পাহাড়ি আঁকাবাঁকা দুর্গম পথ ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে গিয়ে অনিন্দ্যসুন্দর একটি ঝর্ণা দেখাকে বা বনে-জঙ্গলে হাঁটাকেই আমাদের দেশের বেশিরভাগ ভ্রমণকারী ট্রেকিং হিসেবে অভিহিত করে থাকে। কিন্তু একদিনের বেশি সময় ব্যয় করে একটি গন্তব্য থেকে আরেকটি গন্তব্যে হেঁটে পৌঁছানোর মতো প্রাকৃতিক সুযোগ আমাদের দেশে এখনও নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে থাকলেও একা একা সেই দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার কথা খুব মানুষই চিন্তা করে। আর সেই গন্তব্য পার করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় যদি কয়েকমাস হয়ে থাকে? তা-ও আবার একজন ৬৭ বছর বয়সী নারী- একাকী, কোনোরকম আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই? ঠিক এই অসাধ্যটিই সাধন করেছেন এমা গেটউড, যিনি 'গ্র্যান্ডমা গেটউড' নামেই বেশি পরিচিত ও জনপ্রিয়।
শুনতে অদ্ভুত আর সাংঘাতিক বিপজ্জনক মনে হলেও, এ ধরনের ট্রেকিং পাশ্চাত্যে খুবই স্বাভাবিক। আর সেটাকে ‘ট্রেকিং‘ না বলে, ‘হাইকিং‘ বলা হয়ে থাকে। এরকম হাইকিংয়ের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্যের একটি হলো যুক্তরাষ্ট্র। আর যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় একটি ট্রেইল অ্যাপালেশিয়ান ট্রেইল। এ ট্রেইল শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বরং গোটা পৃথিবী জুড়েই হাইকারদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয়। জর্জিয়া থেকে মেইন পর্যন্ত মোট ২,০৫০ মাইল দীর্ঘ এই পথটি অতিক্রমকারী এমাই ছিলেন প্রথম নারী। শুধু তা-ই নয়, তিনিই প্রথম হাইকার, যিনি এই ট্রেইলটি একাধিকবার জয় করেন, তিনি মোট তিনবার এ পথ অতিক্রম করেন। তবে নারী হিসেবে এমার যুদ্ধ শুধু এই ট্রেইল অতিক্রম করাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এই হাইকিং ছিল তার জীবনে প্রশান্তির অন্যতম উৎস।
এমা রোয়েনা ক্যাল্ডওয়েল ১৮৮৭ সালের ২৫ অক্টোবর ওহাইও প্রদেশের গ্যালিয়া কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হিউ ক্যাল্ডওয়েল ছিলেন একজন কৃষক। গৃহযুদ্ধে এক পা হারানোর পর থেকে তিনি মদ্যপান ও জুয়াখেলায় আসক্ত হয়ে পড়েন। এমার মা ইভলিন, তাদের ১৫ জন সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্ব প্রায় একাই পালন করেন। ১৯ বছর বয়সে এমা ২৬ বছর বয়সী পেরি ক্লেটন গেটউডকে বিয়ে করেন, যিনি প্রথমে একজন শিক্ষক ছিলেন; তবে পরে কৃষিকাজ শুরু করেন। বিয়ের আগে ও পরে কৃষিকাজের সাথে জড়িত থাকার কারণে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত খাওয়ার উপযোগী ও চিকিৎসার কাজে ব্যবহারযোগ্য গাছপালা সম্পর্কে এমার খুব ভাল জ্ঞান ছিল, যা ট্রেইলে টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত কাজে দেয়।
পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়
এমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধটি ছিল ৩০ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীর হাতে প্রতিনিয়ত নৃশংসভাবে শারীরিক নির্যাতন ও সহিংসতা সহ্য করা, সেই সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করা, সহিংসতার শিকার হয়েও প্রতিবাদ করার কারণে গ্রেপ্তার হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত বিবাহ-বিচ্ছেদের মাধ্যমে সেই সহিংসতা থেকে মুক্তিলাভ। তার জীবনযুদ্ধের এই গল্প অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় যাবৎ সকলের অগোচরেই ছিল। ২০১৪ সালে 'বেন মন্টগোমারি' নামে ফ্লোরিডার 'ট্যাম্পা বে টাইমস'-এর একজন সাংবাদিক 'গ্র্যান্ডমা গেটউডস্ ওয়াক' নামে একটি বই প্রকাশ করলে তার অভিযানের কথা সাধারণ মানুষ জানতে পারে।
