Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

৪৫০ বছর পুরনো পানাম নগর

চারিদিকে নিস্তব্ধতা, মৃত নগরীর পথে দু-একটা মানুষ। মৃত কোলাহল আর অব্যক্ত ইতিহাস যেন জড়িয়ে আছে এ নগরীর প্রতিটি ইটে। পথের দু’ধারে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকা ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন আর কাঠামোগুলো যেন হারানো জৌলুসের কথা জানান দিচ্ছে। প্রায় ৪৫০ বছর আগে এ নগরী কতটা সমৃদ্ধ ছিলো, তা বারবার ভাবতে বাধ্য করে রাস্তার দু’পাশের দু’তল-ত্রিতল ভবনগুলো। পানাম নগরের পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হতেই পারে, ঈশা খাঁর আমলে চলে গেছেন। কেমন যেন একটা রহস্য জড়িয়ে আছে জায়গাটিতে। প্রতিটি ধ্বংসস্তুপে যেন জড়িয়ে আছে একেকটা কাহিনী। যদিও ধ্বংসস্তুপ বলছি, তবুও এর আকর্ষণের নেই কমতি। ভবনগুলোর নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।

পানাম নগরের প্রবেশ পথ  © লেখক

সোনারগাঁ ও পানাম নগর

একসময় বাংলার রাজধানী ছিলো সোনারগাঁ। তাই সোনারগাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর আর নগরী। সোনারগাঁয়ের ভৌগোলিক অবস্থানের দিকে নজর দিলেই এর গুরুত্ব বোঝা যায়। সোনারগাঁ চারদিক থেকে চারটি নদী দ্বারা বেষ্টিত– উত্তরে ব্রহ্মপুত্র, দক্ষিণে ধলেশ্বরী, পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা। এমন ভৌগোলিক অবস্থান ছিলো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উপযুক্ত। তাই ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ এর আমলে বাংলার রাজধানী ঘোষণা করা হয় সুবর্ণ গ্রামকে, যা পরে সোনারগাঁ হিসেবে পরিচিতি পায়।

১৩৪৬ সালে ইবনে বতুতা চীন, ইন্দোনেশিয়া (জাভা) ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে এর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে সোনারগাঁকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-নগরী রূপে বর্ণনা করেন।

এখানে প্রতিদিনই আসে দর্শনার্থী © লেখক

রাজধানীকে কেন্দ্র করে ক্রমেই গড়ে ওঠে এক অভিজাত শ্রেণি, যারা ছিলেন মূলত বণিক বা ব্যবসায়ী। অভিজাত শ্রেণির বসবাসের ফলে অন্যান্য এলাকা থেকে ব্যবসায়ী ও সওদাগরদের আনাগোনা লেগেই থাকতো এখানে। সেই সময় উঁচু শ্রেণির লোকেদের প্রয়োজনেই; তাদের ব্যবসার সুবিধার্থে সুবর্ণ গ্রামে গড়ে ওঠে কিছু নগরী। এর মধ্যে পানাম নগর অন্যতম। পানাম নগরের প্রবেশপথের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯ শতকের গোড়ার দিকে ধনী হিন্দু বণিকদের দ্বারা এ নগরের প্রসার ঘটে। এ এলাকা প্রসিদ্ধ ছিলো মসলিন কাপড় ও নীল ব্যবসার জন্য।

ইতিহাসবিদ জেমস টেলরের মতে, আড়ংয়ের তাঁতখানা সোনারগাঁর পানাম নামক স্থানে ছিল এবং মসলিন শিল্প কেনাবেচার এক প্রসিদ্ধ বাজার ছিলো পানাম নগর।

পথের দুই পাশে এমনই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়েছে ভবনগুলো © লেখক

