Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ঘেরা বিশ্বের জনপ্রিয় কিছু উপত্যকা

প্রকৃতির সান্নিধ্য মানুষকে বরাবরই আকর্ষণ করে। কারো কাছে পাহাড়ের সবুজ মিতালি, আবার কারো কাছে সাগরের কলতান এক আনন্দময় মুহূর্ত হিসেবে দেখা দেয়। জীবনের ব্যস্তময় সময় থেকে ছুটি নিয়ে নিজেকে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে ফেলার এ যেন এক সুবর্ণ সুযোগ। তাই মানুষ সেই আদিকাল থেকেই প্রকৃতির নিবিড় ভালবাসার টানে ছুটে আসে বারবার।

প্রকৃতির সাথে আনন্দময় মুহূর্ত কাটানোর জন্য কেউ ছুটে যান পাহাড়ের কাছে, কেউ নদী বা সাগরের কাছে, কেউবা অরণ্যে। কিন্তু পাহাড় ও নদীর অপার রূপ যদি একসাথে ধরা দেয় আমাদের সামনে, তাহলে তো কথায় নেই। তাই প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে উপত্যকার গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসাধারণ সব উপত্যকা। এসব উপত্যকার স্বর্গীয় দৃশ্য এককথায় অনবদ্য। একদিকে পাহাড় আর সাগরের মিতালি দেখতে এবং তার সাথে কোথাও কোথাও বিশাল বিস্তৃত সবুজ মাঠে ফুটে থাকা বৈচিত্র্যময় ফুল ও ফসলের অপার সৌন্দর্যে অবগাহন করতে চলুন বেড়িয়ে পড়ি সেসব উপত্যকার খোঁজে।

ওয়াইপিও উপত্যকা, হাওয়াই

এই অনন্য সুন্দর উপত্যকাটি হাওয়াইয়ের হামাকুয়া জেলায় অবস্থিত। একসময় এই উপত্যকা ঘিরে হাওয়াইয়ান রাজাদের বাড়ি ছিল। চারদিকের সবুজ ঘন বন, এক হাজার ফুট পাহাড় বেয়ে নেমে আসা স্বচ্ছ ঝর্ণার পানির অবিশ্রান্ত স্রোতধারা এবং কালো বালির সৈকত দ্বীপটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর উপত্যকা হিসেব স্বীকৃতি দিয়েছে। একে বলা হয়ে থাকে সকল উপত্যকার রাজা।

হাওয়াইয়ের হামাকুয়া জেলায় অবস্থিত ওয়াইপিও উপত্যকা; Source: bestourism.com

ট্রেকিংয়ের জন্য এক আদর্শ স্থান এই ওয়াইপিও উপত্যকা। আড়াই হাজার ফুট উঁচু তিনটি পাহাড় দিয়ে উপত্যকাটি আবৃত। এছাড়া ওয়াইপিও সমুদ্র সৈকতের অপরূপ সৌন্দর্য যেকোনো পর্যটককেই আকৃষ্ট করে। এই অঞ্চলটিতে বৃষ্টি ও সূর্যের খেলা প্রতিনিয়ত চলতে থাকায় উদ্ভিদ ও প্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে উঠেছে উপত্যকাটি। প্রকৃতির এই রূপ-রস দেখতে ভ্রমণপিপাসুরা এখানে আসতে তাই মুখিয়ে থাকে।

জিওঝাইগু উপত্যকা, চীন

চীনের সিচুয়ান প্রদেশে উপত্যকাটি অবস্থিত। ৭,২০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত উপত্যকাটি। ভ্যালির চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যেন এক দুর্দান্ত মাস্টারপিস, যেখানে রয়েছে নীল হ্রদ, জলপ্রপাত, চিরহরিৎ বনাঞ্চল, তুষারাচ্ছাদিত পাহাড় আর তিব্বত ও কিয়াং জনগণের বহু বছরের লালিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

নীল হ্রদ, জলপ্রপাত, চিরহরিৎ বনাঞ্চল, তুষার আচ্ছাদিত পাহাড়ে ঘেরা চীনের জিওঝাইগু উপত্যকা; Source: Wikimedia commons

কিংবদন্তী রয়েছে, ড্যাগো নামে একটি পর্বতের দেবতা দীর্ঘদিন আগে রূপের দেবী সেমোর প্রেমে পড়েন। ড্যাগো দেবী সেমোকে বায়ু ও মেঘের দ্বার তৈরি এক আয়না উপহার দেন। দেবী সেমো কখনোই পর্বতের দেবতা ড্যাগোকে পছন্দ করতেন না। তাই ড্যাগোর  উপহার দেয়া আয়নাটি ১০৮ টুকরোয় ভেঙে ফেলেন সেমো।

