Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গ্র্যাভিটি হিল: অতিপ্রাকৃত নাকি স্বাভাবিক?

মাথায় আপেল পড়ে বিজ্ঞানী নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কারের গল্প কম-বেশি সবারই জানা। তবে এই গল্পটি পুরোপুরি সত্য না হলেও মাধ্যাকর্ষণ ব্যাপারটি কিন্তু একেবারে সত্য। যেকোনো বস্তুকে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিলে সেটি আবার নিচের দিকে ফিরে আসে এই মাধ্যাকর্ষণের কারণেই। মাধ্যাকর্ষণজনিত প্রভাব আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনাকে যদি এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে আপনি দেখবেন আপনার চিরচেনা মাধ্যাকর্ষণ ঠিকভাবে কাজ করছে না, তাহলে কেমন লাগবে? নিজের চোখকে অবিশ্বাস করবেন, নাকি জাদুর প্রভাব মনে করবেন?

পৃথিবীতে কিন্তু এমন বেশ কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে গেলে আপনার মনে হবে মাধ্যাকর্ষণ ঠিকভাবে কাজ করছে না। আর এ কারণে এসব এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কুসংস্কার। পৃথিবীর বুকে এই অদ্ভুত জায়গাগুলো নিয়েই আজকের আয়োজন।

গ্র্যাভিটি হিল

ফেসবুকে প্রায়ই সৌদি আরবের মদিনার ওয়াদী আল জ্বীনের কিছু ভিডিও দেখা যায়। এ ভিডিওগুলোর সবগুলোই মোটামুটি একই রকম, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গাড়ি যেখানে নামার কথা, সেখানে গাড়ি উল্টো দিকে যাচ্ছে। অর্থাৎ চিরচেনা মাধ্যাকর্ষণের পুরো উল্টো ঘটনা! ওয়াদী আল জ্বীনের এই অদ্ভুত ঘটনাটি কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সৌদি আরব ছাড়াও পৃথিবীর বেশ কিছু জায়গায় এরকম অদ্ভুত ঘটনা দেখা যায়। মূলত পাহাড়ি এলাকাতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। আর যেসব জায়গায় এরকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, সেগুলোকে সাধারণভাবে বলা হয় গ্র্যাভিটি হিল। তবে ম্যাগনেটিক হিল বা অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি হিল নামেও পরিচিত এসব জায়গা।

ওয়াদী আল জ্বীনের একটি অংশ; Image Source: worldtravel.com

কী ঘটে গ্র্যাভিটি হিলে?

প্রাচীনকাল থেকেই যেকোনো অস্বাভাবিক ঘটনাকে মানুষ নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে আসছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ব্যাখ্যা স্থানীয়দের মনগড়া ব্যাখ্যা, যেগুলোর সাথে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্কই নেই। আর স্বাভাবিকভাবেই এসব ব্যাখ্যায় থাকে বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত ব্যাপার। সৌদি আরবের ওয়াদী আল জ্বীনের নামকরণ থেকেই সেটা বোঝা যায়। পুরো ব্যাপারটির ব্যাখ্যা হিসেবে পাহাড়টির নামই দেয়া হয়েছে ‘জ্বীনের পাহাড়’!

অনেকে আবার দাবি করেন, এরকম ঘটনা যেখানে ঘটে, সেখানে শক্তিশালী কোনো চুম্বকক্ষেত্র থাকে। চুম্বকের প্রভাবে গাড়ি নিচের দিক থেকে উপরের দিকে যায় বলে তাদের ধারণা। আর এ ব্যাখ্যা থেকেই ‘ম্যাগনেটিক হিল’ নামটি এসেছে। এ ব্যাখ্যায় কিছুটা বিজ্ঞান থাকলেও একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায়, এ ব্যাখ্যাটিও আসলে সঠিক নয়। কারণ গাড়ি ছাড়া অন্যান্য যেকোনো বস্তুকেই এসব জায়গায় রাখলে মনে হয় নিচ থেকে উপরের দিকে চলে আসছে। এছাড়া, আধুনিক গাড়ির বেশিরভাগ অংশই যেসব পদার্থ দিয়ে তৈরি, সেগুলো শক্তিশালী চৌম্বক পদার্থ নয়। ফলে শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবও বাতিল করে দেয়া যায়।

