Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বার্সেলোনা: আধুনিকতা আর ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ এক অপরূপ নগরী

ফুটবল ভক্তদের কাছে ‘বার্সেলোনা’ নামটি স্প্যানিশ লিগের এক জনপ্রিয় ক্লাব হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। কিন্তু এর বাইরেও বার্সেলোনার অন্য একটি পরিচয় আছে। স্পেনের অন্য সব শহর থেকে এই শহরটি এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিরাজমান। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন স্বপ্নের শহর বার্সেলোনা। ভূমধ্যসাগরের রানী বলা হয় বার্সেলোনাকে। নৈপুণ্য, কর্মব্যস্ততা, আভিজাত্য, প্রাচীন ইতিহাস এবং আধুনিকতার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এই শহর। চারপাশে সমুদ্র ও পাহাড় বেষ্টিত পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বার্সেলোনার ঐতিহ্য ও নান্দনিক স্থাপত্য পর্যটকদের মুগ্ধ না করে পারে না।

আর তাই পিকাসো-সালভাদোর দালির মতো বিখ্যাত সব চিত্রশিল্পীদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো বারবার কাছে টেনেছে এই শহর। শুধু কি তা-ই! মাদ্রিদের শ্রেষ্ঠ সন্তান ‘দন কিহোতে’ উপন্যাসের লেখক সের্ভান্তাস স্বয়ং ছিলেন বার্সেলোনার অনুরাগী। তিনি লিখেছিলেন

“বার্সেলোনা- অতিথিসেবার পোতাশ্রয়, বিদেশীর আশ্রয়স্থল, গরিবের সেবাসদন, অকপট বন্ধুত্বের স্থান, সৌন্দর্যে অদ্বিতীয়।”

খ্রিস্টের জন্মের আগে রোমানরা নগরটির সন্ধান পায় এবং তারাই প্রথম এখানে বারকিনো নামে এক উপনিবেশ স্থাপন করে। এই ঔপনিবেশিক স্থানটিতে কয়েক হাজার অধিবাসী ছিল। রোমানরা নগরীর চতুর্দিকে প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীর তৈরি করে নগরীর সুরক্ষার জন্য, যার ধ্বংসাবশেষ এখনো শহরের পুরনো অংশে দেখতে পাওয়া যায়। রোমানদের পর ভিজিগথরা শহরটি অধিকারে নেয় এবং নগরীর নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘বারসিনোনা’।

নগরীর চতুর্দিকে প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ ; Source: wikimedia commons

পরবর্তীতে নগরটি অধিকারে নেয়  মুসলমানেরা। প্রায় দু’শ বছর বার্সেলোনা আরব মুসলমানদের অধীনে ছিল। তাদের তত্ত্বাবধানে এই শহর গড়ে ওঠে। খ্রিস্টানদের পুনর্জাগরণের পর নগরীটি কাতালোনিয়া আরাগোন রাজ্যের অধীনে আসে। তখন থেকেই বার্সেলোনা আরাগোন রাজ্যের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। বর্তমানে বার্সেলোনা স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ থেকে প্রায় সাড়ে ছয়শ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বালেরিক সাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত কাতালোনিয়া প্রদেশের রাজধানী বার্সেলোনা।

বার্সেলোনায় রাজাদের প্রাচীন দূর্গ; Source: wikimedia commons

বার্সেলোনা সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায়  শহরে থেকেও এক পা বাড়ালেই চোখে পড়ে দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল জলরাশি। অনেক পর্যটকেই আসেন নিজেদের নাগরিক জীবন থেকে ছুটি নিয়ে পরিবার বা প্রিয়জনের সাথে বার্সেলোনার সমুদ্র সৈকতে নির্জন মুহুর্ত কাটাতে, আর প্রিয়জনের সঙ্গে উপভোগ করতে চান ঐতিহাসিক শহরের আনাচ-কানাচ। পুরো বার্সেলোনা শহরকে কেন্দ্র করে আছে সাতটি সমুদ্র সৈকত। এসব সৈকতে সূর্যস্নান উপভোগের জন্য পর্যটকদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