এ বইয়ের মাধ্যমেই এমা 'গ্র্যান্ডমা গেটউড' হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বইটি লেখার জন্য বেনের গবেষণার সহায়তায় এমার সন্তানেরা তার রেখে যাওয়া জার্নাল, যার অনেকটাই হাইকিংয়ের সময়ে লেখা হয়েছিল, চিঠি ও একটি স্ক্র্যাপবুক দিয়েছিল। এসব থেকে বেন জানতে পারে, এমার স্বামী তাকে কয়েকবার মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন, একবার তার মাথায় একটি ঝাড়ু ভেঙেছিলেন। তার সন্তানেরা বেনকে জানায়, তাদের বাবার যৌনলিপ্সা অতিরিক্ত মাত্রায় ছিল এবং তিনি তাদের মাকে দিনে বেশ কয়েকবার শারীরিক সম্পর্কের জন্য বাধ্য করত। বিয়ের তিনমাস পর থেকেই এই সহিংসতার শুরু হয়।
এ সহিংসতা থেকে বাঁচতে ১৯৩৭ সালে এমা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ক্যালিফোর্নিয়াতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যান। সেসময় ৯ ও ১১ বছর বয়সী দুই কন্যাসন্তানকে তাদের বাবার কাছেই রেখে যান; কারণ, তিনি জানতেন, তিনি কখনো সন্তানদের গায়ে হাত তুলবেন না। কিন্তু সন্তানদের প্রতি মায়া তাকে আবারও স্বামীর বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য করে। এমার জার্নাল থেকে জানা যায়, ১৯৩৮ সালে তার স্বামী অন্তত ১০ বার এমনভাবে তাকে মারধোর করেন যে তার চেহারাই চেনা যায়নি। ১৯৩৯ সালে স্বামী তাকে মেরে তার কয়েকটা দাঁত ও পাঁজরের একটি হাড় ভেঙে দেন এবং এমার মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে এমা তার স্বামীর দিকে একটি ময়দার বস্তা ছুঁড়ে মারেন।
কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুলিশ ময়দার বস্তা ছোঁড়ার অপরাধে এমাকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, তার স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। পরদিন শহরের মেয়র তার এই করুণ দশা দেখে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা পর্যন্ত এমা মেয়রের বাড়িতেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর অল্প কয়েকদিন পরেই এমা বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করেন এবং অবশেষে ১৯৪১ সালে সেই আবেদন মঞ্জুর করা হলে তার এই যুদ্ধের অবসান ঘটে ও তিনি জয়ী হন। এ অযাচিত যুদ্ধে এমার জীবনের অনেক বড় একটা সময় ব্যয় হলেও জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগটিকে তিনি মোটেও হাতছাড়া হতে দেননি। বরং বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করে পর্যটকদের এবং নারীদের কাছে অমর দৃষ্টান্ত ও প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছেন।
অ্যাপালেশিয়ান ট্রেইল জয়
১৯৪৯ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যায় অ্যাপালেশিয়ান ট্রেইল সম্পর্কে পড়তে গিয়ে এমা জানতে পারেন, তখন পর্যন্ত কোনো নারী এই ট্রেইলটির পুরো পথ হাইকিং করেনি। আর এ তথ্যটিই তাকে এই ট্রেইল জয়ের জন্য আগ্রহী করে তোলে। হাইকিংয়ের জন্য তার বিশেষ প্রশিক্ষণ বলতে পায়ের মাংসপেশীর শক্তি বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন ১০ মাইল হাঁটা ছাড়া আর কিছুই ছিল না, যদিও প্রকৃতপক্ষে ততদিনে তার পুরো জীবনটাই তাকে এই যাত্রার জন্য প্রস্তুত করে ফেলেছিল।
