Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুকাত্রা: পৃথিবীর পৃষ্ঠে ভিনগ্রহীদের দ্বীপরাজ্য

বিজ্ঞানের গবেষণার এক প্রধান অংশ হলো অন্যান্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা। এ পর্যন্ত অনেকগুলো অভিযান চালানো হয়েছে বিভিন্ন গ্রহ পর্যবেক্ষণে। সায়েন্স ফিকশন বইগুলোর সুবাদে সকলের মনে ভিনগ্রহী বা এলিয়েন নিয়ে রয়েছে বিস্তর কল্পনা। ভাবুন তো একবার, কেমন হবে যদি ভিনগ্রহীদের রাজ্য খুঁজে পান পৃথিবীতেই! একবার হলেও জানতে চাইবেন নিশ্চয়ই সেটি কেমন হয়?

হ্যাঁ, আরব সাগরের মাঝে এমনই এক দ্বীপ রয়েছে যেখানে স্বয়ং এলিয়েনদের দেখা না মিললেও ভৌগলিক পরিবেশ এবং গাছপালার রকম সকমের কারণে তাকে ‘এলিয়েন দ্বীপ’ বলা হয়ে থাকে, যেটি কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে পরিত্যক্ত এবং মানুষের জ্ঞানসীমার বাহিরে ছিল। এটিকে পুনরায় আবিষ্কার করা হয়েছে এবং এখন মানব বসতিও গড়ে উঠেছে এখানে। দ্বীপটির নাম সুকাত্রা।

সুকাত্রা দ্বীপপুঞ্জ; Source: wikimedia commons

দ্বীপ বললে ভুল বলা হবে, কেননা সুকাত্রা দ্বীপপুঞ্জ আরব সাগরের চারটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত, যেগুলোর বেশিরভাগ অংশই পড়েছে ইয়েমেনের ভেতরে। ২০১৩ সালে এটিকে একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৩,৭৯৬ বর্গ কিলোমিটার ভূমি বিশিষ্ট এ দ্বীপপুঞ্জ দৈর্ঘ্যে ১৩২ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৫০ কিলোমিটার। এর রাজধানীর নাম হাদিবু।

আবিষ্কার

প্রথম শতকে গ্রিকদের পদচারণা হয়েছিল এই সুকাত্রা দ্বীপমালায়, যা প্রস্তর খন্ডে প্রাপ্ত ভাষার ব্যবহার এবং একটি কাঠের চাকতি দেখে ধারণা করা হয়। আরো ধারণা করা হয়, তৃতীয় শতকের দিকে এই দ্বীপটি প্রাচীন যুগের ব্যবসায়ের মূল কেন্দ্র ছিল। গ্রিকদের পদচারণায় এ দ্বীপমালার সূচনা হলেও ‘সুকাত্রা’ নামটি গ্রিক শব্দ নয়, বরং সংস্কৃত শব্দ সুখাদ্রা থেকে এর উৎপত্তি, যার অর্থ সহায়ক বা স্বর্গসুখ প্রদানকারক।

২০০১ সালে একটি প্রজেক্টে বেলজিয়ামের একদল স্পেলিওলজিস্ট (যারা গুহা বা অন্যান্য বস্তুর গাঠনিক প্রক্রিয়া, বয়স ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেন) এই সুকাত্রা দ্বীপে ‘হালাহ’ নামক একটি গুহার মতো গঠন খুঁজে পান যেটির গভীরতার মোটামুটি ভালই। এছাড়াও বেশ কিছু ফলক, পাথর এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু খুঁজে পান তারা। পরবর্তীতে গবেষণা করে তারা জানান, সেগুলো প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ের এবং আরব সাগর পাড়ি দেবার সময় হয়তো নাবিকেরা দ্বীপে এগুলো ফেলে গিয়েছেন। শুনলে অবাক হতে পারেন, প্রস্তর লেখাগুলোর ভেতরে ভারতীয় ব্রাহ্মলিপিও পাওয়া গিয়েছে!

সুকাত্রা দ্বীপ সম্পর্কে মার্কো পোলোর বইয়ে উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে (দ্য ট্রাভেলস অফ মার্কো পোলো)। যদিও কোথাও বলা নেই তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন বা গিয়েছিলেন, কিন্তু দ্বীপটি সম্পর্কে পোলো জানিয়েছেন।

দ্বীপের গাছগুলো আসলে কেমন?

এলিয়েন দ্বীপ বলার কারণ বুঝতে হলে জানতে হবে এখানকার গাছগুলো সম্পর্কে। এ দ্বীপের বেশিরভাগ উদ্ভিদই স্থানীয়। পৃথিবীর কোথাও এগুলোর দেখা মেলে না। এই স্থানীয় উদ্ভিদগুলো গড়ন এতটাই অদ্ভুত যে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের জীববিজ্ঞানীগণ জরিপ করে প্রায় ৭০০ প্রজাতির স্থানীয় উদ্ভিদ পেয়েছেন সারা পৃথিবীতে। আর সুকাত্রা দ্বীপে ৮২৫ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ৩০৭টি প্রজাতিই স্থানীয়, অর্থাৎ প্রায় ৩৭ শতাংশ উদ্ভিদ আপনি পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখতে পাবেন না। ২০০৪ সালে IUCN এর লাল তালিকায় সুকাত্রার ৩টি অতিবিপন্ন এবং ২৭টি বিপন্ন উদ্ভিদের নাম রয়েছে।

