Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মোগল আমলের হাজী খাজা শাহবাজ খান মসজিদ ও মাজার শরীফ

প্রচলিত আছে যে এটি রমনা এলাকার প্রথম স্থাপনা, অনুপম নিদর্শন ও সংরক্ষিত পুরাকীর্তি। কেউ বলেন- জোড়া মসজিদ, তিন গম্বুজ মসজিদ বা লাল মসজিদ। আবার কারো কাছে জ্বীনের মসজিদ হিসেবেও পরিচিত। বলছি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাজী খাজা শাহবাজ খান মসজিদের কথা। রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ কোলঘেঁষে বাংলা একাডেমি ও হাইকোর্টের মাঝখানে তিন নেতার মাজারের পূর্ব দিকে মসজিদটির অবস্থান। উত্তর ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে গড়ে ওঠা এই মসজিদ বহন করছে মোগল আমলের স্মৃতি। শিল্পী বেঁচে না থাকলেও শিল্পের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে শত শত বছর আগের এই মসজিদ।

হাজী খাজা শাহবাজ খান মসজিদ; ছবি: লেখক

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোগল আমলে কাশ্মীরের অধিবাসী সুফী সাধক খাজা শাহবাজ খান নামের একজন মুসলিম ধনী ব্যবসায়ী বাংলার টঙ্গী এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। টঙ্গী থেকে রমনা এলাকায় এসে তিনি সালাত আদায় করতেন। কিন্তু কেন এখানে এসে সালাত আদায় করতেন এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। শাহজাদা মোহাম্মদ আজম বাংলার সুবেদার থাকাকালে খাজা শাহবাজ খান রমনায় ১৬৭৯ সালে হাজী খাজা শাহবাজ খান মসজিদ ও মাজার শরীফ নির্মাণ করেন।

মসজিদের অভ্যন্তরে দৃশ্য; Image Credit: Semon Ahmed

তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি ভূমি সমতল থেকে খানিকটা উঁচু একটি মাচানের উপর গঠিত। এর বাইরের দৈর্ঘ্য ২০.৭৩ মিটার ও প্রস্থ ৭.৯২ মিটার, এবং দেয়ালের বেধ  ১.২২ মিটার। মসজিদের চার কোণায় অষ্টকোণাকৃতির চারটি মিনার রয়েছে। মিনারের সাথেই আছে বারোটি মিনার আকৃতির ছোট গম্বুজ, যা নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের।

উত্তর-পূর্ব কোণে মিনার ও মিনার আকৃতির ছোট গম্বুজ; ছবি: লেখক

মিহরাববিশিষ্ট ফুলের নকশা করা দুটি খিলান আকৃতিতে মসজিদের অভ্যন্তরটি মোট তিনটি অংশে বিভক্ত। তিনটি অংশের উপর সমান পরিমাপে তিনটি গম্বুজ বিদ্যামান।

মসজিদের প্রবেশপথগুলো একই ধাঁচে তৈরি। প্রধান নামাজ কক্ষে প্রবেশের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ পাশ থেকে একটি করে এবং পূর্বপাশে কিঞ্চিৎ অভিক্ষিত ও খাঁজকাটা তিনটি খিলান রয়েছে। পূর্বদিকের প্রবেশপথগুলোর মাঝেরটি অর্থাৎ মূল খিলানের অপেক্ষাকৃত দু’পাশে দুটি ছোট খিলান আছে। খিলানপথগুলো কাঠের, এবং চৌকাঠের নিচে বাইরে ও ভেতরের অংশ কালো পাথরের তৈরি। মসজিদের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেয়ালজুড়ে দেওয়া হয়েছে পাথরের আবরণ।

প্রধান নামাজ কক্ষের মূল ফটক; ছবি: লেখক

পূর্বপাশের প্রবেশপথগুলোর সাথে পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব আছে। মাঝেরটি কেন্দ্রীয় মিহরাব ও এর পাশেই রয়েছে কালো পাথরের তৈরি একটি মিম্বার, এবং সর্বোচ্চ চূড়া ফুলের নকশায় শোভিত। মসজিদটি জনসাধারণের জন্য সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। প্রতি ওয়াক্তেই এখানে জামাতের সঙ্গে সালাত আদায় করা হয়। প্রধান নামাজকক্ষে মোট চারটি সারিতে একসাথে প্রায় আশি-নব্বইজন মুসল্লি সালাত আদায় করতে পারেন। এছাড়াও, মসজিদের পূর্বদিকে পাকা চত্বর আছে। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে মিলিয়ে প্রায় দেড় থেকে দুশো মুসল্লি নামাজ আদায়ের  জায়গা রয়েছে। মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে ভূমি সমতলে রয়েছে ওজুখানা ও টয়লেটের ব্যবস্থা।

উত্তর-পূর্ব কোণে ভূমি সমতলে ওজুখানা; ছবি: লেখক

মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে আছে মাজার শরীফ। হাজী খাজা শাহবাজ খান মসজিদের আদলে এটি নির্মাণ করেন, এবং তিনি মারা যাওয়ার পর এই মাজার শরীফেই তাকে সমাহিত করা হয়।

