Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বান্দরবান ডায়রি: দামতুয়া কথন

ভেজা মাটি থেকে তাঁবু ভেদ করে উঠে আসা ঠাণ্ডায় রাতে ঘুম হলো ছাড়া-ছাড়া। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আগেই, ভোরের আলো ফুটতেই তাঁবু থেকে আবার বেরিয়ে পড়লাম মেরাইথং চূড়ায় সূর্যোদয় দেখতে। মাতামুহুরির বুক থেকে ভোরের সূর্য যখন ভেসে উঠল, সোনালি আলোয় রীতিমতো রাঙিয়ে দিচ্ছিল সবুজ পাহাড়ের সারা শরীর। এমন অপূর্ব দৃশ্য ছেড়ে উঠতে আর কারই বা মন চায়। কিন্তু সকাল ১০টার পর ১০ কিলো আর্মি চেকপোস্টে নাকি অনেক ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়।

মাতামুহুরির বুকে সূর্যোদয়।
মাতামুহুরির বুকে সূর্যোদয়; Image Credit: Author

কী আর করা। দ্রুত সব গুছিয়ে নেমে আসলাম আবাসিক বাজারে। পথেই দেখলাম, মেরাইথংয়ের ঠিক নিচেই বসেছে বিরাট বাজার। আশেপাশের পাড়ার লোকজন এই ভোরেই নিজেদের জুমের, বাগানের বিভিন্ন ফল-ফসল নিয়ে এসেছে বিক্রি করতে। আবাসিকে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে এবার রওনা দিলাম ১৭ কিলোর উদ্দেশে। সেখানে রাস্তার পাশেই আদুমুরং পাড়া। এখান থেকেই স্থানীয় গাইড সাথে নিয়ে যাত্রা করতে হয় দামতুয়ার দিকে।

ম্রো ভাষায় ‘দামতুয়া’ শব্দের অর্থ- যেখানে মাছ যেতে পারে না। ঝর্ণাটির আরো একটি সুন্দর নাম আছে– ‘তুক অ’; এর মানে, ব্যাঙ ঝর্ণা। মাছ যেতে না পারলেও মানুষের তো আর যেতে বাধা নেই, তাই ভারি ব্যাগপত্র, তাঁবু ইত্যাদি স্থানীয় সমিতি ঘরে রেখে আমরাও বের হলাম ‘রিংলট’ দাদাকে সঙ্গে নিয়ে। তিনিই আমাদের এই দামতুয়া যাত্রার গাইড, বাড়ি এই সামনের পামিয়া মেম্বার পাড়াতেই। দাদা আমাদেরই সমবয়সী হবেন, একদম অমায়িক একজন মানুষ। পড়াশোনা করেছেন বান্দরবান শহরে, হাইস্কুল পর্যন্ত। তার  কাছ থেকেই জানা গেল, আগে পাড়ার মানুষের মধ্যে সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর এত আগ্রহ না থাকলেও ইদানিং বেশিরভাগ বাচ্চাকেই স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছেন অভিভাবকেরা। অল্প সময়েই দাদার সাথে আমাদের ভালো খাতির জমে উঠল। কখনোবা আমাদের-তাদের জীবনযাত্রার নানান গল্প আদান-প্রদান, আবার কখনো নিছক হাসিঠাট্টা করতে করতে পথ চলতে থাকলাম।

সূর্যের প্রথম কিরণে সবুজ পাহাড়ের সোনালি রূপ।
সূর্যের প্রথম কিরণে সবুজ পাহাড়ের সোনালি রূপ; Image Credit: Author

