Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দেবতাখুম: যে খুমে সহস্র শতাব্দী ধরে, দেবতা আছে ঘুমিয়ে!

অনেককাল আগের কথা। ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ তারাছা খালের ঝিরিপথ ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। গভীর আর বুনো অরণ্যে ঘেরা এই খুম থেকে যদি বেশি মাছ পাওয়া যায়, এই আশায়। বৃদ্ধ কখন যে খুমের একদম গভীরে বিশাল এক পাথরের কাছে চলে এসেছে, বলতেই পারবে না। মাছ ধরার ফাঁকে হঠাৎ করেই দৈত্যাকৃতির এক কচ্ছপ দেখে ভয়ে নিজের প্রাণ নিয়ে দৌড়ে পালায় সে। শীলবাধা পাড়াতে ফিরে এসে বৃদ্ধের প্রচণ্ড জ্বর আসে রাতে। ঘুমের ঘোরে সে স্বপ্নে দেখে সেই কচ্ছপ তাকে বলছে, 

আমাকে ভয় পাস নে। বরং আমার কথা সবাইকে বলবি। আমি তোদের জিন (দেবতা)। তোরা যখন মাছ ধরতে যাবি তখন ঐ রাজ পাথরের উপর পূজোর থালি সাজিয়ে প্রার্থনা করে অনুমতি নিয়ে নিবি। আর খবরদার, আমার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করবি না। এর পরিণতি ভালো হবে না।

বেলা ১১ টার ঝকঝকে আকাশের নীচে পুরু গাছের বন, এলোমেলো আর উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেবতাখুমের নামকরণের ইতিহাস শুনছিলাম আমাদের গাইড যোগীন্দ্র দাদার কাছ থেকে। যদিও এই গল্পে নানাজনের নানা মত আছে। অনেকে বলে কচ্ছপ নয়, নাম না জানা এক প্রাণী ছিল। অনেক বৃদ্ধ সেই প্রাণী নিজ চোখ দেখেছে বলে স্বীকারোক্তিও দেয়। আবার অনেকে বলে দেবতার জন্মই হয়েছে এখানে। তবে যে যা-ই বলুক, এই খুমকে কেন সকল খুমের রাজা বলা হয় তা নিজ চোখে না দেখলে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। হিমশীতল পানিতে ভেলায় চড়ে সেই বুনো পাহাড়ের বাঁক কাঁটার সময় একচিলতে আকাশই মনে করিয়ে দেয় এর নাম – দেবতাখুম: যে খুমে সহস্র শতাব্দী ধরে, দেবতা আছে ঘুমিয়ে

সবুজের মায়া গলে পাহাড়ের ফাঁক গলে এমন স্বর্গীয় আলোই উঁকি দেয় দেবতাখুমে; © Wazedur Rahman Wazed

চান্দের গাড়িতে করে পাহাড়ে চড়া, পাহাড়ি পথ আর জঙ্গল ধরে ট্র্যাকিং করা আর ভেলায় চড়ে কায়াকিং করে নিজ গন্তব্যে যাওয়া- এই তিনটির কম্বো প্যাক বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার দেবতাখুম। খুম শব্দের অর্থ জলাধার। দেবতার জন্ম বা দেবতা থাকে এখানে তাই নাম দেবতাখুম। স্থানীয়দের মতে, এই খুমের গভীরতা জায়গাভেদে ৫০-৮০ ফুট এবং দৈর্ঘ্যে এটি প্রায় ৬০০ ফুট। বান্দরবানে যতগুলো খুম আছে, সেসবের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বেশি বণ্য। তাই এখানে যাওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা প্রত্যেক ভ্রমণপ্রেমীরই থাকে। 

আমারও ছিল। আর সেই ইচ্ছা পূরণ করতে সাহায্য করল সেই ভ্রমণপ্রিয় বন্ধু উইলিয়াম ক্লাইভ। ঝর্ণার সন্ধানে সীতাকুণ্ডের গহীনে পর্ব শেষ হতে না হতেই আমরা দেবতাখুমে যাবার প্ল্যান করেছিলাম। আর আমাদের প্ল্যান ও তারিখ মোতাবেক চট্টগ্রামের একটি ভ্রমণবিষয়ক গ্রুপকেও পেয়ে গেলাম। একসাথে ৩০-৩৫ জন হৈ-হুল্লোড় করতে করতে যাবো, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? আমাদের যাবার তারিখ ছিল ১১ নভেম্বর শুক্রবার। সেদিন ভোরের সূর্যকিরণ চট্টগ্রাম শহরের বিশালাকার গাছ ছাতিমের চূড়া ছোঁয়ার আগেই ঘুম ভেঙে গেল আমাদের। আগেই চট্টগ্রাম পৌঁছে গিয়েছিলাম আমি, যেন দেরি না হয়। তাই, মনে তখন একটাই চিন্তা- দেবতাখুম যেতে হবে। তড়িঘড়ি করে ছুটলাম জিইসি মোড়ের উদ্দেশ্যে। একে একে গ্রুপের সব সদস্য আসতে শুরু করলো। ঠিক ৬টা বেজে ৩৫ মিনিটে শুরু হলো রিজার্ভ করা বাসে চড়ে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে যাত্রা। পথিমধ্যে থামিয়ে খাবার খেতে গেলে দেরি হবে বিধায় বাসেই নাস্তার পর্ব সেড়ে নেয়ার চমৎকার প্ল্যান ছিল আয়োজকদের। 

অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহানোর পর বাস আমাদের নামিয়ে দিল বান্দরবান শহরের পূর্বাণী বাস কাউন্টারের সামনে। নেমেই দেখি তিনটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের নিয়ে পাহাড় দাপিয়ে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে। নীচু থেকে যখন পাহাড়ের উপরে উঠতে শুরু করে এই জিপ, তখন মনে হয় যেন চাঁদের দিকেই যাচ্ছে, তাই এর নাম চান্দের গাড়ি। যেহেতু এবারই আমার এই গ্রুপের সাথে প্রথম যাত্রা, তাই পরিচয় কারোর সাথেই ছিল না। যদিও ক্ষণিক আগেই যারা অপরিচিত মানুষ ছিল, মুহূর্ত বাদেই এমনকি সূর্য কিরণের তাপ বদলানোর আগেই তারা কেমন পরিচিত মানুষে পরিণত হয়ে গেল। শুরু হলো আমাদের বান্দরবান শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের রোয়াংছড়ি উপজেলার উদ্দেশ্যে যাত্রা।  

চান্দের গাড়িতে পাহাড়ের খাঁজে কাঁটা রাস্তায় ছুটে চলা আমাদের। © Jobair Ullah

আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাবো, চলো না ঘুরে আসি অজানাতে, চুমকি চলেছে একা পথে, পুরনো সেই দিনের কথা … এমন অসংখ্য কালজয়ী বাংলা গানের পাশাপাশি পাহাড়ি আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে যেন দোলা তুলে দিয়েছিল আমাদের চান্দের গাড়িতে। তাই তো পাহাড়ি পুরো উঁচুনিচু আর আঁকাবাঁকা পথও যেন আমাদের গানের সুরে তাল মিলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমাদের এক অচীনপুরে। যে পুরে কোনো দুঃখ নেই, নেই কোন যান্ত্রিক কোলাহল, নেই সামাজিক-রাজনৈতিক কোনো ইস্যু কিংবা বৈষম্য; আছে কেবল দু-চোখ ভরা আকাশ আর পাহাড়; আর তার ভাজে লুকিয়ে রয়েছে স্রষ্টার নিজের হাতে সাজানো সবুজের অপার রূপের সমাহার। 

রোয়াংছড়ির কচ্ছপতলী বাজার আসার পূর্বেই রোয়াংছড়ি থানায় আপনাকে জানাতে হবে। সেখান থেকে আরো আধা ঘণ্টা বা চল্লিশ মিনিট পাহাড়ি আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথ ধরে ছুটে চলার পর এসে পৌঁছলাম কচ্ছপতলী গ্রাম। গাড়ির রাস্তা এখানেই শেষ। এটা মূলত পাহাড়িদের গ্রাম্য বাজার। এখানে বলতে গেলে প্রয়োজনীয় সবই পাবেন আপনি। একটা হোটেল আছে যাদের রেস্টরুম ভাড়া নিয়ে কাপড় বদলানো এবং দরকারি জিনিসপত্র রেখে ট্র্যাকিংয়ে চলে যেতে পারবেন। 

এখান থেকেই আপনাকে গাইড নিতে হবে। প্রতি ১০ জনে ১ জন করে গাইড। ট্র্যাকিংয়ের পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে এসে দাঁড়ালাম লিরাগাও আর্মি ক্যাম্পের কাছে। সাধারণ কিছু জিজ্ঞাসাবাদ আর কিছু পরামর্শ দিয়ে তারা বিকাল ৫টার মধ্যে ফিরে আসার বিশেষ অনুরোধ জানিয়ে অবশেষে অনুমতি দিলেন। শুরু হলো আমাদের যাত্রা। 

