কুতুবদিয়া: স্মৃতির আয়নায় দ্বীপের আয়না

চতুর্দশ শতাব্দী শেষের পথে। সমুদ্রপথে বর্তমান চট্টগ্রাম থেকে ৭৬ কিলোমিটার, কক্সবাজার থেকে ৮৬ কিলোমিটার দূরে এবং বাঁশখালী, পেকুয়া ও মহেশখালী উপজেলার পাশে উত্তাল বঙ্গোপসাগরের বুক চিড়ে জেগে ওঠে একটি দ্বীপ। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সেই দ্বীপে পা রাখা শুরু করল মানুষ। হযরত কুতুবউদ্দীন নামে এক আধ্যাত্মিক সাধক তার কিছু সঙ্গী-সাথী নিয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করেন। সেই সময়ে আরাকানে নির্যাতিত মুসলমানরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তাদের অনেকেই ভাগ্যান্বেষণের উদ্দেশ্য সেই দ্বীপে যাত্রা শুরু করে। স্থানীয়ভাবে দ্বীপকে তখন ‘দিয়া’ বলা হতো। পরবর্তীতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন এই দ্বীপে আসতে থাকেন। হযরত কুতুবউদ্দীনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তারা এ দ্বীপের নাম রাখেন ‘কুতুবউদ্দীনের দিয়া’, যা পরবর্তীতে কালের বিবর্তনে লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে ‘কুতুবদিয়া’ নামে পরিচিত হয়। কুতুবদিয়ার প্রচলিত ইতিহাস এমনই।

বর্তমানে কুতুবদিয়া কক্সবাজার জেলাধীন একটি উপজেলা। উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ তিন দিকেই বঙ্গোপসাগরের জলরাশি এবং পূর্ব দিকে কুতুবদিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত এ দ্বীপের আয়তন প্রায় ২১৬ বর্গ কিলোমিটার। বাঁশখালী, পেকুয়া, মহেশখালী এ তিন উপজেলা এবং কুতুবদিয়া উপজেলার মধ্যকার বঙ্গোপসাগরের অংশই মূলত কুতুবদিয়া চ্যানেল। এই চ্যানেলই কুতুবদিয়া প্রবেশের প্রধান পথ। পেকুয়া মগনামা ঘাট থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে খুব সহজেই কুতুবদিয়া দ্বীপে পৌঁছানো যায়।

১. পেকুয়া মগনামা জেটিঘাট

চট্টগ্রাম শহরের নতুন চান্দগাঁও থানা কিংবা নতুন ব্রিজ থেকে আনোয়ারা, বাঁশখালী হয়ে অথবা চকোরিয়া হয়ে উভয় উপায়ে পেকুয়া মগনামা বাজারে যাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে প্রতিজন ১৫০ টাকা এবং সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। তাই ভোরে বের হওয়া সবচেয়ে ভাল। মগনামা বাজারে নেমেই দেখে নিতে পারেন চারপাশ। বর্তমানে এটিও একটি ছোটখাট পর্যটন স্পট হয়েছে। সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখার জন্য আশপাশের অঞ্চল থেকে এখানে বহু লোক আসে। দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে যাওয়া কুতুবদিয়া চ্যানেল, ছোট ছোট নৌকায় মাছ ধরার দৃশ্য, বাদাবন বা প্যারাবন, সমুদ্রতীরে আরসিসি ব্লকে বসে নির্মল হাওয়া, লবণের মাঠ, জেটিঘাটে ব্যস্ততার দৃশ্য কাউকে নিরাশ করবে না নিশ্চয়ই। মগনামা জেটিঘাট থেকে কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ স্টিমারঘাট এবং দরবারঘাট দুই জায়গায় যাওয়া যায়। বড়ঘোপ যেতে হলে ডেনিশ বোটে আধাঘণ্টার মতো সময় লাগে, এবং ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা। এছাড়াও জনপ্রতি ৮০ টাকা ভাড়ায় স্পীডবোটে ৭-৮ মিনিটের মধ্যে বড়ঘোপ পৌঁছানো যায়।

