Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেঘ, হাওর ও শিমুলের সন্ধানে সুনামগঞ্জে

লাল গালিচা বা রেড কার্পেট, শুনলেই মাথায় আসে রাষ্ট্রীয় কোনো সংবর্ধনা, অস্কার বা গ্র্যামির মতো জাঁকজমকপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠানের ছবি। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, রাজা-বাদশাদের অভ্যর্থনা জানাতে ব্যবহৃত হতো লাল গালিচা। অর্থাৎ, লাল গালিচা যেন এক অভ্যর্থনার প্রতীক। আর এমনই এক বিশাল শিমুল ফুলের লাল গালিচা আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষা করছে সিলেটের সুনামগঞ্জে। গেলেই দেখতে পাবেন হাজারো শিমুল ফুল বিছিয়ে প্রকৃতি তৈরি করে রেখেছে এক বিশাল লাল গালিচা।

লাল শিমুলের ছড়াছড়ি; Image Source: Local Guides Connect

সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর তীর ঘেঁষে প্রায় ১০০ বিঘা জমি নিয়ে বিস্তৃত এই বিশাল শিমুল বাগান। মাঝে যাদুকাটা নদী, তার একপাশে রক্তিম বর্ণের শিমুল ফুলের বাগানম আর অপরপাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিশাল সব পাহাড়। বছরের একেক সময়ে একেক রূপ ধারণ করে এই বাগান। কখনো শিমুল ফুলে ভরা লাল স্বর্গ, কখনো শুধু পাতায় ভরা এক সবুজ উদ্যান, কিংবা কখনো পাতা-ফুলহীন এক চৌচির প্রান্তর। মেঘালয়ের পাহাড়ের পাদদেশে এবং যাদুকাটা নদীর পার্শ্ববর্তী এই শিমুল বাগান দেখতে সবসময়ই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা ভিড় জমায়। একজন পর্যটক হিসেবে যখনই যান না কেন, এই বাগানের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে আপনি বাধ্য। তবে শিমুল বাগানের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে বেছে নিতে হবে ফেব্রুয়ারি মাস। কারণ, বসন্তের এসময় এ বাগান যেন তার সর্বোচ্চ সৌন্দর্য ধারণ করে।

ফেব্রুয়ারি মাস। পরীক্ষা মাত্র শেষ। ক্লাসও ভালোভাবে শুরু হয়নি। আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে ঠিক করলাম শিমুল বাগান দেখতে যাবো। শীত যাচ্ছে যাচ্ছে ভাব, তবে পুরোপুরি যায়নি। যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দিই আমরা। প্রায় ৮ ঘণ্টা ট্রেন জার্নির পর পরদিন ভোর ছ’টা নাগাদ সিলেট শহরে পৌঁছাই। সিলেট শহরে যেহেতু আসা, তাই সকালটা সিলেটের আশেপাশে একটু ঘুরে রওনা দিই সুনামগঞ্জের দিকে। আগের রাতের ট্রেন জার্নি, তার উপর সকাল থেকে অনবরত ঘোরাঘুরির কারণে বাসে উঠে মাত্র সবাই ঘুম। কখন যে দু’ঘণ্টা পার হলো, আর কখন যে সুনামগঞ্জ পৌঁছে গেলাম, টেরই পেলাম না। বাস থেকে যখন নামলাম, তখন দুপুর তিনটা কী চারটা। তারপর যাওয়া এক ছোট ভাইয়ের বাসায়, সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের জন্য এলাহি কারবার। সবাই ভালোমতো উদরপূর্তি করে চলে যাই সুরমা ব্রিজে।

এখানে অপেক্ষা করে সারি সারি মোটরসাইকেল, যাতে করে যেতে হয় তাহিরপুরের নীলাদ্রি লেকে। প্রত্যেকটা মোটরসাইকেলে দুজন করে চেপে বসি। এরপর চলতে থাকে প্রায় দেড় ঘণ্টার মোটরসাইকেল ভ্রমণ। যতই শহর থেকে দূরে যাচ্ছিলাম, ততই কুয়াশা বাড়ছিল আর কুয়াশার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছিল শরীরের কাঁপুনি। যতই শহরের জঞ্জাল পেছনে ফেলে আসছিলাম, ততই যেন মিশে যাচ্ছিলাম প্রকৃতির মাঝে। কখনো কোনো গ্রামের মধ্য দিয়ে, কখনো আবার বিশাল মাঠের মাঝে সরু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের মোটরসাইকেল। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল মেঘালয় রাজ্যের বিশাল বিশাল সব পাহাড়। বার বার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি একটু আগালেই ছোঁয়া যাবে এসব পাহাড়! কিন্তু যতই এগোই, দূরত্ব যেন একই রয়ে যায়। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর পৌঁছাই যাদুকাটা নদীর তীরে। এই সময়টাতে যদিও খুব একটা পানি ছিল না নদীতে, তারপরও নৌকায় করে মোটরসাইকেলসহ নদী পার হই আমরা। তারপর আরও কিছুক্ষণ চলে মোটরসাইকেল ভ্রমণ।

