Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সেন্তোসা: ট্রাম্প-কিম বৈঠকের সাক্ষী যে দ্বীপ

সম্প্রতি, ১২ই জুন, ২০১৮ তারিখে সমগ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং উন তাদের ঐতিহাসিক বৈঠক সম্পন্ন করে। বিস্ময়কর এবং শক্তিশালী এই দুই নেতার আচমকা বন্ধুসুলভ আচরণ ও বিশ্বশান্তির তাগিদে বৈঠক করার ব্যাপারটা বিশ্ববাসীকে বেশ স্তম্ভিত করে। উক্ত বৈঠকটি সিঙ্গাপুরের সেন্তোসা দ্বীপে সংগঠিত হয়।

এখন কথা হলো- এই দুই বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারী নেতাদের বৈঠক যেখানে হলো, তা কি বিশেষ না হয়ে পারে? আজকে তাহলে এই সেন্তোসা দ্বীপ সম্পর্কে একটু জানা যাক।

সেন্তোসা সিঙ্গাপুরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ রিসোর্ট, যা সড়কপথে ভিভো সিটির সাথে সংযুক্ত এবং এখানে প্রতি বছর ২০ মিলিয়ন পর্যটকের সমাগম ঘটে। ২ বর্গ মাইলের এই ছোট দ্বীপে স্থায়ী বাসিন্দা রয়েছে প্রায় ১,৬৯০ জন। এটা মূলত মনুষ্যনির্মিত দ্বীপ, যা আনন্দ ও বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়। সেন্তোসা দ্বীপে রয়েছে সিলোসো দুর্গ, দুটি গলফ কোর্স, দ্য মার্লিয়ন, ১৪টি হোটেল, ক্যাসিনো, ইউনিভার্সাল স্টুডিওস সিঙ্গাপুর নামক থিম পার্ক, পৃথিবীর অন্যতম জলজ প্রাণীদের সংগ্রহ ‘সিইএ অ্যাকুরিয়াম’, মাদাম তুসোর একটি শাখা, ১১০ মিটারের একটি টাওয়ার, একটি বাটারফ্লাই পার্ক এবং আরও চোখধাঁধানো অনেক কিছু।

সেন্তোসা দ্বীপ; Image source: outgotrip.com

সেন্তোসা শব্দটি মূলত মালয় ভাষার, যার অর্থ হলো ‘সন্ধি ও শান্তি’। বর্তমানে এই দ্বীপটি তার অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা ও শান্তিতে কিছু সময় কাটানোর উপযুক্ত স্থান হলেও অতীতে এর একটি কালো অধ্যায় ছিল। অতীতের বিভিন্ন সময়ে দ্বীপটিতে চলে মৃত্যুর খেলা। দ্বীপটির নাম পূর্বে ছিল ‘পুলাউ ব্লাক্যাঙ মাটি’। মালয় ভাষায় উল্লেখিত অংশটির অর্থ ‘মৃত্যুর দ্বীপ’। ইংরেজিতে দ্বীপটি ‘আইল্যান্ড অফ ডেথ ফ্রম বিহাইন্ড’, ‘ডেড ব্যাক’, ‘বিহাইন্ড দ্য ডেথ’, ‘ডেড আইল্যান্ড’, ‘আইল্যান্ড অফ আফটার ডেথ’ নামেও পরিচিত। এখানে ‘ব্লাক্যাঙ’ (Blakang) মানে পেছনে এবং ‘মাটি’ (Mati) মানে মৃত্যু।

দ্বীপটিকে এরকম অশুভ একটি নাম দেওয়ার কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত রয়েছে। সিঙ্গাপুরের জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে এসকল তথ্য জানা যায়।

