Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তাকানাকুই: মারামারির উৎসব

কারো সাথে মন কষাকষি হলে সেটা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ানো অসম্ভব কিছু না। এমন তো আকছারই ঘটে। আবার অনেক সময় আশেপাশের লোকেরা সেটা থামিয়েও দেন। কিন্তু আমরা যদি আন্দিজ পাহাড়ের ওদিকটাতে একটু উঁকি দেই, তাহলে অদ্ভুত একটি উৎসবের কথা জানতে পারবো। এই উৎসবে আর কিছু হয় না, স্রেফ মারামারি। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে পিটিয়ে দুরমুশ করে দেয় আর দর্শকেরা মহানন্দে হৈ-হল্লা করে। তাকানাকুই নামের এই উৎসবের জন্ম পেরুর কুমবিভিলকাস প্রদেশে।

তাকানাকুই কী?

প্রাচীনকালে পেরুর পার্বত্য অঞ্চলের হর্তাকর্তা ছিল ইনকারা। নিজেদেরকে সূর্যের সন্তান বলে দাবি করা এই রাজবংশ কয়েক শত বছর ধরে পেরু, চিলি আর ইকুয়েডরের বিস্তীর্ণ অংশ শাসন করে গিয়েছে। এই ইনকাদেরই ভাষা কুয়েচুয়া অদ্যাবধি পেরুর ঐ সমস্ত পার্বত্য অঞ্চলে বিদ্যমান। স্প্যানিশ কংকুইস্তাদোরসরা প্রাণান্ত চেষ্টা করলেও এই অঞ্চলের আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের মুখের ভাষাটা কেড়ে নিতে পারেনি।

তো কুয়েচুয়া ভাষায় তাকানাকুই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায়- একে অন্যকে ধরে বেদম পেটানো। কাব্যিক ভাষায় বলা চলে ‘যখন রক্ত টগবগ করে’। প্রায় এক শতাব্দী আগে কোনো এক সময়ে, পেরুর কুমবিভিলকাস প্রদেশের রাজধানী সান্তো টমাসের কয়েকজন উর্বর মস্তিষ্কের মানুষের মাথা থেকে এই আয়োজনের পরিকল্পনা বের হয়। তাছাড়া আইনি সহায়তা নেওয়া খুব ঝামেলার কাজ। মামলার জট তো আর মানুষের সুবিধা অনুযায়ী বাঁধে না। এসব চিন্তা করেই তাকানাকুই উৎসবের আয়োজন করা হয়।

পেরু আর বলিভিয়ার ছড়িয়ে আছে বিস্তীর্ণ আন্দিজ পর্বতমালা। আচরণে সে ভীষণ রুক্ষ। খাড়া ঢাল আর ধারালো পাথরে সারাদেহ সজ্জিত করে সে বসে আছে। সেখানকার আকাশে উড়ে বেড়ায় বিশাল কনডোর শকুন। ঢালের সামান্য ঘাসজমিতে ঘুরে বেড়ায় ভিকুনার পাল। পাথরের আড়ালে গুঁড়ি মেরে বসে থাকে শিকারি পুমা।

পেরুভিয়ান আন্দিজ; source: tripadvisor.com

তো এহেন পরিবেশে জীবনধারণ যে বিশেষ সুখের হবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পানির অভাব, খাবারের অভাব। আলু আর কয়দিন মুখে রোচে মানুষের! শিকারে যাওয়ার হ্যাপাও অনেক। ভিকুনার পিছু পিছু দৌড়াতে গিয়ে কখন যে টুক করে গিরিখাদে পড়ে হাড়-মাংসের স্তূপ বনে যেতে হবে তা কে জানে! কাজেই এখানকার বাসিন্দারা খুব পরিশ্রমী, খুব শক্তিশালী এবং খুব সাবধানী।

