Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভিন দেশে ৯ দিন: আসাম পর্ব

মনে করি আসাম যাবো জোড়া পাঙ্খা টঙাইবো
বাবু বলে কাম কাম সাহেব বলে ধরি আন
সরদার বলে লিবো পিঠের চাম
হে যদুরাম ফাঁকি দিয়া চলাইলি আসাম..

কে এই বাবু আর সাহেব, আর কেই-বা এদের সরদার? গানটা শোনার পর থেকেই আসাম নিয়ে এক ধরনের আগ্রহ কাজ করতো। আসামের চা-বাগান আর বাবুদের নিয়ে আছে এক বিস্তর ইতিহাস। এসব ভাবতে ভাবতেই আসাম নিয়ে চলতো নিজের মনে এক কাটাকুটি খেলা। কিন্তু আসামে যে একদিন যাওয়া হবে, তা কখনো ভাবিনি। আসাম যাওয়া হলেও দেখা হয়নি অসমীয়া চা-বাগান। রুট প্ল্যানের খাতিরে শুধুমাত্র গোহাটি ছিল আমাদের উদ্দেশ্য।

আমাদের আসামের যাত্রার শুরুটা শিলং থেকে।  শিলং পর্ব যারা পড়েননি, এই লিংক ক্লিক করে পড়ে নিতে পারেন।

পঞ্চম দিন

শিলং ভ্রমণের পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সবাই লাগেজ গুছিয়ে তৈরি হয়ে গেলাম। নাস্তা সেরে এবার হোটেল থেকে চেক-আউটের পালা। এরপর অপেক্ষা করতে থাকলাম আমাদের গাড়ির। আজকের দিন পুরোটাই জার্নি। কিছুক্ষণ পর আমাদের গাড়ি এলো। তখন ঘড়িতে সকাল ১০টা। ব্যাগ লাগেজ গাড়িতে উঠিয়ে রওনা দিলাম আসামের উদ্দেশ্যে। শিলং থেকে আসামের ড্রাইভিং ডিসট্যান্স প্রায় ৪ ঘণ্টার মতো।

উমিয়াম লেক; Image source: Road trip to Meghalaya – Campers of Mumbai

আসাম যাওয়ার পথেই পড়ে উমিয়াম লেক। বেলা ১২টার দিকে আমাদের ড্রাইভার লেকের কাছে গাড়ি থামালেন। শান্ত সুন্দর, পরিচ্ছন্ন একটি লেক। লেকের গেটের বাইরে কিছু চায়ের দোকান। আমরা গাড়ি থেকে নেমে শেষবারের মতো শিলং শহরটা মনে ভরে দেখে নিলাম। কেউ লেক দেখছে, কেউবা চা খাচ্ছে! কেউ ছবি তুলেছে, কেউ ব্যস্ত গল্পে। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর আবার রওনা দিলাম।

আমাদের গন্তব্য কামাক্ষা মন্দির। বেলা ২টার দিকে আসামের একটি শহরে এসে পোঁছালাম। আশেপাশে তেমন বাড়িঘর বা বিলবোর্ড না থাকায় জায়গাটা ঠিক ঠাহর করতে পারলাম। তার উপরে সবখানেই অসমীয়া ভাষার ব্যবহার। এখানে শিলংয়ের মতো অত  সুন্দর আবহাওয়া ছিল না। কিছুটা রুক্ষ এবং গরমও ছিল সেদিন। স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবারের জন্য বসলাম। খাবার মেন্যু কিংবা রেস্তোরাঁ, কোনোটিই মনমতো হলো না। তবে যারা দলগত ট্যুর কিংবা বাজেট ট্রাভেলিংয়ে অভ্যস্ত, তাদের কাছে এসব ব্যাপার তেমন আহামরি কিছু নয়। গেলাম পাশের একটি কনফেকশনারিতে। টিভিতে দেখা মুখরোচক ইন্ডিয়ান খাবারগুলোর বিজ্ঞাপন মনে মনে আওড়াতে আওড়াতের চোখ বুলালাম দোকানে। তারপর খাবার কিনে ক্ষুধা মেটালাম। এর মাঝে সবার খাওয়া প্রায় শেষ। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা দিলাম গোহাটির উদ্দেশ্যে।

