Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উত্তরখন্ডের পথে পথে: মায়াবী শহর মাসৌরি

You’re free
A lover sinking in the sea
And we
Will let the water fill our lungs
And sleep

কেম্পটি ফলস থেকে মাসৌরির উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠার পর কানে হেডফোন দিয়ে কান্ট্রি সং শুনছিলাম। তার মাঝে The Paper Kites এর একটি গানের এই লাইনগুলো মনে খুব ধরলো। মনে মনে বার কয়েক আওড়ালাম।

পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে এক ঘন্টা গাড়ি চড়ে মাসৌরি সিটি পৌঁছাতে প্রায় বিকেল ৫টা বেজে গেল। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম। ছোট্ট একটি শহর‚ একেবারে ছবির মতো সুন্দর। দুয়েকটা গাড়ি আস্তে আস্তে যাচ্ছে‚ একদম উঁচুনিচু রাস্তা। দু’পাশে পাথুরে দেয়ালের ফাঁকে বাগানবিলাস উঁকি দিচ্ছে আর ঝুলন্ত বারান্দার সুন্দর সব বাড়ি। খুব নরম এবং কোমল একটা আবহাওয়া‚ এখানে অনেক পর্যটক দেখতে পেলাম।

আমাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল এখানে একটা অ্যাডভেঞ্চার পার্কে যাওয়া। রাস্তায় আসার সময় সাইনবোর্ড আর ড্রাইভার সাহেবের মুখে শুনেছি, এখানে কোথাও একটা বড়সড় অ্যাডভেঞ্চার পার্ক আছে। জিপ লাইনিং, কেবল কারের পাশাপাশি আরো অনেক রোমাঞ্চকর ব্যাপার আছে সেখানে। আমরা সবাই মিলে মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে যে যার মতো খোঁজা শুরু করলাম। কিন্তু এক হেঁসেলে অনেক বাবুর্চির মতো আমরাও শেষমেষ রাস্তা হারিয়ে সব তালগোল করে ফেললাম! শেষে অনেক কষ্টে শহরের কেন্দ্রে ফেরত এলাম।

মাসৌরি শহরের কেন্দ্রে; © রিফাত ইবনে আজাদ তানিম

এই শহরের রাস্তায় অনেক কুকুর‚ পাহাড়ের কুকুরগুলো এত মিশুক! একটু ডাকলেই ন্যাওটা হয়ে যায়‚ আর খুব সুন্দর দেখতে। আমার এক বন্ধু আবার ভীষণ কুকুর ভালবাসে। সে আমাকে বলল, বাংলাদেশে কুকুরদের দেখলেই সবাই মারধর করে বা তাড়া করে। তাই তারাও আমাদের দেখলে ভয় পায়। কিন্তু এখানকার লোকেরা কুকুরদের খুব আদর করে আর যত্ন নেয়, তাই ওরা অনেক পরিষ্কার আর বন্ধুবৎসল।

ঘুরে ঘুরে আমরা শহরের একটি সেন্টারে এসে পৌঁছলাম। পাহাড়ের একেবারে কিনারে রেলিং দিয়ে পার্কের মতো করা‚ ভেতরে বেশ লোকজন ঘুরছে। আমাদের দুয়েকজন আশেপাশের দোকানে স্যুভেনির দেখতে গেল, আমরা তখন ছোট পার্কটায় বেড়াতে এলাম।

রেলিংয়ের একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে কেমন যেন খাঁ খাঁ লাগলো। ভারি শীতল একটা বাতাস বইছিল, সবার গায়ে শাল নাহয় সোয়েটার। এদিকে আমি আবার বেশি মাস্তানি দেখাতে গিয়ে শীতের জামা লাগেজ থেকেই বের করিনি। তরতর করে কাঁপতে কাঁপতে বাইরের দৃশ্য দেখলাম। আশেপাশে ফেরিওয়ালারা এটা ওটা বিক্রি করছে- খেলনা, হাওয়াই মিঠাই, বাদাম, ঝালমুড়ি। ঝালমুড়ি দামাদামি করতে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। ছোট এক বাটি ঝালমুড়ির দাম নাকি ৩০ রুপি! ১০ রুপিতে একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে হাঁটা ধরলাম।