বার্সেলোনায় সৈকতের সূর্যস্নান উপভোগের জন্য আসেন দেশ বিদেশের বহু পর্যটক; Source: The Telegraph

প্রকৃতির এক অপরূপ লাস্যময় সুন্দরীই বটে বার্সেলোনা নগরীটি। বার্সেলোনা সাগর পাড়ের এক রূপ বৈচিত্রময় শহর। স্পেনের এই শহরটি গত বেশ কয়েক দশক ধরে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। অভিযাত্রী কলম্বাস অজানাকে আবিষ্কারের নেশায় সাগরের বুকে পাড়ি দিয়েছিলেন প্রায় ৫০০ বছর আগে কাদিজ বন্দরের অদূর থেকে, কিন্তু ‘নতুন পৃথিবী’ জয় করে সান্তা মারিয়া বন্দরে ফিরে এই বার্সেলোনায় প্রথম অবতরণ করেছিলেন তিনি। বন্দরে নোঙর ফেলা জাহাজগুলির দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ‘কলোন’ মেমোরিয়ালের চূড়ায় দণ্ডায়মান কলম্বাসের প্রস্তরমূর্তি। বার্সেলোনা শহরকে পুরোপুরি চিনতে গেলে দেল কলোন থেকে শুরু করতে হবে মূল যাত্রা।

‘কলোন’ মেমোরিয়ালের চূড়ায় দন্ডায়মান কলম্বাসের প্রস্তরমূর্তি; Source: YouTube

মন্টজুক এবং তিবিদাবো এই দুটো পাহাড় বার্সেলোনা শহরকে ঘিরে রয়েছে। মন্টজুক পাহাড়ের উচ্চতা ১৭৩ মিটার আর তিবিদাবোর উচ্চতা ৫২০ মিটার। তিবিদাবো থেকে বার্সেলোনা শহরটির প্রায় পুরোটাই দেখতে পাওয়া যায়। বার্সেলোনার ঐতিহাসিক ট্রামলাইন ‘দ্য ট্রামভিয়া ব্লাও’-এর সাহায্যে পাহাড়টিতে ওঠার ব্যবস্থা রয়েছে।

বার্সেলোনা শহরকে ঘিরে থাকা মন্টজুক পাহাড়; Source: flickr.com

কলোন মিনারের পাদদেশে অবস্থিত পুয়ের্তা দে লা পাজ (শান্তির প্রবেশদ্বার)। সেই স্থান থেকে পথ চলা শুরু হয় বার্সেলোনার অপরূপ সুন্দর রাজপথ রামব্লার। কলোন মিনার থেকে কাতালোনিয়া স্কোয়ার পর্যন্ত দীর্ঘ এই রাস্তার দু’ধারে পথচারীদের সবুজের পরশ বিছিয়ে রেখেছে ম্যাপল, বার্চ, চেস্টনাট বৃক্ষরাজি। বিকেল হলেই রামব্লা হয়ে ওঠে আলোয় ঝলমল। এটি বার্সেলোনায় আসা পর্যটকদের প্রধান বেড়াবার জায়গা।

বার্সেলোনার অপরূপ সুন্দর রাজপথ রামব্লা; Source: South China Morning Post

চারপাশে ফুলের দোকান, পত্রপত্রিকা বিক্রেতাদের সারি, আইসক্রিম পার্লার- এসব দেখতে দেখতেই ভ্রমণপিপাসুদের এগিয়ে যেতে হয় বার্সেলোনার প্রাণকেন্দ্র কাতালোনিয়া স্কয়ারের দিকে। সবুজ ঘাসের মাঠের চারিদিকে ফোয়ারা দেখলেই বোঝা যায় সেটি কাতালোনিয়া স্কয়ার। কাতালোনিয়া স্কয়ার বার্সেলোনার প্রাচীন ও আধুনিক শহরের মধ্যে যেন এক সময়ের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বার্সেলোনার আরেকটি দারুণ রোম্যান্টিক জায়গা ফন্ত মাগিকা। ১৯২৯ সালে নির্মিত এই ঝর্ণাটির রাতের আলোকচ্ছটা দেখার জন্য পর্যটকরা অধীর আগ্রহে সারা রাত অপেক্ষা করে।

