Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অল্প সময়ে, স্বল্প টাকায় আমার দেখা কলকাতা (পর্ব-২)

কলকাতা ছিলো ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রাজধানী। ফলে ঐতিহাসিক গরিমা তো আছেই; পাশাপাশি উত্তরের সরু গলি, পুরনো বাড়ি আর ক’টা অপরিচ্ছন্ন রাস্তা দেখেই যারা ‘দেখার কিছু নেই’ রায় দিয়ে দেন, তাদেরকে চমকে দেবার মতই কিছু ঐশ্বর্য শহর কলকাতা লুকিয়ে রেখেছে তার থরে-বিথরে। শুধু থাকা চাই আবিষ্কারের আন্তরিক ইচ্ছেটুকু।

আগের পর্বে কলকাতায় পা রেখে সস্তার মধ্যে কিছু ‘মাস্ট ডু অ্যাক্টিভিটিজ’ করবার কথা লিখেছিলাম। যেমন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল, হাওড়া ব্রীজ, দক্ষিণেশ্বর, বেলুড় ইত্যাদি দেখা, হুগলী নদীতে লঞ্চভ্রমণ (পড়তে ক্লিক করুন এখানে)। কিন্তু যেসব জায়গার কথা কিছুটা কম আলোচিত হয়, সেখানে যাবার জন্য বরাদ্দ ছিলো তার পরের দেড়টা দিন। আজ বলবো সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথাই।

মির্জা গালিব স্ট্রিটে আমাদের হোটেল থেকে এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশন বেশি দূরে নয়। সকাল পৌনে সাতটার দিকে বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হাঁটছিলাম, তবে সে কাজ ফুরোনোর আগেই চলে এলাম স্টেশনে। মেট্রোতেও টিকেট সর্বনিম্ন ৫, আর সর্বোচ্চ ১০ রুপি। ৫ রুপি দিয়ে কাটলাম সেন্ট্রাল স্টেশনের টিকেট।

সাধারণত ২-৩ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করতে হয় না মেট্রোর জন্য। একবার প্রায় ৭-৮ মিনিটের এদিক-সেদিক দেখেছিলাম সময়ের, প্ল্যাটফর্ম ভর্তি লোকেদের সে কী বিরক্তি! আমার মতো কমলাপুর স্টেশনের লোকাল ট্রেনে নিয়মিত যাত্রীর কাছে সেটা রীতিমতো হাসির খোরাক। যা-ই হোক, ট্রেন চলে এলো, সেকেন্ডখানেক দাঁড়ালো, মিনিটখানেকে চলেও এলো সেন্ট্রাল।

ঘুরবার গন্তব্যের আগে একটি অভিজ্ঞতা বলে নিই। মেট্রোরেলে অধিকাংশ লোক দাঁড়িয়ে যাতায়াত করেন। আর ট্রেনের গেট ৫-৭ সেকেন্ডের মতো খোলা থাকে। ফলে ঢোকার সময় ভালোরকম হুড়োহুড়ি হয়। ছেলেদের সাথে মেয়েরাও সমান পাল্লা দিয়ে ওঠে-নামে।

“ওস্তাদ, সামনে লেডিস আছে, আস্তে”– এমনটা কলকাতার মেট্রো-যাত্রী নারীদের নিয়ে বলাই যাবে না। এরা সমানে সমান টক্কর দিয়ে চলতে জানে!

সেন্ট্রাল নেমে গুগল ম্যাপে গন্তব্য লিখলাম ফিয়ার্স লেন। আগের দিন তো দু’বার লঞ্চে চড়েছি, একবার বাসে। আর এদিন মেট্রো ছাড়া কিছুতে চড়বো না মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। ফলে পদব্রজেই যাত্রা শুরু। মেবারের বিখ্যাত মহারানা প্রতাপের একটা মূর্তি আছে এদিকে। ম্যাপ ভুল করে খানিক এদিক-ওদিক ঘুরে পোদ্দার কোর্ট হয়ে ঠিকই পেয়ে গেলাম ফিয়ার্স লেনের টিকি।

