Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্র্যাভুয়াঁ: নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ছবি তোলা নিষেধ যে গ্রামে

ব্র্যাভুয়াঁ সুইজারল্যান্ডের একটি ছোট্ট গ্রাম। যেন স্বপ্নের মতোই এক গ্রাম এটি। ৫৬.২ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত গ্রামটিতে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটে। প্রকৃতি যেন তার ঐশ্বর্য দিয়ে গ্রামটিকে সাজিয়ে তুলেছে। কী নেই গ্রামটিতে? গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গছে আলেবুলা নদী। আর নদীর সাথে তাল মিলিয়ে চলে গেছে আলেবুলা বাইপাস সড়ক। আছে বিস্তৃীর্ণ পাহাড়ের সারি। ঝর্ণার কলকল ধ্বনি আগত ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ না করে পারে না।

মানচিত্রে ব্র্যাভুয়াঁর অবস্থান; Source: GoogleMap

ছবির মতো ঝকঝকে সুন্দর গ্রামটিতে এলে মানুষ বিস্মৃত হয়ে যায় তার দুঃখময় স্মৃতি, ভাবনায় আর থাকে না ভবিষ্যতের নানা চিন্তা। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে নিখাদ ছুটি উপভোগই তখন প্রধান ব্যঞ্জনা হয়ে দেখা দেয় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষের হৃদয় জুড়ে। প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্যকে দু’চোখ ভরে উপভোগ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। দিগন্ত বিস্তৃত নয়নাভিরাম সৃষ্টিশীলতাকে হৃদয়ে ধারণ করার জন্য যেন তারা আকুল হয়ে পড়েন।

গ্রামের সাজানো-গোছানো বাড়ি; Source: Wikimedia Commons

ব্র্যাভুয়াঁর ২১.৪ শতাংশ জমি ব্যবহৃত হয়েছে কৃষিকাজে, আর শুধুমাত্র ০.৮ শতাংশ জায়গা সরকারি ও জনগণের স্থায়ী নিবাস ও নানা অফিস-আদালত তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া বাকি ২০.০৪ শতাংশ এলাকা জুড়ে বিশাল বনভূমি ও অবশিষ্ট ৫৭.৫ শতাংশ জায়গা রয়ে গেছে বিশাল বিশাল পাহাড় ও নদীবেষ্টিত অবস্থায়। এই জায়গাগুলোই মূলত পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সরকারি ও বেসরকারি ঘর-বাড়িগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সেগুলো প্রকৃতির সৌন্দর্যে কোনো বিরূপ প্রভাব না ফেলে। সাজানো-গোছানো বসতবাড়িগুলোতে নানা-কারুকার্যময় নকশা গ্রামবাসীর রুচিশীল মানসিকতার পরিচয় বহন করে।

ব্র্যাভুয়াঁ গ্রামটির চারপাশের নৈসর্গিক প্রকৃতি; Source: lonelyplanet.com

২০১৬ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রামটির মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫৩০। এখানকার অধিবাসীরা নানা পেশায় জড়িত। তারা মূলত জার্মান, ইতালীয় এবং রোমানশ ভাষায় কথা বলে। উনিশ শতকে রোমানশ ভাষাটি এখানকার অধিকাংশ জনসাধারণেরই মুখের ভাষা হিসেবে প্রচলিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই ভাষা ক্রমশ তার স্থান হারাতে থাকে। সেই যুদ্ধ থেকে বাঁচার জন্য জার্মানি ও ইতালির অনেক নাগরিক এদেশে এসে ভিড় করে। ফলে তাদের মুখের ভাষার প্রাধান্য বাড়তে থাকে গ্রামটিতে।