মগনামা জেটিঘাট; Image Credit: তারিক আল যিয়াদ

২. কুতুবদিয়া চ্যানেল

কুতুবদিয়া চ্যানেল মোটামুটি ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। শীতকাল ব্যতীত বছরের অন্যান্য সময়ে এ চ্যানেল বেশ উত্তাল থাকে। শীতকালে একেবারে শান্ত নদীর মতো হয়ে যায়। তাই শীতকালই পর্যটকদের জন্য কুতুবদিয়া যাওয়ার উপযুক্ত সময়। সমুদ্রজলের হালকা ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ডেনিস বোটের দোল দোল দোলুনি,সাথে হাঁড় কাঁপানো হিম শীতল হাওয়া এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে। কিছুদূর গেলেই চোখে পড়বে কুতুবদিয়ার সুবিশাল ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। অবশেষে আধ ঘণ্টার মতো সমুদ্রে ভাসার চ্যালেঞ্জিং যাত্রার সমাপ্তি ঘটিয়ে পৌঁছে যাবেন বড়ঘোপ স্টিমারঘাট।

কুতুবদিয়া চ্যানেল; Image Credit: তারিক আল যিয়াদ
 

৩. বড়ঘোপ স্টিমারঘাট

বড়ঘোপ স্টিমারঘাট দিনের পুরোটা সময়ই ব্যস্ত থাকে। মগনামা ঘাটে যাওয়ার জন্য এখান থেকেও ঘণ্টাখানেক পর পর বোট ছাড়ে। ফেরার সময় সন্ধ্যার আগেই এখানে পৌঁছাতে হবে। দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য নানা ধরনের পণ্যের বহর নিয়ে এখানে নোঙর করে বড় বড় পণ্যবাহী নৌকা। পণ্য খালাসে শ্রমিকদের ব্যস্ততা, সার্বক্ষণিক যাত্রীদের আসা যাওয়ায় সবসময় সরগরম থাকে এই বড়ঘোপ স্টিমারঘাট। বড়ঘোপ বাজার যাওয়ার জন্য এখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা, টমটম, টেম্পু পাওয়া যায়। ভাড়া পড়ে ৪০ টাকা।

বড়ঘোপ ঘাটে বাঁধা বোট; Image Credit: তারিক আল যিয়াদ
 

৪. কুতুবদিয়ার পথে প্রান্তরে

কুতুবদিয়ার প্রায় রাস্তাঘাট পাকা, তেমন বড় কোনো গাড়িও চলে না, তাই যাতায়াত ব্যবস্থা খুব ভালো। যারা নিয়মিত শহরে থাকেন, তাদের কাছে মনে হবে এ দ্বীপ এক শান্তপুরী। মানুষের কোনো হট্টগোল নেই, এলোপাথাড়ি গাড়ির কালো ধোঁয়া নেই, অট্টালিকার পাহাড় নেই। আছে হিমশীতল হাওয়া, ইতিউতি অসংখ্য লবণের মাঠ, আছে ধান, তরি-তরকারি, শাকসবজি, ফল-ফলাদির বিশাল বিশাল কৃষিজমি, যেখানে কাজ করছে নারী-পুরুষ-শিশু সবাই। এখানকার লোকজনও বেশ আন্তরিক এবং শান্ত। তাই শহরের দমবন্ধ অবস্থা থেকে বেরিয়ে একটু সুস্থ নিঃশ্বাস নিতে চাইলে কুতুবদিয়া দ্বীপের বিকল্প নেই।

বড়ঘোপ স্টিমারঘাট থেকে কুতুবদিয়ার রূপবৈচিত্র্য এবং জীবনযাত্রা দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবেন বড়ঘোপ বাজারে।

কুতুবদিয়ার ফসলী মাঠ; Image Credit: তারিক আল যিয়াদ

৫. বড়ঘোপ বাজার

কুতুবদিয়া ঘুরে বেড়ানোর জন্য পর্যটকদের নোঙর করতে হবে বড়ঘোপ বাজারে। পর্যটন এলাকা হিসেবে কুতুবদিয়া বেশ উপেক্ষিত। তাই কক্সবাজারের মতো উন্নত পর্যটন সুযোগ সুবিধার কথা মাথায় নিয়ে এ দ্বীপে আসাটা ভুল হবে। উন্নতমানের কোনো রেস্টুরেন্ট না থাকলেও বড়ঘোপ বাজারে কিছু ভালো খাবার হোটেল আছে যেখানে নানা ধরনের মাছ, শুটকি, ভর্তা,  মাংস ইত্যাদি স্থানীয় খাবার দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেতে পারবেন।

