Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অল্প সময়ে, স্বল্প টাকায় আমার দেখা কলকাতা (পর্ব-১)

আরে, এ তো সেই কলকাতা, যেখানে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকেরা দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন! পাশ কেটে যাওয়া বাসে লেখা – মৌলালী, এন্টালি, কসবা। ওদিকে গুগল ম্যাপে চোখে পড়ছে রিপন স্ট্রীট, পার্ক স্ট্রীট… আরে, আমি তো এগুলো চিনি। নচিকেতা, সুমন, অঞ্জনদের সাথে হেডফোনে চড়ে কত বেড়াতে গেছি!

“আমি পাইলাম। আমি ইহাকে পাইলাম” – হ্যাঁ, এটাই মনে হচ্ছিলো, যখন বাস থেকে নেমে কলকাতার ধর্মতলা টার্মিনালে পা রাখলাম, প্রথমবারের মতো। জানুয়ারির ২২ তারিখ। সকালের কাঁচামিঠে রোদে চিকচিক করছিলো দূর থেকে উঁকি দেওয়া টিপু সুলতান মসজিদের মিনারখানি।  

বরাবরই শহুরে চাকচিক্যের চেয়ে ‘পুরাতন’ আমায় টানে বেশি। কলকাতার নিজস্বতাও যেন এই পুরাতনেই লেপ্টে আছে। ওদিকে বাঙালির এই প্রাণের শহর ঠাসা অজস্র বৈচিত্র্যে – তা সে সংস্কৃতি হোক, বা জাতিসত্ত্বা। তাই চূড়ান্ত সস্তায় পুরাতন অলিগলি ঘেঁটে মাত্র আড়াইদিনে সর্বোচ্চ পরিমাণ বৈচিত্র্য আবিষ্কারের পরিকল্পনাই সাজিয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম, পা আর মেট্রোরেল হবে পুরো যাত্রার সঙ্গী। আর গুগল ম্যাপ দেখাবে পথ।

সে মতনই বেরিয়ে পড়েছিলাম দুই বন্ধু। পঞ্চগড় দিয়ে ঢুকে প্রথমে গিয়েছিলাম দার্জিলিং। তিনদিন ওদিকটা ঘুরে তারপর শিলিগুড়ি থেকে বাসযোগে পাক্কা ১৫ ঘণ্টায় কলকাতা। কলকাতায় আরো একদিন আগেই আসবার কথা ছিলো। সেদিন, অর্থাৎ ২১ তারিখ দমদমে ছিলো ফসিলস ব্যান্ডের কনসার্ট। খুব ইচ্ছে ছিলো দেখবার। কিন্তু পঞ্চগড়গামী রেলগাড়িটির ৬ ঘণ্টা বিলম্ব পুরো শিডিউল ওলটপালট করে দিয়েছিলো আমাদের।

কাঁধের ব্যাগ প্রায় ৪ কিলোগ্রাম ছিলো। সাথে কনসার্ট মিস করবার টাটকা দুঃখ। কিন্তু প্রিয় শহরে প্রথম পা রাখবার ভালোলাগায় সেসব মন্দলাগা ম্লান হয়ে যাচ্ছিলো। গুগল ম্যাপ দেখেই এগোচ্ছি। গন্তব্য- হোটেল। গোসল করে মালপত্র রুমে রেখে কত দ্রুত ঘুরতে বেরোবো, তা-ই ভাবছিলাম।

বাংলাদেশিরা কলকাতায় এলে মূলত থাকেন দু’টো জায়গায়। মারকুইস স্ট্রীট অথবা ধর্মতলা নিউ মার্কেট এলাকায়। আমাদের যেহেতু উত্তর কলকাতাই মূলত ঘুরবার শখ, তাই থাকার জন্য নিউ মার্কেট এলাকাকেই বেছে নিয়েছিলাম। ওখানকার এসপ্ল্যানেড মেট্রোস্টেশন থেকে সহজে নানা জায়গায় যেতে পারবো, এটাও মাথায় ছিলো। যা-ই হোক, রাতপ্রতি ৯০০ টাকা ভাড়ায় উঠলাম মির্জা গালিব স্ট্রীটের সেন্টারপয়েন্ট গেস্টহাউজের একটা ডাবল-বেডেড রুমে। 

ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে দশটা। নিউ মার্কেট এলাকা ছেড়ে পা বাড়িয়েছি ব্রিগেডের দিকে। ওদিকেই প্রাতঃরাশ সারলাম। বিশ-ত্রিশ রুপিতেই বেশ ভালো মতন পেট ভরে যায়। হাতে সময় থাকলে বা রিকশা/গাড়িতে চড়লে ডেকার্স লেনের ওদিকটায় গিয়েও প্রাতঃরাশ সারতে পারেন। বেশ নামদার জায়গা। 

৩৫ রুপির পাউ ভাজি, পুরো ভারতের সম্ভবত সবচে’ জনপ্রিয় প্রাতঃরাশ;  ©ইরতিজা দীপ

আবার হাঁটা শুরু করলাম। পথিমধ্যে ইন্দিরা উদ্যানে চোখে পড়লো ভাষা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। মায়ের কোলে শহীদ ভাষাসৈনিক। থিম পরিচিত, তবে উপস্থাপন দৃষ্টিনন্দন। আমার মতে, দুই বাংলা মিলিয়ে ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত এটিই সবচেয়ে সুন্দর স্মারক ভাস্কর্য!

ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম আর বিড়লা প্ল্যানেটারিয়ামে ঢুকিনি ইচ্ছে করেই। যাদুঘর বা পার্কজাতীয় জায়গা সেবার এড়াতে চেয়েছিলাম। সময় আর বাজেট দু’টোই কম ছিলো। সাধারণের চোখে যেখানে ‘দেখার কিছু নেই’, সেখান থেকেই দেখার জিনিস খুঁজবো বলে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। 

কিন্তু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে কি এড়ানো এত সহজ! হলুদ অ্যাম্বাসেডর, ট্রাম, পায়ে টানা রিকশার সঙ্গে ব্রিটিশদের এই স্থাপনাও হয়ে গেছে কলকাতার ‘ট্রেডমার্ক’। আড়াই কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছুই সেখানে। এইটুকু পথে যান ব্যবহার করাই যেতো, কিন্তু হাঁটলে কেবল টাকাই বাঁচে না, অনুভবটাও কিঞ্চিৎ বেশি করা যায় কোনো স্থানকে। 

শীতে ভিক্টোরিয়ার সবুজ ঘাস বাদামী হয়ে গেছে, দু’জন ভারতীয় বললেন ভিক্টোরিয়াও হলদেটে হয়ে যাচ্ছে; ©লেখক

গ্যালারিতে ঢুকতে ভারতীয়দের লাগে ৩০ রুপি। আর অন্যান্য সার্কভুক্ত দেশের বাসিন্দাদের লাগে ১০০ রুপি। টিকেট কেটে ঢুকলাম কোনোরকম। 

শ্বেতপাথরের এই অপূর্ব স্থাপনাটি পুরোদস্তুর ইউরোপীয় নয়। ইন্দো-সারাসেনিক ধারার সাথে রয়েছে মোঘলাই মিশেল।

এর পাশেই আরেকটা ব্রিটিশ আমলের অপরূপ স্থাপত্য। এটি দেখতে আবার পয়সা লাগে না। সেন্ট পল্’স ক্যাথেড্রাল। এর স্থাপত্যকলা গোথিক ধাঁচের। ১৮৪৭ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিলো এর।

ভেতরটায় চমৎকার সব ভাস্কর্য, ঐতিহাসিক ছবির সংগ্রহ। সবচেয়ে ভালো লাগছিলো জানালার রঙিন কাচগুলোর ফাঁক গলে আসা নানা রঙের আলো! ভেতরটায় ছবি তোলা শক্তভাবে বারণ। ঠিক করলাম, পরের বার এলে ওখানকার বেহালা শেখানোর ক্লাস কিংবা কোনো প্রার্থনা সেশনে যোগ দেবো।

