Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শেরপাদের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশিবার জানতে চাওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর

সে অনেককাল আগের কথা। হিমালয়ে পর্বতারোহণ তখনো শখের জিনিস হয়ে ওঠেনি। তিব্বতের পূর্বদিক থেকে একদল মানুষ নেপালে পাড়ি জমায়। দুই অঞ্চল তখনো একই দেশ ছিল। তারা নিজেদের ‘শার-ওয়া’ বলে ডাকতো। তারা আজ আমাদের কাছে পর্বতের অতিমানব শেরপা বলে পরিচিত। আজকাল তো শেরপা শব্দটা বিশেষ্য থেকে ক্রিয়াপদেই রূপ নিয়েছে। যেমন, আমার ব্যাগটা শেরপা করতে পারবে? ভ্রমণে শেরপার গুরুত্ব অপরিহার্য। তাদের নিয়ে প্রায়শ জিজ্ঞাস্য কিছু প্রশ্ন থাকে। অনেকেরই এ ব্যাপারে কৌতূহল হয়। এরকমই কিছু কৌতূহলী প্রশ্ন নিয়ে আজকের আয়োজন। 

শেরপারা কি হিমালয়ের কুলি?

Image Source: Mark Horrel

শেরপারা জাতিগতভাবে সাধারণ কুলি নয়। ক্যাম্প প্রস্তুত করা, অন্য শেরপাদের নিয়ন্ত্রণ করা, কোনো শেরপার কাঁধে ভার বেশি হয়ে গেল কি না, ট্রেকিং দলের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা এগুলো তাদের কাজ। এছাড়া সেবা গ্রহণকারী অভিযাত্রীর সাথে যোগাযোগ, পুরো রাস্তায় তাদের সাহায্য করা থেকে শুরু করে অভিযাত্রী যখন ক্যাম্পে ফিরে আসেন তখন যেন চা গরম থাকে, তা দেখাশোনা করার দায়িত্বও একজন শেরপার।

শেরপা জাতিগোষ্ঠী ছাড়াও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কিছু মানুষ এই কাজ করে থাকেন। তবে তা শুধু বেজক্যাম্প পর্যন্ত। এর পরের ক্যাম্পগুলো থেকে সামিট পর্যন্ত যেতে বেশি দক্ষতার শেরপাদের প্রয়োজন হয়। এদের বেশিরভাগই আসেন শেরপা জাতিগোষ্ঠী থেকে। উচ্চতার ঝুঁকি আর দক্ষতার পাশাপাশি আন্তরিক এই দায়িত্ব পালনের জন্য শেরপারা ভালো অর্থ পান। জীবনের ভয়কে তুচ্ছ করে একজন দক্ষ শেরপা দু’মাসে ৪-৫ হাজার মার্কিন ডলার আয় করে থাকেন।

শেরপারা থাকে কোথায়?

জাতিগত শেরপারা নেপালের সোলুখুম্বু উপত্যকায় পাংবোচি গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মাঝে জায়গা করে নিয়েছিল। উপত্যকাটি বর্তমানে জাতীয় উদ্যান। শেরপাদের গ্রাম থেকেই এভারেস্টে ওঠার পথ শুরু হয়।

আমরা কি শেরপাদের মতো হতে পারি?

১৯৭৬ সালে আমেরিকার একটি গবেষণায় বলা হয়, হাজার বছর ধরে পৃথিবীর অন্যতম বেশি উচ্চতায় আর হিমালয়ের তাপমাত্রায় থাকতে থাকতে শেরপাদের শরীর ওই আবহাওয়ার সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। তাদের শরীর তাদেরকে বেশি উচ্চতায় আর কম অক্সিজেনে বেঁচে থাকার মতো করে প্রস্তুত করেছে। হিমোগ্লোবিনে বাঁধা তাদের শরীরের এনজাইমগুলো আমাদের থেকে একটু আলাদাই। তাদের হৃদপিন্ড শর্করাকে কাজে লাগায়, আর ফুসফুস কম অক্সিজেনে থাকার জন্য অধিকতর উপযোগী।