শুরুর দিকে ঠিকঠাকই ছিলো। কমরেড চারু মজুমদারের প্রতিকৃতি, কাস্তে-হাতুড়ি আর বামপন্থী শ্লোগানে ভরা দেয়াল। সরু গলির দু’ধারে বাঙালি স্থাপত্যকায়দায় বানানো পুরনো সব ঘরবাড়ি। ‘টিপিকাল উত্তর কলকাতা’ বুঝতে যেমন ছবি এতদিন চোখে ভাসতো, প্রায় পুরোটাই মিল পেলাম। কিন্তু এ কী! মিনিট খানেক বাদে বদলে গেলো দৃশ্যপট।

টালিগঞ্জের সেট থেকে এটা মুহূর্তেই যেন হয়ে গেলো অনুরাগ কশ্যপের সিনেমার কোনো সেট! পোশাকে বা দেখতে লোকগুলো কিছুটা অন্যরকম। বাড়িঘর অন্যরকম, মুদিখানার চে’ কসাইখানা বেশি, সেখানে আবার কারওয়ানবাজারের চেয়েও গরু বেশি। এখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক পোস্টারও লেখা উর্দুতে। এটি পুরোটাই বিহার বা উত্তর প্রদেশের মুসলিমদের এলাকা।

ফিয়ার্স লেন; ©লেখক

এই ফিয়ার্স লেনের পেটের ভেতরেই দামজেন লেন। এটিরও একটা অংশ জুড়ে অবাঙালি মুসলিমদের বাস। দামজেন লেনের পরের অংশটি হলো ভারতীয় চীনাদের এলাকা। শুনতে একটু আজব ঠেকলেও ১৯ শতকে দক্ষিণ চীনের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে যারা কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন, তাদেরই বংশধর এরা। অনেকে আরো পরেও এসেছেন। জাতিতে এরা হাক্কা চীনা, কিন্তু পাসপোর্ট ঠিকই ভারতের।

এই চীনাদের একটা বড় অংশ এখন আমেরিকা, কানাডা আর সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমিয়েছে। আর আরেকটা অংশ গিয়ে উঠেছে ট্যাংরার নতুন ‘চায়না টাউনে’। এই এলাকা, অর্থাৎ টেরিটি হচ্ছে পুরনো চায়না টাউন। দামজেন লেন টেরিটিরই ‘টেরিটোরি’! পুরনো চায়না টাউনের এই লেনেই সবচেয়ে বেশি হাক্কা চীনা থাকে।  

ফুড ভ্লগার ট্রেভর জেমস ও মার্ক ওয়েইন্সের দেখানো পথ অনুসারে প্রাতঃরাশ সারলাম টেরিটি বাজারে। চেষ্টা করবেন ভোর ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে এখানে আসতে। এখানে খাবার বিক্রি করেন চীনারাই। আমাদের আগ্রহ গরম গরম চিকেন মোমো’তে। দুজন দু’ প্লেট নিলাম ১০০ টাকায়। প্রতি প্লেটে ৬টা করে থাকে, ১টা করে বখশিশ বিক্রেতাই দিয়েছেন। খাবার খেয়েই ছুটলাম চিনাদের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধমন্দির দর্শনে।

সি-ইপ চার্চ; ©লেখক

খাবারের এলাকা থেকেই কাছেই সি-ইপ চার্চ। তত্ত্বাবধায়ক জানালেন, প্রায় ১২০ বছর বয়স এর। দুঃখজনকভাবে এই ঐতিহ্যবাহী জায়গাটার অবস্থান একটা ময়লার ভাগাড়ের পাশে। হিন্দি প্রায় পারেনই না তত্ত্বাবধায়ক ভদ্রলোক; ইংরেজিটাও ভাঙাচোরা। বুঝলাম, ঐতিহ্য ভালোমত আঁকড়ে পড়ে থাকাদের তিনিও একজন, আজও মান্দারিনকেই একতরফা ধারণ করেন।

এরপর আবার দামজেন লেনে ঢুকলাম। নাম না জানা একটি বৌদ্ধমন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক পল নচিং (পদবির উচ্চারণটা ঠিক বুঝিনি)-এর সাথে আলাপ হলো। বেচারা পলের বাবা এখানে বিয়ে করে তাকে জন্ম দিয়ে চীনে চলে গেছেন। তিনি যদি এখন তার বাবাকে দেখতে চীনে যান, তবে নাকি আর ভারতে ফিরতে পারবেন না, নিয়ম নাকি এটাই! নাতি-নাতনি নিয়ে তিনি কলকাতাতেই সুখী।