পর্যটকদের থাকার জন্য বড়ঘোপ বাজারে ‘হোটেল সমুদ্র বিলাস’ নামে মানসম্মত একটি আবাসিক হোটেল আছে। এটি সমুদ্রের একেবারে লাগোয়া। তাই এই হোটেল থেকে ভালোভাবে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। পুরো দ্বীপ চাইলে একদিনে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব। আবার কেউ চাইলে সৈকতের কাছে ক্যাম্পিং করতে পারেন, কারণ কুতুবদিয়া ক্যাম্পিংয়ের জন্য আদর্শ জায়গা। বড়ঘোপ বাজার থেকে সোজা পশ্চিমে নামলেই কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত।

 
নিরিবিলি সমুদ্র সৈকত; Image Credit: তারিক আল যিয়াদ
 

৬. কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত

কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত দ্বীপের পশ্চিম দিকে অবস্থিত যা উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। দৈর্ঘ্যের দিক থেকে কক্সবাজার এবং কুয়াকাটার পরেই এই সৈকতের অবস্থান। 

তবে এই সৈকতের বেশিরভাগ অংশই একেবারে নিরিবিলি, মানুষের কোলাহলমুক্ত। দ্বীপের বাইরে খুব একটা পরিচিতি না থাকায় এত বিশাল সৈকত থাকা সত্ত্বেও এখানে পর্যটকদের তেমন আনাগোনা নেই। পুরো সৈকতে কেবল স্থানীয় লোকজনের চলাফেরা। সমুদ্রতীর ধরে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে থাকলে চোখে পড়বে অসাধারণ ঝাউবন, সারি সারি মাছ ধরার নৌকা, মাছ খেতে আসা গাংচিলদের দিগ্বিদিক উড়ে বেড়ানো, ছেড়া জাল মেরামত কিংবা ট্রলার নিয়ে ব্যস্ত জেলেদের দল, ফুটবল নিয়ে শিশুদের দৌড়াদৌড়ি আর সৈকতের পাশে গড়ে ওঠা শুটকি পল্লী।

কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকতে সূর্যাস্ত দেখার কথা আলাদাভাবে বলতেই হবে। সমুদ্রতীর ধরে হাঁটবার সময় সঙ্গী হিসেবে থাকবে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়া সূর্য। বেলা গড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সেই সূর্য ঢুকে যাবে নিজ বিশ্রামঘরে। সূর্যাস্তের এই দৃশ্য দেখার জন্য কুতুবদিয়া আদর্শ জায়গা। সূর্যের অস্তদৃশ্য এবং দ্বীপের প্রকৃত জনজীবন দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে যাবেন কুতুবদিয়া বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রে।

সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য; Image Credit: তারিক আল যিয়াদ
 

৭. কুতুবদিয়া বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র

কুতুবদিয়ায় বাতাসের গড় গতি ৩.৪৩ মিটার/সেকেন্ড। মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বাতাসের গতি থাকে অনেক বেশি। জুলাই মাসে কুতুবদিয়ায় বাতাসের গতি ৫.৪ মিটার/সেকেন্ড, যা বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। সমুদ্রতীরের বাতাসের এই গতি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার জন্য এখানে আছে বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র।

সাধারণত বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে আমাদের মাথার উপর ফ্যান ঘুরলে আমরা বাতাস পাই, উইন্ড টারবাইনের কার্যনীতি ঠিক তার বিপরীত। সমুদ্রের পাঁড় ঘেষে সারি সারি সুউচ্চ টাওয়ারের উপর লাগানো আছে রোটর ব্লেড বা টারবাইন ব্লেড। সমুদ্রের দমকা বাতাস এখানে আঘাত করলে ফ্যানের মতোই ঘুরতে থাকে ব্লেডগুলো, যার ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এভাবে উইন্ড টারবাইন বাতাসের গতিশক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রুপান্তর করে।

কুতুবদিয়ার বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র; Image Credit: তারিক আল যিয়াদ

 

কুতুবদিয়াবাসীর বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য ১৯৯৬ সালে সৈকতের দক্ষিণ প্রান্তে আলী আকবর ডেইল এলাকায় ৫০টি উইন্ডমিল স্থাপন করা হয়, যার অধিকাংশই বর্তমানে বিকল অবস্থায় আছে। পরে ২০১৫ সালে আরো ৫০টি হাইব্রিড উইন্ডমিল স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যা থেকে প্রায় এক হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। কিন্তু কুতুবদিয়ার মোট বিদ্যুৎ চাহিদার খুব বেশি মেটাতে পারে না এই বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প। যে কারণে সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে এখানে নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকারের পর্দা। খুব বেশি আগ্রহী হলে এবং যথার্থ ব্যবস্থা থাকলে অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে রাতের কুতুবদিয়া দেখতে দেখতে যেতে পারেন আলী আকবর ডেইল জেটিঘাটে।