এই ভেঙে পড়া আয়নার ১০৮টি রঙিন টুকরো পৃথিবীতে পড়ে তৈরি হয় ১০৮টি রঙিন হ্রদের। স্থানীয়রা একে ‘হাইজি’ বলে অভিহিত করে। এই উপত্যকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হচ্ছে ‘ফাইভ ফ্লাওয়ার লেক’।

এই উপত্যকার স্বচ্ছ পানির লেকে ভেসে বেড়ানোর জন্য পর্যটকদের নিত্য আনাগোনা লেগেই থাকে; Source: Wikimedia commons

উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাকৃতিক বনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে অনেক বিরল প্রজাতির পশুপাখি। এই উপত্যকাটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

হারাউ উপত্যকা, ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত জনপ্রিয় ভ্যালিগুলোর মধ্যে হারাউ ভ্যালি অন্যতম। ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম সুমাত্রা অঞ্চলে অবস্থিত উপত্যকাটি ৬৬৯ একর জুড়ে বিস্তৃত। হারাউ উপত্যকাটি খাড়া রঙিন বেলে পাথর দ্বারা বেষ্টিত, যার উচ্চতা ১০০-৫০০ মিটার। সমগ্র উপত্যকা জুড়ে অতুলনীয় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, সমতলে বিস্তৃত ফসলের মাঠ, গাছপালায় ঢাকা ঘন পাথুরে বন, বিচিত্র সব জলপ্রপাত এবং দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত পর্বতমালা উপত্যকাটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

ইন্দোনেশিয়ার জনপ্রিয় উপত্যকাগুলোর অন্যতম হারাউ; Source: indonesia.travel

হারাউ উপত্যকা ঘিরে রয়েছে এক ডজনেরও মতো জলপ্রপাত, যা ৮০-৩০০ মিটার উঁচু পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে সমতলে। পাখিদের কলকাকলিতে সদা মুখর হারাউ উপত্যকায় পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।

এই উপত্যকায় যারা ভ্রমণ করেছেন তাদের অনেকেরই দাবি, এর অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকেও হার মানায়। উপত্যকার অপরূপ দৃশ্যাবলী পর্যটকদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করে।

ফ্লাওয়ার উপত্যকা, উত্তরাখন্ড, ভারত

ভারতের উত্তরাখন্ড অঞ্চলের এক বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এই ফ্লাওয়ার উপত্যকা অবস্থিত। পুষ্পতি উপত্যকা নামেও পরিচিত এই উপত্যকা হিমালয় পর্বতমালার পশ্চিমে অবস্থিত। ভারতের জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই উপত্যকাটি ১৮৬২ সালে কর্নেল এডমন্ড স্মিথ প্রথম আবিষ্কার করেন।

ফুলের পসরা দিয়ে সাজানো উত্তরাখন্ডের ফ্লাওয়ার ভ্যালি; Source: eventshigh.com

নানা বৈচিত্রময় ফুলের সমারোহে পুরো উপত্যকা জুড়ে যেন চারদিকে রঙের মেলা বসেছে। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় নদী। পুষ্পতি জলপ্রপাতের বহমান জলধারা, সবুজ ফসলের মাঠ, বন্য স্ট্রবেরির মনমাতানো গন্ধে চারপাশ মোহিত হয়ে থাকে। অনেক বিরল বন্য পশু-পাখি, যেমন- কস্তুরি হরিণ, বাদামি ভল্লুক, স্নো লেপার্ড এবং নীল ভেড়ার আবাসস্থল এই ফ্লাওয়ার উপত্যকা। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই উপত্যকাটি দর্শনের জন্য দেশ-বিদেশের বহু পর্যটককেই আকর্ষণ করে এই উপত্যকা।

বিরল প্রজাতির স্নো লেপার্ড; Source: Wikimedia commons

ভ্যালি অব টেন পিক, কানাডা

কানাডার বেন্ফ ন্যাশনাল পার্কের দশটি পর্বতশৃঙ্গকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ভ্যালি অব টেন পিক। উপত্যকাটিকে ঘিরে রয়েছে পাইন গাছের বন, যার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে জনপ্রিয় মোরাইন লেক। নদীটি এ উপত্যকার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। নদীর স্বচ্ছ নীল পানিতে বরফাচ্ছাদিত পর্বতমালার শৃঙ্গগুলো যেন পানির নিচে বয়ে চলা রূপকথার দেশ।

পাইন গাছের বন আর জনপ্রিয় মোরাইন লেক ঘিরে অবস্থিত কানাডার ভ্যালি অব টেন পিক; Source: worldatlas.com