বর্তমানে দর্শনার্থীরা যে পানাম নগর দেখতে যান, সেখানে একটি মাত্রই পাকা রাস্তা। ৬০০ মিটার দীর্ঘ আর ৫ মিটার প্রস্থ এ রাস্তার দু’ পাশে রয়েছে সব মিলিয়ে ৫২টি ভবন। ভবনগুলোতে স্থানীয় নিমার্ণ শিল্পের ছোঁয়া থাকলেও মূলত নিমির্ত হয়েছে ইউরোপীয় ও মোঘল স্থাপত্য রীতির মিশ্রণে। একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ভবন রয়েছে এখানে। ভবনের দেয়ালগুলো বেশ প্রশস্ত। দেয়ালগুলো বিভিন্ন আকৃতির ইট আর সুরকি দিয়ে তৈরী। কিছু কিছু ভবনের দেয়ালের অলংকরণ দেখার মতো। নানা ধরনের নকশা, রঙিন কাঁচ, পাথর, কড়ি, চিনামাটি, টেরাকোটা ব্যবহার করা হয়েছে অলংকরণের জন্য। অধিকাংশ ভবনের মেঝে ধ্বংস হয়ে গেলেও কয়েকটি টিকে আছে, বিশেষ করে যে ভবনগুলোতে আনসারদের অবস্থান। মেঝেগুলোর বেশিরভাগই লাল-সাদা-কালো মোজাইক করা এবং কয়েকটিতে দেখা যায় সাদা-কালো মার্বেল।

এই কাশীনাথ ভবনে অবস্থান করছে আনসাররা © লেখক

এখন আমরা যে আধুনিক ঢাকা শহরে থাকি, সেখানে প্রতিনিয়তই শঙ্কিত থাকতে হয় অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে। কোনো বড় ধরনের দুর্যোগ হলে পালিয়ে বাঁচার জায়গাটুকু নেই এ শহরে আর বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গা বা উঠান তো কল্পনার ব্যাপার। ভাবতে অবাক লাগে, ৪৫০ বছর আগে মানুষের কাছে পরিকল্পিত নগরায়নের গুরুত্ব থাকলেও আধুনিক সময়ে এসে আমরা তা উপলব্ধি করতে পারছি না। হ্যাঁ, পানামকে পরিকল্পিত নগর বলাই যায়। এর নগরের প্রায় প্রতিটি ভবনের সাথে রয়েছে ফাঁকা জায়গা বা উঠান। কোনোটি সামনে, কোনোটি পেছনে আবার কোনোটি বাড়ির মাঝখানে। রয়েছে পানির কূপ ও বাঁধানো পুকুর ঘাট। নগর এলাকার চারপাশ ঘিরে রয়েছে গভীর খাল, যা নগরের প্রতিরক্ষার জন্য তৈরী পরিখা বলে ধারণা করা হয়। এখানে রয়েছে বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনা, যেমন- মঠ, মন্দির, প্যাগোডা।

পানাম নগরের প্রকৃতি আর কোলাহলমুক্ত পরিবেশ মুহূর্তের মাঝেই আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে। নিচ থেকে দেখার পর আপনার হয়তো কোনো ভবনের ছাদ থেকে নগরীটাকে দেখতে মন চাইবে। তবে কোনোভাবেই ছাদে ওঠার চেষ্টা করা উচিত নয়, কেননা ভবনগুলো খুবই দুর্বল। স্থানীয়দের কাছে জানা যায়, আগে বেশ কয়েকবার ভবনের ছাদ ধ্বসে দুর্ঘটনা হয়েছে।

পানাম নগরের সংস্কার

শত শত বছর ধরে অনাদরে পড়ে থাকা, এক সময়ের জৌলুসপূর্ণ পানাম নগর সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো কয়েক দফায়। বিভিন্ন সময়ে নেয়া উদ্যোগগুলোর কোনোটিই কার্যকর হয়নি। একবার কাজ শুরু হলেও সে কাজ মূলত নষ্ট করছিলো হারাতে বসা এ নগরীর প্রকৃত রূপ। এতে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ও সুশীল সমাজ আপত্তি করলে বন্ধ করে দেওয়া হয় সে কাজ।

