ভাসমান বাজারের কথা শুনলেই থাইল্যান্ড, ইতালি কিংবা ভারতের পানির উপর ভেসে চলা কোনো বাজারের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু আমাদের দেশের ভিতরেই যে একই রকম আকর্ষণীয় ভাসমান বাজার রয়েছে সে গল্প তিন-চার বছর আগেও বেশিরভাগ মানুষের কাছে অজানা ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই বাজারের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশের ভাসমান এই বাজারটি গড়ে উঠেছে ৩০টি গ্রামের পেয়ারা বাগানকে ঘিরে। আঁকাবাঁকা খাল জুড়ে পেয়ারাবোঝাই নৌকায় বেচাকেনা চলে সারাদিন। ভাসমান এই পেয়ারা বাজারটির ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আর জানা অজানা কিছু তথ্য নিয়েই আজকের এই ভ্রমণবৃত্তান্ত।
নদী বহুলতার কারণে ‘বাংলার ভেনিস’খ্যাত বরিশাল বিভাগ পর্যটন ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ। বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন ক্ষেত্র হলো এই ভাসমান পেয়ারা বাজার। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস এই নদনদী আর অর্থ আয়ের মধ্যে অন্যতম একটি হলো পেয়ারা ও আমড়া’র চাষ। বরিশালের আমড়ার খ্যাতি শোনেনি, এমন খুব কম মানুষ আছে। ঝালকাঠি সদর উপজেলা এবং পিরোজপুরের বানারিপাড়া ও স্বরূপকাঠি উপজেলার কৃষকেরা বিশেষভাবে এই পেয়ারা চাষের সাথে জড়িত। ঝালকাঠির সুগন্ধা, গাবখান, বিশখালী ও সন্ধ্যা নদী দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পেয়ারা চাষের মূল ক্ষেত্র। ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো এই ভাসমান পেয়ারা বাজারটি গড়ে উঠেছে বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলার সীমান্তবর্তী এক মিলনস্থলে। তিন জেলার ৩০ টি গ্রামের ২০ হাজার পরিবার এই পেয়ারা চাষের কাজে নিয়োজিত। ৩১ হাজার একর জমির উপর প্রায় ৭ হাজার পেয়ারা ও আমড়া বাগান রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
বর্ষা মৌসুমে এলাকার নৌকার কারিগরেরা কিছুটা বাড়তি উপার্জন করে থাকেন। প্রায় ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ভাসমান বাজারে বিভিন্ন ধরনের নৌকার কেনাবেচাও হয়। পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানা গ্রামে সাপ্তাহিক নৌকার হাটে এই কেনাবেচা হয়ে থাকে। মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি শুক্রবার এই নৌকার হাট ও পেয়ারা বাজার বসে। বর্ষা মৌসুমে প্রতি শুক্রবারে একদিকে নৌকায় করে কৃষকেরা শত শত মণ পেয়ারা এই বাজারে নিয়ে আসে, আবার অন্যদিকে নৌকায় করেই এই পেয়ারা পাইকারি দরে বিক্রি হয়ে বিভিন্ন বাজারে খুচরা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গ্রাম্য জীবনযাপনের এক অসাধারণ সমাবেশ উপভোগের জন্য এই সময়ে ১০০ এরও বেশি ট্রলারে করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে, এমনকি বিদেশ থেকেও, ভ্রমণকারী ও ফটোগ্রাফারেরা এখানে ভিড় জমায়। আর এমনই এক দিনে সাক্ষী হয়েছিলাম এই ঐতিহ্যবাহী ও অনন্য ব্যবসায়িক প্রথার এই সফরে।
