Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিরসরাই থেকে সীতাকুণ্ডের পথ ধরে চোখ জুড়ানো কিছু ঝর্ণা

“ঝর্ণা! ঝর্ণা! সুন্দরী ঝর্ণা!
তরলিত চন্দ্রিকা! চন্দন – বর্ণা!
অঞ্চল সিঞ্চিত গৈরিকে স্বর্ণে,
গিরি – মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে
তনু ভরি’ যৌবন, তাপসী অপর্ণা!”

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো আরো বহু কবি ঝর্ণার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঝর্ণাকে নিয়ে কবিতা লিখে গেছেন, কাব্যিক ছন্দে ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্যের গুণগান গেয়ে গেছেন।

ভ্রমণ পিপাসুদের যেমন নদীর বহমানতা, সমুদ্রের উন্মত্ততা মুগ্ধ করে, ঝর্ণার প্রলয়ংকারী সৌন্দর্যও অদ্ভুত আকর্ষণে কাছে টানে। তাই তো নানা প্রতিকূলতা পেরিয়েও দীর্ঘ পথ হেঁটে, কখনো বা খাড়া পথ বেয়ে হলেও ভ্রমণ পিপাসুরা ঝর্ণার কোলে ছুটে যায়।

মিরসরাই থেকে সীতাকুণ্ডের পথ ধরে এগোনোর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমনই কিছু অপরূপ ঝর্ণা নিয়ে আজকের এই লেখা।

খৈয়াছড়া ঝর্ণা

মিরসরাইয়ের রাস্তা ধরে সীতাকুণ্ডের দিকে যেতেই পড়ে খৈয়াছড়া, মিরসরাইয়ের পাহাড়ে বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর দিকে এর অবস্থান। স্থানীয়দের মতে, আরো প্রায় ৪০-৫০ বছর আগে থেকেই এই ঝর্ণার অস্তিত্ব রয়েছে। এক পর্যটক দলের ঝর্ণায় গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০১০ সালে বারৈয়াঢালা থেকে বড়তাকিয়ার পাহাড়ের বিশ আল অংশকে সরকার জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। এতে খৈয়াছড়াও অন্তর্ভুক্ত হয়।

খৈয়াছড়া ঝর্ণা দেখতে যেতে হলে সরাসরি ঝর্ণা পর্যন্ত যানবাহনে করে যাবার উপায় নেই। মিরসরাইয়ে পৌঁছে যেকোনো স্থানীয় যানবাহনে বড়তাকিয়া, খৈয়াছড়া বললেই ঝর্ণায় যাবার পথের রাস্তায় নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে স্থানীয় সিএনজি-তে করে ঝর্ণার সবচেয়ে কাছাকাছি গ্রাম পর্যন্ত যাওয়া যায়।

এখানে পর্যটকদের সুবিধার জন্য রয়েছে কিছু দোকান-পাট। যাবার আগে সেখানে খাবারের অর্ডার দিয়ে যাওয়া যায়। এছাড়া ঝর্ণা থেকে ফিরে এসে জামা-কাপড় বদলানোর সুব্যবস্থা রয়েছে। ট্র্যাকিংয়ের জন্য দরকারি সরঞ্জামও পাওয়া যাবে (বাঁশ, অ্যাংক্লেট) । খৈয়াছড়া ঝর্ণার প্রথম দুটি ধাপ যাওয়ার পথ তুলনামূলক সহজ বাকি পথের তুলনায়। অনেক দূর হাঁটতে হবে, ট্র্যাকিংয়ের ঝামেলা নেই। বাকি ধাপগুলো যেতে চাইলে কখনো উঁচু-নিচু পথ বেয়ে নামতে হবে, কখনো রশি ধরে ঝুলে উঠা-নামা কিংবা এক পা ফেলার মতো সরু পথে পাথর ধরে ধরে পার হবার মতো রাস্তা অতিক্রম করে তবেই সবগুলো ধাপ দেখা সম্ভব।