পানাম নগরে ধ্বংস্তুপের এমন রূপ দেখা যায় সন্ধ্যায় © লেখক

২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড বিশ্বের ১০০টি ধ্বংসপ্রায় নগরীর তালিকায় পানাম নগরের নাম অন্তর্ভুক্ত করে। তবে ২০০১ সালেই বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পানাম নগর সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। শত শত বছর পুরনো এ ভবনগুলো দখল করে বসবাস করছিলো স্থানীয় মানুষ। সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে ভবনগুলো উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালায় কর্তৃপক্ষ। ২০০৯ সালে স্থানীয় প্রশাসন পানাম নগরকে সম্পূর্ণ দখল মুক্ত করার পর প্রাথমিক কাজ শুরু করে। তবে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার কাজের নামে ৯টি ভবনে যেনতেনভাবে চুন-সুরকির প্রলেপ দিয়ে নষ্ট করা হচ্ছিলো প্রত্নতাত্ত্বিক সৌন্দর্য। এতে বিশেষজ্ঞরা বাধা দিলে স্থগিত করা হয় সংস্কার। এখন, পানাম নগরের অবস্থা দেখলে বোঝা যায়, অনেক অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভবনগুলো, কখন যেন আর অভিমান ধরে রাখতে না পেরে ভেঙে পড়বে তারা! পাঁচটি ভবনের সংস্কারের জন্য কোরিয়া ভিত্তিক বহুজাতিক কম্পানি ইয়াং ওয়ান এর সাথে চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। বর্তমানে পানাম নগরে আনসার ক্যাম্প থাকলেও চোখে পড়বে ব্যবস্থাপনার অভাব।

বড় সর্দারবাড়ি © লেখক

যেভাবে যাবেন এই নগরে

ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটারের পথ পানাম নগর। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় অবস্থিত পানাম নগর। গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জের বাসে সোনারগাঁ যাওয়া যাবে। নামতে হবে মোগড়া পাড়া মোড়ে। সেখান থেকে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা বা ইজিবাইকে করে যাওয়া যাবে পানাম নগর।

বড় সর্দারবাড়ির প্রবেশ পথ © লেখক

আরো যা দেখতে পারবেন সোনারগাঁয়ে

বড় সর্দারবাড়ির বিখ্যাত দুই অশ্বারোহী  © লেখক

পানাম নগরে উদ্দেশে সকাল সকাল রওনা হলে সোনারগাঁয়ে আরো কিছু জায়গা ঘুরে দেখতে পারবেন। পানাম নগরের কাছেই রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। পানাম নগর থেকে হেঁটেই চলে যেতে পারবেন শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে। হেঁটে গেলে দশ-পনের মিনিট লাগতে পারে। যেতে পারেন রিক্সা বা অটো- রিক্সাতেও। লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে প্রবেশ করেই বামে চোখে পড়ে বড় সর্দারবাড়ি। চোখে পড়বে পুকুর পাড়ে ঘোড়ার পিঠে দুই সৈনিক। আর সোজা গেলে পাওয়া যাবে জাদুঘরটি।

মেঘনা নদীর পাড়; Source: thedailystar.net

কাছেই রয়েছে বইদ্দার বাজার। এখান থেকে নৌকা ভাড়া করে ঘুরতে পারেন মেঘনা নদীতে। আবার নদী পার হয়ে কাছেই মায়া দ্বীপ (স্থানীয় নাম নলচর) ঘুরে আসতে পারেন।

This write-up is about Panam Nagar, a city that is almost 450 years old. Most of the references are hyperlinked into the article and a book is referred below:

- Khan, Muazzam Hussain. Thousand Years of Sonargaon. Dhaka: 2009

Featured Image © Author

Related Articles