৩ ফেব্রুয়ারি চন্দ্রমাসের হিসেবমতে চীনা নববর্ষ ছিলো এবার। টেরিটি বাজারে নাকি এই নববর্ষের জমকালো উদযাপন হয়। কয়েকজন চীনা অগ্রিম আমন্ত্রণ জানালেন সেদিন থাকবার, কিন্তু অতদিন তো ভারতে থাকবার পরিকল্পনা নেই। কী আর করার! দেখলাম তুং অন আর নাম-সুন চার্চ। নাম-সুন চার্চ সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে। এটি খুঁজে পেতে বড্ড বেগ পেয়েছি। কারণ দু-তিনটে বিহারি বাড়ির ফাঁকে ছিলো এটি।  

নাম-সুন চার্চ; ©লেখক

দশটাও তখনো পুরোপুরি বাজেনি। টেরিটি বাজার পেরিয়ে এগোলাম আরো সামনে। ১০-১৫ মিনিট হেঁটে চলে আসি পোলক স্ট্রীট। এটিকে অনেকে ইহুদি এলাকা বলেন। তবে আমার মতে উপযুক্ত শব্দটা হচ্ছে ‘সিনাগগ বেল্ট’। আশেপাশে বেশ কিছু ইহুদি উপাসনালয় ‘সিনাগগ’ আছে। ২০-৩০ জন ইহুদি, যারা কলকাতারই বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ীভাবে থাকেন, তারা এই সিনাগগগুলোতে যান। কলকাতার ইহুদিদের বাগদাদি ইহুদি বলা হলেও এরা মূলত সিরিয়ান বংশোদ্ভূত।

শুরুতেই পেলাম বেথ-এল সিনাগগ। ভেবেছিলাম, সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে এ জন্মে সিনাগগ দেখা হবে না! ভুল ভাঙলো। পাসপোর্ট দেখিয়েই ভেতরে যাবার অনুমতি মিললো। ঢুকতেই রিসিপশনিস্ট আমাদের জিউ টুপি পরিয়ে দিলেন। সেই টুপি পরে সেলফি তুলতে গেলে মাথায় যে আদৌ কিছু আছে, বোঝাও যায় না, এতই ছোট সেই টুপি! তবে অন্দরমহল বিশাল, আর নান্দনিক। 

বেথ-এল সিনাগগ; ©লেখক

স্পর্শ করে দেখলাম তাদের ধর্মগ্রন্থ তোরাহ। এই সিনাগগটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ডেভিড জোসেফ এজরা, আর এজকিয়েল জুডাহ। ১৮৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর চেয়েও পুরনো হচ্ছে নাভেহ শালোম সিনাগগ (১৮৩১)। অবস্থান পোলক স্ট্রীটেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেদিন দর্শনার্থী প্রবেশ বন্ধ ছিলো সেখানে।

আরেকটু এগিয়ে ব্রাবোর্ন স্ট্রিটের মাঘেন দাভিদ সিনাগগে গিয়েও হলো একই অভিজ্ঞতা। আসন্ন কোনো অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে বিধায় অ-ইহুদীদের প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ। এটি বাকি দু’টোর চেয়ে নতুন (১৮৮১) হলেও আয়তনে ও সৌন্দর্যে আরো ব্যাপক। ইচ্ছে হলে যেতেই পারেন। রোজ রোজ তো আর নিশ্চয়ই আমাদের মতো কপাল পুড়বে না আপনাদের! তবে সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল থাকবেন।

প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরছিলাম, আর ভাবছিলাম – বাঙালি, অবাঙালি, চাইনিজ,সিরিয়ান, কী নেই এখানে! একটা লেখায় পড়েছিলাম, “এ শহরে মিলেমিশে থাকাটাই দস্তুর”! যথার্থ।