দিনের আলোতে নীলাদ্রি লেক; Image Source: YouTube

অবশেষে রাত আটটা নাগাদ নীলাদ্রি লেকে পৌঁছে যাই আমরা। অল্প জিরিয়ে সবাই আবার লেগে পড়ি তাঁবু টাঙাতে। বাতাসের জন্য তাঁবু ঠিকমতো বসানোও যাচ্ছিলো না, তারপরও বসাতে হলো। তাবু টাঙানো শেষ করে খেয়েদেয়ে সবাই যেন একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এবার প্রকৃতি উপভোগের পালা। অন্ধকার কত সুন্দর হতে পারে, ওই রাত ওখানে না থাকলে কখনো হয়তো জানতাম না। একপাশে বাংলাদেশ, তার অপরপাশে ভারতের বড় বড় সব পাহাড়; তাতে আবার জ্বলছিল সোডিয়াম বাতি আর এই দুই দেশের মাঝে নীলাদ্রি লেক। সোডিয়াম বাতির কী অপরূপ প্রতিবিম্ব তৈরি হচ্ছিলো লেকের পানিতে। লোকালয়ের কোনো শব্দ নেই, একটু-আধটু পানির কলকল শব্দ, সাথে উকেলেলের টুংটাং আওয়াজ, একটু শীত শীত হাওয়া, মাথার উপর অসংখ্য তারা, চোখের সামনে বিরাট পাহাড় আর লেকের সমন্বয়- এ যেন পৃথিবীর মাঝে এক টুকরো স্বর্গ। এভাবে ফায়ার ক্যাম্প, সবাই একসাথে বসে আড্ডা দিতে দিতে রাত কখন যেন শেষ হয়ে যায়।

রাতের নীলাদ্রি লেক; Image Credit: Author   

পরদিন আরও ব্যস্ত শিডিউল। ঘুম থেকে উঠে তাঁবু গুছিয়ে যে যার যার ব্যাগ নিয়ে আবার হাঁটা শুরু। এবারের গন্তব্য লাকমাছড়া। সকালের মিষ্টি রোদে হাঁটতে বেশ লাগছিলো। ছুঁতে চাওয়া সেসব পাহাড়ের গা ঘেঁষেও হাটলাম অনেকটা পথ এবং হেঁটে হেঁটেই লাকমাছড়া চলে আসলাম। এই জায়গাটাও বেশ সুন্দর। তাও বাংলাদেশ ভারতের মাঝে ছোট-বড় নুড়ি পাথরের ওপর বয়ে চলছে পানির স্রোত, অনেকটা জাফলংয়ের স্বাদ পাওয়া যায়। তফাৎ এই যে, শীতকালের কাছাকাছি সময়ে পানি একটু কম থাকে আর জাফলংয়ের তুলনায় পর্যটক সংখ্যাও নগণ্য।

লাকমাছড়ার পরের গন্তব্য ছিল শিমুল বাগান। আমাদের পুরো ট্যুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্পট। সকালের নাস্তা সেরে সুনামগঞ্জ বাজার থেকে সিএনজি করে রওনা হই শিমুল বাগানের উদ্দেশ্যে। অনেক দূর থেকেই নজর কাড়ছিল লাল টকটকে এই শিমুল বাগান। বাগানে প্রবেশ করতে হলে টিকিট কাটতে হয় এবং আমরাও টিকিট কেটেই প্রবেশ করলাম। আর এরপর যা দেখলাম, তা দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না। সত্যিই যেন বিশাল এক লাল গালিচা আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। এত বিশাল জায়গা জুড়ে এ বাগান যে, যেদিকেই তাকাই লাল শিমুল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছিল না।

ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ফুল দিয়ে মালা মুকুট বানিয়ে বিক্রি করছিল, কিছু লোক আবার “ঘোড়ায় চড়বেন?” বলে চেঁচাচ্ছিল। এই সময়টায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা ভিড় জমায় এখানে। দুপুর হয়ে যাওয়ায় রোদ ছিল, তবে গাছের ছায়ার কারণে শরীরকে স্পর্শ করতে পারছিল না ঠিকভাবে। পর্যটকদের কেউ কেউ ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত, কেউ আবার ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল পুরো বাগান, কেউ বা পায়ে হেঁটে হেঁটে। শিমুল গাছ ছাড়াও বেশ কিছু লেবু গাছও চোখে পড়ে। উপরে নীল আকাশ, নিচে রক্তিম শিমুল ফুলের ছড়াছড়ি- এ এক অপূর্ব দৃশ্য।