বেলা ৩টার দিকে পৌঁছলাম বিখ্যাত কামাক্ষা মন্দিরে। গত ৪দিন যে ড্রাইভার আমাদের ঘুরিয়েছেন, তিনি এখন নতুন গাড়িতে আমাদের মালপত্র দিয়ে চলে যাবেন। তাকে বিদায় দিয়ে আমরা চললাম মন্দিরের দিকে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম মন্দির।

© লেখক

কামাক্ষা দেবীর এই মন্দিরে শত শত ভক্তের আনাগোনা। কেউ এসেছে দেবী দর্শনে, কেউ-বা এর প্রাচীনত্বের সাক্ষী হতে। প্রচলিত কিংবদন্তির জন্য কামাক্ষা তীর্থযাত্রীদের ভিড়ে পরিপূর্ণ থাকে। মন্দিরে ঢোকার পথেই পাথরের সিঁড়ি। সিঁড়ি ধরেই চারপাশ অনেকগুলো পূজা আর যজ্ঞ-সামগ্রীর দোকান। সিঁড়ি পেরিয়ে প্রবেশ করলাম মন্দিরে। ভারতীয় সহ অনেক দেশের পর্যটকদের আনাগোনা এখানে। পুরোহিত-পণ্ডিত থেকে শুরু করে বিদেশি ফটো জারনালিস্ট, বহু মানুষের সমাগম।

কালিকাপুরাণ মতে, কামাখ্যায় পূজা করলে সব ইচ্ছা পূর্ণ হয়। যেহেতু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান এটি, আমাদের মাঝে অনেকেই দেবী দর্শনে ভেতরে ঢুকল। সেখানে দীর্ঘ লাইন। এর মাঝে আমরা কেউ কেউ দেখছিলাম মন্দিরের নকশা আর পুরনো টেরাকোটার কাজ, আবার কেউ বসেছিল প্রাচীর ঘেরা মন্দিরের ভেতরের উঁচু সেই পাথুরে সিঁড়িতে। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম পুরোটা। তীর্থযাত্রীদের কেউ প্রদীপ নিয়ে মন্দিরের ভেতরে যাচ্ছে, কেউ মন্দির চত্বরের গাছে হলুদ–লাল দাগা বাঁধছে। এভাবেই গেল কিছু সময়।

© লেখক

এর মধ্যে যারা মন্দিরের ভেতরে গিয়েছিল তারা ঘণ্টা খানেক বাদে ফিরে এলো। তখন প্রায় বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা। আমরা মন্দির থেকে বের হয়ে রওনা দিলাম গোহাটি রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে। 

NJP স্টেশন থেকে রাত ১০.৩০ টায় আমাদের ট্রেন ছাড়বে শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে। সময়ের অনেক আগেই আমরা স্টেশনে পৌঁছে গেছি। তাই আমাদের দলের একজনের কাছে ব্যাগের দায়িত্ব দিয়ে আমরা রেল স্টেশনের আশেপাশে একটু ঘুরতে বের হলাম।

ব্যস্ত স্টেশন চত্বর। কেউ অফিস শেষে সারাদিনের ক্লান্তি ট্রেনের অপেক্ষা করছে। আবার স্টেশনের এক কোণায় বসেছে তাসের আসর। কখনো কানে ভেসে আসছে অসমীয়া বুলি, আবার কখনও হিন্দি! একেক স্টেশনে ট্রেন থামছে, যাত্রীরা ছুটে চলেছে অবিরাম। সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে চায়ের দোকানের ছোট্ট ছেলেটা। চিনি কম আর বেশির হিসেব কষতে কষতেই বোধহয় ছোট ছেলেগুলো একদিন চায়ের দোকানের মালিক হয়ে ওঠে। যাই হোক, আমরাও চুমুক দিলাম চায়ের কাপে।

গোহাটি রেলস্টেশন © লেখক

এরপর বের হলাম কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। আসামের সিল্ক শাড়ি বেশ বিখ্যাত। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম জিএস রোডে। এখানে আসাম সিল্ক থেকে শুরু করে, পচমপল্লী, কেরলের তাঁত, ঢাকাই জামদানি আর মটকা- সবই আছে। দামটাও তুলনামূলক কম। কেউ নিজের জন্য, কেউবা গিফটের জন্য কেনাকাটা করছে। এক দোকান থেকে অন্য দোকানে যেতে দেখা হলো আমাদের ক’জন ম্যামদের সাথে। তাদের শপিং ব্যাগের সংখ্যা দেখে বেশ আফসোসও হলো! যাই হোক অবশেষে কেনাকাটা শেষ।

