Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডার্ক ট্যুরিজম: ভ্রমণের গন্তব্য যখন ট্র‍্যাজেডি

কাঁধে ব্যাগ, মুঠোফোনে ম্যাপ, তারপর টিকিট কেটে অজানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া- জগতটাকে এভাবে ঘুরে দেখার ইচ্ছা কার না আছে? ভ্রমণের গন্তব্যস্থল কল্পনা করতে বললে আপনার চোখের সামনে হয়তো ভেসে উঠবে নায়াগ্রা জলপ্রপাত, আইফেল টাওয়ার কিংবা মিশরের পিরামিড। দেশের ভেতরে হয়তো যাইতে চাইবেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কিংবা সাজেক ভ্যালি। শান্ত পাহাড়ের নিস্তব্ধতা থেকে সুবিশাল সমুদ্র, প্রাচীন নগরী থেকে প্রবাসের অলিগলি- পর্যটনের ক্ষেত্র সুবিস্তৃত। আনন্দ, জানার আগ্রহ ও ঘোরার শখ- এসব কিছু মিলিয়ে পর্যটন।

কিন্তু সেই পর্যটনের স্থান যদি হয় এমন কোনো স্থান, যার ইতিহাস কেবল দুঃখ এবং দুর্দশায় ভরা, তাহলে?

অথচ ট্যুরিজম বা পর্যটনের নানা প্রকারের মধ্যে রয়েছে এমনই একধরনের পর্যটনশিল্প, যা কি না ইতিহাসের শোক এবং কষ্টের অধ্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। নাম তার- ডার্ক ট্যুরিজম

না, এটি কালো জাদু বা সে জাতীয় কোনো কিছুই নয়। এটি তার চেয়ে আরো বৃহৎ পরিসরের এবং আলাদা একটি বিষয়৷  

১৯৯৬ সালে ডার্ক ট্যুরিজম (Dark tourism) এর ধারণা প্রবর্তন করেন গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটির দুই ফ্যাকাল্টি সদস্য জন লেনন এবং ম্যালকম ফোলি। তাদের সংজ্ঞানুসারে, দুর্যোগ এবং ট্র‍্যাজেডির সাথে সম্পর্কিত স্থানে ভ্রমণ করাকে ডার্ক ট্যুরিজম বলে। কোনো স্থান অতীতের ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে থাকলে তার প্রতি মানুষের কৌতূহল এবং তা দর্শন করা ডার্ক ট্যুরিজমের অন্তর্গত।  

এই ভয়াবহতা হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা মানবসৃষ্ট কোনো ঘটনা। গোটা বিশ্ব জুড়ে রয়েছে ডার্ক ট্যুরিজমের অজস্র স্থান।

এ স্থান হতে পারে সুনামি, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্পের আঘাতে বিধ্বস্ত কোনো এলাকা। যেমন- ২০১১ সালের সুনামিতে বিধ্বস্ত জাপান বা সাম্প্রতিক সময়ে জলোচ্ছ্বাস কবলিত ইন্দোনেশিয়ায়। অনেক ডার্ক ট্যুরিস্ট ত্রাণকার্যে সাহায্য করে থাকেন এ সময়ে।

ডার্ক ট্যুরিজম হতে পারে অতীতের বড় কোনো দুর্ঘটনাস্থলে, যেমন- চেরনোবিলের পারমানবিক বিপর্যয়ের নিদর্শন বা আবেরফানের বিপর্যয়।

কিন্তু ডার্ক ট্যুরিজম সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে মানুষের নিষ্ঠুরতার চিহ্ন যেখানে পাওয়া যায় সেখানে। যেখানে মানুষের উপর আরেক শ্রেণীর মানুষের চূড়ান্ত অমানবিকতার ইতিহাসের স্বাক্ষী পাওয়া যায়, সেখানেই ডার্ক ট্যুরিজমের প্রবল সম্ভাবনা।