আদু পাড়া পার হয়ে ঝর্ণায় যাওয়ার ট্রেইল চলে গেছে পামিয়া মেম্বার পাড়া, নামসাক পাড়া, কাখই পাড়া ইত্যাদি গ্রাম ঘেঁষে। সবগুলোই মূলত ম্রো পাড়া। ম্রোদের অর্থনীতি প্রধানত জুম চাষ আর জঙ্গল থেকে কাঠ আহরণের উপর নির্ভরশীল। সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক হলেও পাহাড়ি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতোই নারীরা তুলনামূলকভাবে অধিক পরিশ্রমী। বইয়ে পড়া এমন সব কথার বাস্তব প্রমাণ মিলল একদম হাতেনাতেই। চলার পথেই দেখতে পেলাম, পাড়ার নারীরা কেউ কাপড় বোনায়, কেউবা আবার দুপুরের তপ্ত রোদে জুমের কাজে ব্যস্ত। পুরুষরা ইদানিং ‘ট্যুরিস্ট গাইডিং’-এর দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে বলে রিংলট দাদার থেকে জানা গেল। তূলনামূলক অল্প পরিশ্রমে বেশি আয়ের সম্ভাবনাই এর মূল কারণ।

ম্রোদের আতিথেয়তা, স্টাইল আর ফ্যাশন সচেতনতা- এসব অনেক প্রসিদ্ধ বলে শুনেছি। ছেলেমেয়ে উভয়কেই কানে দুল পরতে দেখলাম। পুরুষদের মাথার লম্বা চুলেও দুর্দান্ত সব ঝুঁটি চোখে পড়ল; সেগুলো আবার বিভিন্ন রকম বাহারি মালা দিয়ে সজ্জিত। দামতুয়ার টানে এদিকের পাড়াগুলোতে বাঙালি পর্যটকদের আনাগোনা অনেক বেড়ে যাওয়ায় নারীদের প্রথাগত পোশাক ওয়াংলাই এখন আর চোখে তেমন না পড়লেও খালি গায়ে কোমরে নেংটি পরিহিত ম্রো দাদাদের চোখে পড়ে প্রায়ই। তাদের সুঠাম দেহ যেন কোনো দক্ষ শিল্পীর সুনিপুণ হাতে পাথর কুঁদে তৈরি! এক বড়ভাইয়ের থেকে শোনা, “এমন প্রাপ্তবয়ষ্ক ম্রো পুরুষ পাওয়া খুব কঠিন, যার সিক্স-প্যাক নেই”– কথাটির ব্যাপারেও চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন হতে লাগল বারে বারেই।

সাথের এক বন্ধু তো আবেগে রিংলট দাদাকে জিজ্ঞেসই করে ফেলল, “দাদা কি রেগুলার জিম করেন নাকি?” এক গাল হেসে দাদারও সরল উত্তর, “জিম করা লাগে না দাদা.. ছয়মাস এসে আমাদের সাথে থাকেন, আমরা যা করি, সেসব কাজকর্ম করেন, আপনার বডিও এমন হয়ে যাবে দেখবেন!”

চাইলেই আর ইটপাথরের জঞ্জাল ছেড়ে এতদিন এই পাহাড়ের মায়ার রাজ্যে থেকে যাবার সুযোগ কোথায়! এক অব্যক্ত আফসোস সঙ্গে নিয়ে নিশ্চুপ পথ চলতে থাকলাম।

দূর থেকে দেখা তংপ্রা।
দূর থেকে দেখা তংপ্রা; Image Credit: Author

পথ তেমন একটা দুর্গম বা বিপজ্জনক না হলেও ফিজিকালি কিছুটা ডিমান্ডিং। চার পাঁচটা ছোটবড় পাহাড় ডিঙোতে হলো আমাদের; তার সাথে গা জুড়ানো শীতল জলের ঝিরিপথ তো আছেই। পথে যেতে যেতেই দূর থেকে চোখে পড়ে তংপ্রা ঝর্ণা; হাতে সময় থাকলে কিছুটা ডিট্যুর নিয়ে ঘুরে আসা যায় ওয়াংপা ঝর্ণা থেকেও। আর এমনিতে সারা পথ জুড়েই সবুজ অরণ্য, ক্ষণে ক্ষণে কানে আসে পরিচিত-অপরিচিত অসংখ্য পাখি আর পোকামাকড়ের ডাক। ঝিরিতে রংবেরংয়ের বড়সড় মাকড়সাও চোখে পড়ল বেশ! এছাড়াও মাঝেমাঝেই নজরে আসে পাড়াবাসীদের জুম। পথেই এক দিদির কাছ থেকে আখ কিনে খেলাম, গ্লুকোজ সলিউশনের প্রাকৃতিক বিকল্প! সাথে খাওয়া হলো কলা, মারফা, আর প্রায় মারফার মতোই আরেকটি ফল ‘কলসি’– খেতে অনেকটা বাঙ্গী আর শসার মিলিত স্বাদ।