শামুয়েল এলেন প্রথম এই অঞ্চলটি আবিষ্কার করেন। প্রাথমিকভাবে তার নামেই এ উপত্যকার দশটি শৃঙ্গের নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে প্রথম তিনটি শৃঙ্গের নামকরণ করা হয় বিশ্বের তিনজন বিখ্যাত ব্যক্তির নামে।

এই উপত্যকার কাছেই রয়েছে লার্চ উপত্যকা, লুইসি লেক, সেনটেনিয়াল পাস এবং দৃষ্টিনন্দন এফিয়েল লেক। আর তাই ভ্যালি অব টেন পিকস ছাড়াও প্রকৃতির এসব নান্দনিক সৌন্দর্য দেখতে গ্রীষ্মের শুরুতে এবং শীতের শেষে অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু মানুষদের আগমন ঘটতে থাকে কানাডার এই অঞ্চলে। হেঁটে ঘুরে বেড়িয়ে, মেরিন লেকে নৌবিহার করে কিংবা পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের মধ্য দিয়ে তারা প্রকৃতির সাথে নিজেদের নিঃসঙ্গতা ভাগাভাগি করে নেন।

ডোরো উপত্যকা, পর্তুগাল

উত্তর পর্তুগালের পোর্তো শহরের খুব কাছেই উপত্যকাটি অবস্থিত। ২০০১ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই উপত্যকার প্রধান আকর্ষণ পাহাড় কেটে কেটে তৈরি করা ঢালে রচিত হয়েছে কৃত্রিম বনভূমি। এসব পাহাড়ি ঢালে যেমন নানা গাছের সারি দেখা যায়, তেমনি উপত্যকার বসবাসকারী জনগণ চাষবাষের জন্য এই পাহাড়ি ঢালকেই বেছে নিয়েছে।

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পর্তুগালের ডোরো উপত্যকা; Source: Herald Sun

এই উপত্যকার পাহাড়ি গিরিপথ দিয়ে বয়ে গেছে ডোরো নদীটি। নদীটি উপত্যকার মানুষদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। স্থানীয়দের জীবনযাত্রার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই নদীর পানি। নদীটি পর্তুগাল হয়ে বয়ে গেছে স্পেনের সোরিয়া প্রদেশ পর্যন্ত।

সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময়ে এই উপত্যকার পাহাড়ি ঢালে সূর্যের আলোর ঝিকিমিকি এক অনন্য দৃশ্যের অবতারণা করে। শহরৎকালে উপত্যকার মানুষদের ফসল কাটার ধুম লেগে যায়। ছুটির দিনগুলোতে ডোরো নদীর প্রশান্তময় স্রোতধারার বুকে নৌবিহার আর নির্জন পাহাড়ি পথ বেয়ে হেঁটে যাওয়া সবকিছুতেই যেন এক অনাবিল আনন্দময় মুহূর্ত এনে দেয় পর্যটকদের।

সিম্পলন উপত্যকা, ইতালি

সিম্পলন উপত্যকাকে বলা হয়ে থাকে ভ্যালি অব আল্পস। আল্পসের দক্ষিণে পেনিইন ও লেপটন রেঞ্জের মধ্যে অবস্থিত এটি। সিম্পলন উপত্যকার চারপাশে বেশ কয়েকটি সুউচ্চ পর্বত দ্বারা পরিবেষ্টিত, যাদের উচ্চতা ৪,০০০ মিটারেরও বেশি।

এই উপত্যকাটির একটি অংশ সুইজারল্যান্ডে এবং অপর অংশটি ইতালির এক বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। উপত্যকার পশ্চিমাঞ্চলটি সুইজারল্যান্ডের এবং পূর্বাঞ্চলটি ইতালির অধীনে। এটি সারা বছরই বরফে ঢাকা থাকে। এর পাশ রয়েছে এগিয়ে গেছে জনপ্রিয় সিম্পলন পাস। উপত্যকা থেকে প্রায় ২,০০০ মিটার উঁচুতে তৈরী এই রাস্তা তৈরি হয়েছে সপ্তদশ শতকে।

ভ্যালি অব আল্পস হিসেবে পরিচিত ইতালির আকর্ষণীয় সিম্পলন ভ্যালি; Source: lolwot.com

তবে শীতকালে বেশি বরফ পড়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় সময় বিচ্ছিন্ন থাকে। তাই এ সময়টা পর্যটকেরা এড়িয়ে চলেন। পর্বতারোহীদের কাছে এক আকর্ষণীয় স্থান এই সিম্পলন উপত্যকা।

ফিচার ইমেজ – Wikimedia commons

Related Articles