প্রকৃতির অপার রূপ দু-চোখ ছাড়া উপভোগ করার মতো কোনো যন্ত্র এই দুনিয়ায় আবিষ্কার করতে পারেনি কেউ; © Wazedur Rahman Wazed

পূর্বে দেবতাখুম যাবার সময় দেবতা পাহাড় পাড়ি দিতে হতো। তবে সাম্প্রতিককালে পাহাড়ি পথ যেন কষ্ট করে পাড়ি দিতে না হয় সেজন্য ঝিরিপথের ধার ধরে জঙ্গলের রাস্তা কেটে সাফ করা হয়েছে চলাচলের জন্য। কখনো বনজঙ্গল, কখনো গোড়ালি অবধি ঝিরিপথ, কখনো সাঁকো, কখনোবা আবার বিশাকালার পাথরের মাঝ দিয়ে হাঁটা। এমন করেই ঘণ্টা দেড় থেকে দুই হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম শীলবাঁধা পাড়াতে। 

আরো ১০/১৫ মিনিট হেঁটেই চলে এলাম পং সু আং নামক খুমের কাছে। মূলত এই ছোট খুম পাড়ি দিয়েই দেবতাখুমে যেতে হয়। পূর্বে এই খুম পারাপার ছিল অনেক ভয়ানক এবং কষ্টসাধ্য। অর্ধেক রাস্তা হেঁটে গিয়ে পরে খুমের পানিতে সাঁতার কেটে নয়তো গাছের শেকড় ধরে ঝুলে যেতে হতো। তবে এখন নৌকার ব্যবস্থা থাকায় মাত্র ৫ মিনিটেই এই খুম অতিক্রম করা যায়। তবে সপ্তাহের সবচেয়ে রঙিন দিনে গিয়েছিলাম আমরা। তাই চারদিক ছিল জনারণ্য। প্রায় ঘন্টাখানেক কিংবা তারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে ৫ মিনিটের রাস্তা পাড়ি দেয়ার জন্য। 

পং সু আং যখন পাড়ি দেই ততক্ষণে দুপুরের চড়া রোদ স্তিমিত হতে শুরু করেছে। দূর থেকে দেবতাখুম ঢুকার মুখটা দেখতে অনেক অন্ধকার আর গা ছমছমে লাগছিল। কেমন যেন অদ্ভুত নীরবতা আছে পুরো এলাকা জুড়ে। নিস্তব্ধতার যে একটা ভার রয়েছে, তা বুঝতে হলে আপনাকে যেতে হবে দেবতাখুমে। আপনি শত চেষ্টা করেও চিল্লাতে পারবেন না এখানে। পলকেই মনে হবে এই বুঝি দেবতার ঘুম ভেঙে গেল। পং সু আং পাড়ি দিয়ে এসেই লাইফ জ্যাকেট চাপালাম গাঁয়ে। ভেলা পাওয়া মাত্রই মুহূর্ত দেরি না করে সামনের দিকে বসেই দাঁড় বাইতে শুরু করলাম। যেন কেউ ডাকছিল তখন আমাকে। 

পং সু আং খুমে গাইড যোগীন্দ্র দাদাসহ আমাদের গ্রুপ; © Shopna/Travelling Aroung Bangladesh

একে তো সাঁতার জানা নেই, এর উপর ভেলার সামনের দিকে বসেছি, জানি না কী করে দাঁড় বাইতে হয়; আর এমন এক বড় বৈঠা মানে বাঁশ দিয়েছে যেটার ভারসাম্য ঠিকমতো রেখে দাঁড় বাইতে হিমশিম খাচ্ছিলাম আমি। উপরন্তু, পানি এমন হিমশীতল যে কলজে পর্যন্ত ঠাণ্ডা হবার যোগাড়। ভেলায় চড়ার পূর্বে বিশাল এক পাথরের গাঁয়ে স্লিপ কেটে পায়ের হাড়ে বেশ ভালোই ব্যথা পেয়েছিলাম। যেটা ভেলায় চড়ার পর টনটন করা শুরু করেছিল। তো সেই আধো-আলোময় এক ভিন্ন জগতে আমার মতো দুর্বলচিত্তের মানুষের হাইপার হয়ে যাবার প্রবণতা ছিল অনেক বেশি। আর সেটাই হয়েছিল। অস্থির চিত্তে পাগলপ্রায় আমি ঘন ঘন দাঁড় বাইতে গিয়ে কী করছিলাম তা নিজেও বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় পেছন থেকে নাজমুল দাদা বললেন, দাঁড় বাইবার দরকার নেই, ভেলা নিজেই আমাদের ঠেলে নিয়ে যাবে। আমি যেন প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দেই। 