পথ চলতে চলতে হঠাৎ পানির শব্দ রীতিমতো গর্জনে রূপ নেওয়ায় বুঝতে পারলাম, চলে এসেছি খুব কাছেই। কিছুটা এগুতেই চোখে পড়ল এক প্রাকৃতিক বিস্ময়– ব্যাঙ ঝিরি ক্যাসকেড। প্রকৃতি যেন এখানে নিয়েছে এক স্থপতির ভূমিকা। দক্ষ হাতে স্রোতস্বী জলধারাকে ধারালো ছুরির মতো ব্যবহার করে হাজার বছর ধরে পাষাণশিলা কেটে কেটে তৈরি করেছে অনেকগুলো সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে সাদা ফেনা তৈরি করতে করতে নেমে আসছে স্বচ্ছ পানির ঢল। ফেরার পথে বেশ কিছুক্ষণ এখানে গা এলিয়ে দিয়ে পড়ে ছিলাম একটি ধাপে, মেঘের ভেলায় মন ভাসিয়ে দিয়ে।

বিষ্ময়কর ব্যাং ঝিড়ি ক্যাসকেড।
ব্যাঙ ঝিরি ক্যাসকেড; Image Credit: Author

এখান থেকে ডাউনহিলে আর ৫/৭ মিনিটের মতো যেতেই চোখে ধরা দিল, যার জন্য এতকিছু, সেই রূপসী দামতুয়া। তিনদিক দিয়ে ঘেরা পাথরের দেয়াল থেকে তেড়েফুঁড়ে ফেনিল জলরাশি নেমে আসছে বিপুল প্রাচুর্যে। মনে হয় যেন পথ ভুলে চলে এসছি সবুজ অরণ্য আর সাদা জলের সাক্ষাৎ কোনো স্বর্গে। ডানের ফোয়ারাটি তো আকারে-উচ্চতায় আর পানির প্রবাহে এই বর্ষায় ফুলেফেঁপে ধারণ করেছে রীতিমতো দানবীয় রূপ। বাঁপাশের দু’টি পানির ধারার রূপ এত ভয়ংকর না হলেও মনে গভীর মুগ্ধতা আর সম্ভ্রম এনে দেবার জন্য যথেষ্ট। তাদের পতিত জল নিচে জমা হয়ে তৈরি করেছে সবুজাভ এক জলাশয়।

সবুজ-সাদার স্বর্গ।
দামতুয়ার তিনটি ফোয়ারার জলরাশি একসাথে মিলে তৈরি করেছে এক প্রাকৃতিক সুইমিং পুল; Image Credit: Rhivu

ঝর্ণার তীব্র প্রবাহের কাছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ করে দিয়ে যেন মুহূর্তেই শরীরের সব ক্লান্তি চলে গেল। পানির প্রবল তোড়ে যতই বারবার ছিটকে যাচ্ছি, ততই যেন আরো নতুন উদ্যম এসে ভর করছে শরীরে তার ঐ রুক্ষ পাথুরে গায়ে শরির এলিয়ে দিতে। সে যে কেমন এক স্বর্গীয় শান্তি– তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। ইচ্ছে হচ্ছিল, সারাটা দিনই এই সুবিশাল ঝর্ণার নিচেই কাটিয়ে দিই– কখনোবা দূর পাথরে বসে তন্ময় হয়ে তার রূপ দেখে, আবার কখনোবা চলুক তার ভরা যৌবনে অবগাহন করে।