একটি মতানুসারে উক্ত নামের কারণ হতে পারে দ্বীপটিতে পূর্বে ঘটে যাওয়া হত্যা ও জলদস্যুতা। আবার আরেক তথ্যানুসারে এর কারণ হতে পারে বিভিন্ন যুদ্ধে শহিদ হওয়া যোদ্ধাদের আত্মার সমাগম। আবার অন্য এক ব্যাখ্যা অনুসারে, ১৮৪০ সালে দ্বীপটিতে মহামারী আকারে ছড়িয়ে যাওয়া কোনো রোগের দরুন সেখানে অনেক মানুষ মারা যায় এবং এর ফলে দ্বীপটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। একজন ব্রিটিশ শবপরীক্ষক জলাবদ্ধতা এবং গাছপালার অভাবকে এই মৃত্যুর কারণ হিসেবে ব্যক্ত করেন। উল্লেখিত যুক্তিটি সেই সময় অনেক তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি করলেও ১৮৯৮ সালে এই সমস্যার জট খুলতে সক্ষম হন গবেষকেরা এবং সাধারণ জনগণ জানতে পারে এর মূল কারণ। আর তা ছিল- ম্যালেরিয়া রোগ। এই রোগ সম্পর্কে সেই সময়ে সবার জানা ছিল না বলেই তা প্রতিকার বা প্রতিরোধ কিছুই সম্ভব হয়নি। ম্যালেরিয়া রোগের প্রথম গবেষণাকেন্দ্র উক্ত সেন্তোসা দ্বীপেই নির্মিত হয়। ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ও ভয়াবহতা বোঝানোর জন্যই এই অকল্যাণকর নাম দেওয়া হয় বলে অনেকে মনে করে থাকেন।
এমনকি একজন ব্রিটিশ আর্মি ক্যাপ্টেন ১৮২৭ সালে সেন্তোসায় থাকাকালে এই দ্বীপের নাম ‘সেন্ট জর্জ‘ রাখার আহ্বান জানান। তার বক্তব্যানুসারে, দ্বীপটি ছিল অস্বাস্থ্যকর, জলাবদ্ধ এবং বসবাস অনুপযোগী একটি ভূখণ্ড। তবে নামকরণের তার এই প্রস্তাবটি কখনও স্বীকৃতি পায়নি। যদিও দ্বীপটি ছিল বসবাসের অযোগ্য, তবে তা সিঙ্গাপুরকে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সর্বদাই সাহায্য করেছে। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রতিরক্ষামূলক দুর্গ, চারটি আত্মরক্ষামূলক কাঠামো নির্মাণ করা হয়, যার মধ্য থেকে ‘সিলোসো’ দুর্গই এখন পর্যন্ত অক্ষত আছে।

‘সিলোসো’ দূর্গ; Image source: readabouttravel.blogspot.com

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দ্বীপকে সমুদ্রপথে জাপানের আক্রমণ থেকে সিঙ্গাপুরকে রক্ষা করার প্রধান দুর্গ ছিল। কিন্তু ১৯৪২ সালে আক্রমণাত্মক জাপান মালয়েশিয়া ও নিরপেক্ষ থাইল্যান্ড জয় করে অন্য পথে সিঙ্গাপুর দখল করেই ফেলে। এরপর ‘সেন্তোসা’ দ্বীপকে জাপানিজ সৈনিকেরা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘাঁটিতে পরিণত করে, যেখানে তারা হাজার হাজার চীন অধিবাসীদের ‘ক্লিনজিং অপারেশন’ এর নামে হত্যা করে। সৈনিকেরা আঠার থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সী চাইনিজ পুরুষদেরকে জেরা করে এবং যাদেরকে তারা জাপানিজ মনে করে না, তাদেরকে হত্যা করা হয়। এছাড়াও মিত্রবাহিনীর ৪০০ জন সৈনিককে আটক করে রাখা হয় এবং পরবর্তীতে অধিকাংশকেই হত্যা করা হয়। এই নিষ্ঠুরতা ও হত্যাযজ্ঞের জন্যও দ্বীপের নাম ‘সেন্তোসা’ হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
চতুর্থ ব্যাখ্যানুসারে, দ্বীপে উর্বর মাটির অভাবের কারণেই এই দ্বীপকে ‘ডেড আইল্যান্ড’ বলা হয়। যদিও এ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে, তবুও অনেকের এই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার ছিল, যার দরুন দ্বীপের নাম এরকম হয়েছে।
১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ সরকার সিঙ্গাপুরকে সেন্তোসা দ্বীপ হস্তান্তর করে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই দ্বীপকে নৌবাহিনীর মেডিকেল সেন্টার ও উপকূলবর্তী প্রশিক্ষণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুর সরকার একে রিসোর্টে পরিণত করার জন্য পুনঃসংস্কার করা শুরু করে। ১৯৭২ সালে এর নাম ‘সেন্তোসা’ দেওয়া হয়, যার অর্থ ‘সন্ধি ও শান্তি’।
সেন্তোসা দ্বীপের অতীতে কালো অধ্যায় থাকলেও এখন শুধু আছে ঘোরার অসাধারণ কিছু পর্যটন স্থান। এর মধ্যে তিনটি অতি পরিচিত আকর্ষণীয় স্থানের বর্ণনা দেওয়া হলো।