রওনা দিলাম আবার স্টেশনের উদ্দেশ্যে। ঘড়িতে তখন রাত ৯টা। সবাই যে যার মতো খাওয়া শেষ করে ফিরলাম স্টেশনে। ব্যাগ আর লাগেজ নিয়ে অপেক্ষা করছি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের’। ট্রেনগুলো সেখানকার মানুষদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এই ট্রেনে চড়েই প্রতিদিন শত শত মানুষ অফিস রওনা করে মাইলের পর মাইল। আবার সন্ধ্যায় সেই স্টেশন ধরেই বাড়ি ফেরা। 

আসামের বিখ্যাত সিল্ক শাড়ি; Image source: TravelTriangle

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ট্রেন আসলো। এটা  ছিল ভারতে আমার প্রথম ট্রেন ভ্রমণ। ভিড় ঠেলে সবাই উঠে পড়লাম ট্রেনে। একদিকে ম্যাম আর জয়দা আমাদের সিট নাম্বার বলছে, অন্যদিকে আমরা লাগেজের নজরদারিতে ব্যস্ত সবাই। কিছুক্ষণ পর নির্ধারিত কামরা খুঁজে সেখানে গেলাম। ব্যাগ লাগেজ সব ঠিকঠাক করে বসে পড়লাম নিজের সিটে। ট্রেনের কামরাতে এবং আশেপাশে আমদের দলের মানুষজন ছাড়াও স্থানীয় অনেকেই আছে। কথাও হলো অনেকের সাথে। বাংলার সাথে অসমীয়া ভাষার অনেকটা মিল রয়েছে।

রাত বাড়ছে। আমাদের মধ্যে কেউ গান শুনছে, আবার কেউ চ্যাটিংয়ে মগ্ন। ক্যামেরাতে তোলা শিলংয়ের ছবিগুলো দেখতে দেখতে অনেকে ট্রেনের খাবারের স্বাদ নিচ্ছি, সাথে আছে ট্রেনের স্পেশাল চা। এ কামরা থেকে ও কামরায় মাঝে মাঝে যাওয়া-আসা, আর গল্প। সারাদিনের জার্নিতে সবাই তখন বেশ ক্লান্ত। এভাবেই গল্প আর আড্ডায় কাটল আমাদের রাতের ট্রেন জার্নি। 

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। আসামের ভ্যাপসা গরম থেকে যেন ছাড় পেলাম। রেল কামরার ছোট সেই জানালা দুটি দিয়ে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম কোথায় আছি! কিন্তু মাঠের পর মাঠ আর আর সকালের কুয়াশায় কিছুই দেখতে পেলাম না। স্টেশনের পর স্টেশন আসছে, কখনও রেলের বগিগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে। আবার পরক্ষণেই সেখানে দাঁড়ানোর উপক্রম নেই।

কিছুক্ষণ পর শুনলাম পরের ষ্টেশনই নাকি আমাদের নামতে হবে। লাগেজ আর ব্যাগ নিয়ে নামার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম সবাই। শিলিগুড়ি স্টেশনে ট্রেন থামল। তখন ভোর ৬ টা। আসামে বেশ গরম হওয়ায় আমাদের পরনে তেমন গরম কাপড় ছিল না। কিন্তু শিলিগুড়ি স্টেশনে নেমেই গরম কাপড় সবাই রীতিমতো প্যাকেট হয়ে গেলাম। শীত আর কুয়াশায় দূরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। স্টেশনের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা। ভোরের রেলস্টেশন আমাকে বরাবরই টানে, তাও আবার নতুন এক শহরের!  ধীরে ধীরে কুয়াশা কাটল। রওনা দিলাম নতুন গন্তব্যে।

উদ্দেশ্য সাধের দার্জিলিং…

This article Bengali article is a travel-story. This is the second part of the Author's 9 days journey and it is about the Assam. 

Related Articles