Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বের কয়েকটি ব্যস্ততম দুর্গম রাস্তা

পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে এমন কিছু রাস্তা যা এক কথায় বেশ দুর্গম এবং বিপদজনক। তারপরও সেসব রাস্তা দিয়ে যাত্রী বোঝাই গাড়ি প্রতিদিন চলাচল করছে। রাস্তাগুলোর প্রতি পদে ওঁৎ পেতে থাকে কত শত বিপদ! প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা দুর্ঘটনাও। পাহাড়, জঙ্গল, মরুভূমি, বরফ, গিরিখাদের ভিতর দিয়ে এসব দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়েছে এক শহর থেকে অন্য শহরে। তেমনি কয়েকটি দুর্গম ব্যস্ততম রাস্তার খোঁজ দিচ্ছি আজ।

বলিভিয়ার নর্থ ইয়ংগাস রোড

পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম রাস্তা রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়াতে। এই দুর্গম রাস্তাটির নাম ‘ডেথ রোড অফ বলিভিয়া’। দেশটির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দুর্গম সব পাহাড়-পর্বত। এর মাঝেই রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার অংশ। সমতল ভূমিতেই অবস্থিত মূল শহরটি। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী রাস্তা তৈরি কর হয়েছে পাহাড় কেটে কেটে। তাই এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে হলে এই পাহাড় কাটা রাস্তাই একমাত্র ভরসা। ঠিক তেমনই এক রাস্তা হলো নর্থ ইয়ংগাস রোড। ইয়ংগাস হলো এক ধরনের পাহাড়ি বন বা জঙ্গল। অবাক করা ব্যাপার হলো পাহাড়ের বিভিন্ন উচ্চতায় এর নামের ভিন্নতা।

দুর্গম বলিভিয়ার নর্থ ইয়ংগাস রোড। ছবিসূত্রঃ lamcanh.vn

আন্দিজ পাহাড়ের পূর্ব দিকে অবস্থিত পেরু এবং বলিভিয়াতে এই ধরনের বন দেখা যায়। মূলত সেই বনের নাম থেকেই এই রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে নর্থ ইয়ংগাস রোড। বলিভিয়াতে অবস্থিত লা পাজ একটি শহর। প্রায় নব্বই বছর আগে এই শহরটিকে কোরাইকো নামের আরেকটি শহরের সাথে জুড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল এই ইয়ংগাস রোডটি।

ছবিসূত্রঃ slate.com

১৯৩০ সালে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র প্যারাগুয়ের সঙ্গে যুদ্ধ চলছিল বলিভিয়ার। এই যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল প্যারাগুয়ের অনেক সেনা। ঐ বন্দী সেনাদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল এই রাস্তাটি। বিখ্যাত ‘টিনটিন অ্যান্ড দ্য ব্রোকেন অ্যারো’ কমিকস এই যুদ্ধের পটভূমিকাতেই রচিত। এই ইয়ংগাস রোডকে অ্যার্জে ব্যবহার করেছিলেন কমিকসে টিনটিনকে গাড়িতে তাড়া করার ছবির অংশে। এই দুর্গম রাস্তাটির ৭০ কিলোমিটার জুড়ে দু’পাশে মাঝে মাঝেই একটি করে ক্রস পুঁতে রাখা আছে। এই ক্রসের অর্থ দাঁড়ায় ‘সেখানে কাউকে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ দিতে হয়েছে’। মাত্র দশ-এগারো ফুট চওড়া রাস্তাটির খোলা দিকটিতে নেই কোনো গার্ড রেলিং। দুর্ভাগ্যবশত যদি কেউ একবার গড়িয়ে নিচে পড়েই যায়, তবে তার নিশানা খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। বর্ষাকালে সৃষ্টি হয় সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির।

দুর্গম রাস্তাটির ৭০ কিলোমিটার জুড়ে দু’পাশে ক্রস পুঁতে রাখা আছে। ছবিসূত্রঃ slate.com

এখানে পাহাড়ে ধ্বস নামা যেন একটি সাধারণ ঘটনা। তখন যাত্রার ঝুঁকি আরও বেশি বেড়ে যায়। রাস্তা বা প্রকৃতির দৃশ্যমানতা শূন্যে নেমে আসে যখন পরিবেশ থাকে কুয়াশাছন্ন। সামনে যদি কোনো গাড়ি থাকে, তা-ও যেন দৃষ্টিগোচর হয় না। নুড়ি পাথরের রাস্তা যেন তখন ধূলোময় হয়ে থাকে। পাহাড়ি রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে যেন ওঁৎ পেতে থাকে বিপদজনক বাঁক। এই বিপদজনক বাঁকগুলোতে বছরে প্রায় তিনশোটির অধিক দুর্ঘটনা ঘটার রেকর্ড আছে। অবশ্য ২০০৬ সালে লা পাজ এবং কোরাইকো শহরের মধ্যে একটি নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে। নতুন রাস্তাটি তৈরি হওয়ার পর থেকেই নর্থ ইয়ংগাস রোডটি এখন আর ব্যবহার হয় না। তবে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় ট্যুরিস্টরা প্রতি বছর এখানে আসেন দুর্গমতাকে জয় করার আকাঙ্ক্ষায়।

