Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নীলকুরিঞ্জি: এক যুগ পর পর ফোটে যে ফুল

‘নীলকুরিঞ্জি’ নামের নীল রঙের এক এক অদ্ভুত ফুল ফোটে ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালায়। পর্বতমালাটিকে নীলকুরিঞ্জি ফুলের রাজ্যও বলা যায়। গোটা পর্বতের সারি ঢাকা পড়ে যায় এক আশ্চর্য নীল গালিচায়। এই ফুল প্রকৃতির এক বিস্ময়। সারা বছর তো নয়ই, এমনকি প্রতি বছরে কোনও বিশেষ সময়েও এই ফুল ফোটে না। এখানকার আদিবাসীদের কাছে এই ফুল শুভ বার্তার প্রতীক। এর বিজ্ঞানসম্মত নামটিও বেশ চমকপ্রদ, স্ট্রোবিল্যান্থেস কুনথিয়ানা।

প্রতি ১২ বছরে মাত্র একবার ফোটে এই ফুল! এক যুগ পর পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভারতের তামিলনাড়ু ও কেরালা রাজ্যের নীলগিরি পাহাড়ে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় নীলকুরিঞ্জি ফুলটি। সত্যিই অবাক করার মতো ব্যাপার, কীভাবে এই ফুল বছরের এই হিসেব কষে ফুটতে শুরু করে? নীলকুরিঞ্জি নামটি সর্বাধিক প্রচলিত নাম হলেও কখনো কখনো স্থানীয়রা এই ফুলকে কুরুঞ্জি বা কুরুঞ্জিও নামে অভিহিত করে থাকে। এই ফুল ফুটতে নির্দিষ্ট উচ্চতা ও বিশেষ জলবায়ুর প্রয়োজন।

নীলকুরিঞ্জি ফুলে ছেয়ে যাওয়া নীলগিরি পাহাড়; Source: sreestours.com

নীলকুরিঞ্জি ফুলের বৈশিষ্ট্য

কেউ হঠাৎ করে ফুলটিকে দেখলে এর তেমন কোনো বৈশিষ্ট্যই চোখে পড়বে না। অন্য আর কয়েকটি ফুলের মতোই জংলি কোনো ফুল পাহাড়ি জঙ্গলে ফুটে আছে বলে মনে হবে। ফুলটি দেখতে অনেকটা ঘণ্টার মতো। সাধারণত ফুলগুলো থোকায় থোকায় দলবদ্ধভাবে ফোটে। তাই আলাদাভাবে এই ফুল লোকজনকে খুব একটা আকর্ষণ করার কথা নয়। কিন্তু মাইলের পর মাইল যখন ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়, দেখে মনে হয়, কে যেন নীল-বেগুনি রঙের গালিচা পেতে দিয়েছে।

মাইলের পর মাইল নীল-বেগুনি রঙের গালিচা পেতে থাকা নীলকুরিঞ্জি ফুল; Source: keralatourism.org

প্রায় আগাছার মতোই এতগুলো বছর ফুলের গাছগুলো নিজের মতো করে বাঁচে-মরে; আবার নতুন করে পাতা জন্মায়, প্রকৃতির খেয়ালে নিজের মতো করেই বেড়ে উঠে। কিন্তু যেই ফুলের সময় আসে, অমনি বনের চেহারাটাই পাল্টাতে থাকে। মনে হয়, কে যেন তুলি দিয়ে নীল রঙের ক্যানভাসে ফুলগুলো পরপর এঁকে চলেছেন। কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত প্রতিনিয়ত রং বদলাতে থাকে এই ফুলের।

নীলকুরিঞ্জি ফুল; Source: Deccan Chronicle

ফুলের রঙের ক্রমিক এই পরিবর্তনটিও চোখে পড়ার মতো। কুড়ি থেকে ধীরে ধীরে এই ফুল যখন ফুটতে থাকে, তখন নীল থেকে নীলচে-বেগুনি ও সবশেষে ফিকে বেগুনি রং ধারণ করে এই ফুল। ফুলের এমন ঐশ্বরিক পরিবর্তন দেখার জন্য প্রতি বছর দেশ-বিদেশের পর্যটকদের ভিড় লেগে যায় এই উপত্যকায়। কিন্তু এমনই যার রাজকীয় আবির্ভাব, সেই ফুলের গাছগুলো কিন্তু নিতান্ত অনাদরেই বেঁচে থাকে।