এই গবেষণার পর আরো অনেক গবেষণা হয়েছে তাদের জিনতত্ত্বীয় বিষয়ে। অর্থাৎ আমরা, আমাদের ছেলেমেয়েরা, তাদের ছেলেমেয়েরা যদি শেরপাদের এলাকায় গিয়ে বসতি গড়ি তাহলে আশা করা যায়, আমাদের বংশে একদিন শেরপাদের মতো শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মানুষ তৈরি হবে।

অবশ্য আপনি যদি রেইনল্ড মেসনারের মতো হয়ে থাকেন তো ভিন্ন কথা। তিনি এভারেস্টের শিখরে একাই চলে গিয়েছিলেন, কোনো অক্সিজেন ছাড়া। এছাড়া তিনি পৃথিবীর ১৪টি ৮,০০০ মিটারের বেশি পর্বতের সবগুলোকে জয় করে ফেলেছেন।

বিখ্যাত শেরপারা

Image Source: Explorersweb

শেরপারা জাতিগোষ্ঠীগতভাবে অবশ্যই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিবার এভারেস্টসহ পুরো হিমালয়ের সব পর্বতে সামিট করার সর্বোচ্চ রেকর্ডধারী। ১৯৫৩ সালে স্যার এডমুন্ড হিলারীর সাথে তেনজিং নোরগে শেরপার প্রথমবার এভারেস্ট বিজয় শেরপাদের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন। তিব্বত ও ভারত তেনজিংকে নিজেদের বলে দাবী করে আসছে। খ্যাতিতে পিছিয়ে নেই আপা শেরপাও। তিনি ২০১১ সাল পর্যন্ত ২১বার এভারেস্ট জয় করে ফেলেছেন। স্ত্রীকে তিনি কথা দিয়েছিলেন ২১ তম বারের পর আর এভারেস্টে উঠবেন না। ২০১৮ সালের মে মাসে কামি রিতা শেরপা এই রেকর্ড ভেঙে ২২তম বার এভারেস্ট অভিযান শেষ করেন। এটা পৃথিবীতে সর্বোচ্চবার এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড।

শেরপারা সবসময় এভারেস্টের আশেপাশেই কেন থাকে?

শেরপারা মোটেও শুধু এভারেস্টের আশেপাশেই থাকে না। তাদের রক্তে আছে ভ্রমণের নেশা। প্রায় ৬০০ বছর আগে গল্পের সাংগ্রি-লা খুঁজতে তিব্বত থেকে সোলুখুম্বু অঞ্চলে এসে পৌঁছেছিল। এখানে এসে তারা জীবনকে উন্নততর করে তোলার সুযোগ পায়। এভারেস্ট অভিযান বাড়তে থাকার সাথেই স্বচ্ছল হয়ে ওঠে শেরপারা। তাদের সন্তানেরা কাঠমান্ডু থেকে শুরু করে দেশের বাইরে পর্যন্ত পড়তে যায়। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৫,০০০ এর বেশি শেরপা দেশের বাইরে বসতি গেড়েছেন বিভিন্ন পেশা নিয়ে। বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক শেরপা পাহাড় চড়া ছেড়ে ধরেছেন আরোহণ সম্পর্কিত ব্যবসা, কেউ কেউ ট্যাক্সিও কিংবা বিমানও চালান। প্রবাসী শেরপাদের অর্ধেকের বেশি আছেন আমেরিকায়। এছাড়া ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা জার্মানিতেও আছেন অনেকে।

শেরপারা কি পাহাড় চড়তে ভালোবাসে?