মাসৌরি শহরে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি; © রিফাত ইবনে আজাদ তানিম 

পার্কের ভেতর সুন্দর একটা ছাউনি দেয়া চত্ত্বর আছে। আর আছে সুন্দর কয়েকটা বেঞ্চি ও ল্যাম্পপোস্ট। বেঞ্চিতে বসে ডানে তাকিয়ে দেখি, মহাত্মা গান্ধীর একটি পিতল রঙের মূর্তি। একটি ছবিও তুলে নিলাম। পার্কের সামনে গাদা করে রাখা রয়্যাল এনফিল্ড মোটর সাইকেল। এখানে বেশিরভাগ জায়গায় এই জিনিসটার দেখা পাওয়া যায়। মেয়েরা স্কুটারের পাশাপাশি দিব্যি বাইক চালায়। পাশে দাঁড়ানো এক শিখ ভদ্রলোক তাকিয়ে হাসলেন।
“ইন্ডিয়ায় প্রথম এসেছো?”
“জ্বি আংকেল।”
“প্রথম দফাতেই উত্তরখণ্ড? দিল্লি, কলকাতা এসব দেখনি?”
“খুব বেশি না। সময় করেই উঠতে পারিনি।”
“ওখানে গেলেই বাংলাদেশিরা সবসময় কফি হাউজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ এসব দেখে। এগুলো না দেখে গেলে মিস করবে কিন্তু!”

উঠে একটু সামনে হাঁটা দিতেই দেখি মাসৌরি লাইব্রেরি। আমার বইপত্রের দিকে বরাবরই দুর্বলতা আছে, তাই দৌড়ে গেলাম লাইব্রেরির কাছে। খোশমেজাজে সেখানে ঢোকার পথ জানতে চাইলে নিচে বসে থাকা গার্ড বললেন, এটা শুধুমাত্র সদস্যদের জন্য। মনমরা হয়ে একটা ক্যাফেতে ঢুকে চমৎকার এক মগ ক্যাপুচিনোয় চুমুক দিলাম। এখানকার বেকারিগুলো ভারি সুন্দর। পেস্ট্রিগুলো যেমন সস্তা, তেমনই মজা। এছাড়া মজার মজার পাই, ফলের জুস আর কুকি তো আছেই!

মাসৌরি লাইব্রেরি; © লায়লা শামস

গুগল ম্যাপে খুঁজে বের করলাম এখানে একটি সুন্দর ৫ তারকা রেস্তোরাঁ আছে। নামটা ভারি চমৎকার: নস্ত্রাদামুস রেস্তোরাঁ। ছবি দেখে বেশ পছন্দ হয়ে গেল। আমরা ম্যাপ খুলে রেখে হেঁটে হেঁটে খুঁজতে লাগলাম। এই রাস্তাটা এত সুন্দর, মনে হয় সারাদিন হাঁটলেও ক্লান্তি আসবে না। চারিদিকে খুব সতেজ একটা ভাব। বার দুয়েক অকারণ চক্কর মেরে আমরা রেস্তোরাঁয় পৌঁছালাম।

রেস্তোরাঁর ভেতরে ছাদে বসার ব্যবস্থা আছে। ছাদ থেকে মাসৌরি শহরের বেশ অনেকখানিই দেখা যায়। এদিকে আকাশ একটু মেঘলা মনে হচ্ছিল, আমরা তবুও ছাদে বসে রইলাম। এখানে খুব ভাল একটা ব্যাপার হলো, কেউ যেখানে সেখানে ফস করে সিগারেট ধরাতে পারে না, নিষেধ আছে। এমনকি কোনো কোনো জায়গায় তো সিগারেট হাতে দেখা গেলে রীতিমত হাজতবাস করতে হয়, সাথে গুনতে হয় জরিমানা! তাই আশেপাশে কারো হাতে সিগারেট নেই।