এ-বোম ডোম, হিরোশিমা  ©Koichi Kamoshida

নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের সাক্ষী পোল্যান্ডের অসউইৎজ ক্যাম্প, জাপানের আওকিগাহারা সুইসাইড ফরেস্ট, রুয়ান্ডার গণহত্যার মেমোরিয়াল, পারমাণবিক বোমায় হারিয়ে যাওয়া হিরোশিমা এবং নাগাসাকির ধ্বংসাবশেষ, ৯/১১ হামলার স্বাক্ষী গ্রাউন্ড জিরো- সবক’টি স্থানের একটি ক্ষেত্রে মিল আছে, প্রতিটি স্থান মানুষের বেদনার স্বাক্ষী।

ডার্ক ট্যুরিজম হতে পারে কোনো সিরিয়াল কিলার বা সন্ত্রাসীর একসময়ের আবাসস্থলে। মজার ব্যাপার হলো, ডার্ক ট্যুরিজমকে আকৃষ্ট করে নানা দেশে নানা ধরনের মিউজিয়াম বা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়ে থাকে। লস অ্যাঞ্জেলসের ‘মিউজিয়াম অফ ডেথ’ ডার্ক ট্যুরিস্টদের আকৃষ্ট করার জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের নানা অপরাধীর কুকীর্তির কথা জানতে বহু দর্শনার্থী ঘুরে আসেন এই জাদুঘর। ডার্ক ট্যুরিজমের প্রসারের স্বার্থে বহু সংঘ এবং অনলাইন ওয়েবসাইট রয়েছে।     

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডার্ক ট্যুরিজমের স্বার্থে নয়, বরং ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য যেসব জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোও ডার্ক ট্যুরিজমের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, সাধারণ ভ্রমণের সময় হয়তো কেউ কেউ ডার্ক ট্যুরিস্ট স্পটে ঢুঁ মেরে আসেন। যেমন- কেউ হয়তো জাপান বেড়াতে গিয়েছেন, সময় পাওয়াতে তিনি হিরোশিমা বা নাগাসাকি ঘুরে আসলেন!

ইতালির পম্পেই নগরী; Image Source: thecommonwanderer.com

ডার্ক ট্যুরিজমের স্পটের সময়সীমা নিয়ে বিতর্ক আছে। লেনন এবং ফোলির মতে, ডার্ক ট্যুরিস্ট সাইট কেবল সাম্প্রতিক ঘটনার মাঝে সীমাবদ্ধ। আর এ সময়সীমা তারা নির্ধারণ করেছেন ১৯০০ সাল থেকে। অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর আগের কোনো ঘটনা ডার্ক ট্যুরিজমের আওতায় পড়বে না। তবে অনেক তাত্ত্বিক এর বিরোধিতা করেছেন, কেননা এর আগে বহু ট্র‍্যাজেডি ঘটেছে, যার ফল আজও মানুষের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এর উদাহরণ হিসেবে তারা পম্পেই ট্র‍্যাজেডির কথা উল্লেখ করেছেন। ৭৯ সালে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে যায় ইতালির এ নগরী, মৃত্যু হয় হাজারো মানুষের।

লেনন-ফোলির সংজ্ঞানুসারে, পম্পেই ডার্ক ট্যুরিজমের আওতায় না পড়লেও ভয়াবহতার দিক দিয়ে এটি কোনো অংশে কম নয়। আবার ভিসুভিয়াসও এখনো মরে যায়নি, ঘুমন্ত এই আগ্নেয়গিরি যেকোনো সময়ে আবারও জেগে উঠতে পারে। তাই ডার্ক ট্যুরিজমে পম্পেইকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতেই পারে।

ডার্ক ট্যুরিজমকে কি খুব অদ্ভুত এবং অপরিচিত কোনো বিষয় মনে হচ্ছে? মজার ব্যাপার হলো, আমাদের বাংলাদেশেই ডার্ক ট্যুরিজমের বেশ কিছু স্পট রয়েছে।