মুহুর্তেই সবকিছু যেন থেমে গেল। পৃথিবী তার কক্ষপথে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো, সূর্য আর চন্দ্রও যেন নিজেদের কক্ষপথে আটকে গেল, কোনো এক অপার শক্তির নির্দেশে কেবল দেবতাখুমের পানিই বহমান রইল; আর সেই বহমান পানিতে ভেলায় ভেসে যাচ্ছি আমি এক বিভ্রান্ত পথিক। ডানপাশে যত উঁচুতে চোখ যায় পাহাড় উঠে গেছে, বামপাশেও তা-ই; মধ্যিখানে আকাশ যেন এক চিলতে জায়গা খুঁজে নিজের বিশালতাকে দেখানোর জন্য। এত বিশাল আকাশকেও কেমন অসহায় লাগে দেবতাখুমের সেই বিশালাকার পাহাড়গুলোর ফাঁকে। পাহাড়ের গাঁয়ে সবুজের মেলা আর উপরে একচিলতে নীলাকাশ। পানির রঙ তাই সবজেটে লাগে অনেকটাই। 

এমনই করে চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়ে রাজপাথরের উপর। মূলত এই পাথর পাহাড়িদের কাছে বেশ পবিত্র আর সম্মানের জায়গা। এখানেই জিন বা দেবতার উদ্দেশ্যে তারা অর্ঘ্য বা পূজার থালি সাজিয়ে দিয়ে রাখে। তাই, পারতপক্ষে এই জায়গা এড়িয়ে যাবেন। যতই সামনের দিকে এগোবেন, দেখবেন যাওয়ার রাস্তা সরু হয়ে আসছে। হঠাৎ করেই মনে হতে পারে যেন এটাই শেষ। কিন্তু নাহ, বাঁক কাটলেই দেখবেন এখনো অনেক পথ বাকি। কখনো পাহাড়ের গাঁয়ে দেখতে পাবেন অদ্ভুত খাঁজকাটা নকশা, কখনো বা গুহার মতো বিশাল গর্ত, আবার কখনো উঁচু পাহাড়ের গাঁ বেয়ে নেমে আসা বুনো গাছের শেকড়। যতই সামনের আগাই দিনের আলো কমতে থাকে, কেননা আকাশের সীমারেখা তখন দুই পাহাড়ের ফাঁকে ক্রমশ সরু হয়ে আসছিল। 

স্রষ্টার সঙ্গে কথোপকথনের এমন ব্যর্থ প্রচেষ্টার লোভ সামলানো দেবতাখুমের ঐ নিস্তব্ধ বিশাল শূন্যতায়; © Wazedur Rahman Wazed

প্রায় ২০-২৫ মিনিট ভেলা ভাসানোর পর অবশেষে বাঁক ঘুরতেই দেবতাখুম ভেলার রাস্তার শেষটা চোখে পড়ল। ভেলা একদম তীরে এনে পাথরের সঙ্গে ঠেলে দিচ্ছি নামবো বলে। তখনই ভূতের মতো এক পাহাড়ি লোকের উদয় হলো। তিনি স্পষ্ট বাংলায় বললেন, এখানে রেড ফ্লাগ লাগানো আছে। এটাই আপনাদের জন্য শেষ সীমানা। অনেকবার জিজ্ঞেস আর অনুরোধ করলাম ঝিরিপথটার পর কী আছে? তিনি কোনো কথাই আর বললেন না। অগত্যা আবার ভেলা ভাসিয়ে ফিরে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। 

ফিরে আসার সময় পর পর দুবার আমার ভেলা একদম অর্ধেক কাত হয়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড ভয় আর আতঙ্ক কাজ করছিল তখন। যদিও গাঁয়ে লাইফ জ্যাকেট ছিল, তা-ও পানিতে পড়লেই আমার হাইপার হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। এর মধ্যে মাইকিং চলছিল ফিরে যাবার জন্য। তখন ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছুঁই ছুঁই করছে। কিন্তু এরইমধ্যে যেন দেবতার নিঃশ্বাসে ক্রমশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছিল দেবতাখুম। দিনের আলো যখন নিভু নিভু করছে, ঠিক তখন ভেলা নিয়ে ফিরে আসি আমরা। ৩৩ জনের টিমের মধ্যে আমরা ১০ জনের মতো বাকি ছিলাম। বাকিরা ইতিমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই কচ্ছপতলী বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। পং সু অং নামক সেই খুম পাড়ি দেয়ার সময়ও দিনের শেষ আলো মোমবাতির শিখার মতো ধুঁকে ধুঁকে জ্বলছিল। শুরু হলো আবারো আমাদের পাহাড়ি বনজঙ্গল আর রাস্তা ধরে ট্র্যাকিং করে ছুটে চলা।

