Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বান্দরবান ডায়রি: মেরাইথংয়ের ঝড়ে

পরিস্থিতি দেখে বন্ধু বলছিল- খুব তো বৃষ্টি দেখতে চেয়েছিলে, তাই না? এখন ইচ্ছামতো দেখো, জন্মের সাধ মিটিয়ে দেখ, এবারের চোটে জীবনে আর কোনোদিন বৃষ্টি দেখার সাধ থাকব না।

এমন কথার জবাবে বলতে চাইছিলাম- তাও যাই হোক, প্রকৃতির এমন উন্মত্ত রূপ, এমন মাতাল সৌন্দর্য দেখার ভাগ্য কতজনের হয়? এটাও তো একটা লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স! বলার জন্য সবে মুখ খুলতে যাব, ওমনি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে প্রচণ্ড শব্দে কোথাও বাজ পড়ল। প্রমাদ গুণলাম। পাহাড়ের উপরে বলতে গেলে একদমই ফাঁকা জায়গায় গুড়ি মেরে বসে আছি। হালকা কিছু ঝোপঝাড়ের আড়াল আছে বটে, কিন্তু বাজ পড়লে তা আটকানো যে এর কম্ম নয়, তা যেকোনো দুধের শিশুও বলে দিতে পারে।

হঠাৎ কাছেই ফড়ফড় করে কাপড় ছেঁড়ার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে তাকালাম। একটু সামনেই আমাদের একটা টেন্ট কোনোমতে পিচ করা। এর ভেতরে ব্যাগগুলোকে সুরক্ষিত রেখে আমরা ঝোপের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিলাম। দেখি, প্রচণ্ড দমকা হাওয়ায় তার একটা পোল ভেঙে রেইনফ্লাই ছিঁড়েফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে; সেইসাথে বাতাসে একপাশের তিনটি পেগও খুলে গিয়ে রেইনফ্লাই রীতিমতো পতাকার মতো উড়ছে! আর এই ফাঁকে আমাদের সাধের তাঁবু আর ব্যাকপ্যাক, সবই ভিজে সারা। এমন করুণ দৃশ্য দেখার পরেও আর চুপ থাকা গেল না। ঝোপের ভেতর থেকে বের হয়ে তাঁবুর দিকে পা বাড়ালাম।

ঝড়ের ঠিক আগে; Image Credit: Rivu

খোলা জায়গায় আসতেই মনে হলো, যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি সপাটে ধাক্কা মারল– প্রবল বাতাসের তোড়ে সামনে এগোনোই দায়। সেইসাথে গায়ে হুল ফোটানো মুষলধারে বৃষ্টি তো আছেই। এ যেন নেহায়েৎ বৃষ্টি নয়, বরং আকাশে থাকা কোনো অদৃশ্য মেশিনগানের ব্রাশফায়ার, মেঘনাদের অবিরাম বাণবর্ষণ কিংবা আবাবিল পাখির সেই ভয়ংকর নুড়ি-পাথর! ক্লান্তিহীনভাবে পড়ছে তো পড়ছেই, কোনো বিরাম নেই, শেষ হওয়ার কোনো নামগন্ধ নেই– কেবল তীক্ষ্ণ সূচের মতো অসংখ্য জলকণার সারা শরীর জুড়ে আছড়ে পড়া।

এমন নিদারুণ বিপর্যয়ে কীভাবে এসে পড়লাম, সেটা বুঝতে হলে কিছুটা পেছন ফিরে তাকানো আবশ্যক।

বান্দরবানের বর্ষা দেখা– বাকেট লিস্টে ব্যাপারটা জমা ছিল বহুদিন ধরেই, সময়-সুযোগ আর হয়ে উঠছিল না। এ বছর (২০২০) এমনিই এতদিন ধরে প্রায় গৃহবন্দী, বিভিন্ন মানসিক চাপ; আবার অন্যদিকে ক্যালেন্ডারে বর্ষা শেষ হয়ে গেলেও প্রকৃতির যেন তাতে বয়েই গেছে! সেপ্টেম্বরের শেষে এসেও তাই বৃষ্টি হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই। আর এমন নিয়মিত বর্ষণে এই শরতেও বান্দরবানের আনাচে-কানাচে এখনও ভরা যৌবনের ছোঁয়া। সবকিছু মিলিয়ে মনে হলো, এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর হয় না। এমন দিনে ঘরে বসে থাকাও আর চলে না; চার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে হুটহাট প্ল্যানে তাই সোজা আলিকদম।

ভোরে আবাসিক বাজারে এসে যখন নামলাম, তখন প্রায় সাড়ে ছয়টা বাজে। খাওয়ার হোটেলগুলো সবে খুলতে শুরু করেছে। সেখানেই পুকুর ঘাটে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে সোজা বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য শিলবুনিয়া ঝর্ণা হয়ে মেরাইথং জাদি। রাতে সেখানেই ক্যাম্পিং করার ইচ্ছা।