এমা ১৯৫৫ সালে ৬৭ বছর বয়সে প্রথম এই ট্রেইল জয় করলেও, এটা তার প্রথম প্রচেষ্টা ছিল না। ১৯৫৪ সালে প্রথমবারের যাত্রায় চশমা ভেঙে যাওয়ার কারণে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন এবং মাঝপথেই তার থামতে হয়। এরপর রেঞ্জারদের একটি দল তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে ফিরতে সাহায্য করে। পরের বছর জর্জিয়া থেকে শুরু করে তিনি সফলভাবে এই যাত্রাটি সম্পন্ন করেন। তবে এই দু'বারের কোনোবারই তিনি তার সন্তানদেরকে অভিযানের ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই জানাননি। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এমার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তারা তাদের মায়ের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে।
বেন মন্টগোমারির মতে, এমার ধারণা ছিল, জানতে পারলে তার সন্তানেরা তাকে কিছুতেই ঐ দুঃসাহসী যাত্রায় যেতে দিত না। পায়ে হেঁটে প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি এমা যাত্রার জন্য নিজের হাতে সেলাই করে একটি ছোট ড্রস্ট্রিং (দড়ি টেনে দিয়ে মুখ বাঁধা যায় এমন) ব্যাগ তৈরি করেন। আর সেই ব্যাগে ঠিক যে ক'টি জিনিস না নিলেই না হয়, সেসবই ভরে নেন। এগুলোর মধ্যে ছিল গোসলের সময় ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি একটি পর্দা, যা তিনি বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করেন, একটি সুইস আর্মি ছুরি, ফ্ল্যাশলাইট, ব্যান্ড-এইড, আয়োডিন, কলম ও একটি ছোট নোটবুক।
আর খাবারের জন্য তিনি সাথে নেন ভিয়েনা সসেজ, কিসমিস, বাদাম এবং বিভিন্ন ধরনের ব্রথ বা স্টকের (গরম পানিতে মিশিয়ে/গুলিয়ে খাওয়া হয়) কিউব যা 'বুলিয়ন কিউব' নামে পরিচিত। এ যাত্রায় তিনি মোট সাত জোড়া কাপড়ের তৈরি কেডস্ ব্যবহার করেন। সাথে কোনো তাঁবু রাখার কোনো প্রয়োজনই তিনি বোধ করেননি, বরং অপরিচিত মানুষদের আতিথেয়তার ওপরই বেশি নির্ভর করেছিলেন। আর এ ট্রেইলে চলাকালে বিভিন্ন সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারের কারণে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় এ সুবিধা তিনি যথেষ্টই লাভ করেন। তবে ঠাণ্ডা মাটিতে বা টেবিলের নিচেও তাকে অনেক রাত কাটাতে হয়েছে।
১৯৫৫ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১৪৬ দিন, প্রতিদিন গড়ে ১৪ মাইল হেঁটে, ১৪টি প্রদেশের মধ্য দিয়ে তৈরি পথ অতিক্রম করে তিনি এ ট্রেইলের যাত্রা সম্পূর্ণ করেন। এ বয়সে এ গতিতে হাঁটা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি অনুপ্রেরণামূলক, এমনকি বয় স্কাউটের একটি দল তার সাথে তাল রাখতে ব্যর্থ হয়। ১৯৫৭ ও ১৯৬৪ সালে তিনি যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ট্রেইলটি সম্পূর্ণ করেন। প্রথমবার এ ট্রেইল জয় করার সময়ে এমা ছিলেন ১১ সন্তানের জননী, আর তার ছিল ২৩ জন নাতি-নাতনি।
অ্যাপালেশিয়ান ট্রেইল ছাড়াও এমা আরও কয়েকটি ট্রেইলে হাইকিং করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি মিসৌরি প্রদেশের ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে পোর্টল্যাণ্ড পর্যন্ত ২,০০০ মাইল দীর্ঘ ওরিগন ট্রেইল অতিক্রম করেন। এ কৃতিত্বের কারণে তিনি 'আমেরিকাস মোস্ট সেলিব্রেটেড পেডেস্ট্রিয়ান' হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। তার নিজ প্রদেশ ওহাইওতে বাকি ট্রেইল প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান। সেসময়ে মাত্র ২০ মাইল থেকে শুরু করে আজ এই ট্রেইলের দৈর্ঘ্য ১,৪৪৪ মাইল। ১৯৭৩ সালে ৮৫ বছর বয়সে এমা গেটউড পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে নতুন দুনিয়ায় নতুন এক যাত্রা শুরু করেন।
This is a Bengali article. This describes the brilliant life of Grandma Gatewood based on online research.
Required sources of information have been hyperlinked inside the article.
Featured image: adventure-journal.com