ব্রাবোর্ন পেরিয়ে ক্যানিং স্ট্রিট ধরে সোজা এগোচ্ছি। গুগল ম্যাপে গন্তব্য ‘জাকারিয়া স্ট্রিট’ দিলেই পৌঁছে যাবেন দশ মিনিট পায়ে হেঁটেই। ‘ফুডকা’র ভিডিও দেখে এই স্ট্রিট চিনেছি। রমজান মাসে একবার আসতে হবে এখানে। বাহারি মোগলাই, তুর্কি, আরব, পার্সিয়ান, নবাবি খাবার পাওয়া যায়। কতরকম ফ্লেভার এই একটা শহরে! বিখ্যাত নাখোদা মসজিদটিও এখানে অবস্থিত, ভারি সুন্দর দেখতে।

নাখোদা মসজিদ; Image Source: Trip Advisor

অলিগলি হেঁটে আন্ডাররেটেড জায়গা দেখবো, সস্তায়– এমনটা ভেবেও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে যেমন এড়াতে পারিনি, জোড়াসাঁকোকেও পারলাম না। কলকাতায় এসে ঠাকুরবাড়ি দেখার শখটাও চাগাড় দিয়ে উঠলো। শখ মেটাতে বারোটার প্রখর রোদে অনেকটা পথ হাঁটলাম। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা।

মনটাই ভেঙে গেলো, যখন জানলাম “আজ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ”!  

ঠাকুরবাড়ি; ©ইরতিজা দীপ

শুক্র, শনি সিনাগগ বন্ধ, রোববার কলেজস্ট্রিট বন্ধ, মঙ্গলবার জোড়াসাঁকো বন্ধ। তাই এসেছিলাম বুধবারে। এত রিসার্চ করে এসেও ধরা খেলাম! ফটক থেকে গোটা গাড়িসমেত রাশিয়ান এক দল পর্যটককে ফিরতে দেখে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। পরের গন্তব্য কলেজ স্ট্রিট।

কলেজ স্ট্রিট হলো আমাদের ঢাকার নীলক্ষেতের মতন, বই বাজার। নীলক্ষেত বেড়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়ায়। আর কলেজ স্ট্রিট বেড়ে উঠেছে দু’শ বছরের পুরনো প্রেসিডেন্সি কলেজের ছায়ায়। নেতাজির জন্মদিন উপলক্ষে বইয়ের দোকানেও সব শাটার নামানো! কেবল দে’জ পাবলিকেশন খোলা ছিলো বলে রক্ষা। ক’টা বই কিনতে পেরেছি তা-ও। 

কলেজস্ট্রিটেই পাবেন বিখ্যাত প্যারামাউন্টের শরবত। প্রখর রোদে তুমুল শান্তি, দাম কিছুটা বেশি মনে হতে পারে। দুপুরের খাবারের জন্য বরাদ্দ ছিলো শতবর্ষী দিলখুশা কেবিন। বিকেলে বা সন্ধ্যায় এলে এখানকার ফিশ বা চিকেন কবিরাজি অবশ্যই চেখে দেখবেন, ১০০ রুপি পড়বে। আমরা অবশ্য খুব ক্ষুধার্ত বলে ১০৫ রুপিতে প্রন ফ্রায়েড রাইস (১:১) আর ৯৫ টাকায় চিলি চিকেন (১:২) নিয়েছিলাম।  

মহাত্মা গান্ধী রোড (এমজি রোড) মেট্রোস্টেশন ওখান থেকে হাঁটা রাস্তা। ৫ টাকা ভাড়ায় মেট্রো করে চলে এলাম শ্যামবাজারে। শ্যামবাজারের পাঁচমাথায়  নেতাজির একটা মূর্তি আছে। ঘটনাক্রমে তার জন্মদিনে তার শহরে এসে যখন এত ভোগান্তি, তাকে ‘শুভ জন্মদিন’ জানাতে আরেকটু ঝক্কি নিতে মন চাইলো। গাঁদা ফুলের মালায় শোভিত ছিলেন ঘোড়ায় চড়া নেতাজি।

পাঁচরাস্তার মোড়ের সেই নেতাজি মূর্তি; ©লেখক

শ্যামবাজারে আরেকটা কারণেও এসেছি। পুরনো কলকাতা বললেই চট করে এই জায়গাটার নামই বেশিরভাগ সময় মাথায় আসে। আগেরদিন ও এদিন মিলিয়ে কোনো ট্রাম রাস্তায় চোখে পড়েনি। কেবল ট্রামলাইন চোখে পড়েছে। শ্যামবাজার এসেই প্রথম পেলাম ট্রামের দেখা। যাত্রী ছাড়াই ঘটঘট করে ধীরলয়ে চলছে। যদি চড়ি, তবে কোথায় যাবো- এই দোলাচলের ফাঁকেই চলে গেলো ট্রাম!

