Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আরতেমিস মন্দির: বারবার বিধ্বস্ত হওয়া ছিল যার নিয়তি

কিন্তু যখন আরতেমিসকে দেখলাম তখন মনে হয় বাকি সবকিছু ছায়ায় ঢেকে গেল, ঘোলা হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল আরতেমিস সূর্য হয়ে শুধুমাত্র নিজের ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ করছে।

প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত কবি অ্যান্টিপেটার অব সিডোন এভাবেই প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত আরতেমিসের বর্ণনা দেন। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে নির্মিত এই মন্দিরকে আরতেমিসিয়ামও বলা হয়। প্রথমবার আরতেমিস তৈরি হয় খিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দে। তবে প্রথমটি সম্পর্কে বেশি একটা তথ্য পাওয়া যায় না। পরের মন্দিরগুলো সম্পর্কেই শুধু জানা যায়। তবে প্রথমটিও যে বাকি মন্দিরগুলোর মতো দেবী আরতেমিসের জন্যই তৈরি সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত এশিয়া মাইনর তথা তুরস্কের প্রাচীন ও বিশাল এক শহর ইফেসাসে অবস্থিত উক্ত আরতেমিস মন্দিরটি। এই বিরাট মন্দিরটি তৎকালীন লিডিয়ার সম্রাট ক্রোয়েসাস নির্মাণ করেন। জায়গাটি মূলত বন্যায় বিধ্বস্ত হওয়া একটি জমি ছিল। আরতেমিস বিশ্বের প্রথম মার্বেলের তৈরি মন্দির। সপ্তাশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত মন্দিরটির ব্যাপারে একটি অদ্ভুত বিষয় হলো এটি গত দশ শতকে সাতবার বিভিন্ন কারণে বিধ্বস্ত হয়।

মানচিত্রে আরতেমিস মন্দিরের অবস্থান; Image source: edu.glogster.com

কার জন্য এবং কিভাবে হলো এই মন্দির?

তুরস্কের এই মন্দির তৈরি করা হয় দেবী আরতেমিসের জন্য। ইফেসাসের পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকে গ্রিকদের বসতি ছিল, যার কারণে আশেপাশের লোকজন এই দেবীর প্রতি বিশ্বাসী হতে থাকে। গ্রিক দেবী আরতেমিস ইফেসাসবাসীর কাছেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কেননা দেবীর জন্মস্থান ছিল ইফেসাসের কাছাকাছি দ্বীপ অর্টিগিয়ায়। তিনি ছিলেন সকল দেবদের রাজা জিউস ও লেটোর মেয়ে এবং দেব অ্যাপোলোর যমজ বোন। তিনি ছিলেন একাধারে শিকার, চন্দ্র, সতীত্ব, প্রসবাবস্থা এবং প্রকৃতির দেবী।

দেবী আরতেমিস; Image source: elainemansfield.com

ইফেসাসের তার পার্শ্ববর্তী দেশ লিডিয়ার সাথে কখনও ভালো, কখনও বা খারাপ সম্পর্ক ছিল। তবে তাদের মধ্যে সাদৃশ্যের বাঁধন ছিল সংস্কৃতির দিক থেকে। এরই দরুণ লিডিয়ার সম্রাট ক্রোয়েসাস যখন ইফেসাস জয় করে নেন, তখন তিনি নতুন করে দেবী আরতেমিসকে উৎসর্গ করার জন্য মন্দিরের আরও কিছু ভবন নির্মাণের আদেশ দেন। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাসের মতে, ক্রোয়েসাস শুধুমাত্র কিছু স্তম্ভ দান করেছেন। এমনকি এই আরতেমিসের কিছু কিছু স্তম্ভে লেখা আছে “আরতেমিস কর্তৃক নিবেদিত”।