চৌম্বকক্ষেত্রই কি দায়ী গ্র্যাভিটি হিলের জন্য? Image Source: Wallpaper Wide

মজার ব্যাপার হচ্ছে, গ্র্যাভিটি হিলে যা ঘটে, সেটি একদম স্বাভাবিক। প্রশ্ন জাগতেই পারে, এত মানুষ চাক্ষুষ কিংবা অনলাইন ভিডিওতে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে নিচু এলাকা থেকে উঁচু এলাকায় গাড়ি কিংবা বল নিজে নিজেই চলে যাচ্ছে, তাহলে এটি স্বাভাবিক কীভাবে হয়! বাস্তবে গ্র্যাভিটি হিলে যা ঘটে, তা হচ্ছে অপটিক্যাল ইল্যুশন অর্থাৎ দৃষ্টিভ্রম। মরুভূমিতে মরীচিকার কথা সবাই জানে, সেখানেও কিন্তু দৃষ্টিভ্রম হয়। গ্র্যাভিটি হিলেও সেরকমই দৃষ্টিভ্রম ঘটে, তবে মরীচিকার মতো একই কারণে নয়।

গ্র্যাভিটি হিলে যেটিকে নিচু বলে মনে হয়, সেটি বাস্তবে উঁচু আর যেটিকে উঁচু বলে মনে হয়, সেটিই নিচু। ফলে যেকোনো বস্তু উঁচু থেকে নিচুতে ঢাল বেয়ে নেমে যায় প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু মানুষের দৃষ্টিভ্রমের কারণে উঁচুকে নিচু আর নিচুকে উঁচু মনে হওয়াতেই তৈরি হয় বিভ্রান্তি। আর এই বিভ্রান্তি তৈরি হয় মানুষের চোখ আর মস্তিষ্ক নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করতে না পারায়। এরকম সমন্বয়হীনতার কারণে শুধু উঁচু-নিচু নয়, বরং আরো নানারকম দৃষ্টিভ্রম হয়ে থাকে মানুষের। নিচের ছবিটি খেয়াল করলেই সেটি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেই মনে হবে ছবিটি স্থির নয়; Image source: 123RF

উপরের ছবিটি আসলে একটি স্থিরচিত্র। কিন্তু কিছুক্ষণ একদৃষ্টে এর দিকে তাকিয়ে থাকলেই মনে হয় এটি নড়ছে! একটি স্থিরচিত্র কীভাবে নড়ছে? কোনো জাদু কিংবা অতিপ্রাকৃত ব্যাপার নেই এর মধ্যে। মানুষের সীমাবদ্ধতাই এর জন্য দায়ী। গ্র্যাভিটি হিলে ঠিক এরকমই দৃষ্টিভ্রমের শিকার হয় মানুষ। ফলে সাধারণ দৃষ্টিতে কোনোভাবেই বোঝা যায় না, যা ঘটছে তা স্বাভাবিক। কিন্তু আধুনিক জিপিএস কিংবা সার্ভেয়িংয়ের যন্ত্রের সাহায্যে সহজেই দেখা গিয়েছে যে ঢাল নিচের দিকে গিয়েছে মনে হয়, সেটি আসলে উপরের দিকে গিয়েছে। ২০০২ সালে প্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে ইতালির কয়েকজন বৈজ্ঞানিক বেশ কিছু মডেল তৈরি করে দেখিয়েছেন, কীভাবে এই দৃষ্টিভ্রম কাজ করে। কিন্তু চোখের বিভ্রান্তির কারণে আর কুসংস্কারের প্রভাবে এসব এলাকা নিয়ে নানারকম গল্প-গুজব গড়ে ওঠে। নিচের ভিডিওটি দেখলে আশা করি পরিষ্কার হওয়া যাবে যে কীভাবে আমাদের চোখ আমাদের ধোঁকা দেয়।  