সেগুনবাগিচায় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে নির্মিত ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ কিন্তু একটি ডার্ক ট্যুরিজমের স্পট।

এছাড়া আছে রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মিরপুর বধ্যভূমি, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থান ইত্যাদি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সমাধি, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যে বাড়িতে তাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়- এই সবক’টি স্থানই ডার্ক ট্যুরিজমের অন্তর্গত।     

২০১৩ সালের মর্মান্তিক রানা প্লাজার ধ্বসের স্থানও ডার্ক ট্যুরিজমের স্থান।    

জেনে হোক না জেনে হোক, আমরা কম-বেশি সকলেই ডার্ক ট্যুরিজমে অংশ নিয়েছি।

তবে, নৈতিকতার প্রশ্নে নানা সময়েই ডার্ক ট্যুরিজম নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।

কারো কারো মতে, মানুষের কষ্টকে পুঁজি করে পর্যটন শিল্প প্রচার করাটা নৈতিকভাবে অনুচিত। তারা মনে করেন, ডার্ক ট্যুরিজম অনেকটা নিষিদ্ধ বস্তুর উপর আকর্ষণের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত।

আবার আরেক মহলের মতে, ডার্ক ট্যুরিজম কোনো দোষের কিছু নয়, বরং জানার স্বার্থে ডার্ক ট্যুরিজম অত্যন্ত জরুরি। এ দলের গবেষকদের মতে, মানুষ যদি তার ইতিহাস না জানে, তবে সে কোনোদিনই তার অতীতের ভুল শোধরাতে পারবে না। ডার্ক ট্যুরিজম, তাদের দৃষ্টিতে যে কেবল মৃত্যুর প্রতি কৌতূহল বা ফ্যাসিনেশন দ্বারা প্রভাবিত, তা নয়। বরং ট্র্যাজেডির স্থান বা ঘটনার পেছনের ইতিহাস জানার আগ্রহ থেকেই ডার্ক ট্যুরিজম।

অনেকে হয়তো তারপরও মনে করতে পারেন, অপরের দুঃখ-দুর্দশার ইতিহাসকে নিজের শখের বিষয়ে পরিণত করাটা কতখানি যুক্তিযুক্ত?

যতই সময় অতিবাহিত হোক না কেন, বেদনার ইতিহাস তো বেদনার ইতিহাসই, তা-ই নয় কি?

বিরকেনিউ গেইট, অসউইৎজ ক্যাম্প; Image Source: shutterstock.com

কিন্তু মানুষ হিসেবে যে বৈশিষ্ট্য আমাদের অন্য সকল জীব থেকে আলাদা করে রেখেছে তা হলো আমাদের জানার আগ্রহ, কৌতূহল। আর শুধুমাত্র বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তো চলবে না, ভবিষ্যতের সঠিক পথ বোঝার জন্য আমাদের পেছন ফিরে তাকাতেই হবে। অতীতকে ভুলে কখনো ভবিষ্যতকে গড়া যাবে না। জাতি হিসেবেও আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের ইতিহাস না জানলে আমরা কখনো স্বাধীনতার মর্ম বুঝতে পারবো না। আর এ কেবল জানার জন্য জানা নয়, ভেতর থেকে অনুভব করার বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাজার হাজার মানুষ অসউইৎজ ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে তাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন- আজ ক্যাম্পের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে সাম্প্রদায়িকতা কত ভয়ংকর, কত বিষাক্ত।

আবার মুরাম্বি মেমোরিয়ালে দাঁড়িয়ে,  ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডায় তুতসিদের গণহত্যার জবানবন্দি দেখে মানুষ দেখবে ঘৃণা কী জঘন্য একটা বিষয় এবং কীভাবে কেবল তুতসি পরিচয়ের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলো তাদেরই হুতু প্রতিবেশী!