লিডিয়ার সম্রাট ক্রোয়েসাস;Image source: aclassicaday.blogspot.com

ভাগ্যের পরিহাসে মন্দিরের মতো পবিত্র স্থানটি কয়েকবার ধ্বংস হয়, আবার কয়েকবার নতুন করে গড়েও ওঠে। তবে ইফেসাসবাসীর আসলে সবচাইতে আগে তৈরি মন্দিরটির প্রতিই বেশি বিশ্বাস ছিল। যার কারণে তারা ১২৪৩ মিটার দড়ি দিয়ে পুরোনো মন্দিরটি এবং শহরটির মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপন করে। তাদের বিশ্বাস ছিল এই সংযোগের কারণেই লিডিয়াবাসী কিংবা অন্য কোনো শত্রু তাদের আক্রমণ করতে পারবে না।

আরতেমিস মন্দির

আরতেমিসের বাহ্যিক তথ্য বেশিরভাগ পাওয়া যায় পর্যটক প্লিনির কাছ থেকে। তিনি তার “সেভেন ওয়ান্ডার্স অফ দ্য অ্যানসিয়েন্ট ওয়ার্ল্ড” বইটিতে আরতেমিস মন্দির এবং আরও বাকি ছয়টি আশ্চর্যের বিবরণ দেন। প্লিনি দ্য এল্ডারের তথ্য মোতাবেক, মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৩৭৭ ফুট (১১৪.৯১৫ মিটার) এবং প্রস্থ ২২৫ ফুট (৫৪.৮৬৪ মিটার)। এটি খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে তৈরি এথেন্সের পার্থেনোন থেকেও বড়। আরতেমিস দেখতে অনেকটা ফুটবল খেলার মাঠের মতো এবং প্রায় পুরোটা মার্বেলের তৈরি।

শিল্পীর কল্পনায় আরতেমিস মন্দির;Image source: thoughtco.com

মন্দিরটিতে ১২৭টি স্তম্ভ রয়েছে, যেগুলোর প্রত্যেকটি ৬০ ফুট লম্বা। আরতেমিসের ভেতরে রয়েছে সুন্দর সুন্দর চিত্রশিল্প। বিখ্যাত গ্রিক ভাস্করদের তৈরি অসাধারণ ভাস্কর্য, চিত্র এবং স্বর্ণ ও রূপা দিয়ে সজ্জিত স্তম্ভসমূহ দিয়ে ভরা সমগ্র মন্দিরটি। এর বহির্ভাগের স্তম্ভগুলোতে গ্রিক পুরাণের চরিত্রগুলো চিত্রিত রয়েছে।

আরতেমিস ও হিরোস্ট্র্যাটাস

খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ শতাব্দীতে হিরোস্ট্র্যাটাস নামক একজন ব্যক্তির কারণে পুড়ে যায় মন্দিরটি। আরতেমিস পুনর্নির্মাণ করা হলেও আরও ছয়বার বিনষ্ট করা হয়। তবুও এই পুনর্নির্মাণের কাজ চলে বেশ কয়েকবার। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো মন্দিরে হিরোস্ট্র্যাটাসের আগুন লাগানোর ঘটনাটি।

কথিত আছে, হিরোস্ট্র্যাটাস এই কাজটি কোনো প্রতিশোধ নয়, বরং শুধুমাত্র খ্যাতি অর্জন ও নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্যই করেছিল। তার এই ধরনের কাজ নতুন একটি পরিভাষা ‘হিরোস্ট্র্যাটিক ফেম’ এর সৃষ্টি করে, যার অর্থ ধ্বংসাত্মক উপায়ে খ্যাতি অর্জন করা বা এর চেষ্টা করা। আরতেমিস মন্দিরে যে রাতে আগুন লাগানো হয় সেই রাতেই জন্ম হয় আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের। বলা হয়, দেবী আরতেমিস আলেকজান্ডারের জন্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করানোর জন্য এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, নিজের মন্দিরকেই বাঁচাতে ব্যর্থ হন।