গ্রামের পাশে বয়ে যাওয়া আলেভুলা নদী; Source: Wikimedia Commons

সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে সাজানো গ্রামটিতে রয়েছে প্রাচীন রোমানশ সভ্যতার নিদর্শন সম্বলিত একটি চার্চ। এখানকার চেস জেনেস্কের ঘোড়দৌড়ের স্থানটি সুইজারল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে প্রসিদ্ধ। বোটিং ও রিভার রাফটিংয়ের জন্য আলেভুলা নদী তো রয়েছেই। বিস্তীর্ণ আলেভুলা উপত্যকা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। যারা পাহাড়ে হাইকিং করতে চান, তাদের জন্য আলেভুলা উপত্যকা অপার নৈসর্গিক দৃশ্য নিয়ে অপেক্ষা করছে। উপত্যকার চূড়া প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণের জন্য এক আদর্শ স্থান। এছাড়াও কৃষিভিত্তিক পর্যটনকে আকর্ষণ করার জন্য রয়েছে ইলা ন্যাশনাল পার্ক। গ্রামটিতে স্যুরাভুঁয়া নামক এক স্থান রয়েছে, যা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ৩ কিলোমিটার আর প্রাকৃতিকভাবেই বরফে আচ্ছাদিত। আইস ট্রেকিং ও স্কেটিং করার জন্য এখানে পর্যটকদের রীতিমতো ভিড় লেগে যায়।

স্যুরাভুঁয়ার বরফাচ্ছিদত স্থানে ভ্রমণপিপাসুদের নানা খেলায় মেতে ওঠে; Source: Switzerland Tourism

আলেভুলা রেলওয়ে নির্মাণের পর থেকে ব্র্যাভুয়াঁয় পর্যটকদের আসার সকল রকম সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হলেও, সেই রেলওয়ের ব্যবস্থাপনা ততো আধুনিক নয়। রেললাইনের বেশ কয়েকটি জায়গায় বিশাল বিশাল সর্পিল আকারের টানেল আর সেতু রেলে ভ্রমণকারী পর্যটকদের এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি প্রদান করে। ১৯৪৫ সালে  নির্মিত ‘কুরহাস বারগুন’ হলো এই গ্রামের একমাত্র হোটেল, যা গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরেই অবস্থিত। তবে বর্তমানে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গ্রামবাসীরা পেয়িং গেস্ট হিসেবেও পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে।

২০০৮ সালে আলেবুলা রেলওয়ে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায়। এই রেলওয়ের সাথেই রয়েছে একটি প্রাচীন জাদুঘর। জাদুঘরটিতে গ্রামটির ঐতিহ্যের নানা ইতিহাস যেমন সংরক্ষিত রয়েছে, তেমনি রয়েছে আলেবুলা রেললাইন তৈরির এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। প্রেইডা থেকে ব্র্যাভুয়াঁ যাওয়ার রেললাইনটির একটি রেপ্লিকা এই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে।

সুইজারল্যান্ডের এই ছোট্ট গ্রামটিতে প্রতি বছর দেশ-বিদেশের বহু পর্যটকের সমাগম ঘটে। চোখ ফেরানো যায় না এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে। যারা এই গ্রামে গিয়েছেন, গ্রামটির সৌন্দর্যে প্রত্যেকেই বাকরূদ্ধ হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব ছবি শেয়ার করে জুটেছে বন্ধুদের আক্ষেপ। তাই তো ছবির মতো সাজানো গ্রামটির দৃশ্য নির্ধারিত করা হয়েছে শুধুমাত্র পর্যটকদের দর্শনের জন্য। গ্রামের চারপাশের প্রাকৃতিক সকল সৌন্দর্য হৃদয়ে ধারণ করে রেখে দিতে পারেন চিরদিনের সঞ্চয় হিসেবে। কিন্ত তাই বলে সেই স্মৃতিগুলো ফটো ফ্রেমে আটকে রাখবেন, আর অন্যদের সেসব দৃশ্য দেখিয়ে দূঃখ দেবেন, তা কখনোই হবে না। সেজন্য এই গ্রামের পর্যটন দপ্তর গ্রামটির কোনো ছবি তোলা পর্যটকদের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছেন। যদি এই  নির্দেশ কোনো পর্যটক অমান্য করেন, তবে তাকে দিতে হবে জরিমানা।

দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর; Source: youtube.com

এই অদ্ভুত নিয়ম সম্পর্কে এই গ্রামের অধিবাসীদের মতামত এই যে, গ্রামের দিগন্তজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্য যারা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন না, তাদের দুঃখের কারণ হবে যদি তারা স্থিরচিত্রের মাধ্যমে এ দৃশ্যগুলো দেখেন। আর সেজন্য স্থানীয় পৌরসভা একটি আইন করে এই গ্রামের  এবং এর চারপাশের অসাধারণ ভূ-প্রকৃতির ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। কেউ যদি এই আইনের অমান্য করে এবং হাতেনাতে ছবি তোলার সময় ধরা পড়ে, তাহলে তাকে ৫ ফ্রাঙ্ক জরিমানা গুণতে হবে।

গ্রামটিতে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পর্যটকদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, এখানে ছবি তোলা নিষেধ; Source: lonelyplanet.com

ব্র্যাভুয়াঁ পর্যটন অফিসের এক ওয়েবসাইটে এই ছবি তোলা নিষিদ্ধের সপক্ষে এক বিবৃতি দিয়ে জানানো হয় যে, অন্যকে দুঃখ দেওয়ার অধিকার কারোরই নেই। গ্রামটিতে কাটিয়ে যাওয়া একজন ব্যক্তির সুন্দর ছুটির দিন ও গ্রামটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে সেই ব্যক্তির মুগ্ধ হওয়া দেখে অনেকেই মুগ্ধ হতে পারেন। কিন্তু যেসব ব্যক্তির ওই গ্রামে যাওয়ার আর্থিক ক্ষমতা নেই, বা কোনো কারণে যেতে পারছেন না, সেসব ব্যক্তি মানসিকভাবে ব্যথিত হবেন। সেটা কখনোই ব্র্যাভুয়াঁবাসীর কাম্য নয়। ব্র্যাভুয়াঁর জনগণ বিশ্বের মানুষের সুখের বিষয়ে খুব চিন্তিত। তারা চায় না, তাদের কারণে পৃথিবীর মানুষেরা কোনোরূপ দুঃখ পায়, হৃদয়ে কষ্ট অনুভব করে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্র্যাভুয়াঁর জনগণ ও তার প্রকৃতির কোনো ছবি দেখে, যারা গ্রামটি দর্শনে আসতে পারছে না, তাদের মন যাতে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তে না পারে; সেজন্য জনগণের তরফ থেকেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয় বিবৃতিতে।

দিগন্তজুড়ে ফসলের মাঠ; Source: typist.ph

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই দেখা গেছে, যেসব পয়টক ব্র্যাভুয়াঁতে ভ্রমণে এসেছেন, তাদের  প্রকৃতির সাথে তোলা হাসি-খুশি, আনন্দদায়ক ছবি দেখে অনেকে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন্তব্য করেছেন, যা ব্র্যাভুয়াঁর জনগণের কাছে কিছুতেই কাম্য নয়। একারণেই ব্র্যাভুয়াঁর পর্যটন ওয়েবসাইট এবং সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তাদের আপলোড করা সব ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

শীতকালে তুষারে ঢাকা গ্রামের প্রকৃতি; Source: booking.com

এই গ্রামটিতে গেলে আপনি মুগ্ধ হবেনই, নিঃসন্দেহে বলা যায় সেটা। কিন্তু সেই মুগ্ধতা কারও সাথে শেয়ার করতে পারবেন না। ছবি তুলতে খুব ইচ্ছে করবেই। কিন্তু প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা আপনাকে ছবি তুলতে বাধা দেবে। পাছে জরিমানা গুণতে হয়। তাই প্রকৃতির এই অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করতে একবার হলেও ব্র্যাভুয়াঁ গ্রামটিতে আপনার আসতে হবে। ছবি কিংবা সেলফি নয়, হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে হবে এর সৌন্দর্য।

ফিচার ইমেজ- independent.co.uk

Related Articles