কিন্তু সময় সীমিত। বিকাল পাঁচটায় আলীকদমের দিকের আর ছ’টায় থানচির দিকের রাস্তা বন্ধ করে দেয় সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ; তাই হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে এখান থেকে বের হওয়া আবশ্যক।

ঠিক যেন এক সবুজ-সাদার স্বর্গ!
ঠিক যেন সবুজ-সাদার এক পাথুরে স্বর্গ; Image Credit: Shuvo

ঝর্ণায় নুডলস, স্যুপ খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও গত রাতে রাতভর বৃষ্টি হওয়ায় এবারো শুকনো খড়ি পাওয়া গেল না। অগত্যা সাথে থাকা খেজুর আর চকলেটেই লাঞ্চ সেরে আবার ফেরার পথে চলা শুরু। ফেরার সময় সাক্ষী হতে হলো তিক্ত এক অভিজ্ঞতার। পথে এক জুমে এক বৃদ্ধার কাছ থেকে আবার আখ খেয়ে, তার দাম পরিশোধ করার সময় দেখলাম তিনি প্রথমে হাসিমুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে ম্রো ভাষায় কী যেন বলছেন। তারপর দাদার দিকে তাকিয়েই তার কথার ভঙ্গি পালটে রাগ আর বিরক্তিতে ভরে উঠল। এদিকের পাড়ার নারীরা প্রায়ই বাংলা জানেন না, তাই আমরা ঘটনা বুঝতে না পেরে দাদার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। এদিকে তিনি আবার হাসিমুখে আমাদের কী যেন বলতে থাকলেন।

দাদা তখন ঘটনা ব্যাখ্যা করলেন। আমাদের আগে অন্য একটি দল ঝর্ণা থেকে ফেরার পথে নাকি আখ খেয়েছে, কিন্তু তার দাম না দিয়েই চলে গেছে। তিনি আমাদেরকে আশীর্বাদ দিচ্ছিলেন, আর ঐ দলের প্রতি রাগ ঝাড়ছিলেন দাদার কাছে। পাহাড়ে ঘুরতে এসে এই সাদাসিধে মানুষদের, এই সামান্য কয়টা টাকা নিয়ে ঠকানোর মতো কাজ কীভাবে কোনো পর্যটক করতে পারে, তা আমার মাথায় আসে না। কিছু মানুষের এমন কাজের জন্যই আমাদের সবার উপর থেকেই তাদের বিশ্বাস চলে যায়, যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে সবার উপরে।

বর্ষার দানবীয় দামতুয়া।
বর্ষার দানবীয় দামতুয়া; Image Credit: Rhivu

এখান থেকে কিছুদূর এগুতেই আবার শুরু হলো বৃষ্টি। প্রথমে ফোঁটায় ফোঁটায়, তারপর রীতিমতো মুষলধারে। একদিকে যেমন দেখতে পেলাম পাহাড়ে বৃষ্টির সেই মনমাতানো চোখ জুড়ানো রূপ, অন্যদিকে পিচ্ছিল পাহাড়ে পা টিপে টিপে ওঠানামা ক্লান্তিও বাড়িয়ে দিল অনেকখানি। আর সেইসাথে শুরু হলো জোঁকের অত্যাচার।

এই সবকিছু সামলে যতক্ষণে ফের ১৭ কিলোতে এসে উঠলাম, ততক্ষণে থানচির দিকের চেকপোস্ট বন্ধ হতে আর মাত্র মিনিট বিশেক বাকি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য থানচিতেই, দেশের সর্বোচ্চ, ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝর্ণা লাংলোক আর সুউচ্চ পাথুরে ঝর্ণা লিক্ষিয়াং। দ্রুত মুখে দু’টি গুঁজে দিয়েই রীতিমতো লাফিয়ে উঠলাম বাইকে, আর তারপর সাক্ষী হলাম ডিম পাহাড়ের পথে আরেক রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতার। সে গল্প বলব আরেকদিন।

এর আগের পর্ব- বান্দরবান ডায়েরি: মেরাইথংয়ের ঝড়ে

This article is in Bangla. It is a travel story of Damtua, Bandarban.

Featured Image Credit: Author

Related Articles