ডিম পাহাড় থেকে তিন্দুর দিকে যেতে যেতে দেখি পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভাসছে চারপাশে। সেই মেঘ ভেদ করে একসময় চোখে পড়লো দূরের ঝর্নাধারা। ২০১৬ সালের কথা, সেবার দলে ছিল ৮ জন। ৪ আগস্ট রাতে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু হয় চকরিয়ার উদ্দেশ্যে। যখন চকরিয়া পৌঁছাই তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টির মধ্যেই জিপ ছাড়লো। গন্তব্য আলীকদম। আলীকদম থেকে কিছু শুকনা খাবার আর পলিথিন কেনা হলো। অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস, যেমন- পাহাড়ে ওঠার উপযোগী স্যান্ডেল, স্যালাইন, ফার্স্ট এইড বক্স, টর্চ, ম্যাচ, মোম, ছোট ছুরি, লবণ (জোঁক ছাড়ানোর জন্য), ওডোমস ইত্যাদি ঢাকা থেকেই নেয়া হয়েছিল। এখান থেকে আবার যাত্রা শুরু।
এবারের গন্তব্য ডিমপাহাড়। যাওয়ার পথ, অর্থাৎ আলিকদম থেকে থানচি (৩৩ কি.মি.) রাস্তাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু সড়ক। পাহাড়ের উপর এঁকেবেঁকে চলা রাস্তাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৫০০ ফুট উচ্চতার। পথিমধ্যে বিজিবির চেকপোস্ট রয়েছে। থামলাম একদম ডিম পাহাড়ে এসে।
ট্রেকিং শুরু এখান থেকে। পিচ ঢালা রাস্তার পাশে ইট বিছানো পথের শুরু। তবে কয়েক মিনিট হাঁটার পরেই শেষ হয়ে গেল ইটের রাস্তা। পিচ্ছিল কাদা মাখা, চোরাবালি ভরা, কখনো উঁচু, কখনো নিচু রাস্তায় কিছুক্ষণেই হাঁপ ধরে গেল। পাহাড়ি বন্ধুর পথ, জোঁক আর অনিশ্চয়তার সব ভয়কে চ্যালেঞ্জ করে এই ট্যুরে আসা। একটু বিশ্রাম, পিছিয়ে পড়া, আবার এগোনো। বৃষ্টি শেষের সবুজ পাহাড় আর মেঘের খেলা ক্লান্তি দূর করার জন্য মোক্ষম অস্ত্র ছিল চলার পথে।
এভাবেই প্রায় ৫ ঘন্টা ট্রেকিং করে চলতে চলতে একসময় তিন্দু বাজারের দেখা মিলল পড়ন্ত বিকেলে। বাজার ঘিরেই পাড়া। সাঙ্গু নদীর পাড়ে কাঠের তিনতলা হোটেল আপাতত ঠিকানা। পাঠকদের জানিয়ে রাখি, বাঁশের বানানো হোটেলের ঘরগুলোতে আসবাব বলতে শুধুমাত্র তোষক বিছানো। আর সবার জন্য একটাই কমন বাথরুম। রাতে বাজারের এক দোকানে ডাল, ভাত আর ডিম মিলল সারাদিন পর। ভরপেট খেয়ে ক্লান্ত সবাই ভরা বর্ষার সাঙ্গু নদীর গর্জন শুনতে শুনতে তলিয়ে গেল ঘুমের দেশে।
সকালের পরিকল্পনা নদী পার হয়ে ওপারের খুমিপাড়া। কিন্তু সাঙ্গু নদী এমন ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে যে, সেই চিন্তা বাদ দিতে হলো। তিন্দুতেই কী দেখা যায় সেই ভাবনা শুরু হলো। ওখানকার অধিবাসীরা তথ্য দিল, বেশ বড় এক ঝর্না আছে খানিক দূরে। কিন্তু বর্ষাকালের রাস্তা খুবই বিপদজনক। দ্বিধা দেখা দিল দলে। শেষে স্থানীয় একজনকে গাইড করে তিনজন সাহসীকতার সাথে রওনা দিল বৃষ্টির মধ্যেই। বাকি পাঁচজন তাদের রাস্তা ধরে এগোতে থাকলো। উদ্দেশ্য যতটুকু এগোনো যায়, তবু ঘরে বসে থাকা যাবে না।