এই দ্বীপের সবচেয়ে অদ্ভুত গাছ হলো ড্রাগন-ব্লাড ট্রি। হঠাৎ করে দেখলে ভয় পেয়ে যেতে পারেন বৃহৎ আকৃতির ব্যাঙের ছাতা ভেবে। অদ্ভুত গড়নের ছাতাকৃতির এই গাছটি থেকে লাল বর্ণের আঠালো পদার্থ বের হয়। ধারণা করা হয়, বহুকাল আগের ড্রাগনের রক্ত থেকে এই গাছের উৎপত্তি এবং সে অনুযায়ী এর নামকরণ! এই গাছের আঠা এখন রঙ তৈরিতে এবং বার্নিশের কাজে ব্যবহৃত হয়। খুব সম্ভবত ওষুধ হিসেবে এবং প্রসাধনী হিসেবেও এই উদ্ভিদের ব্যবহার ছিল।

ড্রাগন-ব্লাড ট্রি; Source: darkroastedblend.com

আরেকটি বিশেষ উদ্ভিদ হলো ডেন্ড্রোসসিয়াস। এটি এক প্রকারের শশা গাছ। বিভিন্ন আকৃতির কান্ডটি লম্বা হয়ে চূড়া তৈরি করে, যেখানে হলুদ, গোলাপী ফুল ফোটে। উভলিঙ্গ এই গাছের জন্ম এই দ্বীপের বয়সের দ্বিগুণ আগে বলে গবেষকদের ধারণা। ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এদের বংশবিস্তারের অনুকূল। এই উদ্ভিদগুলোর অদ্ভুত গড়নই এই দ্বীপকে ভিনগ্রহীদের দ্বীপ হিসেবে আখ্যায়িত করার মূল কারণ।

ডেন্ড্রোসসিয়াস; Source: pinterest

এছাড়াও রয়েছে পোমেগ্র্যানেট নামক ফুলেল উদ্ভিদ। এটি আড়াই থেকে চার ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে সাধারণত ফুল এবং ফল হয়। ফুলগুলো সাধারণত গোলাপি বা লালের কাছাকাছি রঙের হয় আর ফল পাকলে তা হলদে-সবুজ রঙ ধারণ করে। এই গাছের কাঠ খুব শক্ত হয় এবং ছোটখাট আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃতও হয়। এই গাছটি সুকাত্রার বিশেষ উদ্ভিদ হলেও হাওয়াইতে এর চাষের চেষ্টা চলছে।

কেমন এখানকার প্রাণিকুল?

মোট ৩১ প্রজাতির প্রাণির দেখা মিলবে এই দ্বীপে, যার ৯৪ শতাংশ অর্থাৎ ২৯টি প্রজাতিই স্থানীয়, যেগুলোর দেখা অন্য কোথাও মিলবে না। স্কিংস, পা-বিহীন টিকটিকি, নানা প্রকারের মাকড়শা এবং তিন প্রকারের বিশুদ্ধ পানির কাঁকড়ার দেখা মিলবে এ দ্বীপে। তাছাড়া রয়েছে বেশ কিছু প্রজাপতি। তবে স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে বাদুড় ছাড়া আর কোনো প্রাণের অস্তিত্ব মেলে নি।

সুকাত্রা দ্বীপের স্থানীয় প্রজাতির একটি মাছ; Source: pinterest

তবে প্রাণের বিকাশের ক্ষেত্রে দিনদিন ঘটছে পরিবর্তন। গত দুই হাজার বছরে মানুষের বসবাস সেভাবে না থাকলেও গড়ে উঠছে গত দুই শতাব্দীতে। এই যে বিস্ময়কর উদ্ভিদকুলের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো এখন আগেকার উদ্ভিদগুলোর প্রতিনিধিত্ব করলেও খুব বেশিদিন বাকি নেই এদের বিলুপ্ত হবার। বড় বড় কুমির ও টিকটিকির আবির্ভাব হয়েছে এবং স্থানীয় বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীগুলো বিলুপ্তির পথে।

সুকাত্রা দ্বীপের একটি পাখি; Source: worldfortravel.com

সুকাত্রায় কীভাবে জীবন চলে মানুষের?

সুকাত্রা দ্বীপপুঞ্জে এখন যারা বাস করেন সবাই মোটামুটি মাছ ধরে, পশুপালন করে এবং খেজুর চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। দ্বীপবাসীরা প্রধানত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এবং তারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও পালন করে থাকেন।

কীভাবে যাবেন এই দ্বীপ ভ্রমণে?

মৌসুমি আবহাওয়ার কারণে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই দ্বীপে কেউ আসতে পারে না। জাহাজে করে আরব সাগর দিয়ে যেতে পারেন বছরের অন্যান্য সময়ে। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক একটি বিমানবন্দর স্থাপন করা হয় এই সুকাত্রা দ্বীপে, যার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হয়েছে। দৈনিক আদেন প্রদেশ থেকে সা’না প্রদেশ পর্যন্ত ফ্লাইট যায় এবং মাঝখানে রায়ান-মুকাল্লা বিমানবন্দরে থামে। সুকাত্রা বিমানবন্দরটি এর প্রধান শহর থেকে ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।

সুকাত্রার রাস্তা; Source: travel-tour-island.com

সুকাত্রার অভ্যন্তরে গণপরিবহনের পরিমাণ খুবই নগণ্য। দুই-একটি মিনিবাসের দেখা মিলতে পারে। তাছাড়া আপনি চাইলে 4WD গাড়িও ভাড়া করতে পারেন। পরিবহন ব্যবস্থা নগণ্য হবার প্রধান কারণ এই এলাকার বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেম। গাড়ির অতিরিক্ত ব্যবহারে খুব বাজেভাবে ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ার আশংকা রয়েছে। তাই ভ্রমণের বেশিরভাগ সময় হয়তো আপনাকে পায়ে হেঁটেই চলতে হতে পারে।

ফিচার ইমেজ-incarabia.com

Related Articles