কাতালোনিয়া স্কোয়ার; Source: TravelingTurks

কাতালোনিয়া স্কোয়ার ও কলোন মিনারের মাঝে রামব্লার দু’ধারে এক বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে পুরনো বার্সেলোনা শহর। বার্সেলোনার প্রাচীন সম্পদের এসব ঐশ্বর্য ভ্রমণপিপাসুরা একদিনে দেখে শেষ করতে পারেন না। এই পুরনো শহরের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে প্লাজা দেল রেই (রাজার প্রাঙ্গন), যাকে ঘিরে আছে আরাগোন রাজাদের প্রাসাদ, কাউন্সিল প্রাসাদ ও গথিক ক্যাথিড্রাল।

বার্সেলোনার গ্র্যান্ড রয়েল প্রাসাদ; Source: yandex.ru

রাজবাড়িগুলো রোমান স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, আবার ক্যাথিড্রাল গথিক স্থাপত্যের এক অনন্য অবদান। এই এলাকার গথিক স্থাপত্যগুলো দেখতে দেখতে আপনার হঠাৎ মনে হতে পারে যেন মধ্যযুগের কোনো এক ধর্মপ্রাণ জনপদে এসে পৌঁছেছেন। চারিদিকে ছোট ছোট চ্যাপেল আর মাঝখানে আকাশচুম্বী ক্যাথিড্রাল। মাঝে মাঝে শুনতে পাবেন গির্জার গর্ভগৃহ থকে ভেসে আসা ঘণ্টাধ্বনি, চোখে পড়বে ধর্মযাজকদের ধীরস্থির পথ চলা।

গথিক ক্যাথিড্রাল; Source: Marriott Traveler

আরো কিছু দূর এগিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে সেন্ত মেরি দেল মারের গির্জা, যার স্থাপত্যশিল্পও এক কথায় অসাধারণ। ১০-১২ মিটার দূরে-দূরে স্তম্ভ, অথচ বিরাট গির্জা দাঁড়িয়ে আছে এই কয়েকটি স্তম্ভের উপরে। সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে রঙিন কাঁচের চিত্রশিল্প- মাতা মেরি, শেষ বিচার, খ্রিস্টের পুনর্জীবন সহ আরও কত কী!

সেন্ত মেরি দেল মারে গির্জা; Source: wikimedia commons

পুরনো শহর থেকে বেরিয়ে এসে মনকাদা স্ট্রিটে রয়েছে পিকাসো মিউজিয়াম। উনংবিংশ শতকের এক শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী পিকাসোর যৌবনকাল কেটেছে এই শহরেই। হাতে নেই অর্থ, ছবি কেনার লোক নেই বললেই চলে, অথচ সালভাদর দালি ও মিরোকে সঙ্গে করে ঘুরে বেড়াতেন শহরের অলিগলিতে, পাগলের মতো ছবি আঁকতেন সারা রাত। ওই দিনগুলিকে পিকাসো কখনোই ভোলেননি। তাই বার্সেলোনাকে দিয়ে গেলেন তার কাছে সযত্নে রাখা ৯০০টি অমূল্য ছবি। মনকাদায় বেরেঙ্গের দে আগুইলার প্রাসাদে রাখা আছে এই চিত্রসম্পদ, যার মধ্যে আছে পিকাসোর আঁকা শান্তির প্রতীক সাদা পায়রা।

পিকাসো মিউজিয়াম; Source: Archilovers

আধুনিক বার্সেলোনার এক অনন্য রূপকার আন্তোনি গাউডি। তার অসাধারণ নকশায় বানানো সাগ্রাদা ফামেলিয়া চার্চ বার্সেলোনার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এটি বিখ্যাত চার্চগুলোর একটি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা চার্চের মধ্যে রং আর আলোর এমন সংমিশ্রণ খুব একটা চোখে পড়ে না। প্রকৃতির অনুপ্রেরণায় গাউডি তার স্থাপত্যের নকশাগুলো তৈরির প্রেরণা পেয়েছেন। ‘পবিত্র পরিবার গির্জা’র গায়ে আলো-আঁধারের সংমিশ্রণে তিনি রচনা করেছেন এক শ্বাসরুদ্ধকর মায়াবী জগৎ। সাগ্রাদা ফামেলিয়া চার্চের ছাদ নির্মাণে তিনি এমন এক আশ্চর্য কলা-কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন, যেখানে মনে হবে এর কলামগুলো গাছের মতো আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে।