১) ইউনিভার্সাল স্টুডিওস সিঙ্গাপুর

ইউনিভার্সাল স্টুডিওস সিঙ্গাপুর’এশিয়ার অন্যতম পরিচিত এবং অসাধারণ একটি থিম পার্ক। এর ভেতরে ২৪টি রাইড আছে, এর মধ্যে ১৮টি রাইড বিশেষভাবে এই পার্কের জন্যই নির্মাণ করা হয়েছে।

ইউনিভার্সাল স্টুডিও সিঙ্গাপুর; Image source: klook.com

পার্কে সাতটি থিম জোন রয়েছে। জোনগুলো হল- হলিউড জোন ( Hollywood zone), নিউ ইয়র্ক জোন (New York Zone), সাই-ফাই জোন (Sci-fi Zone), প্রাচীন মিশর (Ancient Egypt Zone), দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড (The Lost World), ফার ফার অ্যাওয়ে (Far Far Away), মাদাগাস্কার (Madagascar)

হলিউড জোন; Image source: selventhiran.com

ভিন্নধর্মী এই থিম পার্কের সাতটি জোনের বিষয়টি সবার কাছেই বেশ মজাদার। এই পার্কটি প্রতি বছর দুই মিলিয়ন পর্যটককে সেন্তোসা দ্বীপে আসতে আকৃষ্ট করে।

২) সিইএ অ্যাকুরিয়াম

সিইএ (S.E.A.) অ্যাকুরিয়ামের পুরো নাম সাউথ-ইস্ট এশিয়া অ্যাকুরিয়াম। একে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অ্যাকুরিয়াম বলা হয়। এখানে মোট ৪৫ মিলিয়ন লিটার পানি আছে এবং এতে ৮০০ প্রজাতির প্রায় এক লক্ষ সামুদ্রিক জীবের বসবাস।

পৃথিবীর বৃহত্তম অ্যাকুরিয়াম; Image source: rwsentosa

আর এটি পরিদর্শনের জন্য রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্যানেল, যার দৈর্ঘ্য ৮.৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩৬ মিটার। এর মধ্যে আছে- বঙ্গোপসাগরের এবং আন্দামান সাগর ও মালাক্কা প্রণালীর মাছ, সমুদ্রগর্ভের প্রবালপ্রাচীর ইত্যাদি।

৩) দ্য মার্লিয়ন

মার্লিয়ন সিঙ্গাপুরের আদর্শের বর্ণনাকারী মূর্তি। মূর্তির মাথা সিংহের ন্যায় এবং দেহ মাছের মতো। এটি সিঙ্গাপুরের ইতিহাস বর্ণনা করে।

দ্য মার্লিয়ন; Image source: goodyfeed.com

‘সিঙ্গাপুরা’ অর্থ ‘সিংহের শহর‘, যা মাথার অংশ দিয়ে বোঝানো হয় এবং মূর্তির বাকি অংশ দ্বারা মৎস্যজীবীদের গ্রাম ‘তেমাসেক’-এ ঘটে যাওয়া বিবর্তনকে ব্যক্ত করে। ৮.৬ মিটার উচ্চতার মূর্তিটি শহরটির, বিশেষ করে রাতের বেলার অসাধারণ একটি চিত্র তুলে ধরে।

সেন্তোসা দ্বীপকে এতদিন তার কালো অধ্যায় কিংবা অপরূপ সুন্দর পর্যটন স্থান হিসেবে আমাদের সকলের নিকট পরিচিত হয়ে থাকলেও আগামী প্রজন্ম একে ট্রাম্প-কিমের ঐতিহাসিক বৈঠক হিসেবেই বেশি চিনবে বলে মনে হচ্ছে।

ফিচার ইমেজ: tour.issatistravel.com

Related Articles