শুরুতে হাঁটতে এতটা কষ্ট না হলেও অন্ধকার যখন ঝেঁকে বসতে শুরু করলো তখন মনে হচ্ছিল চারিদিকে থেকে ঘোর অমানিশা আমাদের গুটিকতক মানুষকে গ্রাস করে নিতে চাচ্ছে। পাহাড়ে কোনো সন্ধ্যে নেই, তবে পাহাড়ে রাত নামে দ্রুত; কোনো বইতে পড়া এমন কথাই বারবার মাথায় আসছিল। ঝিরিপথে বয়ে চলা পানির কুলকুল শব্দ, ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ঘ্যানঘ্যান্যানি, পাহাড়ি লতাপাতার বুনো গন্ধ, পিনপতন নিস্তব্ধতা আর নিজেদের প্রতিটি পদক্ষেপের শব্দ বাদে পুরো দুনিয়া যেন ডুবে গিয়েছিল এক অদ্ভুত আঁধারে! ৫টা ৪০ মিনিটে যেখানে শহরে কেবল বিকেল শেষ হয়েছে, সেখানে পাহাড়ে যেন নেমে এসেছে মধ্যরাত। 

পকেটে অ্যান্ড্রয়েড ফোনে টর্চ লাইট থাকা সত্ত্বেও অন্ধকারে হাঁটতেই বেশি ভাল লাগছিল। চাঁদের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে আর বুনো পাহাড়ি গন্ধে মাতাল হয়ে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ ও শিহরণ লাগছিল মনে। যেন পথভ্রষ্ট হয়ে একদল পথিক আমরা, হেঁটে চলেছি অনন্তকাল ধরে অসীম প্রান্তরে। অবশেষে যখন লিরাগাও সেনানিবাসে এসে থামি, ততক্ষণে সবাই হোটেলের চেয়ারে বসে পেটপূজায় মগ্ন; নয়তো সারাদিনের ক্লান্তি শেষে দুদণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে ফুরসতে। 

পাহাড়ে কোনো সন্ধ্যে নেই, তবে পাহাড়ে রাত নামে দ্রুত; © Wazedur Rahman Wazed

সেনানিবাসে রিপোর্ট করে দ্রুত কাপড় বদলে জিপে চড়ে চলে এলাম পূর্বাণী বাস কাউন্টারে। পুনরায় বাসে করে চট্টগ্রাম আসা। তবে যখন চট্টগ্রাম নামি, তখন বাজে রাত ১১টা। শরীর আর চলতে চায় না, কিন্তু যান্ত্রিক শহরের যান্ত্রিক জীবন তখন চুম্বকের মতো টানছে। উপায়ান্তর না দেখে রাত ১২টার শেষ বাস ধরতে হলো। তখন বাস ছুটেছে ঢাকার উদ্দেশ্যে, দেবতা ঘুমিয়ে পড়েছে তারাজ্বলা আকাশের নীচে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুই পাহাড়ের ভাজে, দেবী আছে কারো উদ্দেশ্যে পথ চেয়ে, আর আমি হারালাম আবারো যান্ত্রিক কোলাহলে। 

এই দেবতাখুম ট্যুরে জনপ্রতি খরচ হয়েছিল ১৫০০/- টাকা। তবে সেটা চট্টগ্রামবাসীদের জন্য। ঢাকার হিসেবে আমার আলাদা খরচ হয়েছে। যেহেতু চান্দের গাড়ি, গাইড, ভেলা অনেককিছুর প্যাকেজ, তাই দলবেঁধে যাওয়ার পরামর্শ রইল। যখন ফিরছিলাম বান্দরবান থেকে, তখন রাতের আকাশে মেঘের ভেলা একটা বিমূর্ত রূপ নিয়েছিল চাঁদের সংস্পর্শে এসে। সেই বিমূর্ত রূপে যেন দেবতা মুচকি হেসে বলছিল – 

চোখ মেলো তাকাও প্রকৃতির ভাজে,
খুঁজে পাবে আমায়,
আমারই সৃষ্টির প্রতিটি খাঁজে! 

This article is in the Bengali Language. This travel log for one day tour at Debotakhum, Bandarban. 
Necessary references have been hyperlinked inside the article. 

Feature Image: © Wazedur Rahman Wazed 

Related Articles