Image Source: Twitter

শেরপা হলেই এমন নয় যে পাহাড় চড়া ভালোবাসতে হবে। শেরপা জাতিগোষ্ঠীর কাছে উচ্চতম পর্বতগুলোর মাথায় দেবতাদের বাস, আর এ স্থান জয় করা নয়, সম্মান করে দূর থেকে দেখা উচিত। পর্বতের শীর্ষে পৌঁছানোর মোহ এসেছে সুদূর ইউরোপ থেকে। এমনকি যেসব শেরপারা দক্ষতার সাথে পাহাড় জয় করে ফেলেন, তাদের অনেকের বিশ্বাস পাহাড়ে দুর্ঘটনা হয় দেবতার প্রতি যথাযথ সম্মান না দেখানোর কারণে। এভারেস্ট অভিযান শুরু করার আগে তারা পূজা করে দেবতার অনুমতি ও সহায়তা প্রর্থনা করেন।

শেরপাদের সবার নাম লাকপা, পাসাং, পেমবা কেন?

শেরপাদের কারোর নাম লাকপা দর্জি, তো আরেকজন দর্জি লাকপা। তাদের মধ্যে এক নামে বহুজনকে পাওয়া যাবে। এরকম মিলের পেছনে একটা কারণ, তাদের সমাজে শিশুরা সপ্তাহের যে বারে জন্মগ্রহণ করে, সেই বারের নামে শিশুর নামকরণ করার প্রবণতা আছে। এভাবেই অনেকগুলো করে পাসাং (শুক্রবার), পেমবা (শনিবার) শেরপা তৈরি হয়। এছাড়া গুণের নামেও তাদের নাম হয়, যেমন লামো বা সুন্দর।

তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের পুঁথির পাতা থেকে উঠে আসা তেনজিং এখানে বহুল ব্যবহৃত অনেকগুলো নামের একটি।

শেরপারা কী খায়?

Image Source: Thesaurus Synonyms on Science-all

তুষার পর্বতের অতিমানব হয়ে উঠতে হলে তো সাধারণ মানুষের খাওয়াদাওয়া চলবে না। তাহলে কী খেয়ে বেঁচে থাকে শেরপারা? খুব সহজ উত্তর, ডাল-ভাত। হ্যাঁ, ডাল-ভাত নেপালেরও একটি প্রধান খাবার। সাধারণত শেরপারা একবাটি ভাতের সাথে একটু সবজি আর ডাল দিয়েই ভোজন সারেন। দুর্গম পাহাড়ের পথ পেরোতে, বারবার উঠতে নামতে তাদের শরীরের উপর যে ঝক্কি যায় তার জন্য শর্করাসমৃদ্ধ খাবার তাদের ভীষণ দরকার। ভাতের শর্করা আর ডালের আমিষ তাদের পেশিক্ষয় থেকে বাঁচায় ও সুস্থ রাখে।

শেরপারা কি অজেয়?

Image Source: Mpora

রক্তের সূত্রে হিমালয়ের এই রক্ষাকর্তাদের গল্পগুলো যতই দুঃসাহসিক শোনাক না কেন, তারাও দিনশেষে মানুষ। তুষারধ্বস সহ নানা দুর্ঘটনায় তাদেরও মৃত্যু ঘটে। উচ্চতার দোষে বা এমনিতেই যখন অভিযাত্রীরা উদ্ভট আচরণ শুরু করে, এমন নজির আছে যে তারা নিজেদের শেরপাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আসে। এভারেস্টে উঠতে গিয়ে আজ পর্যন্ত যত অভিযাত্রীর মৃত্য হয়েছে তাদের এক-তৃতীয়াংশই শেরপা।

১৯৩৯ সালে একটি নাৎসি আরোহী দল এভারেস্টে আসে। মাঝপথে ঝড়ের কবলে পড়ে অভিযাত্রীদেরকেই উল্টো বয়ে আনতে হয়েছিল শেরপা দলকে। একজন শেরপা কখনোই জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারেন না।

অভিযানের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো তারাই করে, দলের সামনে দড়ি-মই ঠিক করা থেকে দলের নিরাপত্তা বৃদ্ধিও তাদের দায়িত্ব। কিন্তু নিরাপত্তা সীমার বাইরে গিয়ে, দুর্যোগে, দুর্ঘটনায় বা স্বাস্থ্যগত কারণে যদি কোনো অভিযাত্রী মারা যান, তাহলে তা শেরপার দায় নয় মোটেও।

ফিচার ইমেজ: Outside Magazine

Related Articles