বৃষ্টির মধ্যে নানা চড়াই, উৎরাই, কাদায় পিচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তায় আছাড় খেয়ে এগোনো গেল কয়েকমাইল। ক্লান্ত-শ্রান্ত পিছু নেওয়া দল ঝর্নার বদলে পেল এক বড় ঝিরি। এতেই অবগাহন করে ক্লান্তি গেল মুছে। ততক্ষণে বেশি সাহসীরাও ফিরে এসেছে ঝর্নার কাছে পৌঁছাতে না পেরেই। সেখানের রাস্তা পানিতে গেছে তলিয়ে। এভাবেই প্রথম দিন কেটে গেল বান্দরবানে। দ্বিতীয় দিন সকাল। বৃষ্টিমুক্ত রোদ ঝলমলে দিন। সাঙ্গু পার হয়ে খুমিপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আবিষ্কার হলো পথ হারিয়েছি। লোকমুখে সহজ মনে হওয়ায় আর খরচ কমাতে গাইড নেওয়া হয়নি। তার ফলও বোঝা গেল হাড়ে হাড়ে।
যা-ই হোক, নিয়তিকে মেনে নিয়ে সবাই পা বাড়াল দলের অভিজ্ঞ মাসুদের দিকনির্দেশনায়। যে প্রায় কয়েকমাস পরপরই বান্দরবান ভ্রমণ করে। প্রায় ১৫-২০ ফুট উঁচু ঢিবি থেকে গাছের ডাল ধরে ধরে এক ঝিরি পথে নামলাম। সেটা ধরেই এগোলাম। কারণ এই পথ কোনো জলপ্রপাতেরই সৃষ্ট। আর আদিবাসী পাড়াগুলো সাধারণত কোনো ঝর্না বা বড় ঝিরিকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। কিন্তু নানাজনের নানা মতের কারণে সেই ঝিরি ছেড়ে পাহাড়ে উঠে প্রথম বোকামিটা করা হলো। একদম খাঁড়া পাহাড় যেখানে জুম চাষ হয় আর আমবাগান। গাছে পাকা আম, সেগুলো খেতে একটুও কার্পণ্য করা হয়নি, কারণ সবার পেটে ক্ষুধা।
কিন্তু শুধু আমে কি আর পা চলে? উঠছি আর উঠছিই, পথের যেন শেষ নেই কোনো। দুই পা অবশ হয়ে আসে, প্রাণ যায়, তবু পথের দেখা নেই। একটু এগোনো হয়, আবার একটু বিরতি। মনে আশা, এই বুঝি পথ মেলে, এই বুঝি কোনো মানুষের দেখা পাই। কিন্তু কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। যেতে যেতে এমন জায়গায় পৌঁছালাম, যেখানে খাঁড়া পাহাড়ের কিনারে সরু রাস্তা, মাটিতে জোঁক, রাস্তার দুপাশের গাছগুলো ভর্তি বিশালাকায় শুয়োপোকা। সবার গায়ে জোঁক ধরছিল। আর রাস্তাও আস্তে আস্তে আরো সরু হয়ে যাচ্ছিল। এতটাই সরু যে, একটু এদিক ওদিক হলেই সোজা গভীর খাঁদে।
মাঝে মাঝেই রাস্তায় মিলছিল পাকা আনারস, যেন মধু, তবু পথের আশায় মন ভিজছিল না। ওদিকে সন্ধ্যা হওয়ার ভয়। পথ না পেলেও আবার এক ঝিরি পেলাম। ঝিরি তো নয়, যেন জাদু, মুহূর্তেই ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সেই ঝিরিতেই অবশেষে দেখা পেলাম এক আদিবাসীর। তার কাছ থেকেই বুঝতে পারলাম, ভুল পথে ঘোরা হয়েছে। খুমিপাড়ায় ঢোকার মুখেই অদ্ভুত সুন্দর এক ঝর্না যেন স্বাগত জানাল আমাদের। সেই ঝর্নার সৌন্দর্যে এত মুগ্ধ আমরা সঙ্গে সঙ্গেই নেমে গেলাম পানিতে। মেঘ পাহাড়ে ঘেরা, যেন ছবির মত ছোট্ট পরিচ্ছন্ন গ্রাম খুমিপাড়া।