সাগ্রাদা ফামেলিয়া চার্চ; Source: wikimedia commons

মনকাদার অদূরে সিউদাদেলা পার্কে অবস্থিত বার্সেলোনার প্রধান চিড়িয়াখানা। ‘প্লাজা দে এস্পানা’ থেকে অল্প হাঁটলে মন্টজুক পাহাড়। অলিম্পিক স্টেডিয়াম এখানে, কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অসাধারণ এই মালভূমি বরাবরই বার্সেলোনায় ‘বিউটি স্পট’ বলে পরিচিত। এই মন্টজুকের প্রবেশ পথেই দেখা যায় জাতীয় সংগ্রহশালা, যার সামনে দণ্ডায়মান বার্সেলোনার একান্ত নিজস্ব ভাস্কর ‘মিরো’র করা অদ্ভুত এক সাদা-নীল-হলুদ প্রস্তমূর্তি। পাহাড়ের উপর জোয়ান মিরোর স্মরণে তৈরি করা হয়েছে এক জাদুঘর। জাদুঘরটিতে শিল্পীর কর্মময় জীবনের নানা চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শিল্পীর তুলিতে কাতালান ফোক আর্টের বিষয় ও রং চোখে পড়ার মতো। এছাড়া শিল্পীর তৈরি নানা ভাস্কর্য এবং সিরামিকের নানা কাজ পুরো শহর জুড়ে চোখে পড়বে।

বার্সেলোনার জাতীয় সংগ্রহশালা; Source: wikimedia commons

মন্টজুকের আছে স্প্যানিশ গ্রামের নমুনা, যা তার ঐতিহ্যমণ্ডিত অতীতকে ধরে রেখেছে মাটির বাড়িতে, গানে-নাচে। মন্টজুকের চূড়ায় দাঁড়িয়ে পাহাড় থেকে সমুদ্র প্রসারিত বার্সেলোনার ‘স্কাই লাইন’ দেখে নিয়ে সময় থাকলে পর্যটকরা ঘুরে আসেন আধুনিক শহরে। ‘দিয়াগোনাল’, ‘আরাগোন’- এসব সুবিশাল রাজপথে সাজানো গোছানো ‘সুপার মার্কাডো’য় ঘুরে বেড়ানো যায়, আর দেখা যায় স্পেনের সৃজনশীল স্থাপত্যের নির্মাতা গাউডির স্থাপত্যের অসমান্য সব নিদর্শন। এসব নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শহরের আনাচে-কানাচে। তার তৈরি গুয়েল পার্কের প্রবেশদ্বার শুধু নয়, বসার বেঞ্চ পর্যন্ত অদ্ভুত কারুকার্যময়।

আন্তোনি গাউডির তৈরি পার্ক; Source: wikimedia commons

বার্সেলোনার পুরনো ও নতুন দুই শহরেই লোকসংখ্যা কম থাকায় ধাক্কাধাক্কি নেই। চারদিকে প্রচুর খোলা জায়গা, অবারিত মাঠ, বিশাল চওড়া রাস্তা, হাঁটার জন্য এবং গাড়ি চলাচলের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত জায়গা, যা সকলকে মুগ্ধ করে। শহরটি যেন প্রথম থেকেই এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক তৈরি করা হয়েছে, যা এককথায় অসাধারণ। এই শহরের আবহাওয়াও পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। সারা বছরেই আবহাওয়ার গড় তাপমাত্রা থাকে ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে। অতিরিক্ত গরম কিংবা অতিরিক্ত ঠাণ্ডা না হওয়ায় পর্যটকদের কাছে বার্সেলোনা অন্য সব শহর থেকে স্বকীয় এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বার্সেলোনার সবকিছুই যেন এক আশ্চর্য সৌন্দর্যের পরিচায়ক। এর রূপগরিমা শুধু মানুষকে সম্মোহিত করে না, ভাবায়ও।

ফিচার ইমেজ- WeBarcelona.com

Related Articles