রাস্তায় আজকাল আগের মতো নাকি ট্রাম দেখাই যায় না!; ©ইরতিজা দীপ

এখান থেকে বেলগাছিয়াগামী বাসে চড়লাম। ওখানে শুনেছি, জৈন ধর্মের উপাসনালয় আছে। জৈনদের ব্যাপারে কৌতূহল থেকে ওখানেও যেতে চাইছিলাম। ১০ রুপিতে বেলগাছিয়া নেমে ক’মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম সেই জৈন মন্দিরে। কিন্তু কপাল এবারেও খারাপ!

গেট থেকেই ফিরিয়ে দিলো, অনুরোধে কাজ হলো না, শুধু নাকি জৈনরাই আসতে পারেন, তাও বিশেষ উপলক্ষে। গৌরীবাড়িতে আরেকটা মন্দির আছে, দারোয়ান আমাদের সেখানে যাবার পরামর্শ দিলো। ওটায় নাকি সকলে যেতে পারে। দু’টোর মধ্যে তবে তফাতটা কী? এটাও জানলাম দেশে ফিরে।

জৈনদের দু’টো ধারা। একটা দিগম্বর, অন্যটা শ্বেতাম্বর। দিগম্বর সাধুরা উলঙ্গ থাকেন, শ্বেতাম্বর সাধুরা গায়ে সাদা চাদর জড়িয়ে রাখেন। বেলগাছিয়ার মন্দিরটি দিগম্বর সাধুদের বলেই জনসাধারণের প্রবেশে বাধানিষেধ আছে।

স্থানীয় জনতার উচ্চারণ আর গুগল খুব বিপাকে ফেলবে আপনাকে। দু’টো মন্দিরকেই বলবে ‘পরেশনাথ মন্দির’। লোকমুখে একটা ‘বেলগাছিয়ার পরেশনাথ’, আরেকটা ‘মানিকতলার (গৌরীবাড়ি) পরেশনাথ’। আসলে বেলগাছিয়ার মন্দিরটির নাম পরেশনাথ নয়, পর্শ্বনাথ জৈন মন্দির। পরেশনাথ কেবলমাত্র মানিকতলারটাই।

যাহোক, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় মানিকতলার দিকে আর যাইনি। বেলগাছিয়া থেকে আবার বাসে চড়ে শ্যামবাজার ফিরলাম। সেখান থেকে মেট্রো হয়ে এসপ্ল্যানেড। শ্যামবাজারের ওদিকটায় ভালো কিছু মিষ্টির দোকান পড়বে। নলেন গুড়ের সন্দেশ, রাবড়ি, ল্যাংচা অবশ্যই চেখে দেখবেন। কলকাতা হলো মিষ্টির স্বর্গরাজ্য! 

ধর্মতলা পৌঁছে হালকা কেনাকাটা করে বসে গেলাম পেটপুজোয়। সস্তায় নেহারি আর নানরুটি পাওয়া যায় শুনে ঢুকলাম এক বিহারি হোটেলে। সত্তর রুপির মতো পড়েছিলো। হিসেব করে দেখলাম, কোমল পানীয়, মিষ্টি আর বই কেনা বাদ দিলে সারাদিনে খরচ হয়েছে মাত্র ৩৪০ রুপি। বলে রাখা ভালো, আলাদা করে মিষ্টির জন্য অন্তত ১০০ রুপির বাজেট রাখবেন।  