নস্ত্রাদামুস রেস্তোরাঁর ছাদ; © লায়লা শামস

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে মনে হলো মাসৌরির আসল রূপটা ধরা পড়লো। আশেপাশে বাহারি সব বাতি জ্বলছে, মানুষজন সপরিবারে বেড়াতে বের হয়েছে, কেউবা প্রেমিকার হাত ধরে ঘুরছে। সন্ধ্যার পর পর বৃষ্টি নেমে গেল, আমরা ছুট মেরে ছাদ থেকে ভেতরে চলে এলাম। নস্ত্রাদামুস থেকে বের হয়ে লাইব্রেরির বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি কমার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এখানে ছোট একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে সুন্দর সব স্টেশনারি আইটেম, একটি পেন্সিল কিনলাম নোটবুকে লিখবার জন্য।

এ সময় আমাদের ড্রাইভার সাহেব গাড়ি নিয়ে চলে এলেন, আমরা একে একে গাড়িতে উঠলাম। এখান থেকে হোটেলটা আবার প্রায় ১.৫ ঘন্টার রাস্তা। নস্ত্রাদামুসে দৃশ্য দেখতে ঢুকে হালকা জুস বাদে তেমন কিছু খাওয়া পড়েনি। বেকারি থেকে পেস্ট্রি আর কয়েক প্যাকেট চিপস কিনে নিলাম। উত্তরখন্ডের একটি ব্যাপার চোখে পড়ার মতো, এখানে কোথাও কেউ পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করে না। যা কিছুই কিনি না কেন, সবসময় খবরের কাগজ কিংবা কাপড়ের ব্যাগে মুড়ে দেয়। পলিথিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে এবং মানুষ সেটা খুব মন দিয়ে মেনে চলে। ব্যাপারটা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

৬০ রূপিতে কেনা সুস্বাদু ওরিও আইসক্রিম; © লায়লা শামস

হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ১০:৩০ বেজে গেল। ফ্রেশ হতে না হতেই হোটেল ম্যানেজার ডাক দিলেন, রাতের খাবার নাকি এরপর গেলে আর পাওয়া যাবে না। অগত্যা আমরা সবাই আলু পরোটা আর ‘আলু-গোবি ভূনা’ দিয়ে রাতের খাবার সারলাম। খাবারের টেবিলটা ছিল খোলা পাহাড়ের ওপরেই, আজ অবশ্য খাবারটা বেশ ভাল লাগল। কিন্তু একেকজন মাংস খেতে না পেরে খুব মনমরা হয়ে গেল। 

খাওয়া শেষে সবাই রুমের দিকে যাবার সময় খেয়াল করে দেখি, আকাশে বড় একটা চাঁদ!

“পূর্ণিমা! পূর্ণিমা!”, এক বান্ধবী অপ্রকৃতিস্থের মতো চেঁচিয়ে উঠল!

মনে হচ্ছিল, চাইলেই রূপার থালার মতন চাঁদটাকে হাত দিয়ে ধরে ফেলা যাবে। আমরা যে যার রুম থেকে চাদর নিয়ে এসে বাইরে পেতে দিয়ে গোল হয়ে বসে পড়লাম, এমন পূর্ণিমার রাত ঘুমিয়ে কেউ নষ্ট করতে চাইলো না। এদিকে আমাদের যে বন্ধু বোনের বিয়ের জন্যে দেশে রয়ে গিয়েছিল, সে ফোনে জানালো- আগামীকাল সে দিল্লি থেকে দেরাদুন এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছাবে ১২টা নাগাদ। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নৈনিতাল, এর মানে এখান থেকে দেরাদুন হয়ে ঘুরে এরপর নৈনিতাল যেতে হবে। সর্বনাশ!

ড্রাইভার সাহেব মুচকি হাসলেন।
“বেহেনজি, দোস্তকে ১২টায় গাড়ি তুলতে হলে এখান থেকে কম করে হলেও সকাল ৮টা নাগাদ রওনা দিতে হবে। পুরো রাত মৌজ করে সকালে যেতে পারবেন তো?”
“রাত জেগে পরীক্ষা দিয়ে ওসব আমাদের অভ্যাস আছে ভাইসাব”, দাঁত বের করে হেসে আমরা জবাব দিলাম!
“দেখা যাবে সেটা”, বলে ড্রাইভার সাহেব ঘুমাতে গেলেন।