বিপদজনক বাঁকগুলো পার হতে গাড়ির ড্রাইভারকে থাকতে হয় অনেক সচেতন। ছবিসূত্রঃ TripBeam Blog

নিউজিল্যান্ডের স্কিপার্স ক্যানিয়ন রোড

ক্রিকেট প্রেমিকেরা অবশ্যই কুইন্সল্যান্ড শহরটির নাম শুনে থাকবেন। এই কুইন্সল্যান্ড শহরটি অবস্থিত নিউজিল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমের দক্ষিণ আইসল্যান্ডে। শহরটির আরও কয়েক কিলোমিটার উত্তরে রয়েছে স্কিপার্স ক্যানিয়ন গিরিখাদটি। এই গিরিখাদটি এক সময় বিখ্যাত ছিল সোনার খনির জন্যে। প্রায় আজ থেকে দেড়শো বছর আগের কথা। এক দম্পতি এখানকার নদীর জলের স্রোতের নিচে চকচকে সোনার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন। তারা ব্যাপারটি তখন প্রতিবেশীদের সাথে শেয়ার করেন। আর তখন থেকেই লোকের মুখে এই কথা ছড়িয়ে যায় যে, এখানকার নদীর জলেই নাকি মিশে থাকে সোনা!

নিউজিল্যান্ডের স্কিপার্স ক্যানিয়ন রোডের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী। ছবিসূত্রঃ fella.com

লোকমুখে প্রচারিত কথা শুনে অনেকেই তখন ছুটে গেলো সেই শটওভার নদীর তীরে। চতুর্দিক থেকে যেন জনসমাবেশ বাড়তেই লাগলো। দূরদূরান্ত থেকে ঘোড়ার পিঠে চড়ে স্কিপার্স গিরিখাদ পেরিয়েও এলো হাজার হাজার লোক। এভাবে লোক চলাচল করতে করতে মানুষের পায়ের চলাচলের ছাপে স্কিপার্স গিরিখাদে তৈরি হলো ‘স্কিপার্স ক্যানিয়ন রোড’

নিউজিল্যান্ডের স্কিপার্স ক্যানিয়ন রোড। ছবিসূত্রঃ WeirdlyOdd.com

পাহাড়ের খাড়া ঢাল কেটে কেটে সোনার খোঁজে আসা পথচারীরাই তৈরি করলো সরু এই রাস্তা। তারপর একদিন সত্যি সত্যিই স্কিপার্স ক্যানিয়নে খোঁজ মিললো সোনার খনির। তখন মেশিনপত্তর নিয়ে গাড়ি যাওয়ার জন্য পথ কেটে আরও চওড়া করা হলো। এটা হলো ১৮৯০ সালের ঘটনা। বর্তমানে সোনার খনি যদিও নেই, তবুও রয়েছে পর্যটকদের ভীড়। রাস্তাটি হেরিটেজ রোডের মর্যাদা পেয়েছে নিউজিল্যান্ডের আইন মোতাবেক। দুর্গম পথ হওয়া সত্ত্বেও গাড়ি চালানো কিন্তু বন্ধ হয়ে যায়নি। দুর্ঘটনার হাতছানিময় এই রাস্তায় যদি কোনো গাড়ি দুর্ঘটনা কবলিত হয়, তার জন্যে কোনো বীমা কোম্পানি কোনোরূপ দায় নিতে চুক্তিবদ্ধ নয়।

হেরিটেজ রোডের মর্যাদা পাওয়া স্কিপার্স ক্যানিয়ন রোড। ছবিসূত্রঃ F1 Drives

প্রায় সাড়ে ছাব্বিশ কিলোমিটারের এই রাস্তাটিতে নেই কোনো গার্ড রেলিং সুরক্ষা ব্যবস্থা। পুরোটাই কাঁচা রাস্তা। পুরো রাস্তা পাথরের নুড়ি আর ধুলোয় ঢাকা। বর্ষাকালে হয় সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা। মুখোমুখি দুটো গাড়ি চলে গেলে রাস্তা এতোটাই সরু হয়ে পড়ে যে, একটি গাড়িকে না পিছিয়ে গিয়ে উপায় থাকে না।