মাজার শরীফ; ছবি: লেখক

অষ্টভুজাকৃতির ড্রামের উপর ন্যাস্ত এক গম্বুজবিশিষ্ট সমাধিসৌধের চার কোণায় চারটি মিনার রয়েছে। উত্তর, পূর্ব-পশ্চিমে মিহরাব আকৃতির তিনটি প্রবেশপথ রয়েছে। দক্ষিণ পাশে রয়েছে সমাধিসৌধের প্রধান ফটক ও কুঁড়েঘর ছাউনিবেষ্টিত একটি বারান্দা।

দক্ষিণ পাশে সমাধিসৌধের প্রধান ফটক এবং কুঁড়েঘর ছাউনিবেষ্টিত বারান্দা; ছবি: লেখক

প্রতিদিনই এখানে দর্শনার্থীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কেউ আসে মসজিদ ও মাজার দর্শন করতে, কেউ আসে মাজারে ফুল দিতে, আবার কেউ আসে দোয়া নিতে। স্থানীয় লোকগাঁথায় রয়েছে, হাজী খাজা শাহবাজ খানের সঙ্গে এখানে জ্বীন এসেছিল বিধায় অনেকে জ্বীনের প্রভাব থেকে মুক্ত হতেও আসেন। এ থেকেই মসজিদটি জ্বীনের মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পায়। তাছাড়াও মসজিদ ও মাজার হালকা লালরঙা হওয়ায় লাল মসজিদ, মাজারকে মসজিদের আদলে নির্মাণ করায় জোড়া মসজিদ, এবং তিনটি গম্বুজ থাকায় মসজিদটি তিন গম্বুজ মসজিদ হিসেবেও বেশ পরিচিতি লাভ করেছে।

সমাধিসৌধের মূল ফটকে বসে আছেন এক নারী; ছবি: লেখক

একসময় মসজিদ ও মাজার শরীফে প্রবেশের প্রধান ফটকটি ছিল সমাধিসৌধের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। প্রবেশপথের দুই পাশে রয়েছে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। কিন্তু সেই প্রবেশপথ আজ পরিত্যক্ত। স্থানীয় এক বাসিন্দার কাছ থেকে জানা যায়, প্রবেশপথের ওপাশে বসতবাড়ি থাকায় সেখান থেকে যাওয়া-আসার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়।

জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে পরিত্যক্ত প্রধান প্রবেশপথ; ছবি: লেখক

তবে বর্তমানে মসজিদ এবং মাজার শরীফের প্রধান প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে ওজুখানার সামনের পথটি।

বর্তমানে এটিই মসজিদ এবং মাজারের মূল প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে; ছবি: লেখক

মসজিদের খাদেম ও মুয়াজ্জিনের দায়িত্বে আছেন একজন, এবং ইমামের দায়িত্বে একজন। শুক্রবার মুসল্লিদের দানের অর্থই মসজিদের প্রধান আয়ের উৎস। এখান থেকেই ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। বংশগতভাবে একটি পরিবার এই মসজিদ ও মাজার শরীফ দেখাশোনা করেন। ৩৪৩ বছর আগের এই মসজিদ বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

যাবেন কীভাবে

হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ ও মাজার শরীফে যাওয়ার দুটি সহজ মাধ্যম রয়েছে।

প্রথমত, রাজধানীর যেকোনো জায়গা থেকে সর্বপ্রথমে আসতে হবে শাহবাগের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখান থেকে বাংলা একাডেমির সড়ক ধরে কিছু দূর হাঁটলেই হাতের বাঁ-পাশে তিন নেতার মাজারের পেছনে দেখা মিলবে মসজিদ ও মাজার শরীফের। অথবা চাইলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে রিকশায় চড়েও যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে গুনতে হবে ১০-২০ টাকা।

দ্বিতীয়ত, ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বরে আসতে হবে। সেখান থেকে বাসে চড়ে ১০-২০ টাকার বিনিময়ে চলে আসুন হাইকোর্টের সামনে। সেখানে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দিবে হালকা লালরঙা মসজিদটিতে যাওয়ার সড়ক। অথবা চাইলে ১০ টাকার বিনিময়ে রিকশায় চড়েও যেতে পারেন হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ ও মাজার শরীফে।

নিকটস্থ দর্শনীয় স্থান

ঢাকার শাহবাগেই রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। এসব স্থানের অবস্থান কাছাকাছি। হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ দর্শনের পাশাপাশি তিন নেতার (হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন ও শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক) মাজার, ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্স ময়দায় (বর্তমান নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের ছাত্রাবাসের কাছেই অবস্থিত মুসা খান মসজিদ, কার্জন হল, জাতীয় শহীদ মিনার, চারুকলা অনুষদ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি, এবং জাতীয় জাদুঘরও ঘুরে যেতে পারেন। তাছাড়া, হাতে সময়-সুযোগ থাকলে পল্টনে অবস্থিত জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এবং শাহবাগে অবস্থিত রমনা পার্কেও ঢুঁ মারতে পারেন।

বিশেষ নির্দেশনা

  • শুক্রবার জুম্মার নামাজ পর্যন্ত মা-বোনদের মাজার শরীফে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা আছে। এছাড়া অন্যান্য দিন সকাল ১০ ঘটিকা থেকে বিকেল ৫ ঘটিকা পর্যন্ত প্রবেশের অনুমতি রয়েছে।

Related Articles