পাহাড়ের ওপর কেবল আমরা কয়েকটা প্রাণী, মাঝে মাঝে দুয়েকটা নিশাচর ঝটপট করে উড়ে যাচ্ছিল মাথার ওপর দিয়ে। চাঁদের আলোটা একদম তরল পারদের মতো সবকিছুর ওপর গলে পড়ছিল, সবকিছু এত অপার্থিব লাগছিল! কেউ কোনো কথা বলছিল না, নীরবতা ভেঙ্গে দুয়েকজন কথা বললেও আবার চুপ করে যাচ্ছিল। কে একজন গুনগুন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত ধরল, ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’। আমরা গান শুনতে শুনতে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময়-

“আপনারা ভেতরে চলে যান দয়া করে, এখনই।”
কর্কশ গলা শুনে তাকিয়ে দেখি, বোর্ডিং হাউজের ম্যানেজার ভদ্রলোক টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন সুন্দর পূর্ণিমার আলোয় টর্চ হাতে বের হওয়াটাই আমার কাছে রীতিমত অন্যায় লাগল।
“কেন? আমরা সবাই আজ রাতটা বাইরে কাটাব।”
“দেখুন, এখানে রাত-বিরেতে অনেক অঘটন ঘটে। আপনারা ভাল চান তো ভেতরে যান।”
আমরা রাত-বিরাতের অঘটনের কথা শুনে খুব এক চোট হেসে নিলাম। তারপর বললাম,
“আমরা এসব ভূত-প্রেতের আজগুবি গল্পে বিশ্বাস করি না। আপনি চিন্তা করবেন না, আমরা নিরাপদেই আছি।”

ম্যানেজার আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন,
“ভূতের কথা আমি বলছিও না। প্রতি বছর রাতের বেলা পাহাড়ি জানোয়ার আর বাঘ এসে মানুষ মেরে ফেলে এখানে। আমার বলার দরকার বললাম, বাকি আপনাদের বিবেচনা।” এই বলে আমাদের একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দিয়ে তিনি হন হন করে চলে গেলেন।

আমরা খুব আনন্দে ছিলাম, কিন্তু ম্যানেজারের কথায় আমরা একটু ভয় পেয়ে গেলাম। চাদরের ওপরের গোলটা আরও ছোট করে ফেললাম, একজন আরেকজনের গা ঘেঁষে বসলাম। একটু পরপর সবাই এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল, কোথাও কিছু নড়ে উঠলেই সবাই চমকে যেতে লাগলাম।

সারারাত ভয়ে ভয়ে গল্পগুজব করে ভোরের আগমন অবশেষে আমাদের আড্ডা ভেঙে দিতে সক্ষম হলো। বাংলাদেশে থাকতে সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে সাগর তীরে বসে ভোর হওয়া দেখেছিলাম। সাগরের পানির ভেতর থেকে সূর্যের উদয় দেখে আমি ধরেই নিয়েছিলাম, সবচাইতে সুন্দর সূর্যোদয় দেখার অভিজ্ঞতা আমার সেটাই। কিন্তু মাসৌরির এই ভোর আমার সেই ধারণা ভেঙে দিল। পাহাড়ের খাঁজের মধ্য দিয়ে যখন সূর্য উঠলো, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

সবাই তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিলাম, ঘড়িতে দেখি ৬টা বাজে সবে। ৯টায় যদি রওনা দেই, তবুও হাতে ৩ ঘন্টা সময়। আমি শরীরকে একটু প্রশ্রয় দিলাম, বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবলাম একটু জিরিয়ে নিলে কী আর এমন ক্ষতি হবে! এই ‘একটু’ জিরোনোর জন্যে সবাই মিলে কী খেসারত দিতে হবে, তা নিয়ে ঘুণাক্ষরেও মাথায় এলো না। কখন ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেলাম তা টেরও পেলাম না।

ঘুম ভাঙলো বন্ধুদের চেঁচামেচিতে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে সর্বনাশ! প্রায় ১০টা বাজে। নাকেমুখে আলুপরোটা গুঁজে দিয়ে সবাই তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠলাম। ড্রাইভার সাহেবের মিটিমিটি হাসি দেখে নিজের উপর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

মাসৌরি ছেড়ে নিচে নামবার পথে; © রিফাত ইবনে আজাদ তানিম

পুরো রাস্তা আমাদের সেই বন্ধু এয়ারপোর্ট থেকে ফোন দিচ্ছিল, আর আমরা তাকে এটা সেটা বলে বুঝ দিচ্ছিলাম। দেরির কারণ হিসেবে একজন বেশি চালাকি করে ওকে বলে ফেলল, “রাস্তায় অনেক ট্রাফিক জ্যাম।” পাহাড়ের রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যামের কথা কী করে ওর মাথায় এলো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না! 