বাগানের শেষপ্রান্তে যাদুকাটা নদী যা পার হলেই বারিক্কা টিলা। শীতকাল বলে নদীতে পানি ছিল না বললেই চলে। তাই বাগানকে বিদায় জানিয়ে হেঁটেই নদী পার করে ফেলি। পানি ছাড়া নদী দেখতে অনেকটা মরুভূমির মতো। মাথার উপর প্রখর রোদ, বোতলের পানি প্রায় শেষ, কাঁধে বিশাল ব্যাগ আর সামনে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। স্বাস্থ্যের পক্ষে কষ্টকর হলেও বারবার এটাই ভাবছিলাম “আরেহ! আমি তো হেঁটে নদী পার করে ফেললাম।” নদী পার হওয়ার পর আবার গ্রামের রাস্তা ধরে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর আরও কিছু পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে এসে যাই বারিক্কা টিলায়। এটা এমন একটা পাহাড়, যা একইসাথে ভারত ও বাংলাদেশের। দুই দেশের মাঝখানে ১০০ গজ করে করে মোট ২০০ গজ নিয়ে জিরো পয়েন্ট (নিরপেক্ষ একটি স্থান), যা কেবল কিছু বেড়া দিয়ে দুই দেশকে আলাদা করেছে।

বারিক্কা টিলার উপর থেকে পুরো যাদুকাটা নদী খুব ভালোভাবেই দেখা যায়। এখান থেকে নদীটা এত বিরাট মনে হয় যে বিশ্বাসই হয় না, মাত্র কিছুক্ষণ আগেই এ নদী হেঁটে পার করলাম। অবশ্য এই সময়ে নদীর কিছু অংশে পানি ছিল আর কিছু অংশ ছিল একেবারে মরুভূমির মতো শুকনো। উপর থেকে নদীর সৌন্দর্য দেখে লোভ সামলাতে না পেরে আমরা কয়েকজন নেমে পড়ি নদীতে। পানি এতই ঠাণ্ডা ছিল যে একটু আগের ক্লান্তি-গ্লানি সব যেন নিমেষেই ভুলে গেলাম। যেখানে বসে ছিলাম, তার অল্প একটু ব্যবধানেই নৌকা করে কয়লা তুলছিল স্থানীয় লোকজনেরা। পুরো নদী জুড়েই একই দৃশ্য। পানিতে পা ভিজিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ডুবে গিয়েছিলাম অন্য এক জগতে; যেখানে নেই কোনো বিষাদ, নেই কোনো দুশ্চিন্তা বা মন-খারাপি।

প্রকৃতির কোল থেকে একটুও ফিরতে মন চাইছিলো না কিন্তু না ফিরে উপায় নেই। সব মায়াজালকে পিছে ফেলে চলে আসি সুনামগঞ্জ শহরে, সেখান থেকে সিলেটে তারপর রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম।

হাওরের দেশে ঘুরে আসুন; Image Source: Chokkor.com

শিমুল বাগানের লাল গালিচা দেখার উদ্দেশ্যে গেলেও নীলাদ্রি লেকের নীলিমা, লাকমাছড়ার অপরূপ সৌন্দর্য, বারিক্কা টিলার বিশালতা কিংবা যাদুকাটা নদীর উদারতা- সবই যেন আমাদের বুকে টেনে নিয়েছিল, যা দেখে না আসলে হয়তো আফসোস করতাম।

যা করণীয়

বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটকেরা যায় প্রকৃতিকে প্রকৃতির রূপে দেখতে। সৌন্দর্য উপভোগ করা যেমনি আমাদের অধিকার, তেমনি পরিবেশকে সুন্দর রাখা আমাদের দায়িত্ব। তাই পরিবেশকে নষ্ট করা উচিত নয়। যেখানেই যান, সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকবেন, প্রয়োজনে ব্যাগে আলাদা প্যাকেট রাখবেন আবর্জনা ফেলার জন্য। পানির বোতল সবসময় সাথে রাখবেন। গরম পড়লে রোদচশমা ও টুপি রাখতে পারেন। দুর্ঘটনার কথা বিবেচনা করে ফার্স্ট এইড সামগ্রী সাথে রাখতে পারেন। যেখানেই ঘুরতে যান, মাথায় রাখবেন, পরিবেশ যেন আপনার কারণে বিপর্যস্ত না হয়।

This is a Bengali article. This is about a tour to Sunamganj, specifically Shimul Garden that becomes literally a vast red carpet in February.

Featured Image: SAAN Images

Related Articles