স্কিপার্স ক্যানিয়নের গিরিখাদ, পাশে বিপদজনক সেই রাস্তা। ছবিসূত্রঃ Viral X Files

তাই এই রাস্তায় যেসব ড্রাইভার ড্রাইভ করেন তাদের খুবই চৌকস হতে হয় রিভার্স গিয়ারে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে বিষয়টি ঘটে তা হলো হঠাৎ করেই লম্বা একটি ঢালে পড়ে যাওয়া বা খাড়া উপরে ওঠা। অন্ধকার বা কুয়াশার মাঝে গাড়ি চালানো এই রাস্তায় বেশ বিপদজনক। স্কিপার্স রোডের মাঝে শটওভার নদীর উপরেই রয়েছে একটি ব্রীজ। এটি স্কিপার্স ব্রিজ নামেই বিখ্যাত।

চীনের সিচুয়ান-তিব্বত হাইওয়ে

সিচুয়ান বা শু প্রদেশ হলো চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। মূলত পান্ডার জন্যেই সিচুয়ান বিখ্যাত। ছেংড়ু হলো সিচুয়ানের রাজধানী। তিব্বত অবস্থিত সিচুয়ানের পশ্চিম দিকে। তিব্বতের বিখ্যাত বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাই লামার নাম সকলেরই জানা। লাসা হলো তিব্বতের রাজধানী।

চীনের সিচুয়ান-তিব্বত হাইওয়ে। ছবিসূত্রঃ glacierhub.org

হিমালয় পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এই দুটি শহরটিকে জুড়ে দিতে সাহায্য করেছে সিচুয়ান তিব্বত হাইওয়ে। এই হাইওয়ে এগিয়ে গিয়েছে ছেংড়ু থেকে লাসার দিকে ৪০০০-৫০০০ মিটার উচ্চতার ১৪টি পাহাড় এবং এক ডজন নদী পেরিয়ে। এই হাইওয়েটি তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯৫০ সালে এবং শেষ হয় ১৯৫৪ সালে। চীনের ৩১৮ নম্বর ‘ন্যাশনাল ট্রাঙ্ক হাইওয়ে’র শেষভাগ হলো সিচুয়ান তিব্বত হাইওয়ে, যা আসলে সাংহাই থেকে তিব্বত পর্যন্ত বিস্তৃত।

চীনের সিচুয়ান-তিব্বত হাইওয়ের মানচিত্র। ছবিসূত্রঃ gonzotrucker.com

প্রকৃতি অদ্ভুত মায়াময় হয়ে তার জাল ছড়িয়ে রেখেছে এই ২১৪২ কিলোমিটার লম্বা হাইওয়ের দু’পাশে। ছেংড়ু ছেড়ে হাইওয়ের দিকে যতই এগিয়ে যাওয়া যায়, ততই একে একে নানা রকম ঋতু এসে ধরা দেবে অভিযাত্রীদের কাছে। ছবির মতো দেখা মিলবে পাহাড়ি পথের ভাঁজে ভাঁজে বৌদ্ধ মঠগুলোর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য। সূর্যোদয় হয় পাহাড়ের এক দিক থেকে, আবার সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখা যায় পাহাড়ের অন্য দিকে বেখেয়ালি নদী দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে বয়ে চলেছে আপনমনে। এক পশলা বৃষ্টির পর হঠাৎ সাতরঙা রামধনু এক ঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। তারপর আসে হাঁটি হাঁটি পা পা করে শীত ঋতু। সবুজ পাহাড় ধীরে ধীরে রূপ নেবে ধূসর বর্ণের। দূরে উঁকি দিয়ে যায় বরফে ঢাকা পাহাড় চূড়া। তার গা বেয়ে নামে মিষ্টি রোদের ছোঁয়ায় বরফ গলা পানির স্রোত। তুষার আর বরফ গলা পানির পাশাপাশি অবস্থানের এ এক অপূর্ব সন্নিবেশ।

বরফ জমে গিয়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা এই রাস্তার। ছবিসূত্রঃ PagalParrot

পাহাড় বেয়ে গাড়ি যতই উপরে ওঠে, ঠাণ্ডা যেন ততই প্রকট হয়। যতই গাড়ি লাসার কাছাকাছি চলে আসে, ততই শুধু বরফ আর বরফ। এতসব মনভোলানো দৃশ্যের পাশাপাশি অবস্থান নেয় বিপদের হাতছানি। পাহাড়ি রাস্তায় হঠাৎ কুয়াশা, বরফ জমে গিয়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বৃষ্টির কারণে ধ্বসের সৃষ্টি- এমন সব ঘটনা এখানকার নিত্য সঙ্গী। এতসব প্রাকৃতিক দুর্যোগই এই হাইওয়েতে একটু অসতর্কতার কারণে ডেকে আনতে পারে মারাত্মক বিপদ, যা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনাই নয়।

ফিচার ইমেজঃ BMW Blog

Related Articles