২০১৭ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে এক পূর্ণিমার রাতে, প্রথমবারের মতো বরিশালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। যাত্রা শুরু হয় ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে। এই যাত্রায় সঙ্গী হিসেবে ছিলেন আরও জনা চল্লিশেক মানুষ। এটি আমার প্রথম লঞ্চ যাত্রা না হলেও ডেকে এর আগে যাওয়া হয়নি। ডেকে রাত্রিযাপন করে নদীপথ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাটি এই যাত্রায় অতিরিক্ত পাওনা ছিল। তবে, ফেরার পথে কেবিনেই রাত কাটাই, কারণ পরদিন সকালে ঢাকা ফিরেই অফিসে যোগ দিতে হতো এবং সারাদিনের ধকল শেষে রাতের ঘুম খুব জরুরী ছিল। ডেকে ঘুমোনোর অভ্যাস যাদের আছে, তাদের পক্ষেও পর্যাপ্তভাবে ঘুমানো সম্ভব নয়। কারণ সারা রাত আলো জ্বলতেই থাকে, আর কোনো না কোনো হকারের ডাক শুনতে পাওয়া যায়।
আমরা যারা ডেকে রাত কাটাবো বলে পরিকল্পনা করেছিলাম, তাদের জানিয়ে দেওয়া হয় যেন বিকাল পাঁচটা নাগাদ সদরঘাট পৌঁছে যাই। রাত আটটায় লঞ্চ ছাড়ার কথা ছিল। এখন প্রশ্ন, তিন ঘণ্টা আগে কেন আসতে বলা হলো? কারণ ডেকে কারও স্থান নির্ধারণ করে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে স্থান দখল করার মাধ্যমেই রাত কাটাতে হবে। তাই বৃহস্পতিবার দুপুরের পরে অফিস থেকে বেরিয়ে বিকাল সাড়ে পাঁচটার পরে যখন সদরঘাট পৌঁছলাম, তখন মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে রাত কাটানোর জন্য তেমন জাতের কোনো জায়গা আমি পাচ্ছিনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন আমাদের জন্য নির্ধারিত লঞ্চে উঠে গ্রুপের একজন প্রতিনিধির সাথে দেখা হলো- তখন জানতে পারলাম যে ব্যাপারটা আসলে ততটাও গুরুতর নয়। উল্লেখ্য, ঐ প্রতিনিধি ভাই আরও আগে পৌঁছে আমাদের দলের সকলের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান হিসেব করে একটি সুবিধাজনক এলাকা দড়ি বেঁধে দখল করে রেখেছিলেন। উক্ত সীমানার ভিতরে আবার আমরা নিজেদের ব্যাগ দিয়ে আরও সুনির্দিষ্টভাবে নিজেদের স্থান দখল করে রাখি। রাতের খাবারের পরে যখন ঘুমানোর সময় হলো, তখন এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। যারা নিয়মিত এই পথে যাতায়াত করে তারা সকলেই এই দৃশ্যের সাথে পরিচিত।
রীতিমত ঘরের আমেজে বিছানা গুছিয়ে ঘুমাতে যাওয়া প্রতিটি মানুষ নিজেদের পানির বোতলটি জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। মোটামুটি সবাই একইভাবে ঘুমিয়েছিল। বেশ অবাক হলেও নিজের এই অজ্ঞতা সবার সামনে প্রকাশ করতে পারিনি। শুধু বুঝলাম যে আমি একাই এই বিষয়ে অজ্ঞ নই এবং এই সম্পর্কে পরে এমনিই জানতে পারব। তাই অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু আমরা ঘুমাতে যাই প্রায় ভোরের দিকে। সারারাত মেঘে ঢাকা পূর্ণিমার চাঁদ, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর গান বাজনার মাঝে নতুন পরিচিত ভ্রমণকারীদের সাথে গল্প গুজবেই রাত কীভাবে পার হয়ে যায় টের পাইনি। লঞ্চে কাটানো এই সময়টা নিজেই যেন এক পূর্ণ অভিজ্ঞতা! লঞ্চের ভিতরেই রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয় যা আমার মতে যথেষ্ট ভালমানেরই ছিল। এছাড়াও লঞ্চের ভিতরে সারারাত ধরেই চা-নাস্তার ব্যবস্থা থাকে। রাতের শেষদিকে যখন আর জেগে থাকতে পারছিলাম না তখন ডেকে নিজের জন্য নির্ধারিত স্থানটিতে গিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করি। ভোর চারটা বাজার আগেই লঞ্চের ভেঁপু বাজিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় যে আমরা ঘাটে পৌঁছে গেছি।