রাস্তার সবচে’ চেনা দৃশ্য; ©তৌহিদুল শোভান

অঞ্জনের ‘মালা’ গানে যে ওবেরয় ভাইদের নাম শুনেছিলাম, তাদের হোটেল ‘দ্য ওবেরয় গ্র্যান্ড’ দেখলাম। ‘মাসের শেষের দিনটা’ গানে অঞ্জন বলেছিলেন ধর্মতলার মোড়ের অশোকা বারের কথা। পাশ দিয়েই গেলাম সেটার। ঢাউস অ্যাম্বাসেডর গাড়িগুলো, মেট্রোপলিটন ভবনের সাহেবিকেতার দালান, ল্যাম্পপোস্ট– সব কিছু মিলে সন্ধ্যাটা আলাদা ভালোলাগা দিচ্ছিলো।

ভালোলাগার মধ্যে আরেকটু ভালোলাগার যোগান দিতে ৮০ রুপির শিক কাবাব, আর চানাচুর-ভুজিয়া আর লাইম-সোডা কিনে হোটেলে ফিরলাম।

পরদিন সকালে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেলো। গন্তব্য মানিকতলার সেই পরেশনাথ জৈন মন্দির। দেশে ফেরার বাসের টিকেট কাটতে সল্টলেক করুণাময়ীর আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনালে যেতে হতো। তাই ঠিক করলাম টিকেট কেটে ওদিক দিয়েই যাবো মানিকতলা।

এসপ্ল্যানেডের পাতালরেলের রুট দিয়ে সল্টলেক যাবার সুযোগ নেই। আবার হলুদ ট্যাক্সিতে একেবারে চড়া হবে না, সেটাও মানা যাচ্ছিলো না। তাই ভাবলাম বাকেটলিস্টে আরেকটা টিক দিয়েই ফেলা যাক। বলে রাখা ভালো, উবার-ওলায় ভাড়া দেখাচ্ছিলো আরো বেশি ২৯০ রুপি! এর বদলে ২৫০ রুপির চুক্তিতে ট্যাক্সিতেই চড়ে এলাম।

ট্যাক্সি থেকে মেট্রোপলিটন দালান; ©ইরতিজা দীপ

যাবার সময়টায় দক্ষিণ কলকাতার সৌন্দর্যও চোখে পড়লো। টিকেট কেটে যুবভারতী স্টেডিয়ামপাড়ার আশপাশে গিয়ে দেখি, ২৭ জানুয়ারি কলকাতা ডার্বি- মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল! এখনো এই দুই ক্লাব উন্মাদনায় ভাসায় কলকাতাবাসীকে। ‘লোটা’ বনাম ‘মাচা’র সে কী যুদ্ধ!

সল্টলেক থেকে খান্না যাবার বাসে চড়লাম। ভাড়া সঠিক মনে নেই। ২০ রুপির বেশি নয়। হোটেল টু সল্টলেক আর সল্টলেক টু খান্না– এই দুই রুটে এত ভাস্কর্য দেখলাম, হিসেব নেই! বাংলা ও ভারতের অনেক কিংবদন্তির ভাস্কর্য রয়েছে। তবে নেতাজি, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের আধিপত্য কিঞ্চিৎ বেশি।

বাস স্টপেজ থেকে নেমে গুগল ম্যাপ অন করে দিয়ে হাঁটলাম ১৫ মিনিটের মতো। গন্তব্য পরেশনাথ জৈন মন্দির। আশপাশটা পুরো বিহারি এলাকা। এর মাঝে মন্দিরটি আসলে একক কোনো স্থাপনা নয়, এটি আসলে কয়েকটা মন্দির নিয়ে গড়ে ওঠা কমপ্লেক্স। তবে মূল মন্দিরটি কাচের তৈরী। এটিই আসলে পর্যটকদের টানে বেশি। ছবিতে যেমনটা লাগে, মন্দিরটি তার চেয়ে বেশি সুন্দর।

পরেশনাথ জৈন মন্দির; ©লেখক

ভেতরে ছবি তোলা বারণ বলে অন্দরমহল আপনাদের দেখাতে পারছি না। ভেবেছিলাম, সেবকদের সাথে কথা বলে অন্তত দেবতাদের সম্পর্কে জানবো। সেটাও হলো না। আমাদের ভারতীয় ভেবে উনারা পাত্তাই দিলেন না মনে হলো। তারা ব্যস্ত ছিলেন জার্মানি ও স্পেন থেকে আগত একদল পর্যটককে সঙ্গ দিতে! অগত্যা নিজেরাই দেখলাম পুরো মন্দির এলাকা। মন্দিরের অন্দরেও অসাধারণ কাচের কারুকাজ।

