সুখ, তৃপ্তি ও বন্ধুত্ব। যেগুলো কোনো মূল্য দিয়ে কেনা যায় না। শুধুমাত্র কর্পোরেট অর্জন মানেই জীবনের সাফল্য নয়।

আমাদের সমাজে চারপাশে তাকালেই দেখবেন কোনোমতে নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলো পূরণ করেও অনেকে সুখে আছেন। অনেকে আবার কর্পোরেট সাফল্যের চূড়ায় উঠেও ভুগছেন হতাশায়। তাই সুখের সন্ধানই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ, অর্থ-বিত্ত বা যশ-খ্যাতি নয়। লিলি টমলিনের বেশ জনপ্রিয় একটি উক্তি বলে শেষ করি,

ইঁদুর দৌড়ের সমস্যা হলো, আপনি যদি এ দৌড়ে জিতেও যান, দিনশেষে আপনি একটি ইঁদুরই থাকবেন।

Related Articles