ঠিক এই সময় খেয়াল হলো, কিশোর বয়সী বেশ কয়েকটি ছেলে পুরো ডেক জুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। তাদের গায়ে একটি বিছানার চাদর ঠিক ঝোলার আকৃতিতে জড়ানো রয়েছে। একটু ভালভাবে লক্ষ করতেই দেখা গেল, আমার মতো যারা পানির বোতল কোলে নিয়ে ঘুমোয়নি তাদের বোতলগুলি নিমেষেই চাদরে তৈরি ঐ ঝোলার ভিতরে চালান হয়ে যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, চোখের সামনে থেকে আমারটাও গেল। যদিও সামান্য পানির বোতল, কিন্তু অভিজ্ঞতাটা মোটেও সামান্য ছিলনা।
লঞ্চ থেকে নেমেই স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় নাস্তা সেরে আমরা বাসে করে বানারিপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। বানারিপাড়া পৌঁছে সন্ধ্যা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রলারের ছাদে বসে ভীমরুলির ভাসমান পেয়ারা বাজারের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। পুরো নদীপথেই অসংখ্য সেতুর দেখা মেলে- কোনোটি বাঁশের তৈরি, কোনোটি কংক্রিটের। কিছু কিছু সেতু এত নিচু ছিল যে ট্রলারের ছাদে শুয়ে পরে আমাদেরকে নিজেদের মাথা সুরক্ষিত করতে হয়েছিল। নদীপথে চলতে চলতেই চোখে পড়ল অসংখ্য পেয়ারা ও আমড়া বাগান। আমড়া ধরে কিছু কিছু গাছের ডাল এত নিচু ছিল যে। তা আমাদের ট্রলারের ওপর রীতিমত হাতের নাগালে চলে আসে। আমড়া তখনো পর্যাপ্তভাবে বেড়ে ওঠেনি। চলতে চলতেই দেখলাম পেয়ারা চাষিরা বাগানে কাজ করছে, আবার কেউবা নৌকা বেয়ে পেয়ারা বাজারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাচ্ছে।
বাজারে পৌঁছানোর পরে আমরা ইচ্ছামত বাজারে সময় কাটালাম। পেয়ারা কিনলাম। এখানে এক-দুই কেজি হিসেবে পেয়ারা কেনা সম্ভব নয়। নৌকায় যে কয় কেজি রয়েছে তার পুরোটাই কিনে নেওয়া উত্তম। বেশ সুলভেই বিক্রি হয় এই পেয়ারা। কোনোরকম ক্ষতিকর সারের প্রয়োগ ছাড়াই এই পেয়ারা উৎপাদন হয়ে থাকে। পেয়ারার পাশাপাশি কাঁচা কলা ও লেবুও এখানে পাইকারি হিসেবে বিক্রি হচ্ছিল। আর নৌকা বেয়ে এসকল ফল বাজারে নিয়ে আসা কৃষকদের মধ্যে ছেলে-বুড়ো সকল বয়সের মানুষই ছিল। শুক্রবারে স্কুল বন্ধ থাকায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও বাবার সাথে নৌকায় করে এই বাজারে আসে আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ব্যবসায়ের হাতেখড়ি লাভ করে।
পেয়ারা বাজার ঘুরে এসে কুড়িয়ানা গ্রামের এক স্থানীয় অধিবাসীর বাড়িতেই আমাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল। তারপরে আমাদের গন্তব্য ছিল দুর্গাসাগর ও গুঠিয়া মসজিদ। এই দুইটি স্থানও বেশ বিখ্যাত। সবশেষে আমরা আবারো বরিশাল লঞ্চ ঘাটে ফিরে যাই। তবে এবারে ডেকের পরিবর্তে লঞ্চের কেবিনে রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল ৭ টার আগেই ঢাকা পৌঁছে যাই। সব মিলে মোটামুটি ৩৮ ঘণ্টা। আর খরচ ছিল মাত্র ২০০০ টাকার মতো।
This article is written in Bengali and is an informative travel story based on the autor's personal experience. Relevant sources of information are hyperlinked inside the article.
Featured Image: Offroad Bangladesh