৮. আলী আকবর ডেইল জেটিঘাট

আলী আকবর ডেইল জেটিঘাট কুতুবদিয়ার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত। এটি মূলত সাগরে মাছ ধরার বিভিন্ন ট্রলারের আশ্রয়কেন্দ্র। দিনের বেলা এখান থেকে পার্শ্ববর্তী মহেশখালীর মাতারবাড়ি ইউনিয়নে যাওয়ার জন্য যাত্রীবাহী ডেনিশ বোট ছাড়ে। এ ঘাটের মূল সৌন্দর্য অনুভব করা যায় রাতে। চারপাশে অন্ধকারের রাজত্ব, মাথার উপর গৃহত্যাগী জোৎস্না, সমুদ্রের শীতল হাওয়া, সারি সারি ট্রলারের গায়ে রঙ-বেরঙের মিটি মিটি আলো, কিছুক্ষণ পর পর জাহাজের আওয়াজ- সব মিলিয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি। সশরীরে না আসলে এখানকার অনুভূতি কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব না। গ্রীষ্মকালে অত্যধিক গরমের কারণে আশপাশের লোকজন এ ঘাটে এসে সময় কাটায়, এবং স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে ঘরোয়া গানের আসরও হয় বলে শোনা যায়।

এই জেটিঘাটে রাতে আসা-যাওয়ার পথ খুব একটি মসৃণ নয়। সাধারণত কুতুবদিয়ার বাড়িঘর, দোকানপাটে সৌরবিদ্যুৎ কিংবা জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকলেও এদিককার রাস্তাঘাট অন্ধকারে ডুবে থাকে। তাই পর্যটকদের জন্য রাতের বেলায় আলী আকবর ডেইল জেটিঘাটে আসা অনেকটাই অসম্ভব।

আলী আকবর ডেইল জেটিঘাট; Image Credit: তারিক আল যিয়াদ

৯. কুতুব শরীফ দরবার

পরদিন সকালে কুতুবদিয়ার যেকোনো জায়গা থেকে রওনা হতে পারেন উপজেলার ধুরুং এলাকায় অবস্থিত কুতুব শরীফ দরবারের উদ্দেশ্যে। কক্সবাজার, চট্টগ্রামের বাইরে কুতুবদিয়ার পরিচিতির বড় একটা কারণ ‘কুতুব শরীফ দরবার’। ১৯১১ সালে এই কুতুবদিয়ার মাটিতেই জন্মগ্রহণ করেন শাহ আব্দুল মালেক আল কুতুবী মুহিউদ্দিন আজমী (রাহঃ) নামে এক আধ্যাত্মিক সাধক। মালেক শাহ হুজুর নামে যিনি সর্বাধিক পরিচিত। শিক্ষাজীবন এবং কর্মজীবন শেষ করে এই আধ্যাত্মিক সাধক ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে নিজ বাড়িতে ‘কুতুব শরীফ দরবার’ প্রতিষ্ঠা করেন। তারই ফলশ্রুতিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এ দরবারের অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত। বর্তমানে এ দরবারের অধীনে মসজিদ, মাদ্রাসা, হেফজখানা, এতিমখানাসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দরবার পরিচালনা দায়িত্বে আছেন হুজুরের পুত্র শাহজাদা শেখ ফরিদ আল কুতুবী।

২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মালেক শাহ (রহঃ) ইন্তেকাল করেন, এবং প্রতিবছর ১৯ ফেব্রুয়ারি (৭ই ফাল্গুন) বার্ষিক ফাতেহা ও ওরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে অগণিত ভক্তবৃন্দ সমবেত হন কুতুবদিয়ায়। এ দিন সকাল থেকেই খতমে কোরান, হামদ-নাত, ইসলামিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, ওয়াজ ও মোশায়েরা মাহফিল, স্মৃতিচারণ, মিলাদ, জেয়ারত, জিকির ও আখেরী মোনাজাত ইত্যাদি কর্মসূচী চলতে থাকে। এছাড়া রান্নাবান্না, থাকা-খাওয়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ তো আছেই। তাই এ সময়ে কুতুবদিয়ায় যেতে পারলে অভিজ্ঞতার খাতা সমৃদ্ধ হবে নিঃসন্দেহে। শুধু দরবার শরীফ যেতে চাইলে পেকুয়ার মগনামা ঘাট কিংবা বাঁশখালীর ছনুয়া ঘাট থেকে সরাসরি দরবারঘাট হয়ে কুতুব শরীফ দরবারে পৌঁছানো যায়।