মেরাইথং/মারাইথং/মারায়ন তং, বেশ কয়েকভাবে উচ্চারিত হওয়া এই পাহাড়টির উচ্চতা প্রায় ১৬৪০ ফুট। এটি মূলত বিখ্যাত এর চূড়া থেকে পাওয়া অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যের জন্য। একপাশে মিরিঞ্জা রেঞ্জের পাহাড়সারি, আর অন্যপাশে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলা মাতামুহুরি নদীর সাথে আকাশে ভেসে বেড়ানো পেঁজা তুলার মতো মেঘের সমন্বয় এক অলৌকিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে।

শিল্বুনিয়া ঝর্ণা; Image Credit: Author

শিলবুনিয়া ঝর্ণাটি খুব একটা বড় না হলেও এই বর্ষার সুবাদে পানির প্রবাহ দারুণ। ঝর্ণা দেখে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই আমাদের হাঁটা আবার শুরু হলো। মেরাইথংয়ের চূড়ায় উঠার পথটি এক বিরামহীন চড়াই, কোনো নামানামি ছাড়া একটানা কেবল আপহিলে উঠতে থাকা। আমাদের পাঁচজনের দলে তিনজনেরই এর আগের ট্রেকিং অভিজ্ঞতা বলতে গেলে কেবল কেওক্রাডং আর হামহাম; সেও প্রায় বছর তিনেক আগের কথা। তাই কিছুক্ষণ পরপরই থেমে থেমে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।

এদিকে পাহাড়ের গায়ে ম্রো সম্প্রদায়ের বাস, যদিও চূড়ার নিচের পাড়াটি মারমাদের। ম্রো’রা ঘর বাঁধে পাহাড়ের ঢালে, উঁচু মাচার ওপর। ঘর তৈরির মূল উপাদান বাঁশ। মাচার নিচে যেমন মুরগি, শূকর ইত্যাদি গৃহপালিত প্রাণীর জায়গা হয়, তেমনি কাজে লাগে কাঠ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সংরক্ষণে। দিনের তখন প্রায় মধ্যভাগ হওয়ায় পাড়ায় প্রাপ্তবয়ষ্ক তেমন কাউকেই চোখে পড়ল না, খেলতে থাকা কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে আমাদের হঠাৎ আগমনে কিছুটা বিচলিত হয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কেবল।

ম্রো’দের ঘর যেমন হয়; Image Credit: Shuvo

এভাবে থেমে, থেমে; চলতে, চলতে অবশেষে পৌঁছে গেলাম চূড়ার গজ পঞ্চাশেক নিচে এক সমতল খোলা মাঠের মতো স্থানে। ধর্মীয় কারণে একদম চূড়ায় ক্যাম্পিং করার অনুমতি নেই, এখানেই টেন্ট পিচ করতে হবে। তখনই ঘটল বিপত্তি। দুটি টেন্ট কেবল পিচ করব, এই সময়টুকুও পাওয়া গেল না। তার আগেই হঠাৎ আকাশ ভেঙে বর্ষণ আর সেইসাথে একদম সবকিছু উড়িয়ে নেওয়া বাতাস! একটি টেন্ট কেবল পিচ করা হয়েছে, তার ভেতরে সবার ব্যাগগুলো ঢুকিয়ে ফেলা হলো দ্রুত। আর নিজেদের অবস্থা এর মধ্যেই ভেজা কাকের মতো, কোনোমতে আশ্রয় নেয়া হল পাশেই একটা ঝোপে।

ঐ খাটানো তাঁবুর প্রায় উড়ে যাওয়া, তা আরও আধঘণ্টা পরের ঘটনা। এই কাণ্ডে এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেল, এভাবে টেন্ট পেতে ফেলে রাখা কিংবা এই ব্জ্রপাতের মাঝে আমাদের এই খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেও নিরাপদ কিছু নয়। তাই সিদ্ধান্ত হলো, সবাই মিলে এই বৃষ্টি মাথায় করেই টেন্ট, ব্যাগ সব একসাথে করে একেকজন একেক কোনা ধরে তুলে চূড়ায় উঠে যাব। সেখানে কারবারি দাদার একটা ঘর আছে। চূড়ায় রাত্রিযাপন নিষেধ হলেও এই বৃষ্টির মধ্যে একটু আশ্রয় তো পাওয়া যাবেই। বৃষ্টি থামলে তখন না হয় আবার নামিয়ে আনা যাবে সব।

মেরাইথং চূড়ার বোধিবৃক্ষ; Image Credit: Rivu

প্রবল বর্ষণ আর উন্মত্ত বাতাস ঠেলে পিচ্ছিল পথে একটু একটু করে টেন্ট, ব্যাগ সমস্তই উঠিয়ে নেওয়া হলো। দাদার সে ঘরে উঠেই আগে সবার ব্যাকপ্যাক খালি করার পালা। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা, রেইনকাভার থাকার পরেও পেছন দিক থেকে চুঁইয়ে ঢোকা পানিতে সব শুকনো জামাকাপড় ভিজে একবারে শেষ। এর মধ্যেই তুলনামূলক কম ভেজা লুঙি-গামছা যার যা আছে, তা-ই পরে খাওয়া সেরে ফেলা হলো আবাসিক বাজার থেকে প্যাকেট করে নিয়ে আসা খাবারে।