যাবার কথা ১২টায়, সেখানে আমরা প্রায় সাড়ে ৩টা বাজে গিয়ে দেরাদুন এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। সেই অপেক্ষারত বন্ধুর কতখানি গালাগাল সহ্য করতে হয়েছিল আমাদের, তা আর এখানে না বলি। ওকে খুশি করতে পথিমধ্যে এক নন-ভেজ দোকানে গাড়ি থামিয়ে পেটপুরে চিকেন খাওয়ালাম। সোজা পথে না নিয়ে গাড়ি হরিদ্বার হয়ে চালাতে বললাম যেন ও নেমে গঙ্গায় গোসল করতে পারে, এই সুবাদে আমাদেরও হরিদ্বার দেখা হয়ে যাবে আর কী!

গঙ্গা নদী, হরিদ্বার শহর; © রিফাত ইবনে আজাদ তানিম

হাইওয়ের পাশে লাল মাটির ওপর গাড়ি থামিয়ে আমরা সবাই নেমে প্রথমেই দেখি বিশাল বড় একটা শিবমূর্তি, ৮-৯ তলা দালানের চেয়েও লম্বা। গলায় সাপ জড়িয়ে ত্রিশূল হাতে সম্ভ্রম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভোলানাথ। আমাদেরকে মেইন গেটের ভেতর ঢুকতে দিল না, খোলা একটা রেলিং দেওয়া জায়গায় দাঁড়িয়ে বাইরে দেখতে লাগলাম। হাজার হাজার মানুষ নদীতে গোসল করছে, কেউ কেউ আবার পাত্রে ভরে পানি নিচ্ছে, কেউ করছে প্রণাম। এখানে আশেপাশে কোথায় নাকি মনসাদেবী আর চন্ডীদেবীর মন্দির আছে, হাতে সময় বেশি নেই বলে সেগুলো দেখে যেতে পারলাম না।

যাত্রা আবার শুরু হলো। মাঝে মাঝে খানিক যাত্রা বিরতি দিয়ে আমরা নৈনিতালের দিকে এগোতে লাগলাম। সন্ধ্যা পার হয়ে ক্রমে রাত বাড়লো, কিন্তু এখানকার লোকজনের সেসব খবর নেই। যাবার পথে অন্তত পক্ষে গোটাসাতেক বিয়ের অনুষ্ঠান চোখে পড়ল। ভারতের বিয়ের জাঁকজমক কেবল সিনেমায় দেখেছিলাম এতদিন, এবার সামনাসামনি দেখলাম। এত ঝলমলে একেকটা বিয়ে! একটা বোধহয় মুসলমান বিয়ে ছিল, পোশাক আশাকে বোঝা যাচ্ছিল। সেই বিয়েতে রীতিমত একেকজন আকাশে দুমদাম গুলি ছুঁড়ছিল!

রাতে অখাদ্য একটা চাওমিন দিয়ে ডিনার সেরে গাড়িতে উঠলাম। এবার খানিকটা বিরক্তি ধরে গেল। এত ঘুমিয়ে, গান শুনে আর গল্প করেও পথ শেষ হচ্ছে না। একজন তো রীতিমত অসুস্থই হয়ে পড়ল। রাত বেড়ে ভোর প্রায় যখন ৩টা, যখন আমাদের সবার চোখে ঘুম আয়েশ করে নেমে এসেছে, তখন ড্রাইভার সাহেব একটা গেটের সামনে ব্রেক কষে বললেন,
“নৈনিতালে পা ফেলুন দেখি সবাই!”

ফিচার ইমেজ : © রিফাত ইবনে আজাদ তানিম

Related Articles