সেন্ট পল্’স ক্যাথেড্রালের পুরোটাকে ফোনের এক ফ্রেমে আনা ভীষণ কঠিন; ©ইরতিজা দীপ

বেরিয়ে জওহরলাল নেহরু রোড থেকে চড়লাম লোকাল বাসে। উদ্দেশ্য, ট্যাক্সির টাকা বাঁচানো আর অভিজ্ঞতা অর্জন। গন্তব্য হাওড়া স্টেশন।

ভাড়া ১৫ রুপি নিয়েছিলো, দরদাম করতে হয় কিনা কে জানে! এদের বাসগুলো ঢাকার মতো নয়, হয় বেজায় ছোট, নয়ত বেশ লম্বা। নিরেট ধাতব বডি সম্ভবত, ভারতেই বানানো। 

আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম। ঢাকার বাসের সম্মুখকাচে সাঁটানো থাকে কালেমা, আয়াতুল কুরসি অথবা ‘মায়ের দোয়া’। আর এখানে ইঞ্জিনের জায়গাটায় মিনি সাইজ মন্দির। ছোট্ট একটা বিগ্রহকে ঘিরে আসল ফুল আর প্লাস্টিকের মালার সমন্বয়ে ছিমছাম ডেকোরেশন!

বাজার, পরিদর্শনযোগ্য উপাসনালয় আর পাবলিক বাস/ট্রেন, প্রাণের স্পন্দন টের পেতে এ জায়গাগুলোয় নিজেকে গলিয়ে দেওয়া সেরা উপায়; ©লেখক

হাওড়া ব্রীজ দেখলাম। আহা! কলকাতা ও হাওড়ার সংযোগস্থাপনকারী এই সেতুর একটা ভালো নামও আছে– রবীন্দ্র সেতু। বর্তমান এই সেতুটি দেশভাগের দু’বছর আগে উদ্বোধন করা হয়েছিলো।

বাস থেকে নামার উপায় ছিলো না। আবার সেতুর ওপর ছবি তোলাও মানা। মজার বিষয় হচ্ছে, এই হাওড়া ব্রীজের নিচে যে নদীটা, সেটিকে আমজনতা গঙ্গা বলেই ডাকে। কিন্তু নদীর নাম আসলে হুগলি! গঙ্গারই শাখা, তবে মূলধারা নয়।

বাস থেকে হাওড়া স্টেশনে নেমেই এর বিশালতায় হারিয়ে গেলাম। ভারতের সবচেয়ে বেশি প্ল্যাটফর্মওয়ালা স্টেশন এটি– ২৩ টি! বাইরের কাউন্টার থেকে ১০ রুপির কমে বালি স্টেশনে যাবার টিকেট কেটেছিলাম। কিন্তু কোন ট্রেনে, কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠবো, বুঝতে পারছিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম পুলিশকে। জবাব এলো, “সেকি, কিচু না জেনেই ঢুকে পড়েচিস!” 

‘তুই’ সম্বোধনটা আবারও দেখলাম বেনাপোল বন্দরে, “কোন পোর্ট দিয়ে ঢুকেছিলিস?” জানতাম, এখানে ‘তুই’-এর চল বেশি। তারপরও পুলিশ বা কাস্টমস কর্মকর্তার মত দায়িত্বশীল লোকেরা এভাবে সম্বোধন করলে নিজেকে দাগী অপরাধী মনে হয়!