কুতুব শরীফ দরবারের অভ্যন্তর; Image Credit: Ahmed Tuhin

১০. শতবর্ষ প্রাচীন বাতিঘর

দরবার ঘুরে দেখা শেষ হলে বিকেলে যেতে পারেন কুতুবদিয়ার বিখ্যাত বাতিঘর দেখতে। উপজেলার একেবারে উত্তর দিকে দক্ষিণ ধুরুং নামক এলাকায় বাতিঘরের অবস্থান। ইস্পাতের কৌণিক দণ্ড ব্যবহার করে ১৯৬৫ সালে ৭ একর জমিতে বর্তমান বাতিঘরটি তৈরি করা হয়। ১২০ ফুট উচ্চতার বাতিঘরটির একেবারে উপরের অংশে রয়েছে বাতি, যেখান থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়। কুতুবদিয়ায় বাতিঘর স্থাপনের ইতিহাস অবশ্য বেশ পুরনো। সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজের নাবিকদের পথ চলার সুবিধার্থে এবং নির্বিঘ্নে জাহাজ চলাচলের জন্য ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রথম এই এলাকায় বাতিঘর স্থাপন করে। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হেয়ারের তত্ত্বাবধানে এবং ইঞ্জিনিয়ার জে এইচ টুগুডের নির্দেশনায় বাতিঘরটি নির্মিত হয়েছিল। পাথরের ভিত্তির উপর নির্মিত প্রায় ৪০ মিটার উচ্চতার বাতিঘরটির পাটাতন এবং সিঁড়ি ছিল কাঠের। নারকেল তেলের সাহায্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় বসানো ল্যাম্পটি জ্বালানো হতো যা প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূর থেকে সমুদ্রে চলাচলকারী নাবিকদের দিক-নির্দেশনা দিত। ১৮৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বাতিঘরটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে স্থায়ীভাবে বিলীন হয়ে যায়।

বর্তমান বাতিঘর; Image Credit: Rafe Ahmed

বর্তমানে নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন বাতিঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি নেই। তাই বাহিরে থেকে দেখে এবং সামনের নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকতে ঘুরে বেড়ানো যায়। ভাগ্য ভাল থাকলে, ভাটার সময় পুরনো বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষও দেখতে পেতে পারেন। ফিরতি পথ ধরতে চাইলে সন্ধ্যার আগেই বড়ঘোপ কিংবা দরবার ঘাটে পৌঁছাতে হবে। সন্ধ্যার পরে সাধারণত আর কোনো ড্যানিশ বোট চলাচল করে না। তাই কোনোভাবে বোট মিস করে ফেললে আরেকটি রাত কাটাতে হবে কুতুবদিয়ায়।

সমুদ্রপাড়ে চলছে শুটকির কাজ; Image Credit: Author

১১. পরিশেষে

মাছ, মাঠ, কৃষি এই তিনে মিলে কুতুবদিয়ার মূল অর্থনীতি। বেশিরভাগ মানুষ মাছের ব্যবসা, শুটকি, লবণের মাঠ, কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। এর বাইরে অন্যান্যরা শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে কর্মরত। এছাড়াও অনেকে পুলিশ, নৌবাহিনী, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরিরত। দ্বীপাঞ্চল হওয়ায় এখানকার মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করতে হয় প্রতিনিয়ত। ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে এখানে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ১০ হাজার মানুষ। সরকারিভাবে এবং বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় এখানে প্রচুর আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। তবে আশেপাশের অন্যান্য দ্বীপ এবং উপকূল থেকে কুতুবদিয়া কিছুটা উঁচু হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব বর্তমানে তুলনামূলক কম। বিদ্যুৎ সংকট এ দ্বীপের প্রধানতম সংকট। এছাড়া টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকার কারণে প্রতিবছর ভাঙনের কবলে পড়ে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হচ্ছে কুতুবদিয়ার সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলো।

প্রকৃতির সাথে এখানকার মানুষের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। তাই দ্বীপাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য এবং প্রকৃত জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখতে চাইলে কুতুবদিয়া আদর্শ জায়গা।

Related Articles