গ্রাম প্রধানের ঘরে উঠলাম আমরা। বিশাল এক ঘর বরাদ্দ আমাদের জন্য। বাঁশের তৈরি ঘরের সাথেই রান্না ঘর। এই ঘরের শৈল্পিক সৌন্দর্য অনন্য। বিকেলে পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে ভাব জমাতে হলো কথা ছাড়াই, কারণ কেউই বাংলা বোঝে না। পরদিন সকালের পরিকল্পনা গ্রাম প্রধানের সাথে তিনটা বিশালাকায় (তাদের ভাষ্যমতে খুম) ঝর্না দর্শন। রাত থেকেই পা ব্যথায় দাঁড়ানোই যাচ্ছিল না। প্যারাসিটামলেও যে কাজ হয়নি বোঝা গেল সকালে। কিন্তু পাহাড় যে ডাকছে। সেই বুনোডাকের অদ্ভুত এক মাদকতা আছে। ঘরে থাকা দায়। অগত্যা বেরিয়ে পড়া দলবলসহ।
ঝকঝকে রৌদ্রজ্জ্বল সকালে যাত্রাপথের চারিদিকে সবুজের সমারোহ আর মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। তবে প্রথম ঝর্নার যত কাছাকাছি পথ ফুরোচ্ছিল, ততই দুর্গম হয়ে উঠছিল রাস্তা। ঘন জঙ্গলের স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারে থাকা জোঁকগুলো সবাইকে খুবই পছন্দ করছিল বুঝি। এত বেশি জোঁক যে হাঁটা যাচ্ছিল না, দৌড়াতে হচ্ছিল। সবারই পায়ে, গায়ে সবখানে জোঁক। ডোরাকাটা টাইগার জোঁকগুলো একটু বেশিই ভয়ংকর। এর মধ্যে দিয়েই প্রায় টারজানের মতো শেকড় বেয়ে নামা হলো প্রথম ঝর্নায়। প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। শুভ্র এই ঝর্নার জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে থাকতে কার না মনে হয় সার্থক মানব জন্ম? এই দৃশ্য ভুলিয়ে দিল পথের ভয়াবহতা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঝর্নায় যাওয়ার রাস্তা দেখে মনে হলো জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারব না।
তৃতীয় ঝর্নার রাস্তা ছিল বেশি ভয়ংকর, তার চেয়েও ভয়ংকর সুন্দর ছিল ঐ ঝর্নার সৌন্দর্য। এসব প্রবল মুগ্ধতা স্মৃতিতে সযত্নে রেখে রওনা দিলাম খুমিপাড়ার দিকে। সন্ধ্যার বান্দরবানের সূর্যাস্ত কত সুন্দর হয় সেটা জানতে পাঠক না হয় ঘুরেই আসলেন কোনো এক খুমিপাড়ার মতো কোথাও। রাতে বনমোরগ রান্না করলাম নিজেরাই। ঘুমাতে যাওয়ার আগে উঠোনের উঁচু জায়গায় বসে গল্প করতে করতে একসময় অনুভব করলাম মেঘ ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের। অভূতপূর্ব সেই রাত।
সকালে খুমিপাড়াকে বিদায় জানিয়ে নৌকায় পাড়ি জমালাম রুমাবাজারের দিকে। নৌকার ভ্রমণও ছিল এক ভিন্ন আমেজের। রুমা বাজার থেকে চান্দের গাড়িতে করে রওনা দিলাম বান্দরবান শহরে। এই রাস্তার ভ্রমণ যেন আমাদের যাত্রার শেষটা মধুময় সমাপ্তি করল। চান্দের গাড়িতে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রোলার কোস্টারের মতোই। নীলগিরি থেমে দাঁড়াতেই মেঘ ঘিরে ধরলো আমাদের। মেঘের মধ্যে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে উঠলাম, তুমি সন্ধ্যারও মেঘমালা...। গোধূলীর আলো মেলাতে মেলাতে আমরাও চিরচেনা শহরের যান্ত্রিক জীবনের দিকে এগোতে থাকলাম। আবার অপেক্ষা… বন্ধুরা মিলে অন্য কোথাও একাত্ম হয়ে যাওয়ার।
This Bangla travel strory exerts a wild tour into the deep and wild Bandarban. Traveller goup had the chance to experience wild beauty of rainy season in the hill tracks as well as a mesmerizing beauty of an tribal village.