নীলকুরিঞ্জি ফুল ফুটলে নীলগিরির বিস্তীর্ণ এলাকায় মৌমাছি সহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গের আধিক্য বহু গুণ বেড়ে যায়। উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এবং ভূবিজ্ঞানীদের মতে, নীলকুরিঞ্জির বৈচিত্রময় রং, মিষ্টি গন্ধ এবং ফুলে মধুর আধিক্য কীটপতঙ্গদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। ফলে মৌমাছিরা মধুর লোভে, অন্য পতঙ্গরা বংশবিস্তারের নেশায় এই ফুলের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়।

নীলকুরিঞ্জি ফুলের মধুর আকর্ষণে মৌমাছির দল ভিড় জমায়; Source: Sree’s Tours

কোন কোন অঞ্চলে দেখা মেলে এই ফুলের

তামিলনাড়ু ও কেরালা রাজ্যের আশেপাশের এই ফুলের আধিক্য দেখতে পাওয়া যায়। মুন্নার জেলার নীলগিরি পাহাড়েই সবচেয়ে বেশি ফোটে এই ফুল। শোনা যায়, নীলগিরি পাহাড়ের নামই হয়েছে এই ফুল থেকে৷ যখন এই ফুল ফোটে পাহাড়ের ঢালে ঢালে, তখন থাকে শুধু নীলেরই বাহার৷ ২০০৬ সালে এমনই নীল রঙের ফুলে ঢেকে গিয়েছিল নীলগিরি। ২০১৮ তে, এরপর ২০৩০ এ নীলগিরির বিস্তীর্ণ এলাকা ফের একবার ঢেকে যাবে নীলকুরিঞ্জি ফুলে।

শেষবার ২০০৬ তে তামিলনাড়ুর কোদাইকানালের পালনি পাহাড়ে রেকর্ড সংখ্যক নীলকুরিঞ্জি ফুটেছিল। টার্নাস ভ্যালি উপত্যকায় এই ফুলের চাদর মেলেছিল। আবার কেরালার মুন্নার থেকে কোদাইকানালের দিকে যেতে সড়কপথে কেরালা-তামিলনাড়ু সীমান্তের টপ স্টেশন নামক জায়গাটির প্রধান আকর্ষণই হলো নীলকুরিঞ্জি। যে বছর এই ফুল ফোটে, তখন আশেপাশের কোথাও তিল ধারণের জায়গা থাকে না৷

নীলকুরিঞ্জির ফুলের পসরা নিয়ে সাজানো কাদাভারি পার্বত্য অঞ্চলের ‘কুরিঞ্জিসালা স্যাংচুয়ারি’; Source: keralatourism.org

তামিলনাড়ুর ক্লাভরাই এবং কেরালার কোভিলুরের মাঝখানের পার্বত্য অঞ্চলটিও এই ফুলের জন্য পরিচিত। নীলকুরিঞ্জির জন্যই পর্যটন মানচিত্রে বিশেষ জায়গা করেছে কাদাভারি পার্বত্য অঞ্চল। এমন কয়েকটি অঞ্চল নিয়েই গড়ে উঠেছে ‘কুরিঞ্জিসালা স্যাংচুয়ারি’। এছাড়া মুন্নার থেকে ৩৬ কি.মি. দূরে কোচি-মাদুরাই হাইওয়ের লাগোয়া পাহাড়ের কোলে ২০০৮ সালে ফুটেছিল নীলকুরিঞ্জি।

আবার ২০২০ সালে এই ফুল ফুটবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া আরো কয়েকটি অঞ্চলে এই ফুল ফুটলেও সবসময় এর হিসেব রাখা সম্ভব হয় না। আর তাই নীল আকাশ, সবুজ পাহাড় আর এর মাঝে নীলকুরিঞ্জি ফুলের কার্পেট, অনেক সময় অনেক ভ্রমণপিপাসুদের কাছেই অধরা থেকে যায়।