পেরু আর বলিভিয়ায় পারস্পরিক বিরোধ মেটাবার এই প্রথা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত আছে। সান্তো টমাসের উৎসবটা বিশ্বব্যাপী পরিচয় পেয়েছে এই যা! তা পাবেই না বা কেন? বিখ্যাত পর্যটন শহর কুজকোর ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের এই শহরে ১২ হাজার মানুষের বাস। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১২ হাজার ফুট। পুলিশ অফিসার মাত্র ৩ জন। ঐতিহাসিকভাবেই পেরুভিয়ান সরকারের হাত এখানে খুব দুর্বল। নিকটস্থ আদালতে গাড়িতে করে যেতেই অর্ধেকটা দিন কাবার হয়ে যায়।

তা সমাধানটা তাহলে কী? ঐ তাকানাকুই। দুই হাতের মুঠিতে ন্যাকড়া জড়িয়ে নেমে পড়লেই হল। ব্যস। মোটা দাগে এই উৎসবের মূলকথাটা খুব সরল। কারো সাথে কারো গোল বাঁধল। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তা এভাবে তো সমস্যার সমাধান হয় না। কাজেই শহরের মাঝে গোল চত্বরে দুজনে একদফা লড়ে নিলেই হয়। এতে দু’পক্ষের গায়ের ঝাল তো মিটবেই আবার একই সাথে রাগটাও পড়ে যাবে।

সান্তো টমাস; source: yochumbivilcas.files.wordpress.com

বৌ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে? মদ খাওয়ার সময় ধাক্কা লেগেছে? অপমান করেছে? চুরি করেছে? লাগাও কড়া। পুলিশের কি মাথাব্যথা? বেদম মার লাগাও প্রতিপক্ষকে। তাই বলে হাড় মাংস থেঁতলে লম্বা করে দেওয়া চলবে না। কেউ মাটিতে পড়ে গেলেই খেলা বন্ধ। রেফারীও থাকে এই খেলায় আর তিনি ধোপদুরস্ত নিপাট কোনো ভদ্রলোক নন। তাকানুকুই এর রেফারীদের হাতে থাকে খাটি চামড়ার চাবুক। কেউ কথা না শুনলে চাবকে সিধে করে নেন। আশেপাশের জনতাও তাতে সাহায্য করে। আর বলতে ভুলে গিয়েছি, তাকানুকুই খেলার আগের দিন শহরে দেদার মদ আর বিয়ার চলে। কাজেই দর্শকরাও যে চড়া মৌতাতের পাহাড়ি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজব এই উৎসবে আদৌ কোনো লাভ হয় কি না কে জানে তবে আয়োজনটা যে খুবই ব্যতিক্রমী তাতে কোন সন্দেহ নেই।

উৎসবের খুঁটিনাটি

প্রতিবছর ক্রিসমাসের দিন মানে ২৫ ডিসেম্বর ভোরবেলা এই মারামারির আয়োজন বসে। কয়েকদিন ধরে বেদম মদ্যপান আর নাচগানে শহরে চলে আসে উৎসবের আমেজ। ষোল শতকের তাকি উনকুই নামক প্রতিরোধ আন্দোলনকে সম্মান করে গাওয়া হয় ওয়েইলিয়া নামের বিশেষ ঘরানার সঙ্গীত। হাজার হাজার কণ্ঠে মুখরিত হয় আন্দিজের প্রাচীন গিরিকন্দর। গানগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে প্রতিরোধ, সাহস আর স্বাধীনতা। দখলদার স্প্যানিশদের শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছে এসব পাহাড়িদের পূর্বপুরুষেরা। তখনো তারা হার মানেননি। বর্তমানের অধিবাসীরাও লিমার কর্তাদের ধার ধারেন না। তাদের দেখাদেখি এখন কুজকো আর লিমাসহ নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এই তাকানাকুই।

জোর লড়াই; Source: AP

মিছিল করে সবাই জমা হয় কোনো ফাঁকা জায়গায়, পুরুষেরা উচ্চকণ্ঠে গান গায় বিশেষ এক সুরে। প্রতিপক্ষ এসে দেখা করে মাঝের ফাঁকা জায়গায়। আর নিয়মকানুন? চুল টানা আর মাটিতে পড়ে গেলে মারামারি চলবে না। এছাড়া লাথি, ঘুষি সবই চলে। তবে সবই খালি হাতে। অস্ত্র নিষিদ্ধ। রেফারী বিজ্ঞ বিচারকের কাজ করে। কেউ যদি রেফারীর সিদ্ধান্ত পছন্দ না করে, সে আপিল করতে পারে। আপিলে জিতলে আরেক দফা লড়াই চলে। নারী-পুরুষ তো বটেই; বাচ্চা, এমনকি বুড়ো-বুড়িও এই মারামারিতে অংশ নিতে পারে। তবে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে লড়াই করা নিষেধ।