তবে এসব খচখচ দূর হয়ে গেলো ভারতীয় রেলের করিৎকর্মা রূপ দেখে। দশ মিনিট পর পর লোকাল ট্রেন। উঠে গেলেই হচ্ছে। ভাড়া কালেভদ্রে ৫/১০ পেরিয়ে ২০ ছোঁয়। দশ মিনিটে চলে এলাম বালি স্টেশনে।

প্ল্যাটফর্মেই আমাদের বরণ করলো স্থানীয় দুই বন্ধু। সেখান দু’ কদম অন্য পাশে হাঁটলেই বালি হল্ট স্টেশন। ওখান থেকে দক্ষিণেশ্বর যাবার ট্রেন। দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির আর গঙ্গার ওপরে একটা বৈকালিক লঞ্চ রাইড দেওয়ার ইচ্ছা থেকেই যাওয়া সেখানে।

বালি হল্ট থেকে এক স্টেশন পরেই দক্ষিণেশ্বর। আবারও ৫ রুপি ও ৫ মিনিটের রেলভ্রমণ। স্টেশন থেকে নেমেই দেখলাম, একটা স্কাই ওয়াক চলে গেছে মন্দির অবধি। উদ্বোধন নাকি বেশিদিন আগের নয়। ওটায় হেঁটেই ঢুকলাম মূল মন্দির এলাকায়।

ঘড়িতে সময় সোয়া তিনটার মতো। সকালের খাবার খেয়েছিলাম ১১টায়। এরপর আর কিছু খাওয়া হয়নি। মন্দির এলাকায় নেমেই তাই ঢুকলাম খাবার-হোটেলে। ২০ রুপি দিয়ে খেলাম চানার ডাল আর কচুরি। স্বাদ একেবারে মন্দ নয়।

অ্যাকশন ক্যামের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল বা ড্রোন শট ছাড়া এ মন্দিরের সৌন্দর্য বা ব্যাপ্তি বোঝানো সম্ভব না; ©লেখক

অসংখ্য দর্শনার্থী মন্দিরে। ঢোকার লাইনটি তো প্রায় কয়েকশ’ গজ লম্বা। বিএসএফ সদস্যরা দেহতল্লাশি করে ঢুকতে দিচ্ছেন। ১৮৫৫ সালে স্থানীয় জমিদার রানি রাসমণি এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বাইরের মত ভেতরটাও চমৎকার। অনেকগুলো ছোট ছোট মন্দিরের সাথে একটা মূল ভবতারিণী মায়ের মন্দির।

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের কক্ষটিও দেখা হলো। তবে সবচেয়ে ভালো লাগলো করিডোর দেখে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হলেও সেখানে হিন্দু মনীষীদের পাশাপাশি ভারত ও বাংলার মুসলিম ও খ্রিস্টান প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্বের ছবিও শোভা পাচ্ছিলো। সকাল নাগাদ নাকি প্রসাদ নেবার জন্য বিরাট লাইন লেগে যায় এখানে!

মন্দির থেকে একটু এগোলেই লঞ্চঘাট। ওপারে বেলুড় মঠ। ১০ কিংবা ১৫ রুপি টিকেট। হুগলির জলে পড়ন্ত সূর্যের সোনালী আলো বেশ লাগছিলো। নদীতে ভাসবার এই স্বাদ নেবার জন্যই মূলত এই রুট আর গন্তব্য বেছে নিয়েছিলাম। যে গঙ্গা, তথা হুগলি নদী দেখে কলকাতাবাসী ‘পলিউশান’ বলে হা-হুতাশ করেন, সেটিকেও বেশ স্বচ্ছই মনে হলো, অন্তত বুড়িগঙ্গার থেকে তো বটেই।  

হুগলির বুকে সেতুসঙ্গম, বাম কোণে উঁকি দিচ্ছে দক্ষিণেশ্বর মন্দির; ©লেখক

আধা ঘণ্টাও লাগেনি বোধ হয়। বেলুড় পৌঁছে গেলাম। রঙ দেখে ধাঁধা লাগে, কাদামাটির প্রাসাদ নয় তো! জানতে পারলাম, স্থাপত্যকলায় বাংলার প্রধান চার ধর্মের উপসনালয়ের মোটিফকে গ্রহণ করা হয়েছে। ওপারে রামকৃষ্ণের কালীমন্দির, আর এপারে তার শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের প্রতিষ্ঠা করা মঠ। ফুলে ঢাকা পুরো এলাকা চোখে অন্যরকম প্রশান্তি দিচ্ছিলো।