চেরনোবিল বিপর্যয়ের চিহ্ন; Image Source: diveprice.com

অতীতের ভুল, গ্লানি বা বেদনা থেকে শিক্ষা নেবার জন্য তাই অবশ্যই উচিত এ সকল স্থানে যাওয়া, জানা। তবে এসব স্থানে যাওয়া বলতে কেবলমাত্র নিজের চেকলিস্টে টিক দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পর্যটকের সংবেদনশীলতাটাও জরুরি।

ডার্ক ট্যুরিজমের স্পট অন্যান্য ট্যুরিস্ট স্পটের চেয়ে আলাদা। এসব স্থান অতীতের বেদনাকে ধারণ করছে, তাই অবশ্যই পর্যটককে সেরকম মার্জিত আচরণ করতে হবে। যদি সারি সারি কবরের সামনে কেউ সেলফি স্টিক নিয়ে নিজের সবচেয়ে ভালো প্রোফাইল পিকচার তুলতে বসে- তাহলে তা অত্যন্ত অশোভন হবে।

সে কারণে এসব জায়গায় ভ্রমণের সময় নিজের আচরণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, আপনার আচরণ যেন কোনোভাবে স্থানীয় মানুষ বা যাদের ইতিহাস তাদেরকে আঘাত না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বিশ্বের নানা স্থানে ভ্রমণ করার সুযোগ বা সামর্থ্য অনেকেরই থাকে না, তাই যাদের তা আছে, তাদের উচিত ভ্রমণের সময় সহানুভূতিশীল হওয়া।

ডার্ক ট্যুরিজম বা যেকোনো ধরনের ভ্রমণের সময় ভ্রমণের স্থান, সেখানকার মানুষ এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানার সাথে সাথে পর্যটকের সাথে সেই স্থানের জনপদের মধ্যে একধরনের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পর্যটক সেই জনপদের স্থানে নিজেকে রেখে চিন্তা করার সুযোগ পায়, এভাবে অপরকে বোঝার মানসিকতা থেকে মানুষ বিদ্বেষমূলক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসে। মানুষ উদার হয়, সহমর্মী হয়।

দিনশেষে এসব স্থানে ভ্রমণের পেছনে আপনার উদ্দেশ্য কী সেটাই মুখ্য বিষয়। সেটা কি মৃত্যু ও বিষাদের প্রতি কৌতূহল? ইতিহাস জানার আগ্রহ? নাকি বন্ধুবান্ধবের মাঝে ‘ব্যতিক্রম’ হবার ইচ্ছা?

আপনি কি একজন ডার্ক ট্যুরিস্ট?

আপনার উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, ভ্রমণের সময় আপনার আচরণ যথাযথ সম্মান এবং সংবেদনশীলতার পরিচয় দিলে এ নিয়ে আর কোনো বিতর্ক হবার কারণ থাকবে না।

শুধুমাত্র ক্যামেরা দিয়ে নয়, বিষাদের ইতিহাসের স্বাক্ষী এসব স্থানকে নিজের অন্তর দিয়ে দেখুন। বাড়ি ফিরে আসার সময় শান্তি, সহানুভূতি এবং অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা নিয়ে আসুন, মনে ধারণ করুন। তাহলেই একটু একটু করে পৃথিবীটা আরো সুন্দর, আরো  সহনশীল হয়ে উঠবে।

তাই শুরুটা হোক নিজেকে দিয়ে।                       

সাম্প্রতিককালে নেটফ্লিক্স ডার্ক ট্যুরিজম সম্পর্কে ‘ডার্ক ট্যুরিস্ট’ নামের একটি ধারাবাহিক ডকুমেন্টারি সিরিজ নির্মাণ করেছে। সাংবাদিক ডেভিড ফ্যারিয়ারের উপস্থাপনায় প্রচারিত ধারাবাহিকটির ট্রেইলার নিচে দেখে নিতে পারেন। 

This article is written in Bangla. It's about the phenomenon and practice of Dark Tourism. All the necessary references have been hyperlinked. 

Feature image © Kenneth Garrett

Related Articles