দুই নারী লড়ছে; Source: fscclub.com

তাকানাকুই এর পোশাক

তাকানাকুই উৎসবের সময় পোশাক-আশাকে বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। মানুষ এসময় মূলত পাঁচ রকমের পোশাক পরে। উলের তৈরি ঘোড়ায় চড়ার পোশাক, চামড়ার জ্যাকেট আর লাল, সবুজ, হলুদ, সাদা রঙ এর রঙচঙা স্কি মাস্ক হল মাখেনো নামক পোশাকের অংশ। হাতে থাকে মহিষের শিং দিয়ে তৈরি মদের পাত্র।

মাখেনো পোশাকধারী কয়েকজন; Source: usatoday.com

মাখেনা পোশাকের সাথে অনেকে জুড়ে দেন একটি টুপি। টুপির মাথায় বসে থাকবে কোনো মৃত পাখি বা হরিণের খুলি। তৈরি হয়ে গেল কুয়ারাওয়াতান্না পোশাক। বেশিরভাগ মানুষ এই পোশাকটাকেই বেছে নেয়। মাথায় এক খানা মরা পাখি কিংবা খুলি থাকলে সাজটা জমকালো হয় বলেই হয়তবা।

কুয়ারাওয়াতান্না; Source: blogs.pjstar.com

এরপরে আসে নেগরো পোশাকধারীদের পালা। নেগরো পোশাকটা মূলত দাস মালিকদের পোশাকের অনুকরণে বানানো হয়। উঁচু কানাতের চামড়ার বুট, সুন্দর শার্ট, ওয়েস্টকোট ইত্যাদি পরে ফুলবাবু সেজে ঘুরে বেড়ায় নেগরোরা। একটা সময়ে কেবল ধনী লোকেরাই এই পোশাক পরতো। চল্লিশের দশকে পঙ্গপালের ঝাঁক এসে আন্দিজকে ন্যাড়া করে দিয়ে গিয়েছিল। তাদের কথা স্মরণ করেই তৈরি হয়েছে লাঙ্গোস নামের বিচিত্র পোশাক। নানা রকম চকচকে বস্তু দিয়ে বানানো হয় এই পোশাক। হাতে ঝুলিয়ে নিতে হবে মরা কোনো একটা পাখি।

এর বাইরে সবাই যে পোশাকই পরুক না কেন, সবগুলোকেই কারা গালো নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। কারা গালো যারা পরে তারা মিছিলে অংশ নেয়, নাচ, গান, হৈ-হুল্লোড় সবই করে। শুধু মারামারিতে কোনো অংশ নেয় না।

পরিশেষে

শেষে ছোট্ট একটি তথ্য দেওয়া যাক। প্রত্যেক মারামারির শেষে একটি কাজ বাধ্যতামূলকভাবে করতে হয়। সেটি হলো হারুক বা জিতুক, প্রতিপক্ষের সাথে করমর্দন ও আলিঙ্গন করতেই হবে। বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায় কষে ধস্তাধস্তি করবার পর এই সামান্য সৌজন্যটুকুই সরল পাহাড়িদের বিরোধ মেটাবার জন্য যথেষ্ট হয়েছে। অথচ আমাদের আধুনিক সমাজে আইনমাফিক অহিংস পদ্ধতিতে মামলা লড়েও এটি কোনোভাবেই সম্ভব হয় না।

লিমার কর্তারা বেশ কয়েকবার আইন করে তাকানাকুই নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু পাহাড়িদের প্রতিরোধের মুখে সে পদক্ষেপ বাতিল হয়। নিজেদের স্বতন্ত্রতা রক্ষা করবার স্পৃহা তাদের রক্তে। আর সেই ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেই টিকে রয়েছে তাকানাকুই।

ফিচার ইমেজ: sebastiancastaneda.com

Related Articles