হিরোস্ট্র্যাটাসকে ইরোস্ট্র্যাটাসও বলা হয়। হিরোস্ট্র্যাটাস আগে থেকেই জানতো যে, মার্বেলের তৈরি মন্দিরটির সে বড় কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তবে তার মতে, সে যদি সেই মন্দিরের আসবাবপত্রেরও ক্ষতি করতে পারে, তাহলে তা-ও তার জন্য হবে এক বিশাল অর্জন। তার মধ্যে নিজের শক্তি প্রদর্শনের আসক্তি ছিল অনেক বেশি, যার জন্য সে আরতেমিস মন্দিরে আগুন লাগানোর পরেও সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে এবং এই কাজের জন্য গর্ব করে সবার সামনে নিজের প্রশংসা করতে থাকে। 

পরবর্তীতে সে মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাকে শুধু শাস্তিই নয়, বরং খ্যাতি অর্জনের যে আশা ছিল তা নিষ্পত্তি করার জন্য একটি আইন পাশ করা হয়, যে মোতাবেক তার নামই দেশে কেউ বলতে পারবে না। তবে এতকিছুর পরও তার ইচ্ছেটা পূরণ হয়েই গেছে। শুধু ইফেসাসবাসী নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব এখনও তার নাম মনে রেখেছে।

আরতেমিস মন্দিরের একাংশ;Image source:telegraph.co.uk

পরবর্তী সময়ে আরতেমিস মন্দির

আলেকজান্ডার পরবর্তীতে বিধ্বস্ত আরতেমিস পুনর্নির্মাণের অর্থ বহন করতে চাইলেও ইফেসাসবাসী তা কখনই গ্রহণ করেনি। যদিও ধ্বংসের পরপরই নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে যায়, তবে তা শেষ হতে সময় লেগে যায়। গ্রিক সাহিত্যিক স্ট্রাবো এ সম্পর্কে বলেন, “তারা (ইফেসাসবাসী) বলে, একজন দেবতার উপাসনালয়ের জন্য টাকা অপর দেবতার কাছ থেকে নেওয়া যাবে না।” পরে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে এই কাজ সম্পন্ন করে।

আরতেমিস মন্দির ঘুরে দেখছে পর্যটকেরা;Image source: worldsincredible.blogspot.com

আরতেমিস মন্দির মূলত জলাভূমিবিশিষ্ট জায়গায় অবস্থিত এবং ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তবুও ২৬২ খ্রিস্টাব্দে রহস্যজনকভাবে এখানে ভূমিকম্প হয়। অনবরত খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারের কারণে ইফেসাসে আরতেমিস দেবীর প্রতি বিশ্বাস কমে যায় এবং এরই ভাবধারায় ২৬৮ সালে কিছু বর্বর ব্যক্তি আবারও পুড়িয়ে দেয় এই মন্দিরটি।

৩৯১ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট থিওডোসিয়াস মন্দিরটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেন, যখন তিনি খ্রিস্টানকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে শেষবারের মতো আরতেমিস মন্দির ধ্বংস করা হয় ৪০১ খ্রিস্টাব্দে। ধর্ম নিয়ে সৃষ্ট দাঙ্গা-ফ্যাসাদের জেরে এই ঘটনা ঘটে। এই সময় থেকে ইফেসাসও বিলুপ্ত হতে থাকে। অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং সেখানে জীবিকা নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। পরিত্যক্ত এই স্থান থেকে অনেক কিছু চুরি হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায় কিংবা মাটি চাপা পড়ে। ১৮৬৯ সালে প্রথমবারের মতো জন টারটল উড এই মন্দিরের অস্তিত্ব খুঁজে পান।

ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক কিংবা সামাজিক- সকল প্রেক্ষাপট থেকে আরতেমিস মন্দির ইফেসাস শহরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ছিল। শত শত বছর আগের রহস্যঘেরা মন্দিরটির অনেক কিছু অজানা রয়ে গেলেও কমপক্ষে এর অবস্থান নিয়ে কোনো রহস্য নেই।

ফিচার ইমেজ: youtube.com

Related Articles