বেলুড় মঠ; ©লেখক

সাদা ও গেরুয়া পোশাক পরা সাধু-সেবায়েত-মহারাজরা হেঁটে যাচ্ছিলেন। এখানে পুরোদস্তুর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ই আছে- রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ এডুকেশনাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এটি সহ পুরো ভারতে চারটি ক্যাম্পাস রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির। 

বেলুড় থেকে ১০ রুপি টোটো ভাড়া করে আবার গেলাম দক্ষিণেশ্বর স্টেশনে হাওড়াগামী ট্রেন ধরতে। মূল কলকাতায় যেতে হলে আগে হাওড়াতেই যেতে হবে। ৫ রুপির টিকেট কেটে আবারও দুম করে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি না নিয়ে আবারও লঞ্চই নিলাম। হাওড়া টু বাবুঘাট। ১০ রুপি বা এর কমে নদীভ্রমণ কে না চাইবে! 

সূর্য পাটে গেলে সেতুর সৌন্দর্য যেন বেড়ে যায় আরো; ©ইরতিজা দীপ 

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা, কি সাতটা তখন। লঞ্চ থেকে আলো ঝলমলে হাওড়া ব্রীজ আর মিলেনিয়াম পার্ক দেখতে বেশ লাগছিলো। ফুরফুরে বাতাসকে সঙ্গী করে বাবুঘাট থেকে আবার হাঁটা দিলাম। ট্যুর গাইড হিসেবে কাজ করছে গুগল ম্যাপ।

বাবুঘাটে নামার খানিক আগে; ©লেখক

নিউ মার্কেটকে গন্তব্যে রেখে হাঁটছিলাম গুগল ম্যাপের নির্দেশনা দেখে। পথিমধ্যে পড়লো ইডেন গার্ডেন্স, হাইকোর্ট। ক’মাস পর এলে আইপিএল-টা দেখতে পারতাম- এই আক্ষেপ করছিলাম। এরই ফাঁকে পেয়ে গেলাম ‘আকাশবাণী কলকাতা’। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় রেডিওর অ্যান্টেনা খাড়া করে আমার দাদুরা যে স্টেশনের খবর শোনার জন্যে উদগ্রীব থাকতেন, এটি সেটিরই কার্যালয়। 

পথিমধ্যে ফুচকা, পাপড়ি চাট খেয়েছি। সর্বভারতীয় বৈচিত্র্যের মিনিয়েচার হচ্ছে কলকাতার স্ট্রিট ফুড ইন্ডাস্ট্রি, বাহারি খাবার, সবই সস্তা! প্রায় দেড় ঘণ্টা হাঁটবার পর অবশেষে পৌঁছাই নিউ মার্কেট এলাকায়।

ছোটবেলায় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতাম, কলা ভবন-কার্জন হল-সিনেট ভবন-অ্যানেক্স বিল্ডিং দেখে ভাবতাম “আরে, এগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টা আসলে কই!” পরে বোধোদয় হয়েছিলো। ভাবলাম, নিউ মার্কেটও তার মানে হয়ত বিশেষ কিছু নয়, পুরো এলাকা নিয়েই আসলে একটা মার্কেট। 

কথা পুরো ভুল নয়, পুরো এলাকাটাকেই লোকে এখন নিউ মার্কেট বলে। কিন্তু গায়েগতরে ‘নিউ মার্কেট’ বলেই দিব্যি একটা মার্কেটও আছে!

হাস্যকর ব্যাপার হলো, তিনদিন ঐ এলাকায় থেকেও সত্যিটা জানিনি। সত্যি জেনেছি ঢাকায় এসে। জানলাম, লিন্ডসে স্ট্রীটে হগ সাহেবের মার্কেট বলে যে লালরঙা দালান দেখেছি, ওটাই নিউ মার্কেট! ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ঢাকা নিউ মার্কেট ঢাকার সবচে’ পুরনো ‘শপিংমল’-এর একটি। ওদিকে কলকাতা নিউ মার্কেটও সাহেবরা বানিয়েছিলো ১৮৭৪-এ। তবুও এরা ‘নিউ মার্কেট’-ই রয়ে গেছে।  

এই সেই বোকা বানানো নিউ মার্কেট; Image Source: Make My Trip

বন্ধুর এমআই ব্যান্ড জানালো, সারাদিনে হেঁটেছি প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার। আর খরচ হয়েছে জনপ্রতি মাত্র ১৩৫ রুপি! রাতটা তাই ভাবলাম ভুরিভোজ করা প্রয়োজন। ক্যালরিও দরকার, সাথে কিছু টাকা না খসালে তো আর বিদেশভ্রমণ ঠাওর হয় না!