নীলকুরিঞ্জি ফুলের বৈচিত্রময় প্রজাতি

প্রায় ৫০০ এর অধিক প্রজাতির হয়ে থাকে নীলকুরিঞ্জি ফুল। শুধু এশিয়াতেই ২৫০ এর অধিক প্রজাতির দেখা মেলে। এর মধ্যে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ৪৬টির মতো প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। ১,৩০০ থেকে ২,৪০০ মিটার উচ্চতার পাহাড়ই এই ফুল ফোটার আদর্শ স্থান বলে প্রকৃতিবিদরা মনে করে থাকেন। অবশ্য আবহাওয়া ঠিকমতো পেলে এর চেয়ে একটু কম উচ্চতাতেও এই গাছ দিব্যি বেঁচে থাকে। অনেক রকম প্রজাতির হয় বলে ফুল ফোটার ধরনটাও বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। গাছগুলোর দৈর্ঘ্য শ্রেণীভেদে কখনো ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটারের মতো, কখনো আট থেকে দশ ফুট উচ্চতারও হয়ে থাকে।

বিভিন্ন প্রজাতির নীলকুরিঞ্জি ফুল; Source: Deccan Chronicle

ফুল ফোটার প্রকৃত সময়

প্রায় প্রজাতির ক্ষেত্রে এই ফুল ফোটে প্রতি ১২ বছরে মাত্র একবার। কিন্তু কয়েকটি প্রজাতির ক্ষেত্রে এর ভিন্নতাও দেখা যায়। কয়েকটি প্রজাতির বেলায় এই ফুল ফুটতে ১৬ বছরও সময় লেগে যায়। ১২ বছর পর পর এই ফুল ফুটলেও ওই বছরের যেকোনো সময়ই কিন্তু এই ফুলের দেখা পাওয়া যায়। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় একবার মাত্র নীলকুরিঞ্জি ফুল ফোটে। সাধারণত জুলাই থেকে ডিসেম্বর হলো এই ফুল ফোটার আদর্শ সময়। পিক সিজন হলো আগস্ট থেকে অক্টোবর। তখন গাড়োয়ালের ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সকেও হার মানায় এই ফুলের উপত্যকা।

নীলকুরিঞ্জি ফুলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পর্যটন শিল্প

নীলগিরি ও তার আশেপাশের অঞ্চল বরাবরই পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র। নীলগিরির প্রায় ৩২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্রতি ১২ বছরে এক বার নীল রঙের ফুলে ঢেকে যায়। আর এই ফুলের টানেই দেশ-বিদেশের বহু পর্যটকের সমাগম ঘটে এই এলাকায়।

পর্যটকরা এই ফুল দেখার সাথে সাথে নীলগিরি ও তার আশেপাশের প্রকৃতির মনোরম শোভা উপভোগ করার সুযোগ পান। এই সময়ে ভ্রমণকারীদের জন্য বিশেষ ট্রেকিংয়েরও ব্যবস্থা করা হয়। আবার কেউ কেউ নীলকুরিঞ্জির পোস্টাল স্ট্যাম্প সংগ্রহ করেন স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখার জন্য। ছবি তোলার এক আদর্শ স্থান নীলকুরিঞ্জি ফুলে ঘেরা এই নীলগিরি পর্বতমালা।

এই ফুল ফুটলে বছরের একটা বিশেষ সময়ে এই ফুল দেখতে দেশ বিদেশের বহু পর্যটকদের সমাগম ঘটে; Source: Metro Vaartha

ফুল, প্রকৃতি, রোমাঞ্চ সব মিলিয়ে তামিলনাড়ু ও কেরালার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল যখন সেজে ওঠে নীলের চাদরে, তখন প্রকৃতির এই অদ্ভুত সৌন্দর্য একবার দেখে আসতে পারেন যে কেউই।

ফিচার ইমেজ: keralatourism.org

Related Articles