সবগুলো ধাপ দেখতে চাইলে ঝর্ণার পথে হাঁটা শুরু করার আগেই নিচে জুতা রেখে আসা সুবিধাজনক। অ্যাংক্লেট পরে উঠলে ভালো গ্রিপ পাওয়া যায় পিচ্ছিল জায়গাগুলোতে। খৈয়াছড়া ঝর্ণার ঝিরিপথ একই পথ বরাবর। ঝর্ণার পানির স্রোত ধরে আগে পরপর সবগুলো ঝর্ণা পাওয়া যাবে একই পথে। তাই গাইড না নিলেও পথ হারানোর ভয় নেই। খৈয়াছড়া অপরূপ রূপ ধারণ করে বর্ষায়। সরু পথগুলো তখন পার হয়ে যাওয়া কিছুটা বিপদজনক, তাই অভিজ্ঞতা না থাকলে ভরা বর্ষায় না যাওয়াই ভালো। তবে শুকনো মৌসুমে যাওয়ার চেয়ে বর্ষার একদম শুরুতে কিংবা শেষে যাওয়া ভালো।

খৈয়াছড়ার মূল উৎস ঝর্ণা; source: Rafia Tamanna
খৈয়াছড়ার মূল উৎস ঝর্ণা; Photographer: Rafia Tamanna
খৈয়াছড়া; Source: wikimedia.org
পাহাড়ি পথ বেয়ে ওঠার সময় চারপাশের দৃশ্য; Photographer: Rafia Tamanna

নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা

নাপিত্তাছড়া ঝর্ণাও মিরসরাইয়ের পাহাড়ে অবস্থিত। এই পথের বড় ঝর্ণা ৩টি। ঝর্ণা তিনটিকে স্থানীয়রা কুপিকাটাখুম, মিঠাছড়ি এবং বান্দরখুম নামে ডাকে। ঝর্ণার ঝিরি বয়ে চলার রাস্তার নাম নাপিত্তাছড়া থেকেই এই নামটির প্রচলন বেশি হয়। নাপিত্তাছড়ার প্রথম দুটি ঝর্ণা মাঝারি আকারের, সবশেষের ঝর্ণাটি অনেক বড়। যাবার জন্য প্রথমে মিরসরাই থেকে নয়দুয়ারী বাজার আসতে হবে। এখানেও সবচেয়ে কাছের গ্রামের দোকানে খাওয়া দাওয়া, ব্যাগ রেখে যাওয়া এবং ট্র্যাকিংয়ের জন্য জরুরি সরঞ্জামাদির সুবিধা পাওয়া যাবে।

নাপিত্তাছড়ার তিনটি ঝর্ণার একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব খুব বেশি নয়। খুব অল্প সময়েই দেখে শেষ করা যায়। বর্ষায় বেশি পানি থাকলে এর সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায়। তবে তখন ঝর্ণার পানির নিচ পর্যন্ত যেতে হলে সাঁতার জানা প্রয়োজন। 

নাপিত্তাছড়ার কুপিকাটাখুম; Source: wikimwdia.org
নাপিত্তাছড়ার মিঠাছড়া ঝর্ণা; Source: Somoy TV
নাপিত্তাছড়ার বান্দরখুম ঝর্ণা; Source: wikimedia.org

কমলদহ ঝর্ণা

মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া কিংবা নাপিত্তাছড়া ঝর্ণার তুলনায় কম পরিচিত ট্রেইল হলো কমলদহের ট্রেইল। যেতে হলে মিরসরাইয়ের বড়দারোগাহাট নামতে হবে। রেললাইন ধরে গ্রামের পথ ধরে হাঁটলেই ঝিরিপথ খুঁজে পাওয়া যাবে। খুব পরিচিত না হওয়ায় সচরাচর ‘টুরিস্ট প্লেস’ এর মতো গড়ে ওঠেনি। তবে এটি বাকি দুটোর থেকে একটু অন্য ধাঁচের। এর ঝিরিপথ একই পথ ধরে না। একটি বড় ঝর্ণা ও তার উপঝর্ণাগুলো দেখে আবার পেছনে ফিরে আসতে হয়, এসে অন্য ঝর্ণার ঝিরিপথ ধরে এগোতে হয়। এখানে তাই স্থানীয় কোনো গাইড নিয়ে যাওয়া ভালো।

বড় কমলদহ, ছাগলকান্দা ও পাথরভাঙা ঝর্ণা অত্যধিক পরিচিত। কমলদহ ঝর্ণার সবচেয়ে অন্যরকম ব্যাপারটি হলো, বর্ষার সময়ে এবং অন্য সময়ে এর রূপ একদম অন্যরকম। এই ঝর্ণাগুলোয় দীর্ঘ ঝিরিপথ ধরে হেঁটে যেতে হয়, যেগুলো দুর্গম না, কিন্তু পথের দূরত্বটা বেশ। বর্ষাকালে ঝিরিপথের পানি বেড়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। পানির তোড়ে ভেসে যাবার অবস্থাও হয়। বেশ কিছু মানুষ একত্রে হাত ধরে স্রোতের জায়গাগুলো পার হতে হয়।