কলকাতায় আসার আগে বিখ্যাত খাবারের দোকানগুলো নিয়ে বেশ পড়াশোনা করে এসেছিলাম। সেইমতন জানতাম, বিরিয়ানির জন্য আরসালান আর আমিনিয়া হচ্ছে কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় দুইটি চেইন রেস্তোরাঁ।

ইচ্ছে ছিলো, পার্ক স্ট্রিট বা হাতিবাগান ওদিকে গেলে আরসালানে খাবো। কিন্তু ধর্মতলার আশেপাশে যেহেতু আরসালান নেই, তাই ঠিক করলাম, আজকের ডিনার করবো আমিনিয়াতেই।

মাটন বিরিয়ানি নিলাম। হায়দরাবাদী কায়দায় রান্না করা কিনা, জানি না। মশলা একটু অন্যরকম, খানিকটা ঝাঁঝালো। খেতে মোটামুটি। দাম ১৮০ রুপি। ব্যক্তিগতভাবে ঢাকাই কাচ্চিকেই এর তুলনায় এগিয়ে রাখবো। তবে কলকাতার এক বন্ধু বললো, জাকারিয়া স্ট্রীট শাখার আমিনিয়ায় খাবারের স্বাদ নাকি এর চেয়ে ভালো! পরদিন গিয়েছিলাম সেই জাকারিয়া স্ট্রীটেই। খাবারের স্বর্গরাজ্য।

রাত্রিবেলার পেটপুজোর পর একটু আধটু স্ট্রিট ফটোগ্রাফির হাতে ঝালাই দিতে হয়; ©তৌহিদুল শোভান 

তবে খাবারের স্বর্গ জাকারিয়া স্ট্রীটে গিয়েও খুব একটা সময় দিতে পারিনি পরদিন। কেন? 

কারণ, কলকাতার ঘিঞ্জি গলির ভেতরে লুকিয়ে থাকা ‘খাজানা’ অনুসন্ধানেই বেশি বিভোর ছিলাম। এক শহরের কতগুলো পরত হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

প্রথাগত উত্তর কলকাতাসুলভ সরুগলি, ওখান থেকেই উর্দুভাষীদের কলোনি, ওটা শেষ হতেই চাইনিজদের কলোনি, তারপর ইহুদি এলাকা, খানিক সামনেই আরব্য-পারসিক-সিন্ধি-মোঘলাই খাবারের পসরা সাজিয়ে বসা জাকারিয়া স্ট্রীট, সেখান থেকে আধঘণ্টা হাঁটলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, সেখান থেকে কাছেই দু’শো বছরের প্রাচীন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ (পূর্বতন হিন্দু কলেজ) আর মান্না দে’র বিখ্যাত কফিহাউজ– এত বৈচিত্র্য-ঐতিহ্য গুলে খেয়েছি মাত্র একটা বেলায়! তাও পায়ে হেঁটে। সাথে ছিলো ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ কিংবা পথের ধারের সব মুখরোচক খাবার।  

তবে এখানে নয়, সে গল্প বলবো পরের লেখায়। অচেনা শহরের অতি-অচেনা অংশকে সস্তায় আবিষ্কারের রোমাঞ্চ নিতে চাইলে পরের কিস্তি পড়তে পারেন। ক্লিক করুন এখানে।         

This is a Bangla article and describes a budget tour experience by the writer to Kolkata, the city of culture and heritage. It's the first part of a series-article on respective topic.  

Featured Image ©Author

Related Articles