উপরের ভিডিওটির মতোই গ্র্যাভিটি হিলে অবস্থানকালে আমাদের চোখ আমাদের ধোঁকা দেয়। যখন কেউ গ্র্যাভিটি হিলের মতো কোনো জায়গায় অবস্থান করে, তখন সে রাস্তা বা পাহাড়ের ঢালকে একভাবে দেখে, আবার গ্র্যাভিটি হিলের বাইরে থেকে একই ঢালকে অন্যভাবে দেখে। গ্র্যাভিটি হিলে অবস্থানকালে দৃষ্টিভ্রমই হচ্ছে স্থানটির ‘অস্বাভাবিকতা’র কারণ। এর সাথে সম্পর্ক নেই কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপারের, নেই কোনো চৌম্বকক্ষেত্রেরও।

গ্র্যাভিটি হিল রয়েছে যেসব জায়গায়

ফেসবুকের কল্যাণে সৌদি আরবের ওয়াদী আল জ্বীন আমাদের দেশে সবচেয়ে পরিচিত গ্র্যাভিটি হিল। মদিনা থেকে পশ্চিমে অবস্থিত এই পাহাড়টির ঢাল তৈরি করে এক অদ্ভুত দৃষ্টিভ্রমের, যার ফলে গাড়ি নিউট্রালের দিকে দেখা যায় ঢাল বেয়ে নিচে না নেমে উল্টো উপরের দিকে যাচ্ছে। মদিনার মতো পবিত্র নগরের পাশে এরকম স্থান অনেককেই ভাবতে বাধ্য করে যে, এর পেছনে কোনো অতিপ্রাকৃত কারণ রয়েছে। কিন্তু ঐ যে, আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, পুরোটাই দৃষ্টিভ্রম।

সৌদি আরব ছাড়াও এরকম স্থান আরো অনেক অঞ্চলেই রয়েছে। সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি রয়েছে আমেরিকায়। এদের মধ্যে স্পুক হিল বেশ বিখ্যাত। আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ওয়েলস হৃদ এলাকায় অবস্থিত স্পুক হিল। ওয়াদী আল জ্বীনের মতো এখানেও ঢালে অবস্থিত গাড়ি প্রকৃতির সব নিয়ম অমান্য করে উপরের দিকে যাচ্ছে বলে মনে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এলাকাটি পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় এলাকা। পেনসিলভেনিয়ার নিউ প্যারিস এলাকায় তো আবার রয়েছে দুটি গ্র্যাভিটি হিল রাস্তা। এছাড়াও ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন, টেক্সাসসহ অনেকগুলো অঙ্গরাজ্যেই রয়েছে গ্র্যাভিটি হিল রাস্তা। উত্তর আমেরিকার কানাডা ও মেক্সিকোতেও রয়েছে বেশ কয়েকটি গ্র্যাভিটি হিল।

স্পুক হিলের একটি সাইনবোর্ড; Image Source: Two RV Gypsies

আমাদের পাশের দেশ ভারতে লাদাখের লেহের কাছে, গুজরাটেও রয়েছে এমন রাস্তা, যেখানে গেলে গ্র্যাভিটি হিলের অভিজ্ঞতা পাবেন। ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য; এশিয়ার অন্যান্য এলাকার মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, ওমান প্রভৃতি অঞ্চলে দেখা মেলে গ্র্যাভিটি হিলের। তবে মজার ব্যাপার হলো, রাশিয়ার মতো বিশাল দেশে নেই একটি গ্রাভিটি হিলও। দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে চারটি গ্রাভিটি হিল এলাকা, যার দুটিই নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে রয়েছে দুটি গ্র্যাভিটি হিল।

লাদাখের গ্রাভিটি হিল; Image Source: My Travel Tales

পৃথিবীর নানা প্রান্তে অবস্থিত গ্র্যাভিটি হিলগুলো প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৃষ্টি। আর মানুষের চোখের সীমাবদ্ধতা সেগুলোকে করে তুলেছে আকর্ষণীয়। যুগের পর যুগ এসব এলাকা নিয়ে থাকা কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস এখনো টিকে রয়েছে। তবে এখন বেশিরভাগ মানুষ আর এসব এলাকাকে ভয়ের চোখে দেখে না, বরং প্রকৃতির এই অদ্ভুত সৃষ্টি উপভোগ করতেই যায়।  

ফিচার ইমেজ- Youtube

Related Articles