মন্দির দেখা শেষ। ওদিকে ‘লাঞ্চ আওয়ার’ শুরু। মানে, হাতিবাগানের আরসালানের বিরিয়ানি চাখবার সময় হয়ে গেছে। ম্যাপ দেখে আবারও মিনিট পনের-বিশ হাঁটা। 

পৌঁছেই ২৪০ টাকায় ১:১ মাটন বিরিয়ানি অর্ডার করলাম। ধর্মতলার আমিনিয়ার মতো এবার হতাশ হইনি, এটা দারুণ খেতে। হায়দরাবাদী বিরিয়ানিটা শুনেছি অন্যরকম। পরেরবার এসে খাবো ওটা।

আরসালানের বিখ্যাত মাটন বিরিয়ানি; ©ইরতিজা দীপ

আরো খানিকটা হেঁটে এলাম শোভাবাজার সুতানুটি মেট্রোস্টেশনে। ওখান থেকে ৫ রুপিতে আবার এসপ্ল্যানেড। কেনাকাটা করলাম কিছু, বন্ধুর কেনাকাটার সঙ্গী হলাম। নিউ মার্কেটের কাছে ভালো দোসা পাওয়া যায়। একটা খেলে পেট ভরে যায় অনেকটাই। ৬০-৭০ রুপি পড়বে বড়জোর, বেশ খেতে। 

কেনাকাটা শেষে ভাবলাম তুলির শেষ আঁচড়টাই দেওয়া হয়নি। কলেজ স্ট্রিটে আগের দিন গিয়ে ইন্ডিয়ান কফি হাউজের কাছ থেকে ফিরে এসেছি। কাঠফাটা দুপুরে সেখানে যাবার বদলে পরদিন সন্ধ্যায় আসবার পরিকল্পনা করেছিলাম। সেইমতোই চলে এলাম কফি হাউজে, মান্না দে’র বিখ্যাত সেই কফি হাউজ!

কফি হাউজ; ©ইরতিজা দীপ

এসপ্ল্যানেড থেকে সেন্ট্রাল বা এমজি রোড স্টেশনে নামলেই হবে। বাকি রাস্তা পায়ে হাঁটার। আড্ডা দিতে চলে এলেন আমার কলকাতার তিন বন্ধু। দোতলায় একটা কর্নারে গিয়ে বসলাম।

উঁচু সিলিং থেকে লম্বা বারে ঝুলিয়ে দেওয়া বৈদ্যুতিক পাখা, কাঠের রেলিং, সিঁড়িঘরে সাঁটা নান্দনিক প্রতিবাদী পোস্টার/চিকা, শতবর্ষ প্রাচীন কাঠের আসবাব, পাগড়ি পরা বেয়ারা– বর্তমানে বসেই কেমন জানি চল্লিশ দশকের স্বাদ পাচ্ছিলাম! সিনেমা, রাজনীতির আড্ডার সাথে অনিয়ন পকোড়া, ব্ল্যাক কফি, আর ধূমপায়ী হলে ফেলুদার প্রিয় চারমিনার– আর কী লাগে বাঙালির!

জম্পেশ আড্ডা দিয়ে হোটেলে ফিরলাম। সকালে রওনা দিয়ে রাতেই পৌঁছে গেলাম ঢাকায়। সময়স্বল্পতার জন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রিন্সেপ ঘাটে সূর্যাস্ত আর পার্কস্ট্রিটে সন্ধ্যা-রাত উপভোগের সুযোগ হয়নি।

খুব ইচ্ছে, পরেরবার এলে একটা ফুড ট্যুর করবো। বই পড়ে, গান শুনে যে শহরটার ছবি এঁকেছিলাম মনে, নাম মাত্র খরচে তার কিছু অংশ চাক্ষুষ অনুভবও করলাম। বারবার তো ফিরে আসতেই হবে এখানে। আসবো।

This is a Bangla article and describes a budget tour experience by the writer to Kolkata, the city of culture and heritage. Its the second and last part of a series-article on respective topic.  

Featured Image ©Author

Related Articles