বৃষ্টি সম্পূর্ণ থামল আরো প্রায় ঘণ্টাখানেক পর। যদিও তখনও ঘন কুয়াশার মতো শীতল সাদা মেঘ আমাদের অতিক্রম করে যাচ্ছে, ঘিরে রেখেছে চারদিক। দূরের পাহাড়ের সকল খাঁজে-ভাজে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘের ভেলা। সদ্য স্নান করা পাহাড়সারি হয়ে উঠেছে আরো উজ্জ্বল, আরো সবুজ। প্রচণ্ড বাতাসে মেঘের চাদর সরে গিয়েছিল কয়েক মিনিটের মধ্যেই; আমরাও তাই আশেপাশের গাছের ডালে, জুমের বেড়ায় ভেজা কাপড় সব মেলে দিয়ে, মেতে ছিলাম প্রকৃতির এই চোখ জুড়ানো অপরূপ সৌন্দর্যসুধা অবলোকনে।

সদ্য বৃষ্টিস্নাত মেরাইথং চূড়ায়; Image Credit: Author

আমাদের সেই ভিজে যাওয়া তাঁবু যতক্ষণে শুকাল, ততক্ষণে সূর্য ডুবে গিয়ে আকাশে উঠে এসেছে সুকান্তের সেই ঝলসানো রুটির মতো উজ্জ্বল চাঁদ! এই চাঁদের আলোতেই নিজেদের মাল-সামান সব গুছিয়ে নিয়ে আবার নিচে নেমে যেতে হলো, সেই খোলা মাঠে– যেখানে বৃষ্টির নির্দয় আগ্রাসনে পড়েছিলাম। ঝটপট তাঁবু গেড়ে সবাই বসে গেলাম রাতের খাবারের প্রস্তুতিতে। ক্যাম্পিং স্টোভ নিয়ে আসিনি সাথে, এমন বর্ষণের পর শুকনো লাকড়ি পাওয়ার সম্ভাবনাও প্রায় শূন্য। তাই বেকার না খেটে, সাথে আনা মুড়ি-চিড়া-চানাচুর বেশি করে ঝাল-তেল দিয়ে মাখিয়ে নেয়া হলো। আর তা দিয়েই হয়ে গেল আমাদের জম্পেশ ডিনার!

ততক্ষণে চাঁদের আলোতে চারদিক রীতিমতো উদ্ভাসিত। এ এমন অদ্ভুত এক সৌন্দর্য– ভাষায় যার ব্যাখ্যা দেয়া অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এর আগে হিমালয়ের সাদা পাহাড়ে জোছনা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু আমাদের সবুজ পাহাড়ের জোছনাও যে তার চেয়ে কোনো অংশেই কম যায় না, আজকের এ রাত যেন সেই উপলব্ধিটি জাগিয়ে তোলার জন্যই।

গৃহত্যাগী জোছনা; Image Credit: Rivu

এমন মায়াময় জোছনায় আমাদের ফটোগ্রাফার বন্ধু বিভিন্ন কায়দা-কসরত করে যাচ্ছে চাঁদ আর তাঁবুর নানান ধরনের ছবি তোলার, আর আমরা বসেছি আড্ডায়। নিজেদের হাজারো জটিলতায় ভরা যান্ত্রিক জীবনটাকে যেন খুবই মেকি মনে হয় পাহাড়ে এলে, আপন করে নিতে ইচ্ছা হয় এখানকার সাদাসিধে মানুষের সহজ-সরল জীবনযাপন। যেখানে এত জটিলতা নেই, অতীতের হাজারো আফসোস, হতাশা কিংবা ভবিষ্যতের এত আকাঙ্ক্ষা-দুশ্চিন্তা নেই, জীবনটা যেখানে কেবলই বর্তমানের। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের শত অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা আর তা পূরণ করতে গিয়ে তৈরি হওয়া কতশত শারীরিক, মানসিক চাপ- তার সবকিছুর মোক্ষম সমাধান নিয়ে যেন স্মিত হাসছে এই পাহাড়ি জীবনযাত্রা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়তই, কত অল্পতেই আসলে সন্তুষ্ট হওয়া যায়, কত সহজেই শান্তি পাওয়া যায়!

উদাস মনে এমন গভীর জীবনদর্শনের আড্ডা সারারাত ধরে চালিয়ে যেতে চাইলেও তা আর হয়ে ওঠে না। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া চাই, কারণ একে তো দীর্ঘদিন পর এত ধকল নেয়া ক্লান্ত শরীর বিশ্রাম চায়; তার উপর আবার কাল ভোরেই নিচে নেমে যেতে হবে। সকাল সকাল রওনা করতে হবে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য, অনিন্দ্যসুন্দর ঝর্ণা দামতুয়ার উদ্দেশে।

This article is in Bangla. It is a travel story to the Merai thong peak of Bandarban and how the travelers dealt with a sudden storm. 

Featured Image Credit: Tanver Revnat

Related Articles