বর্ষার সময় বাঁশ নিয়ে যাওয়া আবশ্যক। বর্ষা ছাড়াও ঝর্ণাগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। রোদ থাকলে, ঝর্ণার পানিতে রংধনুর দেখা মেলে। আর ২-৩ দিন ক্রমাগত বৃষ্টি হবার পর গেলে ঝর্ণা যে অসাধারণ রূপ ধারণ করে অন্য সময়ে দেখা ঝর্ণার সাথে একে মেলানোই যায় না। এই ট্রেইলের ঝিরিপথ কিছুদূর পরপর দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, একদিকে কিছুক্ষণ গেলে আবার দুটো পথ, দুটো পথেই দুটি ঝর্ণা। আবার প্রথম মোড়ে ফিরে এলে অন্য পথ ধরে এগোলে আবার দুটি পথ। এই দুটি পথে আরো দুটি ঝর্ণা। বর্ষায় স্রোতের কারণে হেঁটে ঝর্ণা পর্যন্ত যেতে সময় বেশি লাগে। তাই একদিনে ৩-৪টির বেশি ঝর্ণা দেখে আসা সম্ভব হয় না। কিন্তু এই সময়েই কমলদহ সবচেয়ে সুন্দর রূপ ধারণ করে। তবে হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা না থাকলে এই সময়ে যাওয়া উচিত নয়। ঝর্ণা থেকে নেমে এসে গ্রামের দোকানে খাওয়াদাওয়া ও বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থা আছে। এখানকার দোকানে জামা-কাপড় বদলানোর ব্যবস্থা নেই। তবে দোকানে বললেই গ্রামের কোনো মানুষের বাড়িতে ব্যবস্থা করে দেন তারা।

বড় কমলদহ ঝর্ণা; Photographer: Rafia Tamanna
কমলদহ ট্রেইলের ছাগলকান্দা ঝর্ণা; Photographer: Rafia Tamanna

ঝরঝরি ঝর্ণা

ঝরঝরিও তেমন একটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি এখনো। এখানে যেতে হলে প্রথমে মিরসরাইয়ের পন্থিছিলায় নামতে হবে। পন্থিছিলা থেকে পূর্বদিকে কিছুদূর গেলেই রেললাইন পাওয়া যাবে। রেললাইনের পথ ধরে এগোলেই গ্রামের মেঠোপথ। মেঠোপথ দিয়ে হাঁটলেই ঝর্ণার ঝিরিপথ। স্থানীয় কোনো মানুষকে গাইড হিসেবে নিয়ে নেওয়া ভালো। ঝিরি ধরে এগিয়ে পাহাড় পার হতে হয়, এরপর আবার ঝিরি ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঝর্ণার দেখা মেলে। এর নাম ঝরঝরি প্রপাত। ঝরঝরি প্রপাত থেকে আরেকটি পাহাড় পার হয়ে ঝিরি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিছু অসাধারণ ক্যাসকেড ও খুম পাওয়া যাবে। এগুলো পার হয়ে আরো হাঁটলেই মূর্তি ঝর্ণার দেখা মেলে। মূর্তি ঝর্ণা বেয়ে উপরে উঠলে আরো কিছু ঝর্ণার দেখা মেলে।

ঝরঝরি; Source: vromonguide.com

এই সবগুলো ঝর্ণায়ই ট্র্যাকিং করে যেতে হয়, তাই সেরকম মনোবল তৈরি করে যাওয়া ভালো। মোবাইল, ক্যামেরা সুরক্ষার জন্য পলিথিনের ব্যাগ, গামছা, জোঁক থেকে বাঁচতে সরিষার তেল এসব নিয়ে যেতে হবে।

পর্যটকদের আগমন বাড়ার পর ঝর্ণাগুলোর ঝিরিপথ ক্রমশ নোংরা হয়ে যাচ্ছে। তাই অপচনশীল দ্রব্য, এমনকি পারতপক্ষে পচনশীল দ্রব্যও ফেলা উচিত না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই জায়গাগুলো আমাদের সকলের সহযোগিতা ছাড়া তার আসল রূপ ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে।

Feature Image: mathieudupuis.com (প্রতীকি ছবি) 

Related Articles